আকিবের লাল জ্যাকেট

আকিবের লাল জ্যাকেট

গল্প রফিক মুহাম্মদ জানুয়ারি ২০২৪

ওয়াও... কী সুন্দর! ধোঁয়ার মতো ঘন সাদা কুয়াশায় চারিদিক ঘেরা। আশপাশের বাড়ি-ঘর গাছপালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন অদ্ভুত সুন্দর সকাল এর আগে কোনোদিন দেখেনি আকিব। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বরফ পড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখেছে। কিন্তু এমন কুয়াশা ঘেরা শীত সকালের দৃশ্য এর আগে কোথাও দেখেনি। পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আকিব অবাক হয়ে চারদিক দেখছে। কিন্তু ধোঁয়ার মতো কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু দূরে পুকুরের পানি থেকেও কী সুন্দর ধোঁয়া উড়ছে। আকিব ওর দাদাকে জিজ্ঞেস করে, দাদাজান পুকুরের পানি থেকে এমন ধোঁয়া উড়ছে কেন?

আকিবের দাদা আসিফ আলী মাস্টার একটু মুচকি হেসে বলেন, হঠাৎ শীত একটু বেশি পড়ছে তো তাই ধোঁয়ার মতো কুয়াশা পড়ছে। এই দেখছো না চারদিকে কেমন ঘন কুয়াশা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে এটা খুব বেশিক্ষণ থাকবে না। কিছুক্ষণ পরেই পুব আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঁকি দেবে। এরপর ধীরে ধীরে এই কুয়াশা কেটে যাবে। সূর্যের ঝলমলে আলোতে চারদিক ফর্সা হয়ে যাবে। তখন শীত সকালের সৌন্দর্য অন্যরকম হবে।

: তাই? কুয়াশা ঘেরা এমন সুন্দর শীতের সকাল এর আগে আমি কখনো দেখিনি দাদাজান। কী সুন্দর ধোঁয়ার মতো কুয়াশা উড়ছে।

পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে আসিফ আলী মাস্টার আর তার নাতি আকিব হাসান দাঁড়িয়ে শীত সকালের এই মনোরম দৃশ্য দেখছেন। পুকুর ঘাটে পাকা বেঞ্চ কুয়াশায় ভেজা থাকায় তাতে তারা বসতে পারছেন না। আফিস আলী মাস্টারের একমাত্র ছেলে আলিফ হাসান ঢাকায় একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। তার একমাত্র ছেলে আকিব হাসান। ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ডিসেম্বরের শুরুতেই ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন স্কুল ছুটি। তাই বাবা-মাকে নিয়ে গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। গতকাল ঢাকা থেকে নেত্রকোনা শহরে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এরপর নেত্রকোনা থেকে অটো-রিকশা দিয়ে দাদার বাড়ি যেতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লেগেছে। রাতে দাদার বাড়ি গিয়ে বাইরের তেমন কিছুই দেখা হয়নি। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আকিব রাতে তার দাদার সাথেই ঘুমিয়েছে। দাদাজান অনেক সুন্দর গল্প জানেন। ঢাকায় গেলে আকিব তো সবসময় দাদাজানের কাছে গল্প শুনে। বিশেষ করে দাদাজান যখন ভূতের গল্প বলেন তখন ভয়ে আকিবের গা শিউরে ওঠে। গত রাতে দাদাজান হলুদ পরীর গল্প শুরু করেছিলেন। পরীর দেশের এক রাজকন্যা। সে খুব দুঃখী। পরীরা সবসময় হেসে খেলে বেড়ায়। কিন্তু রাজকন্যা হলুদ পরী সবসময় চুপচাপ বসে থাকে। তার মনে অনেক দুঃখ...। এ পর্যন্ত শোনার পরই আকিব ঘুমিয়ে পড়ে। দাদাজান ওর গায়ে লেপটা ভালো করে মুড়িয়ে দেন।

সকালে আজান শুনে আকিবের ঘুম ভেঙে যায়। জেগে দেখে দাদাজান নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। সেও তখন বলে, দাদাজান আমিও আপনার সাথে নামাজ পড়তে যাবো। আসিফ মাস্টার বলেন, এত শীতের মধ্যে তুমি যাবে?

: যাবো দাদাজান। আমার তো শীতের জ্যাকেট আছে। আমার খুব প্রিয় এই লাল জ্যাকেট। এটা গায়ে পরলে আর শীত লাগবে না।

: ঠিক আছে তাহলে উঠে তাড়াতাড়ি বাথরুম সেরে অজু করে তৈরি হয়ে নাও।

আসিফ আলী মাস্টার রিটায়ার্ড করার পর গাঁয়েই থাকেন। গাঁয়ের কৃষি কাজ দেখাশোনা করেই তাঁর সময় কাটে। তিনি প্রতিদিন বাড়ির পাশের মসজিদে নামাজ পড়ে পুকুর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করেন। এরপর শানবাঁধানো ঘাটে বসে কিছুক্ষণ  সময় কাটান। শীতের সময় পুকুর ঘাটে বসে সকালের মিঠে রোদ উপভোগ করেন। প্রতিদিনের মতো আজও তিনি পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছেন। তবে আজ তার সঙ্গে রয়েছে আদরের নাতি আকিব।

ঋতুর পালা বদলে হেমন্তের শেষে চুপে চুপে শীত চলে এসেছে। পৌষের শুরুতেই এবার শীত বেশ জেঁকে বসেছে। ঘন কুয়াশা ঘেরা সকালে সূর্যিমামা বারবার উঁকি মারার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। তারপরও সূর্যিমামার উঁকিঝুঁকিতে কুয়াশার চাদর সরে চারদিক কিছুটা ফর্সা হতে শুরু করেছে। আর তাতেই পাখির কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠছে পুকুর পাড়। পুকুর পাড়ে শিমুল গাছে টকটকে লাল ফুল ফুটেছে। আর সে ফুলের মধু খেতে ছুটে এসেছে কতশত পাখি। এত পাখির কিচিরমিচির রব শুনে আকিব তো বিস্ময়ে হতবাক। সে আবার প্রশ্ন করে, দাদাজান এত পাখির কলরব কোথা থেকে আসছে?

: এই তো পুকুরের উত্তর পাড়ে একটা শিমুল গাছ আছে। তাতে ফুল ফুটেছে। ওই শিমুল গাছেই ময়না, শালিক, টিয়া এসব অনেক পাখি এসে ভিড় করেছে।

: তাই?

: হ্যাঁ তাই। আর একটু ফর্সা হলে তুমি দেখতে পারবে। কী সুন্দর টকটকে লাল শিমুল ফুল। শিশির ভেজা লাল শিমুল ফুলে সূর্যের কিরণ পড়ে ঝিকমিক করবে। আর পাখিরা এ ফুল থেকে ও ফুলে ছুটে ছুটে কী সুন্দর মধু খাচ্ছে।

দেখতে দেখতে পুব আকাশ রাঙিয়ে সূর্যিমামা উঁকি দেয়। পুকুরের পানিতে কয়েকটা হাঁস সাঁতার কাটছে। তাতে পানিতে মৃদু ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আর তাতে সূর্য কিরণ ঝিকমিক করছে। শিমুল গাছের দিকে তাকিয়ে আকিব এবার হতবাক হয়ে যায়। এত লাল, গাছের ডালে ডালে যেন আগুন জ্বলছে। আকিব এবার দৌড়ে শিমুল গাছের নিচে চলে যায়। গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুড়িয়ে নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। আসিফ মাস্টারও আকিবের পিছে পিছে শিমুল গাছের নিচে চলে আসেন। আকিবকে শিমুল ফুল শুঁকতে দেখে, তিনি মুচকি হেসে বলেন, দাদা ভাই এই শিমুল ফুলের কোনো গন্ধ নেই। এর শুধু রং আছে। আর এই লাল রং কীট-পতঙ্গ বা পাখিদের আকৃষ্ট করে। শিমুল ফুলের মতো পলাশ ফুলও দেখতে লাল কিন্তু কোনো গন্ধ নেই।

অজস্র শিমুল ফুল পড়ে গাছের নিচটাও লাল হয়ে আছে। এত সুন্দর দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না। আকিব এবার বলে, দাদাজান আপনি একটু দাঁড়ান আমি আব্বুর মোবাইলটা নিয়ে আসি। এখানে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে হবে। শিমুল গাছে ফুলে ফুলে পাখিদের ছোটাছুটির ছবি তুলতে হবে।

পুকুর পাড়ে ঘোরাঘুরি, সেলফি আর ছবি তোলা শেষ করে বাড়ি ফিরে দাদার সাথে নাশতা খেতে বসে আকিব। ঘরের বারান্দায় রোদে পাটি বিছিয়ে ওরা সকালের নাশতা খেতে বসেছে। আকিবের জন্য ওর দাদি ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা এসব বানিয়েছেন। ভাপা পিঠা হাতে নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে আসিফ আলী বলেন, দাদু ভাই সকালের এই মিষ্টি রোদে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। 

: হ্যাঁ দাদাজান। ভাপা পিঠা তো আমার খুবই পছন্দের। ঢাকার বাসায় তো আম্মু ভাপা পিঠা বানাতে পারে না। বাইরে রাস্তার পাশে বসে অনেকে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করে। আব্বু মাঝে মাঝে সেখান থেকে ভাপা পিঠা কিনে আনেন। আচ্ছা দাদাজান এই যে আপনি মিষ্টি রোদ বললেন, রোদ আবার মিষ্টি হয় নাকি?

: আসিফ মাস্টার এবার আকিবের গালে আলতো আদর করে বলেন, আচ্ছা মিষ্টি জিনিসটা কী? যা খেতে খুব ভালো লাগে, মজা লাগে তাইতো?

: হ্যাঁ...

: এই যে তুমি রোদে বসে পিঠা খাচ্ছ কেমন লাগছে?

: ভালো লাগছে। এই শীতের মধ্যে রোদে বসে বেশ আরাম লাগছে।

: এই যে রোদটা ভালো লাগছে, আরাম লাগছে এটাকেই ভালোবেসে সবাই মিষ্টি রোদ বলে।

বিকেলে গ্রাম দেখতে দাদাজানের সাথে বাইরে যেতে অস্থির হয়ে পড়েছে আকিব। জোহরের নামাজ আদায় করে খাওয়াদাওয়া শেষ করেই আসিফ মাস্টারকে বাইরে যেতে তাগাদা দিচ্ছে আকিব। আসিফ মাস্টার বলেছেন, আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকেই সরাসরি ঘুরতে বের হবেন। আকিবের মা এসে আকিবকে বলছে, বাইরে বেড়াতে গেলে সোয়েটার পরে যেও। না হলে কিন্তু ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

: আম্মু সোয়েটার পরে পরবো। এখন আমি আমার এই লাল জ্যাকেটাই পরে যাবো। এই জ্যাকেটটা পরলে আর ঠাণ্ডা লাগবে না। 

দাদার সাথে বিকেলে ঘুরতে বের হয়ে আকিব তো মুগ্ধ। পুকুরের পূর্ব দিকে বিশাল খোলা মাঠ। পাকা ধান কেটে নেওয়ার পর মাঠে পড়ে আছে শুকনো নাড়া। মাঠের একপাশে অনেকটা এলাকাজুড়ে হলুদ দেখা যাচ্ছে। বিকেলের হালকা রোদ পড়ে ওই হলুদ রং কেমন চিকচিক করছে। আকিব সে দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলে, ওয়াও! কী সুন্দর এই হলুদ রঙের এলাকা। এই যে হলুদ দেখা যাচ্ছে এসব কী দাদাজান।

: আসিফ মাস্টার বলেন, ওখানে সব সরিষার ক্ষেত। সরিষার হলুদ ফুল ফুটে পুরো এলাকাটাই হলুদ দেখা যাচ্ছে।

আকিব দৌড়ে ছুটে যায় সরিষার ক্ষেতে। ক্ষেতের ছোট ছোট আল দিয়ে সে ছুটে চলে। সরিষা ক্ষেতে বসে হলুদ ফুলের সাথে সেলফি তোলে। এত সুন্দর তাদের গ্রাম, আকিব খুশিতে উড়তে থাকে। মাঠ থেকে গ্রামের দিকে তাকিয়ে দেখে কী সুন্দর সবুজে ঘেরা গ্রামটি। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। বিস্তীর্ণ মাঠের পূর্বপাশে ছোট্ট বিল। বিলের পরেই যে গ্রামটা দেখা যায় তার সাথে যেন আকাশটা মিশে আছে। মাঠের এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই সূর্য পশ্চিম আকাশে তাদের বাড়ির পেছনে গাছের আড়ালে চলে যাচ্ছে। আসিফ আলী মাস্টার এবার তাড়া দিয়ে বলেন, চলো দাদু ভাই, এবার বাড়ির দিকে যাওয়া যাক। কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান হবে।

: ঠিক আছে দাদাজান চলেন।

মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আকিব হঠাৎ দেখে ওর মতো বয়সের একটি ছেলে খালি গায়ে মাথায় একটি বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠের ঠাণ্ডা বাতাস ছেলেটির গায়ে লাগছে। শীতে ছেলেটি বেশ জড়সড় হয়েই মাথায় বস্তা নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আকিব ওর দাদাকে বলে, দাদাজান ছেলেটি মাথায় করে কী নিয়ে যাচ্ছে।

: আসিফ মাস্টার বলেন, মাঠ থেকে শুকনো গোবর কুড়িয়ে বস্তায় ভরে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে রান্না-বান্না করবে। এছাড়া এগুলো জ্বালিয়ে চারপাশে বসে শরীরটাকে গরম করবে।

: কেন দাদাজান ওদের শীতের জামাকাপড় নেই?

: না তেমন নেই। ওরা খুব গরিব তো। ছেঁড়া-ফাড়া কিছু জামাকাপড় আছে ওগুলো জড়িয়ে কোনোরকমে শীতের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করে।

: দাদাজান এই ছেলেটির শীতে খুব কষ্ট হয় তাই না?

: হ্যাঁ তা তো হয়-ই...। আসিফ মাস্টারের বুক থেকে অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।

: আকিব এবার দৌড়ে ছেলেটার কাছে যায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, এই তোমার নাম কী? ছেলেটা কিছুটা থতমত খেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে আসিফ মাস্টারকে দেখে। তারপর বলে, আমার নাম সুমন।

: সুমন, দাদাজান বলেছেন, তোমার কোনো শীতের জামা নেই। শীতে তোমার খুব কষ্ট হয়। এই নাও আমার এই লাল জ্যাকেটটা আমি তোমাকে দিলাম।

: ছেলেটা হতবাক। সে কী করবে বুঝতে পারে না। আসিফ মাস্টার কাছে এসে বলেন, সুমন এ আমার নাতি আকিব। ঢাকায় থাকে। নে এটা আকিব তোকে দিয়েছে।

সুমনের চোখ-মুখ খুশিতে নেচে ওঠে। এক চিলতে হাসি দিয়ে সে জ্যাকেটটা হাতে নেয়।

আসিফ মাস্টার আকিবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তার ভেতরটা আনন্দে নেচে ওঠে। দু’চোখে আনন্দাশ্রু ছলছল করতে থাকে। গর্বে তার বুকটা ভরে যায়। আকিবকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ