অপেক্ষার প্রহর   -আশরাফুল ইসলাম

অপেক্ষার প্রহর -আশরাফুল ইসলাম

তোমাদের গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মতিঝিলের ব্যস্ত একটি সড়ক, শাপলা চত্বর, ঢাকা। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত ও কোলাহলপূর্ণ সড়ক। কোথাও যে কোন ফাঁক নেই। নানান রঙের নানান পেশার মানুষে ভরা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের কার্যচাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও মুহূর্তের জন্য কোন প্রকার বিরতি নেই। থেমে নেই মানুষের কর্মবিরতি। স্রষ্টার প্রাকৃতিক নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে এই বিশ্বমন্ডল। তার সাথে সমান তালে তাল মিলাচ্ছে আমার জীবন।
আমার নাম জাহিদ, বয়স চব্বিশ। গ্রামের বাড়ি জামালপুর। এখানে একটি ছোট অফিসে ফাইলের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় আমাকে। থাকা খাওয়া পাশের একটি মেসে, বাবা-মায়ের বড় সন্তান। তাই বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় যথারীতি। এ জন্য পোশাকে আশাকে, সাজ-সজ্জায় আরামদায়ক জীবনযাপন না করা আমার জন্য বিধেয়।
আমাদের মেসমেট ৫ জন। ওসমান ভাই, ফারুক, শহীদ, শরীফ আর আমি। আমাদের সবার বড় ওসমান সাহেব, বাড়ি কুমিল্লা, বেশ চমৎকার লোক। সহজ সরল মনের অধিকারী। আমরা সবাই একেকজন একেক অফিসে কম বেতনে চাকরি করি। মেসমেটদের মাঝে ফারুক আর ওসমান বিবাহিত। বাকিরা বিয়ের উপযুক্ত।
আজ রমজানের ১৭ তারিখ, ২৬ জুলাই ২০১০ ইংরেজি। তার মানে ঈদের আর মাত্র ১২-১৩ দিন বাকি। এর মধ্যে মায়ের জন্য একটা শাড়ি, বাবার জন্য পাঞ্জাবি, ছোট বোনের জন্য একটা জামা কিনতে হবে। গত ঈদে ছোট বোনটি একটা জামার জন্য খুব আবদার করেছিল। কিন্তু পরে তা অরণ্যের রোদন হয়ে গেল। এবার অন্তত তার আবদারটা সবার আগেই রাখতে হবে।
আজ শুক্রবার। তাই অফিস বন্ধ। আমাদের হলিডের বিকেলে আড্ডা আর বেড়ানোর পার্ক হয় ছাদ। ছাদে এসে সবাই আনন্দ কৌতুক আর রসিকতায় মত্ত হই। মাঝে মধ্যে গানও হয়। আমাদের সবার বড় ওসমান ভাই সুরের মাঝে হারিয়ে দেয় আমাদের সবার মন। আমাদের সাথে সঙ্গ দেয় পাশের বাসার ইব্রাহিম মিয়া। তিনি খুব রসিক মানুষ। হাসাতে আর মজা দিতে তিনি বেশ স্মার্ট।
বিকেলের সোনালি সূর্য যখন লাল বর্ণ ধারণ করার প্রচেষ্টায় বিভোর, ঠিক তখনি ছাদের এক কোণে একা একা বসে কি যেন ভাবছেন ওসমান ভাই। যে মুখে সারাক্ষণ হাসি-মুখে যেন শ্রাবণের আকাশভরা মেঘের আঁচ লক্ষ করছি। জানতে চাইলাম, কোন সমস্যা? মাথা নাড়িয়ে জবাব দেন, না। কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে, এমন মলিন মুখ নিয়ে বসে আছেন যে?
জবাব দেন, ওসমান ভাই : বাড়ি থেকে ফোন করেছে। বাবা নাকি ভীষণ অসুস্থ। টাকা পাঠাতে হবে। আর পাঠানোর মতো কোন টাকা-পয়সা আমার কাছে নেই, কেউ ধারও দিচ্ছে না। আমি বললাম আপনার অফিসের ম্যানেজার সাহেবকে বলে দেখুন না এই মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস অগ্রিম দিয়ে দেয়ার জন্য। ওসমান ভাই বললো বলেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ম্যানেজার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন ২৬ রমজানের আগে কাউকে বেতন দেয়া হবে না।
আমরা সবাই তাকে সান্ত্বনার সুরে বলি, এভাবে কাঁদলে কোনো লাভ হবে না। ‘আপনার এ দুরবস্থার জন্য আমার যে খারাপ লাগছে না তা না,- বলল শরীফ।
আসলে আমাদের মতো গরিবরা সারা জীবন কষ্ট লাঞ্ছনা ভোগ করে পয়সার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ধনীদের জন্য শ্রম দিই। এতে তারা ধনী থেকে আরো ধনী হয় আর আমরা গরিব থেকে আরো গরিব। অথচ এটা সত্য যে আমরা আছি বলেই তারাও বেঁচে আছে। আমরা মরে গেলেও ধনীরা আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আমাদের কেউ না খেয়ে থাকলে তাকে খাবার দেয় না। কিন্তু না খেয়ে সে মারা গেলে তার লাশের ওপরে দু’টাকা এক টাকা করে ছুড়ে মারে।
কিন্তু আমরা যদি একবার জেগে ওঠি, কাজ বন্ধ করে দিই, তবে ধনীদের মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। কিন্তু এটা তারা বুঝে না। আমি বললাম, ঠিক আছে আমরা ৪ জনে যা পারি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবো। পরদিন সকালবেলা আমরা সবাই ওসমান ভাইকে কিছু টাকা ধার দিয়ে তার বাবার জন্য পাঠাতে বলি। ওসমান ভাই টাকাটা ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করে তার গ্রামে পাঠিয়ে দেন।
২৬ রমজান। আগস্টের ৪ তারিখ। সারা দেশের প্রায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আজ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। আর আজকে সবাই মাইনে এবং বোনাস হাতে ঘরে ফিরবে, এ জন্য তাদের আনন্দের সীমা নেই। আমিও বেরিয়ে নিজ কর্মস্থলে যাই। আমার অফিসটা বেশি দূর না। তাই আমি সবার পরেই বাসা থেকে বের হই।
বেলা প্রায় ২টা। সেলারি পেয়ে সোজা মার্কেটের দিকে ছুটলাম। সবাই কিনছে। কেউ নিজের জন্য, কেউ বাবা, মার জন্য। কেউ বা ঘরনির জন্য। মেসের অন্যরাও এসেছে মার্কেটে। কিন্তু ওসমান ভাই?
হয়তো ঈদের খুশিতে পরিবার পরিজনের জন্য সবচেয়ে সেরা জিনিসটি কিনছেন। উনি আবার ভাবুক লোক, ভেবে শুনে ভালো মনে হলে তবেই তিনি তা কিনেন।
কিরে ভাই! আমরা সবাই আছি কিন্তু ওসমান ভাই যে নেই? বলল শরীফ।
ফারুক : উনি হয়তো পছন্দ করতে পারছেন না।
শহীদ বলে আরে না...। তার পুরো মার্কেট কিনা শেষ হয়নি। দেখবেন পুরো মার্কেট কিনে আনবেন। আমরা সবাই হেসে উঠি।
আস্তে আস্তে ইফতারের সময় হয়ে যায়। কিন্তু ওসমান ভাই এখনো বাসায় ফেরেননি। সবাই তাকে রেখে ইফতার করল। ইফতারের আগে আমি তার ফোনে একটা কল করে দেখি ফোন বন্ধ। রাত ১১টা। এখনো তার বাসায় ফেরার নাম নেই। আমরা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কারণ তিনি তো কখনো বেশি রাত করে ফেরেন না। রাত আরো গভীর হয়ে ওঠে। সেই সাথে ভয়ও আরো বেড়ে যায়।
আমরা সবাই তিনি যেখানে কাজ করেন সেখানে খোঁজ করি। এক ধরনের টেনশন আমাদের আক্রান্ত করে। আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানাই। পুলিশ আমাদেরকে মামলা করতে বলেন। আমরা থানায় একটি জিডি করি।

২৭ রমজান। ৫ আগস্ট ২০১০ ইংরেজি।
সকাল হলো। কিন্তু ওসমান ভাই এখনো ফিরলেন না। প্রায় ২১ ঘণ্টা ধরে তিনি নিখোঁজ। এরকম তো তিনি করেন না। কখনো কোথাও গেলে না আসতে পারলে তিনি ফোন করে বলে দিতেন। কিন্তু আজ যেন সবকিছু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
আমরা সবাই তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় ফোন করি। তার কথা জিজ্ঞেস করতেই তার স্ত্রী বলেন, সেদিন ফোন দিয়েছিল ফোনে বলল, মনটা নাকি ভালো নেই। কারণ জানতে চাইলে তার অফিসিয়াল কারণ বলে ফোনটা কেটে দেয়। এরপর আর কোন যোগাযোগ হয়নি তার সাথে।
সমস্ত বিষয়টা আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। রহস্যময় এই ঘটনার শেষ কি হবে? আমরা সবাই খুব টেনশনে আছি। আমরা সবাই একসাথে হয়ে ওসমান ভাইয়ের ব্যাগপত্র খুলে দেখি, তাতে কিছুই নেই।
তখন শরীফ বলে, শনিবার রাতে ওসমান ভাইকে ছাদে কার সাথে মোবাইলে তর্ক করতে দেখি। তর্কের এক মহূর্তে দেখি ফোনটা কেটে যায়। প্রায় ১৫-২০ মিনিট এভাবে তর্ক করে।
আমরা পুলিশকে এসব তথ্য দিই। পুলিশ আমাদেরকে ওসমান ভাইকে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দেয়। পুলিশ সুপার রমজান আলী আমার ফোন নাম্বার নিয়ে যান। আমরা সবাই আজ আর টিকেটের জন্য কাউন্টারে গেলাম না। সবাই একটু বেশি ভয় পাচ্ছি। তার বাড়ি থেকে অনেক কল আসছে।
২৮ রমজান, ৬ আগস্ট ২০১০ ইংরেজি। সকালবেলা পুলিশ সুপার রমজান আলীর ফোন। দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিই তাকে। পুলিশ সুপার জানান, তারা খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। এসব বলে তিনি ফোনটা রেখে দেন। কাল হয়তো ঈদের চাঁদ উঠবে। চারিদিকে আনন্দের জোয়ার বইছে। কিন্তু আমাদের মন ভালো না। বিকাল প্রায় ৫টার দিকে পুলিশ সুপার রমজান আলী আমাদেরকে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলেন। আমরা দ্রুত বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক মানুষ ভিড় জমিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু এগিয়ে দেখি সেখানে একটা লাশ পড়ে আছে। ভালো করে দেখি সে লাশটা আর কেউ নয় আমাদের সবার বড় ভাই ওসমান ভাই। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমরা সবাই ওসমান ভাইকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু যেভাবে খুঁজে পেলাম, এমনটা কখনো ভাবতে পারিনি। আমরা তার মৃত্যুর খবরটা তার গ্রামের বাড়িতে পাঠাই। পুলিশ লাশটাকে পোস্টমর্টেমের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বুকের দুই পাশে দু’টি গুলি করা হয়। তিনি মারা যান প্রায় ১৩ ঘণ্টা আগে এবং মৃত্যুর আগে তিনি ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছিলেন। পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বলে, হয়তো তারা ওসমানকে ৪ আগস্ট অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর পর ১ দিন অবরুদ্ধ রাখার পর ৬ আগস্ট ভোর ৫টায় হত্যা করে। তার মা ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর কাঁদতে কাঁদতে নির্বাক হয়ে যান। ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সহধর্মিণী বেহুঁশ হয়ে গেছেন। এই অনাগত শিশুটি তার বাবার মুখ দেখে যেতে পারেনি। বঞ্চিত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় পিতৃস্নেহ থেকে।
ওসমান ভাইয়ের দাফন শেষ করার পর আমরা তার পরিবারের কাছে যাই। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি। ওনার তিন বছরের ছোট বাচ্ছাটা আব্বু আব্বু বলে খুব চিৎকার করছে। জানি না তার এ চিৎকার কবে শেষ হবে? আমরা তার বাকরুদ্ধ মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি।
ওসমান ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে ২০১৫ সালের এই সময় প্রায় এক বছর হতে চললো। তার মা এখনো জানেন না তার ছেলের মৃত্যুর হত্যাকরী কারা? কারা তাকে পুত্রছাড়া করেছে? তার ছেলেমেয়েদেরকে পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছে? তার স্ত্রীকে বিধবা করেছে। এভাবে আর কত মায়ের বুক খালি হবে? কত স্ত্রী বিধবা হবে? কত শিশু এতিম হবে? অথচ তার মা বিশ্বাস করেন ঈদে তার ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে। এখনো প্রত্যেকটা ঈদে ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। ছেলের জন্য চালের নাড়– বানান। হয়তো এ অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষ হবে না কোন দিন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ