অন্য রকম রমিজ   -মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস

অন্য রকম রমিজ -মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস

গল্প আগস্ট ২০১৫

রমিজকে দেখে সবাই হতবাক। যে শহর নিয়ে এত দুশ্চিন্তা, সেই শহর থেকে রমিজ ভালো হয়ে ফিরবে, তা কি ভাবা যায়? মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ওর এমন পরিবর্তন সকলের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান রমিজ। সংসারে কোন অভাব নেই। পিতা তাজ মোহাম্মদ প্রাইমারির শিক্ষক। মা ফারজানা রহমান গৃহিণী। দু’জনই শিক্ষিত। তাদের ইচ্ছা ছেলেটাকে বড় মাপের মানুষ বানাবেন। কিন্তু বারবার হোঁচট খান। কোনভাবেই ওকে পড়ার টেবিলে বসাতে পারেন না। সারাদিন খেলার মাঠ না হয় পাড়ার ছেলেদের সাথে আড্ডা। জেএসসিতে টেনেহিঁচড়ে পাস করলেও এসএসসি পরীক্ষায় কোনভাবেই ভাল রেজাল্ট করতে পারবে না। এটা ভেবে পিতা-মাতা কোন কূলকিনারা পান না। চোখে অন্ধকার দেখেন তারা। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
তাজ মোহাম্মদের বাল্যবন্ধু তোয়াব খান শহরে থাকেন। তার পরামর্শে রমিজকে সেখানকার একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করেন। রাখেন একটা পরিচিত মেসে। এতে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও তাজ মোহাম্মদের মাথায় চেপে বসে আরেক দুশ্চিন্তা। অবশ্য দুশ্চিন্তার একটা কারণও আছে। তার এক প্রতিবেশী এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েও আর লেখাপড়া করতে পারেনি।
স্ত্রী ফারজানা রহমান স্বামীকে সান্ত্বনা দেন,
: কাছে রেখেও তো ভালো করতে পারলাম না। এখন ভালো স্কুলে দিলাম। দোয়া করো যেন ভালো রেজাল্ট করতে পারে।
: ভালো রেজাল্ট করলেই ভালো মানুষ হওয়া যায় না। গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছেলে নাহিদ আমাদের চোখের সামনেই শেষ হয়ে গেল। তোমার ছেলেটাও যদি সেই পথ ধরে।
: ছিঃ ছিঃ ও কথা আর একটি বারও মুখে আনবে না। পিতা-মাতার দোয়া পেলে ও নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।
তাজ মোহাম্মদ চুপ হয়ে যান। স্ত্রীর কথায় কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পান তিনি।
শহুরে জীবনের ছয় মাস পার হয়ে যায়। ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসে রমিজ। এ সময় গ্রামে আনন্দমেলা বসে। রমিজ এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু আজ আর মেলায় যায় না। ঈদের রাতটা এক রকম নীরবে নিভৃতে কেটে যায়। ভোরে মসজিদে আজান হয়। রমিজ আব্বু আম্মুকে ডেকে দিয়ে মসজিদে চলে যায়। নামাজ শেষে সোজা বাড়িতে এসে কুরআন-হাদিস নিয়ে বসে। তারপর ক্লাসের বই। রমিজের এই পরিবর্তন দেখে হতবাক হয়ে যান পিতা-মাতা। তাদের দুই গন্ড বেয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ফারজানা রহমান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন,
: বাবা তুই নামাজ পড়িস! কুরআন পড়িস! এসব কোথায় শিখলি? কিভাবে শিখলি?
: আম্মু, আমি শুধু ভালো স্কুলে ভর্তি হয়নি। একটা ভালো মেসও পেয়েছি। সেখানে সবাই নামাজ পড়ে। ইবাদত করে। মা-ছেলের এমন দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান তাজ মোহাম্মদ। অবশেষে মুখ খোলেন তিনি-
: আমরা এত দিন চেষ্টা করে যা করতে পারিনি, তা ছয় মাসে সম্ভব হলো কী করে?
কী সাংঘাতিক ব্যাপার। স্কুল পড়–য়া ছেলে রমিজের মুখে এমন কথা শুনে গর্বে বুক ভরে যায় পিতা-মাতার। তারা ভাবেন, রমিজ সত্যি সত্যিই বড় মাপের মানুষ হবে।
দেখতে দেখতে পার হয়ে যায় দুই বছর। রমিজ এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পায়। খবর শুনে ওর পিতা-মাতা আনন্দে আত্মহারা। দু’দিন পর ঈদ। সেই ঈদ আর রেজাল্টের আনন্দ এক সাথে মিশে খুশির বন্যা বয়ে যায় তাদের পরিবারে। তাজ মোহাম্মদ তাড়াহুড়ো করে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে দাওয়াত করেন সবাইকে।
এ দিকে রমিজকে স্কুল থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। শিক্ষক-সহপাঠীরা ওর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। সেই মালা পরে বাড়ি ফিরবে রমিজ।
তাজ মোহাম্মদ গ্রামের মানুষ হলেও চা খেতে অভ্যস্ত। অন্তত সকালে এক কাপ দুধ চা তার চাই-ই। প্রতিদিনের মত আজও চা নিয়ে আসেন ফারজানা। তাজ মোহাম্মদ কাপটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেন তাকে-
: আসলে ভালো পরিবেশ ছাড়া সন্তানদের রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কথা শেষ করে তাজ মোহাম্মদ চায়ের কাপটা মুখে ধরেন।
: এ কি! চা না শরবত?
: যে লেকচার ধরেছ, তাতে গনগনে আগুনও বরফ হয়ে যাবার কথা।
: লেকচার নয় ফারজানা, বাস্তব। অসৎ সঙ্গে পড়ে নাহিদ নষ্ট হয়েছে। আর সৎ সঙ্গে থেকে রমিজ আলোর সন্ধান পেয়েছে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ