অনুতাপের এক রাত - আহসান বিল্লাহ

অনুতাপের এক রাত - আহসান বিল্লাহ

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রচণ্ড ব্যথায় শাফিন মাথা তুলে তাকালো সামনের দিকে, ঝাপসা চোখে যা দেখল তা বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রিয় বন্ধু রিশাত পড়ে আছে উবুড় হয়ে। দুই হাত পিছনে এক সাথে বাঁধা। শাফিন বন্ধুর হাত ধরার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল যে, তার নিজের দুটি হাত বন্ধুর মতোই পেছনে বাঁধা। কী ঘটেছে খানিক চিন্তা করতেই মনে পড়ে গেল সব। আজ স্কুল থেকে পালানোর সময় রাস্তায় কিছু গুণ্ডা মার্কা লোক নাকে-মুখে রুমাল চেপে ধরেছিল। এর পর আর কিছু মনে নেই। এখন বুঝতে পারছে শাফিন ও তার বন্ধু একদল অপহরণকারীর হাতে। আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করছে। পা দুটিও বাঁধা থাকায় সহজ হচ্ছে না। ডানে বামে মোড় দিয়ে উঠার চেষ্ট করতে লাগল। অবশেষে কোনোরকমে উঠে বসলো। রিশাতের জ্ঞানও আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। শাফিন চারদিকটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড পিপাসা লাগছে আর ক্ষুধাও লাগছে বেশ। সেই সকালে মায়ের হাতের পরোটা আর ডিমের মামলেট খেয়ে স্কুলে এসেছে। কয়টা বাজে দেখার জন্য রিশাতের হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। এতক্ষণে বাড়িতে থাকার কথা। নিশ্চয়ই আম্মু আব্বু অনেক টেনশনে আছেন। কিন্তু কিভাবে যাবে বাড়ি? এখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ আছে কিনা? তাও বুঝতে পারছে না। চার দিক কেমন যেন অন্ধকার গা ছম ছম করা পরিবেশ। রিশাত মাথা তুলে তাকাল। কিরে আমরা কোথায়? জনতে চাইল রিশাত। শাফিন ইশারায় চুপ থাকতে বললো। কারো আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাঁ ঘরের দরজা খোলার শব্দ, শাফিন অজ্ঞানের ভান করে শুয়ে পড়ল আগের মতো। একটা লোক ঘরে ঢুকছে সাথে একটা প্লাস্টিকের পানির জগ ও স্টিলের একটা গ্লাস সেই সাথে একটা প্লেটে কিছু খাবার। শাফিন চোখ মিট মিট করে আলো-আঁধারে দেখে নিলো। পেছন পেছন আরো দু’জন ঘরে প্রবেশ করলো। একজন বললো ছেলে দু’টির মনে হয় এখনো জ্ঞান ফিরেনি। হুম তাইত দেখছি নেতা টাইপের লোকটার উত্তর। কাল সকালে গাড়ি আসবে ওদেরকে সেই গাড়িতে তুলে দিবে। আর শোন! রাতে ভালো করে খাবার দিবে। আর খাবারের সাথে ওষুধ মিশাবে যাতে কালও তারা সারা দিন ঘুমায়। তা না হলে ওদের নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। গাড়িতে ঘুমালে টেনশন কম। বুঝলে? নেতা এইসব বলে বিজ্ঞের ভাষণ দিলো। শাফিন ও রিশাত অজ্ঞানের ভান করে সব শুনলো।

দুই. সাধারণত স্কুল ছুটির মিনিট ত্রিশের মধ্যে শাফিন বাড়ি চলে আসে। আজ প্রায় এক ঘণ্টা হতে চলেছে। এখনো শাফিন বাড়ি ফিরেনি। শাফিনের মা বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। এমন সময় মোবাইলের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। মেসেজটা দেখে শাফিনের মা ছেলের প্রতি আরো রেগে গেল। স্কুলের মেসেজ, যার মানে আজও ছেলেটা স্কুলে না গিয়ে হয়তো কোথাও খেলায় মেতে উঠেছে। আজ আসুক ছেলেটাকে কঠিন ভাবে শায়েস্তা করতে হবে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। শাফিনের বাসায় ফেরার নাম নেই। এখন মায়ের সকল রাগ যেন অজানা শঙ্কায় পরিণত হতে শুরু করলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রিশাতের মায়ের নাম্বারে কল দিতে যাবে এমন সময় রিশাতের মায়ের কল আসলো মোবাইলে। : আপা! শাফিন কি বাসায় ফিরেছে? ব্যস্ত গলায় রিশাতের মা। না; আমি তো শাফিনের খোঁজ নিতে আপনাকে ফোন দিচ্ছিলাম এখনই। রিশাত কই এখনো আসেনি? শাফিনের মায়ের উৎকণ্ঠিত জবাব। : না। খুবই টেনশনে আছি। কোথায় গেল? আচ্ছা ওরা আপনাদের বাড়ি গেলে দ্রুত পাঠিয়ে দিয়েন। শাফিনের বাবা অফিস থেকে বাসায় এসে দেখে শাফিনের মা খুবই গম্ভীর চিন্তামগ্ন। চুপচাপ একটা ভুতড়ে পরিবেশ যেন বাড়িতে। কী হলো আজ এতো চুপচাপ কেন? আমার গুণধর ছেলের নামে নতুন কোনো অভিযোগ আসেনি? জানতে চাইল শাফিনের বাবা। চোখ ছল ছল করে মায়ের উত্তর ওগো! ছেলেটা এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি আবার স্কুল থেকে মেসেজ এসছে ‘সে নাকি স্কুলেও যায়নি।’ : কি বল! আমাকে আগে বলোনি কেন? জানতে চাইল শাফিনের বাবা। : আমি কিছুই বুঝতেছি না বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন মিসেস জাহানারা মানে শাফিনের মা। ‘আচ্ছা কান্না করার কি আছে আমি বরং স্কুলের দিকে যাই, খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় গেল’ বললেন শাফিনের বাবা আজমল সাহেব। দ্রুত কাপড় পাল্টে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। স্কুলের গেইটম্যানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন। তারা দু’ জনই স্কুল গেটে আসছিল কিন্তু স্কুলে না ঢুকে কোথাও চলে গেছে। স্কুলের পশ্চিম পাশটায় ঘন জঙ্গল, পাশে একটা খেলার মাঠ, আজমল সাহেব সেই মাঠে তন্ন তন্ন করে খোঁজ নিলেন, কেউ কোনো হদিস দিতে পারল না। অগত্যা বাসায় ফিরে এলেন। নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে ফোন করে শাফিনের খোঁজ করতে লাগলেন। রিশাতের বাবাও সকল আত্মীয় এবং সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যর্থ হলেন। নিকট আত্মীয় যারা কাছাকাছি ছিলেন অনেকেই বাড়িতে চলে আসছেন। অনেকেই থানায় দ্রুত জিডি করতে বললেন তবে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শই বেশি। তাই থানা পুলিশের বিষয়টি আগামী কালের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। শাফিনের মা এক নাগাড়ে কেঁদে চলছেন। রিশাতের বাবা-মা চলে এসেছেন শাফিনদের বাড়ি। ছেলে দুটি এক সঙ্গে উধাও হয়েছে, নাকি কোন কিডন্যাপারদের হাতে অপহরণ হয়েছে! কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। ইদানীং চারদিকে গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ ইত্যাদির খবর প্রতিদিন পত্রিকায় আসে। এই সব ভাবতেই অজানা আশঙ্কায় গা হিম হয়ে আসছে সকলের। অপহরণকারীদের হাতে পড়লে মুক্তিপণের জন্য ফোন কল আসবে। এমনিতে কারো সাথে শত্রুতা নেই। ছেলে দুটি খেলা-পাগল ক্লাস ফাঁকি দিয়ে খেলার নেশা। কিন্তু তাদের ক্ষতি করার মতো কোনো শত্রু নেই।

তিন. এক এক করে তিনজনই বেরিয়ে গেল। ঘরটা নীরব কোনো সাড়াশব্দ নেই। যাবার সময় একটা ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে গেল। লাইটের সুইচ বাইরে। দু’জন উঠে বসলো রিশাত শাফিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করলো। ‘আমরা অপহরণকারীদের জিম্মায়’ বললো শাফিন। আমাদের এখান থেকে রাতের মধ্যেই পালাতে হবে। তা না হলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে অথবা বিক্রি করে দেবে। রিশাত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললো- শুনেছি; ওরা মানুষের কিডনি, চোখ ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি করে। হায় আল্লাহ! আমাদের তুমি রক্ষা কর। পিতা-মাতার কথা না শুনে স্কুল পালানোর এতো বড় শাস্তি আল্লাহ তুমি আমাদের দিয়ো না। বলেই হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো রিশাত। রিশাতের কান্না দেখে শাফিনের দু’ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ‘আমাদের উচিত শাস্তিই হচ্ছে আজ’ মনে মনে ধিক্কার দিল নিজেদের। না জানি বাবা-মা কী করছেন। এতক্ষণে পাড়া মহল্লায় আমাদের খোঁজে হয়রান হচ্ছেন। মা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। এই সব ভাবতেই দু’জনের কান্না যেন আরো বেড়ে গেল। অনেক দূর থেকে মাগরিবের আজানের ক্ষীণ শব্দ শুনা যাচ্ছে, তার মানে এই জায়গাটার আশপাশে লোকালয় নেই। চারদিক দেখে মনে হলো এটি একটি মাটির ঘর। ওপরে পুরাতন টিনের চাল, সামনে একটি দরজা এবং ঘরের ঠিক পেছনের দিকে ছোট একটি জানালা। দরজা ও জানালা কাঠের তৈরি। দরজার নিচে মেঝে থেকে এক ইঞ্চির মতো ফাঁকা আছে, যা দিয়ে বাইরের বাতাস ও অল্প আলো ঘরের ভিতরে আসছে। ঘরের ভিতরে ছোট পার্টিশন করা একটা টয়লেট আছে। হামাগুড়ি দিয়ে শাফিন দরজার কাছে গেল। চৌকাঠের নিচ দিয়ে বাহিরে কিছু দূরে একটি ঘর দেখতে পেল। সম্ভবত ঐ লোকগুলো সেই ঘরেই আছে। শাফিন চিৎ হয়ে শুয়ে দুই পা দিয়ে দরজায় লাথি মারতে লাগল। হাতে একটা লাঠি নিয়ে প্রথম লোকটা আসলো এবং দরজা খুলে ওমনি দু ঘা বসিয়ে দিল শাফিনের পায়ে। মাগো বলে একটা চিৎকার দিল। এই দেখে রিশাত ভয়ে কান্না করতে লাগল। লোকটা হুঙ্কার দিয়ে বললো ‘দরজায় লাথি দিলে পা দুটি কেটে ফেলা হবে। এখানে জল খাবার আছে আমি হাত খুলে দিচ্ছি খেয়ে ভালো ছেলের মতো শুয়ে থাক’। হাত খুলে দিতেই রিশাত ও শাফিন ঢকঢক করে পানি পান করলো আর কয়েকটা পাউরুটি ও কলা খেয়ে নিল। সারা দিনের অভুক্ত দুটি শিশুর শরীর যেন ক্লান্তিতে নিস্তেজ হয়ে আসছে। খাবার শেষে আবার হাত বেঁধে ফেলে রেখে চলে গেল। শাফিন মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছে আর দু’ চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ‘হে আল্লাহ আমরা তোমার দুষ্ট শিশু বান্দা, আমাদের তুমি মাফ করে দাও! আল্লাহ তুমি ছাড়া এই বিপদ থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ আমরা ওয়াদা করছি কখনো স্কুল ফাঁকি দেবো না। কখনো পিতা-মাতার অবাধ্য হবো না। নামাজ পড়বো, ভালো হয়ে চলবো। আল্লাহ তুমি এখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ দাও’। শরীরে প্লাস্টিকের পাটির দাগ পড়েছে, পিঠে ও মাথায় অনেক ব্যথা করছে। স্কুল ব্যাগের ভিতরে ব্যথানাশক মলম ছিল। খেলার সময় ব্যথা পেলে ব্যবহার করার জন্য শাফিন রেখেছিল। নিশাতের ব্যাগে একটা মোবাইলও ছিল কিন্তু ব্যাগ দুটি তারা নিয়ে গেছে। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে অবলম্বন করার মতো তেমন কিছুই নেই। ঘরের মাচায় কিছু শুকনো কাঠ আর লাকড়ি। নিচে আছে দুইটি প্লাস্টিকের মাদুর আর এক কোণে কিছু ময়লা জমানো। তারা নিজেদের এই অসহায় অবস্থায় দেখে বেঁচে থাকার আশা যেন ছেড়ে দিলো। বিড়বিড় করে বারবার বাবা আর মায়ের কাছে ক্ষমা ও আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে লাগল।

চার. সারা রাত জেগে কাটালো দুটি পরিবার। সবাই উদ্বিগ্ন, তরতাজা দুটি প্রাণ হারিয়ে গেল কিভাবে? কেউ মানতে পারছে না। এতক্ষণে স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষকদের কাছেও সংবাদ পৌঁছে গেছে। স্কুলের হেডস্যার বাসায় এসে সবাইকে সান্ত¡না দিয়ে গেছেন। সবাই রাত পোহাবার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইতোমধ্যে থানায় ফোন করে জানানো হয়েছে। থানা থেকে চারদিকে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। কোথাও থেকে কোনো ফোন এলে থানায় নাম্বারসহ যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুরো এলাকা যেন থম থমে। কারণ কয়েকদিন আগেও এলাকার এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে মুক্তিপণ চাওয়া হয় ফোনের মাধ্যমে কিন্তু মুক্তিপণ দেয়া হলেও ছেলেকে জীবিত পায়নি এলাকাবাসী। রাস্তার পাশে তার মৃত লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মাস পেরুতে না পেরুতে আবারও দুটি ছেলে নিখোঁজ। এ নিয়ে থানার পুলিশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এলাকাবাসী অনেকটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। রিশাত ও শাফিনদের খবরে সবাই উদ্বিগ্ন। সর্বত্র এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। এভাবে চলতে থাকলে এলাকার স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের ঘরে আটকে রাখতে হবে। চারদিকে এই সব ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। প্রশাসনের ওপরের মহলেও এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। থানা-পুলিশ বিষয়টা খুবই সিরিয়াসলি নিচ্ছে। তারা তাদের সোর্স চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে শাফিনের মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মাথায় পানি দেয়া হচ্ছে। যখনই জ্ঞান ফিরে তখনই শাফিন বলে আবার জ্ঞান হারায়।

পাঁচ. শাফিন ও রিশাত একটু শক্ত হলো। ইতোমধ্যে রাতের খাবার চলে এলো। রাতের খাবার দেখে দু’ জনের খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু সন্ধ্যায় অপহরণকারীদের কথা মনে হতেই শিউরে উঠলো। শাফিন বললো আমি খাবো না। রিশাতও তাই বললো। তবে সেই লোকটা বললো সমস্যা নাই ক্ষিদে লাগলে আমাকে ডাক দিস। আমি বাঁধন খুলে দেবো। আর খাবারটা রেখে গেলাম। এভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। শাফিন চৌকাঠের নিচ দিয়ে বাহিরে দেখলো। না কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কয়েকবার ডাকও দিলো কোনো সাড়া শব্দ নেই। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়ছে। এই রিশাত উঠ! কী হয়েছে? উঠ না। ডাকলো শাফিন। রিশাত উঠে আবার কাঁদতে শুরু করলো। শোন! কাঁদলে কিছু হবে না। রাত পোহাবার আগেই যা করার করতে হবে। তারা পরস্পর পিঠে পিঠ দিয়ে বসলো যাতে একজন আরেক জনের হাতের বাঁধন খুলতে পারে। অনেক কষ্ট করে দু’ হাত বন্ধন মুক্ত করতে পারলো। এবার পায়ের বাঁধন খুলে মুক্ত হয়ে দাঁড়ালো। কী যে ভালো লাগছে! সারা দিন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে থেকে পায়ের গোড়ালি ফুলে গেছে। হাত দুটিও ব্যথা করছে। কিন্তু এসবে থেমে থাকা যাবে না। বাঁচতে হলে একটা উপায় তাকে বের করতে হবে। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ময়লা রাখা স্থানে কয়েকটা মোমবাতি পড়ে আছে। ওপরে কিছু কাঠ আর লাকড়ি ছাড়া কিছুই নেই। মোমগুলো কুড়িয়ে মেঝেতে রাখল। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা হারিকেন ঝুলছে এক কোনায়। তার মানে বিদ্যুৎ চলে গেলে এখানে মোমবাতি বা হারিকেন জ্বালানো হয়। রাত বাজে তিনটা, দুটি ছোট স্কুলপড়–য়া ছেলে জীবন বাঁচানোর জন্য উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। যাদের মা সন্তানের চিন্তায় আর্তনাদ করছে। বাবা পাগলপারা হয়ে ছুটাছুটি করছে। রিশাত কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো ওরা আমাদের বাঁচতে দিবে না। রিশাতের ন্যাকামিতে শাফিন রেগে গিয়ে বললো ‘তো আমি কী করবো? ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব?’ ওমনি রিশাত বললো তাই কর। আমরা ঘরে আগুন লাগিয়ে দেই তখন ওরা আগুন নিভাতে আসবে আর আমরা তখন দৌড়ে পালিয়ে যাবো। শাফিন একটু রাগ করলেও বুদ্ধিটা মন্দ না। চেষ্ট করা যেতে পারে। কিন্তু আগুন পাবো কোথায়? শাফিনের জ্বলন্ত লাইটের দিকে তাকালো। তারটা বাহির থেকে আসা পেঁচানো আছে বেশ খানিকটা। ঝটপট নিচে নামিয়ে আনল। হাত ঘড়ির আলো জ্বেলে লাইটটা খুলে ফেললো। তারটা খানিক ছিঁড়ে রেখে আবার লাইটটা লাগিয়ে দিলো একটা তার দরকার ছিল পেয়ে গেল। এবার হারিকেনটা নামালো একটু ভারি মনে হলো তার মানে এটার ভেতরে কেরোসিন জাতীয় তেল আছে। আগুন জ্বালাতে বেশ কাজে লাগবে। রিশাতকে বললো এক কাজ কর। কী কাজ বল! বললো রিশাত। এই দেখ হারিকেনে কেরোসিন তেল আছে এগুলো তোর মোজাতে ভিজিয়ে ভালো করে জানালার কাঠে মেখে দে। যদি আগুন জ্বালাতে পারি তবে জানালায় আগুন লাগিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে এবং জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবো। যেহেতু জানালাটা পেছন দিকে এবং ছোট সুতরাং অপহরণকারীরা বুঝতে পারবে না। দরজাটা ভেতর দিয়ে আটকিয়ে দিলে তারা খুলে ভেতরে আসতে পারবে না। যদিও আসে তবে মোটাসোটা লাকড়ি মাচা থেকে নামিয়ে রাখলাম। এ দিয়ে সোজা মাথায় মারবো। রিশাত দ্রুত জানালার চৌকাঠে কেরোসিন তেল লাগাতে আরম্ভ করলো। শাফিন রিফাতের হাত ঘড়িটা খুলে ছোট ছোট ট্যাবলেটের মতো ব্যাটারি বের করলো। ব্যাটারির দুই পাশে দু’টি চিকন তার সংযোগ করে তারের অপর প্রান্তদ্বয় এক সাথে ঘষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরির চেষ্টা করতে লাগল। হারিকেনের সলতার কাছে কায়েকবার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ করার পর হঠাৎ করে আগুন ধরে গেল। কাক্সিক্ষত এ বিজয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখানে আবেগী হওয়া যাবে না। সাবধানে কাজ করতে হবে। এবার মোমবাতিতে আগুন নিয়ে জানালার চৌকাঠে ধরিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জানালার কাঠ পুড়ে গেল। নিঃশব্দে সব কিছু চলছে। মুক্তির নেশায় দুটি কিশোরের অসাধ্য সাধনের এক কঠিন সংগ্রাম চলছে। জানালা ছোট হলেও তা দিয়ে অনায়াসে বের হওয়া যাবে। প্রথমে শাফিন বের হলো। এর পর রিশাত কে বের করে আনল। দুটি কিশোর অন্ধকার রাতে শত্রুর ঘর থেকে পালিয়েছে। বাহিরে অন্ধকার সামনে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির পথ কোনটি? এ স্থানের নামই বা কী? কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু এ বিষয়টা বুঝতে পারছে যে এখনই বাড়ি পৌঁছানো দরকার। তা না হলে অপহরণকারীরা ধরতে পারলে জানে মেরে ফেলবে। অন্ধকার রাতের জ্বলন্ত তারার মিটিমিটি আলোয় যে দিকটা একটু ফাঁকা মনে হয়েছে সে দিকেই হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটছে তো হাঁটছে কোথাও বাড়িঘর চোখে পড়ছে না। তবু জীবন বাঁচানোর তাগিদে হেঁটেই চলছে দু’টি কিশোর। যতই হাঁটছে ততই ক্লান্ত শরীর আরো ক্লান্ত হচ্ছে। তবে চারদিক ক্রমান্বয়ে আলোকিত হতে শুরু করছে। এমন সময় কানে ভেসে এলো ফজরের আজানের সুর। অনেকটা স্পষ্ট হয়তো আশপাশেই কোথাও মসজিদ হবে। আওয়াজের গতিপথে কান খাড়া করে চোখ তুলে তাকাল। অনেক দূরে একটা মিনার দেখা যায়। যাক! একটা টার্গেট পাওয়া গেল। শোন রিশাত আমরা যদি ঐ মসজিদ পযর্ন্ত পৌঁছাতে পারি তবে আমরা বিপদমুক্ত হবো। তারা যখন মসজিদের কিনারায় তখন নামাজের একামত চলছে। তাড়াতাড়ি অজু করে দু’জন মসজিদে মুসল্লিদের সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। নামাজে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় বারবার শোকর আদায় করছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে দুটি কিশোর প্রাণ। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সের একটা লোক বিষয়টা খেয়াল করলেন। নামাজ শেষে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলেন তাদের পরিচয়। সব কিছু শুনে ইমাম সাহেব নিজ হুজরাতে বিশ্রাম নিতে দিলেন আর শাফিনের বাবার মোবাইল নাম্বার চেয়ে নিলেন। সবার মাঝে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। অনেকেই নীরবে চোখের জল ফেলছে। ছেলে দুটির জন্য সবারই মন খারাপ। কয়েকজন সহপাঠী রাতে খবর পেয়ে বাড়ি এসেছে এখনো যায়নি। হঠাৎ শাফিনের বাবার মোবাইল বেজে উঠলো। আঁতকে উঠলেন তিনি দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখেন একটি অপরিচিত নাম্বার। নাম্বার দেখে যে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। কাঁপা গলায় কোনো রকমে সালাম দিলেন। ওয়ালাইকুম সালাম, খুব মিষ্টি সুরে অপর পাশ থেকে উত্তর এলো এবং জানতে চাইলো ‘আপনি কি আজমল সাহেব? জি জি আমি আজমল, আমি শাফিনের বাবা বলছি। কাঁপা ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবাব দিলেন আজমল সাহেব। ঐ ইমাম সাহেবের ঠিকানা দিলেন আর বললেন দ্রুত চলে আসুন। আজমল সাহেব ও রিশাতের বাবা পুলিশের গাড়িসহ রওয়ানা হলেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ