অনন্তের পথে  ।  ওমর আল ফারুক

অনন্তের পথে । ওমর আল ফারুক

গল্প এপ্রিল ২০১৯

অনন্তের পথে । ওমর আল ফারুকরজনীর আঁধার তাড়িয়ে সূর্যের রাজত্ব শুরু হয়েছে। চারিদিকে এখন ফকফকে আলোর বন্যা। বেতস বনে ঝিকিমিকি আলো দেয়া জোনাকির দেখা নেই, খোঁজ নেই আসমানি তারকাদের। নিশাচর প্রাণীরা লুকিয়ে পড়েছে যার যার গোপন আবাসে। দিবসের পাখিদের ওড়াউড়ি আর কিচিরমিচির রবে মুখর হয়ে উঠেছে পরিবেশ। এই সাতসকালে সাদিকের মায়ের ব্যস্ততা সাদিককে নিয়ে। সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে বেছে বেছে তার পছন্দের খাবার রান্না করেছেন। খানাপিনা করানোর পর এখন ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছেন। এ সময় তিনি ঘর থেকে উঠানের দিকে তাকিয়ে সাদিকের উদ্দেশ্যে বললেন, : বাবা, পোশাক পরেছ? তোমার আসবাবপত্র গোছান শেষ। এসে দেখে যাও কিছু থেকে গেল কি না।’ সাদিক শহরের একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছুটিতে কিছুদিনের জন্য বাড়ি এসেছিল। আজ তার ফেরার দিন। উঠান থেকে সাদিক ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তর দেয়, : ‘জি, আম্মু। পরেছি।’ জিনিসপত্র সব ঠিকঠাক নেওয়া হয়েছে কি না পরখ করে নেয় সে। এরপর ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। তার মাও তার সাথে হাঁটা শুরু করেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেন, ‘বাবা, আজকের পৃথিবীটা তোমাদের জন্য। তোমরা একে বাসযোগ্য করে গড়ে তোল। কেবল নিজে ভালো হলে ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকার জন্য পরিবেশও ভালো হতে হয়। রাতে প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে ‘নিজে তো ভালো আছি’ এই স্বার্থপর চিন্তায় ঘুমিয়ে থাকলে নিজের ঘরও পুড়তে সময় নেয় না।’ মায়ের কথায় সাদিক থেমে যায়। থেমে যান তিনিও। তারপর মায়ের মুখপানে দৃষ্টি রেখে বেদনামিশ্রিত সুরে সাদিক বলে, : ‘আম্মু, আমাদের প্রজন্মটা জাতীয় স্বকীয়তা ভুলতে বসেছে। মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সংস্কৃতির সংজ্ঞাটাই এরা বদলে দিতে চায় যেন। চারিদিকের পরিবেশ দিনদিন দূষিত হয়ে পড়ছে।’ : ‘ঠিক বলেছ। তোমার অনুধাবন যথার্থ। পশ্চিমের কপটচারী সংস্কৃতির মোহে পড়ে আজকের তারুণ্য ধ্বংসের পথে হাঁটছে। তোমাকে খুব সাবধান হতে হবে, বাবা। যে কোন সময় পা পিছলে পড়ে যেতে পার, লীন হতে পার ধ্বংসের মাঝে।’ : ‘দেখ আম্মু, তোমার দোয়া আর রবের দয়া থাকলে তা কখনো হবে না।’ সাদিক জবাবে বলে। এ সময় তিনি ছেলের হাতে ধরা ব্যাগটা নিজের কাছে নিয়ে সামনে চলতে শুরু করেন। মায়ের সাথে সেও চলা শুরু করে। চলতে চলতে তার মা বলেন, : ‘ইনশাআল্লাহ। শোন সাদিক, জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি বাঁচিয়ে রাখতে তোমাকে তৎপরতা চালাতে হবে। এ জন্য প্রথমেই এক কাজ করতে হবে। তোমার চিন্তাধারার অনেককে পাবে, তাদের সঙ্গী হও। ধ্বংসের সয়লাবকে রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।’ : ‘জি, আম্মু। তুমি ঠিক বলেছ। একার পক্ষে প্রতিরোধ তো দূরের কথা নিজেই টিকে থাকা যায় না। এই বসুন্ধরাকে সুখকর সুবাসিত বসুন্ধরায় পরিণত করতে আমাদের মতো তরুণদের বিকল্প নেই। আমিও যেন সে লক্ষ্যে কাজ করে যেতে পারি। সবসময় আমার জন্য এই দোয়া কোরো, আম্মু। সাদিকের কথা শুনে চোখেমুখে খুশির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে তার মায়ের। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, : ‘সন্তানের জন্য মায়ের কাছে দোয়া চাইতে হয় না, বাবা। মায়ের হৃদয় গহিনে সন্তানের স্থান থাকে সর্বত্র।’ আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে সাদিক বলে, : ‘আচ্ছা আম্মু, তুমি এত ভালো কেন?’ এ সময় সদর দরজায় এসে থেমে যায় মা-ছেলে। ছেলের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দিতে দিতে মুখে হাসির রেখা টেনে উত্তরে বললেন, : ‘পৃথিবীর সব মায়েরাই সন্তানের কাছে ভালো হয়।’ : ‘তারপরও তাদের থেকে তুমি ব্যতিক্রম।’ : ‘প্রতিটি মানুষই অন্যের থেকে আলাদা। চেহারায় কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও মন মানসিকতা, আচার ব্যবহার, কাজকর্মে থাকে বিস্তর পার্থক্য।’ এবার স্বর উঁচু করে সাদিক বলে উঠল, : ‘দেখলে আম্মু, যুক্তিতেও তোমার তুলনা নেই।’ : ‘ওসব কথা রাখ, বাবা। বাড়িতে কবে আসছ তাই বল।’ : ‘এবার একবারে নির্বাচনী পরীক্ষা শেষ করে ফিরব, আম্মু।’ ছেলের কথা শুনে তিনি যেন চমকে উঠলেন। করুণ স্বরে বললেন, : ‘দেরিতে আসলে আমার যে অনেক কষ্ট হবে!’ : ‘কী করব আম্মু, টিউশনি করতে গেলে ঘনঘন ছুটি কাটালে টিউশনি থাকে না।’ আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে কথাগুলো বলে সাদিক। : ‘তাইত, ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার আব্বু বেঁচে থাকলে তোমাকে এত কষ্ট করতে হতো না। আর দেরি কর না বাবা, যাও।’ কান্নায় রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ। সাদিক আর কথা বাড়ায় না। কারণ যত সময় যাবে কষ্ট ততই বাড়তে থাকবে। ব্যথাতুর বুকটাকে পাথর চাপা দিয়ে উপশম করার চেষ্টা করে। বিসমিল্লাহ বলে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সদর দরজা পর্যন্ত আম্মুও তার সঙ্গ দেন। রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। এই কিছুক্ষণ আর পিছনে তাকায় না। তাকাতে পারে না। জানে আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে তার পথপানে তাকিয়ে আছেন। মিনিট খানেকের মধ্যে মোটর ভ্যান পেয়ে উঠে যায়। শেষবারের মত ফিরে তাকায় সে। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছেন আম্মু। আঁচলে ঢাকা মুখ।

পিচঢালা পথ বেয়ে ছুটছে মোটর ভ্যান। সাদিক যাত্রীবেশে বসে আছে। পথের দুই ধারে লোনা পানির ঘের। ঘেরগুলো নদীর জোয়ার ভাটার সাথে স¤পর্কিত। প্রধানত বাগদা চিংড়ির চাষ হয় এসব ঘেরে। আরো আছে পাইশা, ভেটকি, ভাঙানের মতো অতি সুস্বাদু মাছ। কোথাও আবার বসতবাড়ি। যার অধিকাংশই সুন্দরবনের গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। পাশেই নদী আর সুন্দরবন। সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে সুন্দরের কারুকার্য এঁকে দাঁড়িয়ে আছে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় তার মনোলোভা সৌন্দর্যের প্রতি। সাদিকের শৈশব কেটেছে নদীর চরে খেলাধুলা করে। কেওড়ার মৌসুমে দলবেঁধে কেওড়া পাড়ার আনন্দ বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। নৌকায় চড়ে খালের ভিতরে ঘুরতে যাওয়া ছিলো রোমাঞ্চকর। হঠাৎ যদি বাঘ মামার সাথে দেখা হয়ে যায়; এমন ভাবনায় শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠত। সাদিকের দৃষ্টি সম্মুখে থাকলেও সে দৃষ্টিতে আলো নেই। ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় সে আক্রান্ত। সে যাচ্ছে ঠিকই তবে মনটা তার পড়ে থাকে মায়াবী গ্রামটিতে। গ্রামের অপূর্ব পরশ ছেড়ে ঘোলাটে শহর কিছুতেই ভালো লাগে না তার। তারপরও যেতে হচ্ছে, যেতে হয়। জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হতে সব চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে নেই। কড়া ব্রেক করে ভ্যান দাঁড়িয়ে যেতেই ভাবনায় ছেদ পড়ে সাদিকের। বাসস্ট্যান্ড এসে গেছে। চালকের পাওনা মিটিয়ে সে কাউন্টারের উদ্দেশ্যে চলে।

খুলনাগামী দূরপাল্লার বাসে চেপে বসেছে সাদিক। পাশের সিটে তার স্কুলজীবনের শিক্ষক শফিক স্যার বসেছেন। ওনার সাথে টিকিট কাউন্টারে দেখা। দু’জনের গন্তব্য একই জেনে পাশাপাশি সিট নেয়া হয়েছে। গাড়ি ছাড়তে এখনো মিনিটখানেক বাকি। স্যার বললেন, : ‘সাদিক, তোমার পড়ালেখার খোঁজখবর শোনাও।’ : ‘এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবো, স্যার।’ বিনয়ের সাথে উত্তর দিলো সে। : ‘ও, আচ্ছা। এসএসসিতে তো গোল্ডেন পেয়েছিলে। এবার প্রস্তুতি কেমন নিয়েছ?’ : ‘আলহামদুলিল্লাহ্, স্যার। চেষ্টার ত্রুটি করছি না।’ : ‘জানি, চেষ্টার ত্রুটি করার ছেলে তুমি নও। কিভাবে খরচ চালাচ্ছ, কোথায় থাকছ?’ : ‘স্যার, কয়েকটি টিউশনি আর বৃত্তি থেকে কিছু পাই। এই দিয়েই আলহামদুলিল্লাহ্ চলে যায়।’ : ‘মেসে থাকো নিশ্চয়?’ : ‘জি, স্যার। মেসেই থাকি।’ : ‘বিজ্ঞানের সাবজেক্টগুলো প্রাইভেট পড়তে হয় না?’ : ‘খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। ক্লাসেই চেষ্টা করি ঠিকভাবে বুঝে নেয়ার। কখনো প্রয়োজন হলেও কিছু করার থাকে না। প্রাইভেট বিল দেয়ার সাধ্য যে নেই!’ শেষের কথাটা সাদিকের ভারি শোনাল। স্যার গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবছেন। তার কথাগুলো সম্ভবত ওনাকে ¯পর্শ করেছে। এর মধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে স্যার বললেন, : ‘সাদিক, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাও। তারপর বল কী দেখলে।’ গুরুগম্ভীর সে কণ্ঠ। সাদিক কিছুটা বিস্মিত। সে বুঝতে পারল না কিসের জন্য স্যার তাকাতে বললেন। সে দেখল, ছোটবড় ঘরবাড়ি, মাঠঘাট, জলাশয় ফেলে ক্রমাগত ছুটছে তাদের বহনকারী যান। স্যার কি এগুলো দেখতে বলেছেন? নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করে কোন সদুত্তর পায় না। : ‘দেখলে কিছু?’ কিছুক্ষণ পর স্যার জানতে চাইলেন। : ‘জি, স্যার। দেখেছি। মাঠঘাট, ঘরবাড়ি’ কথা শেষ করতে না দিয়ে স্যার বললেন, : ‘কোনটা আকারে ছোট, কোনটা বৃহৎ। কোনটা মাটি, খড়, গোলপাতা দিয়ে নির্মিত, কোনটা ইটের গাঁথুনি। তাই না? : ‘জি, স্যার।’ উত্তরে বলল সাদিক। : ‘পৃথিবীতে মানুষ ধনী গরিব, কালো সাদা, ছোটখাটো হয়। কেউ ড্রাইভার, কেউ যাত্রী হয়। কেউ আবার ওই গাড়ি মেরামত করে জীবিকা নির্বাহ করে। সকলে ড্রাইভার হলে যাত্রী হতো কে? আবার কৃষক মাঠে ফসল না ফলালে ড্রাইভার, যাত্রী, মিস্ত্রি সবাইকে না খেয়ে থাকতে হতো। আমরা অসুস্থ হই। সুস্থতার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় আমাদের। এভাবে গোটা প্রাণিজগতের পেশাকে শৃঙ্খলার স্বার্থেই চক্রাকারে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল করা হয়েছে।’ এ পর্যন্ত বলে স্যার থেমে গেলেন। সামান্য বিরতির পর পুনরায় বলতে শুরু করলেন, : ‘পৃথিবীটা মানুষের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। বংশ, বর্ণ, উচ্চতা, পেশা, অর্থ স¤পদ সবকিছুই এই পরীক্ষার উপাদান। কাউকে অঢেল অর্থ দিয়ে, কাউকে অর্থের স্বল্পতা দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা সবাই সম্মুখে এগিয়ে চলছি আর আমাদের কর্মগুলো মহাকালের গর্ভে জমা হচ্ছে। একদিন একত্রিত করা হবে সব অতীতকে। সুতরাং তোমার যে অভাব রয়েছে সেটা পরীক্ষার জন্যই দেওয়া হয়েছে। অভাবের কারণে তোমাকে থমকে গেলে চলবে না। অর্থকষ্টকে জয় করতে হবে। পৃথিবীতে ভূরিভূরি উদাহরণ আছে শূন্য থেকে গণ্য হওয়ার। তুমি গণ্য হওয়ার চেষ্টা করে যাও। তবে কেবল অর্থ স¤পদে নয়, মানুষের মত মানুষ হিসেবে গণ্য হতে হবে।’ : ‘স্যার!’ ভেজা শোনাল সাদিকের কণ্ঠ। : ‘বল সাদিক।’ : ‘জীবনকে এভাবে উপলব্ধি করা গেলে সবকিছু কতই না সহজ হয়ে যেত! ইনশাআল্লাহ আমরণ মেনে চলব এই মহামূল্যবান কথাগুলো।’ ছলছল করছে তার চোখ দু’টি। : ‘আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। পারার মত যোগ্যতা তোমার মধ্যে রয়েছে।’ তাদের কথোপকথন আর সামনে আগায় না। গাড়ির সুপারভাইজার এ সময় টিকিট চেক করছে। তারা নিজেদের টিকিট বের করে সুপারভাইজারকে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

দূরপাল্লার বাস অথচ বিভিন্ন স্থানে থামছে। সিট ছাড়াও যাত্রী নিয়ে বাস ভরে ফেলেছে। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ দুই সারির মাঝে চলাচলের রাস্তায় টুল পেতে বসেছে। এমন ভিড়ের মধ্যে একজন বৃদ্ধের প্রতি নজর পড়ল সাদিকের। অন্যের সিট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। মানুষের মনে চিন্তার দ্বান্দ্বিক একটা অবস্থান থাকে সবসময়। কোনটি করব, কোনটি করব না, কিভাবে করব ইত্যাদি বিষয়ে চলে দ্বন্দ্ব। একটা চিন্তা ভালোর দিকে প্রবাহিত হয়; অন্যটি মন্দের দিকে। কখনো জয়ের মুকুট পরে ভালো আবার কখনো মন্দ জয়ী হয়। তার আলোকেই মানুষের কর্ম পরিচালিত হয়। দৃশ্যটি দেখে সাদিকের মন ও দ্বন্দ্বের খেলায় মেতে উঠল। বিবেক বলল, : ‘ওনাকে বসতে দেবো। দেয়া দরকার।’ : ‘এই ভিড়ে এত দীর্ঘ পথ দাঁড়িয়ে যাব!’ কেউ একজন ভেতর থেকে প্রতিবাদ করল। : ‘অন্যের কষ্টকে নিজের করে নেয়ার মাঝেই রয়েছে প্রকৃত সুখ, জীবনের মাহাত্ম্য।’ প্রতি-উত্তর এলো। : ‘কী দরকার এসব করার? যেভাবে বসে আছি ওভাবেই থাকি। অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।’ বিবেক যেন হারার উপক্রম। এমন সময় তার মায়ের কথা মনে হলো। ‘বাবা, কখনো অন্যের কষ্ট দেখে এড়িয়ে যেও না। যথাসাধ্য চেষ্টা কোরো প্রতিকার করার। প্রকৃত মানুষ মানুষের কল্যাণ চিন্তায় বিভোর থাকে।’ ধরাশায়ী বিবেক অকস্মাৎ শক্তিশালী হয়ে উঠল তার। অন্যসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে সিট থেকে চট করে উঠে দাঁড়াল সে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল বৃদ্ধের কাছে। ওনাকে নিজের সিটে বসিয়ে দিতে দেখে স্যার বললেন, : ‘সাদিক, মুরব্বিকে আমার সিটে বসিয়ে দাও। আমি বরং দাঁড়িয়ে যাই।’ : ‘সে কী বলছেন স্যার, গুরুজনদের দাঁড়িয়ে রেখে আমি বসে যেতে পারি! কিছুতেই না। আপনি বসুন দয়া করে।’ সাদিকের জোরাজুরিতে বসে গেলেন তিনি। বৃদ্ধকে ভালোভাবে বসিয়ে দিয়ে সিট ধরে দাঁড়াল সাদিক। সো সো ভো ভো শব্দ তুলে ছুটে চলছে গাড়ি। রাস্তার দুইধারে সবুজের সমারোহ। ফল ফসলের খেত চিত্তাকর্ষক ভঙিমায় চাদর বিছিয়ে আছে। কোথাও হরিৎ চাদরে আবৃত কচি ধানের বুনন, কোথাও সবজি বাগান। বসত বাড়ির আঙিনায় আম কাঁঠালের সারিও দৃষ্টি কাড়ার মতো। বাসের জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করছে সাদিক। শহরে এমন মনোলোভা রূপময়তা দেখা যায় না। চাকচিক্যের বাহাদুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানকোঠায় সত্যিকারের প্রাণের ¯পন্দন নেই। মানুষগুলো যেন যান্ত্রিক। মানুষ মুহূর্তেই এক স্থান থেকে দূরবর্তী স্থানে যেতে না পারলেও কল্পনায় ছুটে যেতে পারে তেপান্তরে। ফেলে আসা অতীত আবছা ছবির ফ্রেমে ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। বর্তমানকে ভেবে নেয় বাস্তবতায় আর ভবিষ্যৎকে ভাবে নিজের মত করে। প্রকৃতি দেখতে দেখতে সাদিক হারিয়ে যায় তার শৈশবে। গ্রামের মাঠঘাট, বন বনানী আর নদীর চরে যেন ছুটে বেড়াচ্ছে সে। আম্মু এখন কী করছেন? হয়ত তাকে নিয়েই ভেবে চলেছেন। আম্মুর অশ্রুভেজা চোখ দুটি তার হৃদয়কে চৌচির করে দিতে থাকে। দৃষ্টিসীমা ঝাপসা হয়ে আসে।

জেলা শহরে এসে বাস থেমে গেল। অনেকে নেমে যাওয়ায় বাসে সেই ভিড় আর নেই। মুরব্বিও নেমে গেলেন। নতুন করে কিছু যাত্রী উঠল। দীর্ঘক্ষণ পর এবার সিটে বসার সুযোগ পেল সে। আধাঘণ্টা চলার পর আবারো থেমে গেল গাড়ি। কয়েকজন নতুন যাত্রী উঠান হলো অথচ একটা সিটও খালি নেই। তার মধ্যে ছোট শিশুকে নিয়ে একজন মাও আছেন। সাদিক কালক্ষেপণ না করে নিজের সিটে ওনাকে বসতে দিলো। তারপর আবারো প্রকৃতি দেখা। প্রকৃতিতে নিখাদ ভালোবাসা রয়েছে। সহজেই যার প্রেমে হারিয়ে যাওয়া যায়। সে ভালোবাসা বিতরণে কৃপণতা করে না। ছোট বড়, ধনী গরিবের মাঝে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করে না। তার সৌন্দর্যের মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃত বিশ্বাসী মনন তাই খুঁজে পায়।

: ‘স্যার, সামনের স্টপেজে আমাকে নেমে যেতে হবে।’ পাশে বসে থাকা স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল সাদিক। শহরে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। বিভিন্ন স্থানে যাত্রী নামানোর জন্য থামছে এখন। : ‘ঠিক আছে, যাও। আমারও বেশি পথ বাকি নেই। মেডিক্যালের সামনে নামব।’ : ‘স্যার, আমার বাসায় যদি যেতেন!’ অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল সাদিক। : ‘আরে, সেই সুযোগ থাকলে তো হতো। একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। ডাক্তার দেখিয়ে আজই ফিরতে হবে। কাল সকালে অবশ্যই স্কুলে উপস্থিত হতে হবে।’ : ‘কিন্তু স্যার!’ : ‘কোন কিন্তু নয়। আল্লাহ চাইলে অন্য কোন দিন যাবো। আর শোন, তোমাকে বড় হতে হবে, অনেক বড়। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা তোমার একান্ত কর্তব্য। স্কুলজীবন থেকে তোমার মাঝে যে ভালো মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি আজও তার সরব উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করলাম। ওটাকে মরতে দিও না, আরো বিকশিত কর। তোমার মত আত্মত্যাগী যুবকদের এই সময়ে খুব প্রয়োজন। বিগড়ে যাওয়া সমাজটাকে ঠিক করতে হবে যে!’ : ‘দোয়া চাই স্যার। সত্যিই যেন ভালো মানুষ হতে পারি।’ : ‘দোয়া চাওয়ার প্রয়োজন নেই। সারাপথ অন্যেকে বসিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে এসেছ। ওই মানুষগুলোর মন থেকে স্বতঃস্ফূর্ত যে দোয়া তুমি পেয়েছ সেটাই যথেষ্ট।’

ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে মেসের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছে সাদিক। ঠিক আগের মতোই বাসও ছুটে চলছে তাকে রেখে। এভাবে চলছে, সবকিছুই ছুটে চলছে তার অন্তিম গন্তব্যপানে। মানুষ চলতে চলতে চলেই যায় অনন্তের পথে। শুধু স্মৃতিরা বর্জ্য হয়ে পড়ে থাকে মহাকালের গর্ভে। স্মৃতির ডালায় ব্যক্তির কর্মমুখর জীবনের ছাপ থাকে। ভালো মন্দের মিশেল। ভালো বা মন্দ কর্ম অন্তর্ধানের পরেও দীর্ঘদিন ব্যক্তিকে ধরাধামে টিকিয়ে রাখে। কর্ম ভালো হলে শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় মানুষ তাকে স্মরণ করে। তার থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রেরণা নিতে থাকে। আর কর্ম মন্দ হলে মানুষ ঘৃণাভরে স্মরণ করে। আলোচিত হতে থাকে শিক্ষার বিষয়বস্তু হিসেবে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ