অন্যরকম আনন্দ   -আরিফ শাওন

অন্যরকম আনন্দ -আরিফ শাওন

তোমাদের গল্প জুন ২০১৮

আম্মু আমি বের হলাম। এই বলে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো আফনান। পরীক্ষার বেশি দিন বাকি নেই। একটু আগে বের হওয়ার অবশ্য কারণও আছে। প্রথম সে ক্লাস ক্যাপ্টেন ইভানের বাড়িতে যাবে। তার বাসায় কিছু কাজ আছে। কাজ শেষে দু’জন এক সাথে স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিবে।
গত কয়দিন ধরে কালবৈশাখী ঝড় বইছে পুরো শহরজুড়ে। বাড়ি থেকে দাদু ফোন করছিলেন আব্বুর কাছে। দাদু বলেছেন গ্রামেও নাকি প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। নাতিকে দেখেশুনে রাখার জন্য কড়া নির্দেশ দিলেন তিনি।
রাস্তার দু’ধারে কাদা মাটিতে মাখামাখি। তাই সতর্ক দৃষ্টি ফেলে হাঁটছে আফনান। তাকে ইভানের বাসার যেতে হলে মাজার গেট হয়ে যেতে হবে। দোকান থেকে দু’টি চিপস কিনে নিলো সে। ইভানের বাসায় পড়া দাগাতে দাগাতে দু’জনে বেশ মজা করে খেতে পারবে। মূলত ইভান চিপস খুব পছন্দ করে। সে দেখে খুশি হবে।
মোড় পার হয়ে কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখে মানুষের ভিড়। পথচারীরা কাকে যেনো ঘিরে ধরেছে। ভিড় ঠেলে আফনানের দেখার ইচ্ছে জাগলো। রহস্যটা কী? ভেতরে ঢুকেই দেখে- একজন মধ্যবয়সী লোক মাটিতে পড়ে আছে। তার হুঁশ ফিরানোর জন্য চেষ্টা করছেন দু’জন। তাদের একজন বলল- হয়ত মৃগি রোগ হয়েছে। কারো কাছে চমড়ার জুতা আছে? থাকলে দেন। নাকে গন্ধ শুঁকতে দিই।
আফনানের খুব খারাপ লাগলো। তার পায়ে চামড়া জুতা ছিল না। যদি থাকতো তাহলে সে দিতে পারত। এখন সে আফসোস করতে করতে ভাবছে- যদি আম্মুর কথা মতো নতুন চামড়া জুতা পরে আসতাম তাহলে একজন অসহায় মানুষের কাজে লাগত।
কেউ একজন এগিয়ে দিলো চামড়ার জুতা। উঁহু! হাজারো চেষ্টা করেও হুঁশ ফিরানো যাচ্ছে না। মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে এক পর্যায়ে হুঁশ ফিরে আসে। লোকটির কাছে আফনান প্রশ্ন করে বসল- কী হয়েছে আপনার?
পাশের এক লোক বলল- কোত্থেকে এসেছেন?
কোনো সাড়া শব্দ নেই। হয়ত পরিপূর্ণ হুঁশ ফিরে আসেনি। এর মধ্যে ঢিল ছুড়ার মত হাজারো প্রশ্ন করতে লাগলো। কী হয়েছে? কোত্থেকে এসেছেন? নাম কী আপনার? আরো কতো কী?
আফফানের কানের গোড়ায় গিয়ে আস্তে করে বলল- কী হয়েছে আপনার?
কোনো উত্তর নেই। হয়ত তিনি এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। কিংবা এমন প্রশ্ন যেনো কখনো শুনেননি। অপরিচিত বলে মনে হচ্ছে শব্দগুলো।
আবার প্রশ্ন করল- আপনি এখন কোথায় আছেন জানেন?
মৃদু স্বরে ঠোঁট নেড়ে বলল- না।
কিছুক্ষণ পর চিন্তা করে বলল- চট্টগ্রাম। সামনে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক বলল- হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন।
কেউ একজন প্রশ্ন করল- কোত্থেকে এসেছেন?
বলল- সিলেট থেকে এসেছি কাজ করার জন্য।
সম্ভবত এখন পরিপুর্ণ হুঁশ ফিরে এসেছে।
বৃদ্ধবয়সী একলোক বলল- এখানে কী জন্য এসেছো?
এখানে এমনি আসিনি। স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে যখন এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছিলাম। তখন এক মানুষ এসে বলল, কোথায় যাবেন?
বলল- কোথাও যাবো না। চট্টগ্রাম এসেছি কাজে করার জন্য।
লোকটি বলল- আচ্ছা। ঠিক আছে। একটা কাজ আছে করবা?
বললাম, হ্যাঁ।
মনে মনে একটু খুশি হলাম। চট্টগ্রামে আসা মাত্রই কাজ পেয়ে গেলাম। তারপর তাকে সব খুলে বললাম- ভাই, মাস দুয়েক পর ঈদ। বাড়িতে বউ আছে। বাচ্চা আছে। একটা বোন আছে আর বৃদ্ধ বাবা আছেন। তদের মধ্যে আমিই একমাত্র উপার্জন করি।
গত দু’তিন মাস ধরে বেকার ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছি। কোনো কাজ পাই না। ঘরের অবস্থাও দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। ভাবলাম কোথাও যাই। কাজ-টাজ পাই কিনা দেখি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম চট্টগ্রাম যাবো। কারণ চট্টগ্রাম যেহেতু বন্দরনগরী কাজ-টাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এবার ঈদে যদি সবাইকে কাপড় কিনে দিতে না পারি তাহলে সবাই কষ্ট পাবে। পাশের বাড়ির চাচা থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিলাম। হাতে মোবাইল ছিলো। তা নিয়েই রওনা দিলাম। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের উদ্দেশে।
লোকটি আমাকে গাড়িতে করে এই জায়গায় নিয়ে এলো। এখানে আসার পর আমাকে বার বার জিজ্ঞাসা করছে। তুমি কি এই জায়গা চিনো? আমি বললাম- না, চিনি না। তারপর কি হলো আমি আর জানি না।
তারপর কিছুই মনে নেই?
না। আমার আর কিছুই মনে নেই।
নাম কী আপনার?
আমজাদ হোসেন।
আমজাদ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল- আমার মোবাইল! আমার টাকা! কোথায়? আমি এখন কী করব?
উপস্থিত সকলে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করল। সবাই যার যার কাজে চলে গেলো। কিন্তু আফনান গেলো না। তখন বাজে সকাল সাড়ে নয়টা।
আফনান বলল- ঐ যে জাদুঘরের গেট দেখতে পাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে বসুন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি। দূরে কোথাও গেলে আপনাকে পাবো না। এক ঘণ্টা পর আসছি আমি।
লোকটি অপরিচিত জায়গায় এসে পরাজিতের মতো ‘হ্যাঁ’ সূচক বাক্যে মেনে নিলো।
আফনান তাড়াতাড়ি হেঁটে ইভানের বাড়িতে গেলো। পড়া দাগানোর এক ফাঁকে তাকে সব ঘটনা খুলে বলল। ইভানের দুঃখ হলো লোকটির জন্য। ইভান তাড়াতাড়ি ছুটে গেলো তার বড়ো ভাইয়ার কাছে। পুরো ঘটনা শুনালো। আচমকা তাজ্জব হয়ে গেলেন তিনি। ইভান বলল- ভাইয়া এখন লোকটির জন্য কী করলে ভালো হয়।
লোকটি কি তার বাড়িতে যোগাযোগ করেছে?
না। মোবাইল, টাকা সব নিয়ে গেছে হাইজাকারে।
উফ! তার কাছে কোনো মোবাইল নাম্বার মুখস্থ নেই?
না ভাইয়া। নতুন মোবাইল কিনেছে। তাই হয়তো মুখস্থ নেই।
আহ! লোকটির জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। কতো আনন্দ নিয়ে টাকা কর্জ করে কাজ করতে এসেছে। ঈদে সবাইকে অন্যদের মতো নতুন কাপড় কিনে দেবে বলে। কিন্তু কি হলো! এখন যদি তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় তাহলে সবাই তাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। লজ্জায় নিজে নিজে মারা যাবে। তার মেয়েটি যদি বলে- আব্বু। আমার জন্য কী এনেছো? তখন কোনো জবাব দিতে পারবে না সে।
আফনান বলল- ভাইয়া। তার জন্য সবাই বাড়িতে চিন্তা করবে। সে যদি বাড়িতে যোগাযোগ না করে এখানে কাজ করে তাহলে কী ভালো হবে?
তাও ঠিক বলেছো।
ভাইয়া, তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে হবে। কিছুদিন পর বিশ্রাম নিয়ে আবার আসবে চট্টগ্রাম।
আবার চট্টগ্রাম এসে কী করবে?
ইভান- কেন ভাইয়া। আমাদের দোকানে রমজান উপলক্ষে কর্মচারী নিয়োগ দিবেন না?
হ্যাঁ। দিবো তো।
তাহলে লোকটি আমাদের দোকানে ঈদ পর্যন্ত কাজ করবে।
চিন্তা করে দেখা যাক।
না ভাইয়া তাকে দোকানে নিয়ে যাও।
আফনান- লোকটির পরিবারের দিকে তাকিয়ে হলেও তাকে আপনাদের দোকানে রেখে দিন ভাইয়া।
আচ্ছা। ঠিক আছে।
আফনান ও ইভান খুশিতে একহাত লাফিয়ে উঠলো। এটা অন্যরকম আনন্দ। অন্য রকম তৃপ্তি। যা বলে কয়ে বুঝানো যাবে না।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ