অভিমান    -তমসুর হোসেন

অভিমান -তমসুর হোসেন

গল্প আগস্ট ২০১৫

রাগ করে মাহমুদ ধানখেতে লুকিয়ে থাকল। চাষিরা আউশ ধানের সাথে আমনের বীজ মিশিয়ে দেন। সেই চারা আশ্বিনে সবল হয়ে ওঠে। দেউলা বিলে চাষিরা এমন করেই ধান বোনেন। এসব খেত এতটা জংলাটে হয় যে মানুষ খুন করলেও কেউ টের পাবে না।
সকালে মনটা বিগড়ে গেল মাহমুদের। স্কুলের ছাত্ররা নীলসাগরে যাবে পিকনিক করতে। মাকে বলেছে সে। পঞ্চাশ টাকা জমা করতে হবে। সংসারে অভাব লেগেই থাকে। বাবার কাছে এ কথা বলা যাবে না। অন্যদের মত বাবার কাছে সব আদায় করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন মেলার জন্য পয়সা চেয়ে থাপ্পড় খেয়েছে সে। আর একদিন বইয়ের কথা বলে ধমক খেয়ে কিছু চাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। বাবা অবশ্য বইয়ের বিষয়ে অনেক সতর্ক। বই কেনার পর মলাট লাগিয়ে নাম লিখে দেন। বাবা তার নাম লেখেন আবু তাহের মাহমুদ। বইয়ের মলাটে মাহমুদ বাবার দেহের সুবাস পায়। কিন্তু বাবাকে ডাকতে ভয় পায় সে। অন্য দিকে মায়ের কাছে সব দাবি অসঙ্কোচে প্রকাশ করে।
‘পিকনিকের টাকা দিতে হবে।’
‘কোথায় পাবো টাকা। আমি কি রোজগার করি?’
‘আজ টাকা দেয়ার শেষদিন।’
‘বাবাকে বল। আমাকে বলছ কেন?’
‘তুমি বল। আমি বলব না।’
‘ঘরে চাল নেই। পিকনিক হবে কোত্থেকে?’
‘সুপারি বিক্রি করব।’
‘পিঠের ছাল রাখবে না। সংসারের অভাবের কথা ভাব।’
মাহমুদ ভাবল সে বাড়িতে থাকবে না। সবাই নীলসাগর যাবে। তার ভাগ্যে হবে না। কী করবে সে! এত দূরে চলে যাবে যেখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। রাস্তার লোককে বাবা বলে তার কাছে থাকবে। সে যদি খেতে না-ও দেয় তবুও সে কষ্ট পাবে না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে মাহমুদ আল পথ ধরে দেউলা বিলে পৌঁছল। জায়গাটা জনহীন, নিরিবিলি। ধানগাছের আড়ালে বসে সে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল। এখানে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। কেউ ঘাস কাটতে এলে সেই তার দেখা পাবে। সকালে কিছু খায়নি মাহমুদ। অন্য দিন সে ঘুম থেকে জেগেই বিছানায় বসে মুড়িকলা খায়। আজ পিকনিকের কথা মাথায় থাকায় খাওয়ার কথা ভুলে গেছে। বেলা বাড়লে তার ক্ষুধা লাগল। লাগুক যত ক্ষুধা! সে এখানে বসে সারাটা দিন কাঁদবে। যে মা তাকে টাকা দেয় না অমন মায়ের কাছে ফিরে যেয়ে লাভ নেই। আশ্বিনের শেষে একটু শীত হয়। ধানের পাতায় কুয়াশা লেগে থাকে। বিলের মাঝখানে চলে এসেছে মাহমুদ। এতদূর আসতে তার জামা-প্যান্ট ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়ে বসে থেকে তার ঠান্ডা লাগছে। ঠান্ডায় খুব হাঁচি হয় তার।
রোদ দেখে একটু ফাঁকা জায়গায় বসল মাহমুদ। এবার দেউলার দোলায় ইঁদুরের উৎপাত হয়েছে। যেখানে সেখানে ইঁদুর খাল দিয়েছে। একটা কাল দাঁড়াশ তার পাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল। ওটা মনে হয় ইঁদুরের সন্ধান করছে। এখানে থাকলে সাপ কামড়াতে পারে। কামড়াক! অসুবিধা কী? মাহমুদ এ জীবন রাখতে চায় না। সাপের বিষে সে মরে থাকবে। তখন মায়ের মনে শান্তি হবে। অমন নির্দয় মায়ের এ রকম শাস্তি হওয়া উচিত। একটা বুনো হুলো খরগোশের পেছনে ছুটে তার পাশ দিয়ে গেল। কেমন চকচকে তার চোখ। হুলোটা থমকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ভাগ্যিস পাশে একটা নলের ডাঁটা পড়ে ছিল। ডাঁটা হাতে নিতেই হুলোটা পালিয়ে গেল। হুলো দেখে ভয় পেল মাহমুদ। সে সাপ আর হুলোকে খুব ভয় পায়। একটু পরে আকাশ মলিন হয়ে ঝিরঝির বৃষ্টি নামল। মাহমুদ ভাবল, ভালোই হল। বৃষ্টিতে ভিজে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবে। এমনই তো সে চায়। কিন্তু বাদ সাধল মাঠের চিনা জোঁক। বৃষ্টির পরশ পেয়ে মানুষের রক্তের গন্ধে দল বেঁধে ছুটে আসতে লাগল। পা বেয়ে শরীরে জোঁক উঠতেই ভয়ে চিৎকার দিল মাহমুদ। জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে সে বিলের পশ্চিমে নদীর ধারে চলে এল।
ভাটিতে বয়ে যাচ্ছে নদীর স্রোত। আশ্বিনের সকালে লোকেরা জাল ফেলে মাছ ধরার কথা। কিন্তু একটি জনপোকাও নেই নদীর পারে। এখান থেকে পোয়া মাইল দক্ষিণে ওদের বাড়ি ছিল। নদীর ভাঙনে গেল বছর ওরা চলে গেছে দেউলার বিলের পূর্ব দিকে। ভিটে পড়ে আছে শিমুল এবং বরই গাছ বুকে নিয়ে। বাবা জমি চাষ করতে এদিকে এলে ভিটে দেখে যায়। নদীতে একটা মরা ছাগল ভেসে যাচ্ছে। কাকেরা ঠোকর মেরে গায়ের মাংস খুলে খাচ্ছে। হেঁটে হেঁটে পরিত্যক্ত ভিটেয় এসে দাঁড়াল মাহমুদ। তার দাদীর কবর নদীর কাছাড়ে পড়ে গেছে। আর কয়চাপ মাটি পড়লে নদীতে চলে যাবে। কবরের পাশে বসে চোখের পানিতে ভাসতে লাগল সে। আগে তাদের অবস্থা কত ভাল ছিল। কত লোকজনে ভরে ছিল বাড়ি। দাদী তাকে সারাদিন আদর দিয়ে ভরে তুলত। এখন তার কোন খোঁজ নেই। তার আবদার শোনার কোন মানুষ নেই সংসারে। অন্তরের নীরব ভাষায় দাদীকে অনেক কথা জানাল মাহমুদ। কিন্তু দাদী কোন জবাব দিল না। খেলার সাথী ইউনুসের সাথে দেখা হলো তার। ইউনুস তাকে দেখে অবাক হলো।
‘আরে মাহমুদ। কার সাথে এসেছ?’
‘কারো সাথে না। একা এসেছি।’
‘একা মানে! আন্টি আসে নাই সাথে?’
‘একা আসতে ভালো লাগল। তাই চলে এলাম।’
‘আমাদের বাড়ি যাওনি কেন? একি শরীরের অবস্থা তোমার!’
মাহমুদের কাপড় ভেজা। ইউনুস বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে শূন্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে সে কেন বসে আছে। বাড়িতে গিয়ে ওকে নিজের কাপড় পরতে দেয়। তারপর গরম ভাত খেয়ে কম্বল চেপে গল্প করে। ইউনুসের বাবা বিলে মাছ ধরে বাড়ি এসে ওকে দেখে খুশি হয়। খাওয়া সেরে উনিও গল্পে যোগ দেন। যখন মাহমুদের বাড়ি এখানে ছিল তখন তারা দু’জনে জ্যাঠার কাছে গল্প শুনত। গল্প বলে উনি কখনো বিরক্ত হতেন না। এত গল্প মানুষের পেটে জমা থাকতে পারে। উনি বলেন-
‘মামুদ, এসে ভালোই হয়েছে।’
‘ক’দিন থেকে আসতে চাই। আজ চলে এলাম।’
‘তোমাদের ভিটেয় রাতে কি হয় জান?’
‘কী করে জানব। আমি তো এখানে থাকি না।’
‘সারারাত ভূতেরা মেলা বসায়। কত যে নাচানাচি হয়।’
‘আপনি দেখেছেন?’
‘দেখিনি মানে। কাছে গিয়ে দেখেছি। শিমুল গাছে পা দিয়ে দাঁড়ায়।’
‘কয়টা ভূত আসে?’
‘সেটা আমি বলতে পারব না। অত কি কেউ গুনতে পারে। বরই গাছটায় ছোটরা কিলবিল করে।’
‘বাবাকে বলেননি এসব কথা?’
‘কত বলেছি। উনি শুনেও শোনেন না।’
ভূতের কথা শুনে মাহমুদ ভয়ে এতটুকু হয়ে যায়। ইউনুছ রাতে তাকে ভূত দেখাবে। নদীর ওপর দিকে গভীর রাতে আলো জ্বালিয়ে ভূতেরা আসে। ওরা নাকি নদী থেকে মাছ ধরে এনে আগুনে পুড়ে খায়। কেউ নেই বলে ভিটেটা ভূতেরা দখল করে নিয়েছে। এত ভূতের মধ্যে কেমন করে থাকছে দাদী। কত যেন কষ্ট হচ্ছে তার। মাহমুদ ইউনুসকে সাথে নিয়ে নদীর দিকে যায়। এখান থেকে দক্ষিণে কাশের বনের পাশে একটা পাড়া ছিল। সেখানে তার অনেক খেলার সাথী ছিল। মজু, প্রহল্লাদ আর কৈশরী এখন কোথায় থাকে সে খবর সে জানে না মাহমুদ। শুনেছে তারা বাড়ি করেছে নদীর অন্য পাড়ে। আহা! ওরা কত ভালো ছিল। এখন মাহমুদের জীবনে কত শূন্যতা। কে তাকে দেবে এতটুকু সান্ত্বনা। তাদের ভিটে গ্রাস করতে নদীর মোটেই সময় লাগবে না। কেন যে নদীটা দাদীর কবর গিলে খাচ্ছে না তা বুঝতে পারে না সে। এতটুকু দয়া কেন করছে সে দাদীর সাথে। এখানে এসে ওর মনটা উদাস হয়ে যায়। মনে হয় একটা ছনের ঘর বেঁধে সে দাদীর কবরের পাশে থাকবে। রাতে যখন সবাই নিদ্রা যাবে তখন দাদীর সাথে গল্প করবে সে। সে থাকলে ভূতের সাহস হবে না ভিটের মধ্যে জটলা করার। ভূতেরা সমস্যা করলে সে দাদীকে ডাকবে-
‘ও দাদী ওঠো। দেখ না বাড়িতে ভূতেরা কী করছে।’
‘কে ডাকে এত রাতে? একটু যে ভালো করে ঘুমাব তারও জো নেই।’
‘আরে ঘুমাবে এখন। রাতটা পড়ে আছে না।’
‘কী দরকার?
‘কী দরকার মানে! বাড়িতে ভূতেরা মিটিং করছে আর তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছ?’
‘ভূত তাড়িয়ে আমার লাভ?’
‘তুমি না হয় কবরে ঘুমাতে পার। আমার দশা কি হচ্ছে ভেবেছ একবার?’
‘তোমার উৎপাতে মরেও সুখ নেই। কে তুমি। কার ছেলে?’
‘আমি তোমার নাতি। মাহমুদ সাউদ। চিনতে পারছ না?’
‘চিনেছি। তা তুমি এখানে কেন?’
‘এখানে কেন মানে? এখানে থাকব আমি।’
এসব কথা ভেবে চোখের জলে বুক ভাসায় মাহমুদ। নদীর পাড় থেকে নলের ডাঁটা এনে দাদীর কবরের চারদিকে গেড়ে দেয় সে। এই জনহীন ভিটেয় দাদীর নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে। কেউ নেই যে দাদী তার সাথে কথা বলবে। বাবার সাথে সে তো কোন কথাই বলতে পারে না। এখন থেকে সে একাই এইখানে রাত কাটাবে। এটা তার দাদুর ভিটা। কোনো ভূতের এত সাহস যে ওর সাথে তর্ক করবে। একেকটাকে এমন শট মারবে যে নদীর মাঝে যেয়ে পড়বে। ইউনুসের বাবাকে বলে কালই সে ঘর তৈরি করার কাজে লেগে যাবে। যতদিন দাদীর কবর থাকবে ততদিন সে এখান থেকে এক পা নড়বে না। আশ্বিনের হালকা রোদের দিন ফুরিয়ে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে নদীর ধারে। ইউনুস বলে-
‘চল বাড়ি যাই। রাত হয়ে যাচ্ছে।’
‘তুমি যাও। আমি এখানে থাকব।’
‘পাগল হয়েছ। এখানে মানুষ থাকে?’
‘কেন দাদী থাকছে না। দাদীর পাশে শুয়ে থাকব।’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’
মাহমুদকে জোর করে টেনে বাড়িতে নিয়ে যায় ইউনুস। সে বুঝতে পারে না ওর মনে কিসের কষ্ট। ওর সাথে কত ঘুরেছে সে। সেই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মাহমুদ কেন এমন হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ও মনে খুব আঘাত পেয়েছে। বাড়ি এসে ওরা দেখতে পেল মাহমুদের বাবা-মা এসেছে ওকে খোঁজার জন্য। মা ওকে বুকে তুলে নিলো। দাওয়ায় বসে বাবা চোখের পানি ফেলতে লাগল। সারাটা দিন ওকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজেছে তারা। ইউনুস ওদেরকে সব কথা বলল। অনেকদিন পর তারা এসেছে বলে বাড়িতে খুশির আমেজ তৈরি হলো। বাবার সাথে মাহমুদ বাড়ি যেতে চায় না। ইউনুস বলে-
‘মাহমুদ ওর দাদীর কাছে থাকতে চায়। ওর কী হয়েছে?’
‘কী করব বাবা। অভাবের কারণে ওর দাবি পূরণ করতে পারি না।’
‘কী চেয়েছিল ও?’
‘পিকনিকে যেতে চায়। তার টাকা জোটাতে পারিনি।’
‘না দিতে পারলে বুঝিয়ে বলতেন।’
‘ও এমন জিদ করে। কিছুই বুঝতে চায় না।’
‘সন্তানকে আদর করলে সব কথাই বুঝানো যায়। ওকে সবসময় কাছে রাখবেন।’
ইউনুস মাহমুদকে বোঝায়। বাবা-মায়ের কষ্ট সন্তানের বুঝতে হয়। অন্যের সাথে তাল দিতে যেয়ে ওদের মনে আঘাত দেয়া ভালো নয়। মাহমুদের বাবাকেও ওর বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে বলে সে। একটু পরে আকাশে শরতের চাঁদ ওঠে। সে আলোয় চারদিক প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। মাহমুদের মনটাও আনন্দে নেচে ওঠে আলোর ঢেউ লেগে। বাবার হাত ধরে জোসনার কুসুমে পা ফেলে সে বাড়ি ফিরে আসে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ