অবশেষে সোনার হরিণ ধরা দিল স্পেনের হাতে

অবশেষে সোনার হরিণ ধরা দিল স্পেনের হাতে

প্রচ্ছদ রচনা আগস্ট ২০১০

হাসান শরীফ

স্পেনের বিশ্বকাপ জয়আরো অনেক আগেই বিশ্বকাপ তাদের হাতে উঠতে পারতো। কিন্তু নানা জটিলতা আর হিসাবের মারপ্যাঁচে হয়নি। শিরোপা জয় তো দূরের কথা, সেমিফাইনালে পর্যন্ত তারা উঠতে পারেনি। তবে এবার প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেই বাজিমাত স্পেনের। ২০০৮ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবার ফেবারিট হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল স্পেন।  ফেবারিটের তকমাটি এবার আর তাদের জন্য ভারী হয়ে ওঠেনি। আরেক শিরোপাপ্রত্যাশী নেদারল্যান্ডসকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে নিয়েছে লা রোজারা। ফাইনালে ১-০ গোলে হারিয়েছে তারা। আর তৃতীয়বারের মতো রানার্সআপেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো নেদারল্যান্ডসকে। নির্ধারিত সময়ের খেলা গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের ২৬ মিনিটে একমাত্র গোলটি করেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। সব হিসাব এতেই ছিল।

শুধু শিরোপা নয়, ফেয়ারপ্লে ট্রফিও তারা জিতে নিয়েছে। অর্থাৎ যখন তারা পেল, তখন দু’হাত ভরেই পেয়েছে সব কিছু। সুইজারল্যান্ডের কাছে হারের মধ্য দিয়ে টুর্নামেন্টে তাদের শুরু হলেও তারা চ্যাম্পিয়নের মতোই খেলেছে বাকি ম্যাচগুলোতে এবং টুর্নামেন্টের শেষে কেউ বলেনি, অযোগ্য দলের হাতে ট্রফিটি পড়েছে।

খেলার প্রথম মিনিট থেকেই স্পেন চেপে ধরে নেদারল্যান্ডসকে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চললেও ¯েপনিশদের কাছে অনেকটাই মিইয়ে পড়েছিল টোটাল ফুটবল মন্ত্রে দীক্ষা নেয়ারা। ফাইনালের উত্তেজনায় ফুটবলাররা বোধহয় পরিচ্ছন্ন খেলার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। একের পর এক ফাউল করে বসেন উভয় দলের খেলোয়াড়রা। আর রেফারি কার্ড দেখিয়ে যেতে থাকেন।

ডাচরা সবচেয়ে ভালো সুযোগ পেয়েছিল ৩৩ মিনিটে। জন হেইটিঙ্গার দূরপাল্লার শট প্রায় স্পেনের গোলবারে পৌঁছে যাচ্ছিলো। ইকার ক্যাসিয়াস শূন্যে ভেসে বলের নিচে আঙুল ছুঁইয়ে বিপদমুক্ত হন।

অতিরিক্ত সময়ে আরিয়ান রোবেন বক্সের ডান দিক থেকে গোলে কিক নিয়েছিলেন। গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী ইকার ক্যাসিয়াস এবারও বাঁচিয়ে দেন স্পেনকে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুটা একটু পরিচ্ছন্ন ছিলো। কিন্তু অষ্টম মিনিটেই হলুদ কার্ড দেখেন গিয়োভান্নি ব্রঙ্কহর্স্ট। খানিক বাদেই হেইতিঙ্গা পঞ্চম ডাচ খেলোয়াড় হিসেবে হলুদ কার্ডের শিকার হন।

৬২ মিনিটে দারুণ এক সুযোগ নষ্ট হয় ডাচদের। মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে একাই গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যান আরিয়ান রোবেন। বক্সের ওপর থেকে বাঁ পায়ের প্লেসিং শট নিলে ইকার ক্যাসিয়াসের পায়ে লেগে বল চলে যায় সীমানার বাইরে।

৬৭ মিনিটে ডান দিক দিয়ে এগোচ্ছিলেন রবিন ফন পার্সি। কিন্তু তাকে অবৈধভাবে ফেলে দেয়ায় হলুদ কার্ড দেখেন স্পেনের ক্যাপদেভিয়া।

বদলি খেলোয়াড় নাভাসের মাইনাস বল থামাতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন ডাচ ডিফেন্ডার। সুযোগে শট নেন ডেভিড ভিয়া। কিন্তু গোলরক্ষক বাঁচিয়ে দেন।

৭৬ মিনিটে জাভির কর্নার কিক থেকে সার্গিও রামোস লাফিয়ে হেড নিলে বল চলে যায় ক্রসবারের ওপর দিয়ে। আরিয়ান  রোবেন দুর্বার গতিতে ছুটে যান স্পেনের গোলপোস্টের দিকে। দুইজনকে পরাস্ত করে শেষে বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হার মানেন স্প্যানিশ গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসের কাছে।

খেলার তখনো সাত মিনিট বাকি। শেষ পর্যন্ত গোল হলো না। অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় খেলা। অতিরক্ত সময়ের ১১ মিনিটে জেসাস নাভাস ডান দিক থেকে শট নিলে ব্রঙ্কহর্স্টের পায়ে লেগে বল চলে যায় সীমানার বাইরে। ১৪ মিনিটে একক প্রচেষ্টায় নিশানায় বল পাঠানো চেষ্টা করেছিলেন সেস ফ্যাব্রেগাস।

১৯ মিনিটের সময় ১০ জনের দলে পরিণত হয় নেদারল্যান্ডস। শিরোপা জয়ের স্বপ্ন তখন তাদের ফিকে হয়ে গেছে। জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠান : উদ্বোধনীর মতো এবারের বিশ্বকাপের সমাপনীটাও হয়েছে জমকালো। কলাম্বিয়ান পপ গায়িকা শাকিরা জোহানেসবার্গ সকার সিটির স্টেজ মাতান। অনুষ্ঠানের শুরুতেই অনিন্দ্যনীয় কণ্ঠ আর নাচের তালে তালে দর্শকদের উদ্দীপ্ত করেন তিনি। তার গানে অংশ নিয়েছেন ৭০০ জন সহশিল্পী। লেজার শোতে ফুটিয়ে তোলা হয় অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জাতীয় পতাকা, আফ্রিকা মহাদেশের মানচিত্র এবং বিশ্বকাপ ট্রফি। সঙ্গে আতশবাজির ফোয়ারা তো ছিলোই। এরপর একে একে আফ্রিকান শিল্পীরা গান ও নাচ পরিবেশন করেন। আঞ্চলিক সংস্কৃতি ফুটে ওঠে তাদের পারফর্মে। যার জন্য বিশ্বকাপ দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেই জীবন্ত কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার উপস্থিতিতে পরিবেশন করা হয় সমাপনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ১৭টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্যবর্গ এবং হলিউডের একঝাঁক তারকা। ২১৫টি দেশের ৭০০ মিলিয়নেরও অধিক মানুষ টিভি পর্দায় অনুষ্ঠানটি সরাসরি উপভোগ করে। স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে জমকালো অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করেন প্রায় লাখখানেক দর্শক।

সেরা খেলোয়াড় ফরলান : উরুগুয়ের স্ট্রাইকার দিয়েগো ফরলান এবারের বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে সোনার বল পুরস্কার পেয়েছেন। এবারের বিশ্বকাপে অসাধারণ ফুটবল খেলেছেন উরুগুয়ের এই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়। করেছেন পাঁচ গোল। তার দুর্দান্ত নৈপুণ্যে ৪০ বছর পর আবারো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি। নেদারল্যান্ডসের ওয়েসলি স্নেইডার পেয়েছেন সিলভার বল। ব্রোঞ্জ বল পেয়েছেন স্পেনের ডেভিড ভিয়া।

ডাবল জিতলেন মুলার : ডেভিড ভিয়া, ওয়েসলি স্নাইডার ও দিয়েগো ফরলানকে পাশ কাটিয়ে সেরা গোলদাতার পুরস্কার জিতে নিয়েছেন জার্মানির মিডফিল্ডার টমাস মুলার। সঙ্গে পেয়েছেন সেরা উঠতি খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিও। মুলার বিশ্বকাপে নিজের পঞ্চম গোলটি করেন উরুগুয়ের বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে। এবারের বিশ্বকাপে পাঁচটি করে গোল করেছেন আরো তিনজন উরুগুয়ের দিয়েগো ফরলান, স্পেনের ভিয়া ও নেদারল্যান্ডসের স্নাইডার। কিন্তু সতীর্থদের দিয়ে আরো তিন গোল করানোয় ফিফা গোল্ডেন বুটের জন্য বেছে নেয় ২০ বছরের এই জার্মান মিডফিল্ডারকেই। তাকে টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের স্বীকৃতিও দেয় ফিফা। অথচ বিশ্বকাপে আসার আগে জাতীয় দলের হয়ে মাত্র দু’টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো এই জার্মান তরুণের।

ক্যাসিয়াস সেরা গোলরক্ষক : স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াসকে সেরা গোলরক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছে ফিফা। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারানোর পরপরই ভোটাভুটিতে তাকে সেরা গোলরক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করে সংস্থাটি। ফলে গোল্ডেন গ্লাভস পুরস্কারে ভূষিত হলেন তিনি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ডাচ খেলোয়াড় আরিয়েন রোবেনের বাড়িয়ে দেয়া বল দারুণভাবে ঠেকিয়ে দেন এই রিয়াল মাদ্রিদ তারকা। পুরো টুর্নামেন্টে সাতটি গোল হজম করতে হয়েছে ক্যাসিয়াসকে। কোয়ার্টার ফাইনালেও প্যারাগুয়ের বিপক্ষে একটি পেনাল্টি শট ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ওই খেলায় ১-০ গোলের ব্যবধানে জিতে স্পেন। বলতে হয় ফাইনালে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন স্পেনকে। নেদারল্যান্ডসের নিশ্চিত গোলের বল থামিয়েছেন একাধিকবার।  

হলুদ কার্ডের বিশ্বকাপ : হলুদ কার্ডের দিক থেকেও এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার ফাইনাল খেলায় উভয় দল মিলে পেয়েছে ১৩টি হলুদ কার্ড। যার একটি পরে লাল কার্ড হয়ে যায়। সেটি জুটেছে হেইটিঙ্গার ভাগ্যে। ম্যাচ রেফারি ইংলিশম্যান হাওয়ার্ড ওয়েব ডাচদের দেখিয়েছেন আটটি হলুদ কার্ড। স্পেনের খেলোয়াড়রাও বাদ যাননি। তাদের পাঁচজনকে কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। গত বিশ্বকাপের ফাইনালে কার্ড ছিলো চারটি। সে ম্যাচে জিনেদিন জিদান পেয়েছিলেন লাল কার্ড। এ দিক দিয়ে কার্ডের অতীত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলো ভুভুজেলার বিশ্বকাপ। দেখা হবে ব্রাজিলে : বিশ্বকাপের ১৯তম আসরের সমাপ্তি হলো। চার বছর পর ২০১৪ সালে পরবর্তী  আসর বসবে ব্রাজিলে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ