আগুন ঝরা দিন

আগুন ঝরা দিন

গল্প আগস্ট ২০১১

আহমদ মতিউর রহমান

এক.

নীল নদের এক প্রান্তে নাইল সিটি। কায়রোর সুনসান আবাসিক এলাকা। এর একটু দক্ষিণে অপেরা স্কোয়ার। সপ্তাহের প্রায় সাতটি দিনই এই এলাকা লোকে গিজগিজ করে। আজ শুক্রবার বলে সকালের দিকটায় একটু শান্তভাব রয়েছে। বিকেলে সন্ধ্যায় জমে উঠবে। আন্দালুস রোড পেরিয়ে একটি তিনতলা বাড়ি। সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে অপেরা স্কোয়ার হয়ে কাসর আল নাইল সেতুতে।

অপেরা স্কোয়ারের সামনে জটলা দেখে থেমে যায় ঘানিম আল জাওয়াদ। কাস এইটের ছাত্র- বছর ঘুরলেই নাইনে পা দেবে, তারপর মাধ্যমিকের প্রস্তুতি। বয়স ১২ পেরিয়ে ১৩-তে পড়লো।

ফিস ফিস করে বলা অনেক কথাই ইদানীং তার কানে আসছে।

আল কাহেরা মানে কায়রোর অবস্থা ভাল নয়, দেশের তো নয়ই। আগামীতে দেশটির কী হবে এ চিন্তায় অস্থির সবাই।

আব্বার মুখ গোমরা। বড় চাচা সর্বদা অস্থির- মনে হয় এক ঝড়ো হাওয়ার মুখোমুখি। জাওয়াদ তো আর ছোট শিশুটি নয়- সে বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে বা হচ্ছে।

জটলা দেখে এগিয়ে যায় জাওয়াদ। একটা লোককে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে আরো তিনজন লোক। লোকটার কী অপরাধ কেউ জানে না। যে লোকগুলো তাকে বেঁধে রেখেছে তারা পুলিশ নয়, কোনো বাহিনী নয়- গায়ে ইউনিফরম নেই।

: সাদা পুলিশ। বললো একজন।

: আর কী হবে, সরকারি পেটোয়া বাহিনী। আরেক জনের মন্তব্য।

: সদরে মামলুকাতের দিন শেষ হয়ে এসেছে।

এখন নতুন দিনের অপেক্ষা। এটা শেষ কামড়।

বললো আরো একজন। প্রেসিডেন্ট মোবারকের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত।

ভিড় ঠেলে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলো জাওয়াদ। না এ তল্লাটের কেউ নয়, একদম অচেনা। তবে লোকটাকে দেখে মায়া হলো জাওয়াদের- এই লোক কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত থাকতে পারে না। ওহ্ কি মারটাই না তাকে মেরেছে লোকগুলো। মুখে গায়ে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। এটা অত্যাচার। সরকারের বিরুদ্ধে, মন্ত্রী-সরকারি দলের লোকের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না এ ভারী অন্যায়। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে এ অন্যায় চলছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।

আব্বা এ কারণেই বোধ হয় চিন্তিত। বিশেষ করে তার ছোট ভাই মানে জাওয়াদের চাচাকে নিয়ে তার চিন্তা।

বিএসসি পাস করে বেকার বসে আছেন চাচা ঘানিম আল ফাইয়াজ। চাকরির দরখাস্ত করেও কাজ হয়নি- গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, অমুক দলের সঙ্গে যুক্ত- সাফ কথা চাকরি হবে না।

কেন ধর্ম পালন করা, ধর্মের দিকে মানুষকে আহ্বান করা, ধর্মের আদলে লোকদের পরিচালনা করতে যাওয়া কি অন্যায়? এভাবে ধর্ম পালন করতে দেখে কতো লোককে ইখওয়ান সন্দেহে আটক, পঙ্গু আর হত্যা করে গুম করেছে তার হিসাব লেখা নেই। এটা মিসরে, কায়রোতে কার না অজানা। তবে মুখ ফুটে বলা বারণ।

ছোট চাচার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে জাওয়াদ জানতে পেরেছে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কথা।

হাসানুল বান্না এই দলের প্রতিষ্ঠাতা।

সেটা ১৯২৮ সালের কথা। তুচ্ছ কারণে দলটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে- নেতাকেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় অকারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ করেও ইখওয়ানকে মুছে ফেলা যায়নি। পারেননি গামাল নাসের, আনোয়ার সাদাত। মোবারকও পারবেন না। লোকেরা তো পথে-ঘাটে তাই বলাবলি করে।

আটক লোকটার চেহারা এখনো চোখে ভাসছে জাওয়াদের। লোকটা কি ইখওয়ানের কোনো সদস্য- তার চাচার মতো। হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। মোবারকের সমালোচনা করা, সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করা অপরাধ?

হ্যাঁ অপরাধ। মিসরে এটাই অপরাধ।

জানো না এখানে গণতন্ত্র নেই। কথা বলার স্বাধীনতা নেই, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নেই। জাওয়াদের ভেতর থেকে আরেকজন জাওয়াদ যেন কথা বলে ওঠে।

সে আরো বলে, দেখো না ওবামা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না কাঁদলেও মোবারককে কিছু বলে না। মোবারকের আয়ু শেষ হয়েছে- তার ছেলে এখন ক্ষমতায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানো না। ওবামা ক’ দিন আগে কায়রোতে যে ভাষণ দিয়েছেন কতো জাঁকজমকের সঙ্গে তা দেশবাসী শুনেছে। কিন্তু তার পর কিছু হয়েছে কি?

ঠিক ঠিক। মাথা নাড়ে জাওয়াদ। মোবারকের জায়গায় নতুন জুনিয়র মোবারক আসছে। তার মানে আরো ৩২ বছর চলবে একই ধরনের শাসন নিষ্পেষণ! না, আর ভাবতে পারে না।  আজ বাসায় গিয়ে চাচাকে সাবধান করতে হবে। ঐ লোকটার মতো তার অবস্থা হোক, এটা সে চায় না।

আরেকটু সামনে এগোলেই কাসর আল নাইল ব্রিজ। নীল নদের ওপর চমৎকার এই সেতুটি। সেতুর অপর তীর আল তাহরির এভিনিউ- তারপর তাহরির স্কোয়ার।

বাজারে লোকের কাছে সে শুনতে পেয়েছে তাহরির স্কোয়ারে কী যেন হতে যাচ্ছে। সবাই জড়ো হচ্ছে সেখানে। সেখানে নিজে যাবে এবং দেখে আসবে এই চিন্তাতেই পা বাড়িয়েছিল জাওয়াদ। কাসর আল নাইল সেতুর সামান্য আগেই থমকে গেল।

সেতু পার হয়ে তাহরির স্কোয়ারে গেলে বাস বা স্কুটারে চাপতে হবে। কিন্তু বাসে-স্কুটারে কঠোর চেকিং তাকে নিবৃত্ত করলো। পর মুহূর্তে পুলিশের একটি জিপ শাঁ করে সেতু মুখে বেরিয়ে গেল। এর ভেতরে আটক অবস্থায় কয়েকজন লোক। সেই লোকটাকে এক লহমায় খেয়াল করলো জাওয়াদ।

দুই.

নীল নদ বিধৌত কায়রোর আসল নাম আল কাহিরা। কাহিরাকে ইংরেজরা নাম দিয়েছে কায়রো। যেমন মিসরের আসল নাম মেছের হলেও তার নাম দিয়েছে ইজিপ্ট। বিশ্বের ১৬তম জনবহুল শহর কায়রো। একে বলা হয় হাজার মিনারের শহর, সিটি অব থাউজেন্ড মিনারেটস। মুসলিম সভ্যতার একটি আদি কেন্দ্র মিসর তথা কায়রো। এখানকার আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, এটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে শত শত বছর ধরে।

নামে হাজার মিনারের শহর হলেও এখানে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ইসলামী আকিদার প্রচার প্রসার নিষিদ্ধ। ইসলামপন্থী দলগুলোর ওপর নির্যাতন চালিয়ে এগুলোকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এসব কথা ভাবতে গিয়ে হতাশায় বুক ভারী হয়ে ওঠে জাওয়াদের।

এসব তো গেল এক দিক। অন্য দিকে বিশ্বের বড় একটি পর্যটন আকর্ষণ মিসর আর মিসরের পিরামিড। প্রাচীন সভ্যতার এসব নিদর্শন দেখতে আর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে সারা বিশ্বের সব দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসে, এটা ভাবতেও ভাল লাগে। অথচ এই দেশটার অন্তরকে বলতে গেলে স্তব্ধ করে রেখেছে এলাকার প্রশাসন। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে মিসরের গৌরবকে বাড়িয়ে দিয়েছেন নাগিব মাফফুজ। এ কথা ভাবতেও ভাল লাগে জাওয়াদের।

কম কথার সাদামাঠা এ মানুষটিকে তার ভাল লেগে গিয়েছিল। একদিন আব্বার সঙ্গে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেও এসেছে। এটা অবশ্য কয়েক বছর আগের কথা। সে তখন ছিল শিশু এবং মাহফুজ তখন বেঁচেছিলেন। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেই রেস্তোরাঁটি যেখানে নিয়মিত বসতেন, আড্ডা দিতেন মাহফুজ। জাওয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি একদিন অনেক বড় হবে।

এখন সে ভাবে, সে আসলেই কি অনেক বড় হতে পারবে? আর বড় হলেই বা লাভ কী? তার চাচার মতো উচ্চ শিক্ষা নিয়েও চাকরি পাবে না। মনটা দমে যায়। মনে মনে ভাবে এই শাসকেরা বিদায় হলেই ভাল হয়।

দেশটা বেঁচে যায়, মানুষগুলো মুক্তি পায়। আব্বা তাকে একদিন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা একটা দেখার জিনিস বটে। আব্বা বলেছিলেন, মিসরের একটা গৌরব যদি থাকে সেটা এই আল আজহার।

৯৭০ সালে এটা তৈরি। তার পর থেকে এটা জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে। বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখান থেকে আল আজহারে ছাত্র পড়তে আসে না। তার আব্বা নিজেও ছিলেন আল আজহারের ছাত্র।

এসব কথা ভাবতে গর্বে তার বুকটাও ফুলে ওঠে। বড় হয়ে সেও আল আজহারে পড়ার ইচ্ছা রাখে।

তিন.

পড়ার টেবিলে বসেছিল জাওয়াদ। পড়ায় তেমন মন বসে না। ভেতর থেকে আম্মার তাড়া, বাবা বইগুলো একটু নেড়ে চেড়ে দেখ, পরীক্ষার আর বেশি বাকি নেই।

আম্মার এই এক স্বভাব। সব সময় পড়ার জন্য তাগাদা। যেন এ ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের আর কোনো কাজ নেই। আম্মার তাড়া খেয়ে ছোট বোন রাফিয়া বই নিয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে টেবিলে।

: আমি তো বলেছি, আমাদের ওসবের দরকার নেই। তার চেয়ে বরং একটা চাকরির চেষ্টা কর।

ড্রয়িং রুম থেকে আব্বার গম্ভীর গলা শোনা গেল। নিশ্চয়ই চাচাকে বকাঝকা করছেন আব্বা।

আব্বা ঘানিম আল সাইয়েদ একজন সরকারি কর্মকর্তা। স্বাস্থ্য দফতরে কাজ করেন। ছোট ভাইয়ের কারণে তার চাকরির না জানি কোনো ক্ষতি হয় সেই আশঙ্কায় থাকেন তিনি।

তার শ্যালক মানে জাওয়াদের মামা আবদেল মুগিদও তাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

ও তাহলে মামা এ কথা বলার জন্যই গতকাল বাসায় এসেছিলেন। মামা নির্বিরোধী লোক, চান না ছোট ভাইয়ের কারণে তার ভগ্নিপতির কোনো ক্ষতি হোক।

সরকারি গোয়েন্দারা এখন চারদিকে হায়েনার মতো ঘোরাঘুরি করছে।

মামা কাল বলছিলেন অনেক কথা। তবে আসল কথা, জানা গেল রাতে, ছোট চাচার কাছে।

: খবর আছে, খবর আছে। কাছে এসে চুপি চুপি বলছিলেন তিনি।

: কী খবর!

: কেন শুনিসনি। তিউনিসিয়ার একনায়ক জয়নুল আবেদিন বেন আলী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, জনগণের জয় হয়েছে।

: তাই নাকি। এতো খুবই ভাল খবর।

: পত্রিকাতে এসব খবর পাবি না, পাবি ছিটেফোঁটা। নেটে যা, টুইটারে ঢোক, দেখবি কী কাণ্ড।

কম্পিউটারে গেম খেলে আর ভিডিও দেখেই তো সময় শেষ হয়ে যায়। নেট ঘাঁটবে টুইটার, ফেসবুক দেখবে কখন। তার ওপর মায়ের বকুনি।

না আজ এসব খবর নিতে হবে নেটে। মনে মনে ঠিক করলো জাওয়াদ। ড্রইং রুম থেকে আব্বার গলাই শুধু শোনা যাচ্ছে- আর কারো কথা নেই। আব্বার সামনে কেউ কিছু বলতে চায় না, সবাই চুপ করে শোনে। চাচাও এর বাইরে নন।

আম্মা মাঝে মাঝে ফোঁড়ন কাটেন।

তো লোকগুলো আজীবন বসে বসে মার খাবে? কোনো প্রতিবাদ করবে না? এটা এক প্রকার ছোট চাচার পক্ষ নেয়া বোঝালেও মা ঠিক তা নেননি- তিনি বিপক্ষ হয়েছেন আব্বার। আব্বার সব কথা, সব কাজ আম্মা মুখ বুজে সহ্য করতে চান না।

আম্মা প্রতিবাদ করলে আব্বা এক সময় ক্ষান্ত দেন।

আমার কথা আমি বললাম, যা ভাল বোঝ তোমরা করো।

এরপর টিভি সিরিয়াল বা খবরে মন দেন আব্বা। আর চায়ের কাপে ফুঁ। রাত ৯টায় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন চাচা ঘানিম আল ফাইয়াজ।

সঙ্গে প্রতিবেশী আবদেল মুনিম। তাহরির স্কোয়ারে কয়েক হাজার লোক সমাবেশ করেছে, মিছিল করেছে। তবে পুলিশের তাড়া খেয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। যে যার মতো ভেগে গেছে। শুধু কায়রো নয়, আলেকজান্দ্রিয়াসহ সব শহরেই বিক্ষোভ হয়েছে, মিছিল হয়েছে। মিসরবাসী জেগে উঠেছেন। একবারে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন ফাইয়াজ। তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। যেন একটা অসাধ্য সাধন করে এসেছেন।

: তোরা বলতে চাস মিছিল-মিটিং করেছিস। পুলিশ করতে দিল। আব্বার এখনো বিস্ময় কাটেনি।

: হ্যাঁ, ভাইয়া তাই। এটা অবিশ্বাস্য। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

: তোরা জড়ো হলি কিভাবে? খবর পেলি কোথায়? পুলিশ-গোয়েন্দা বসে থাকলো?

: তুমি আছ সাবেক আমলে। এখন সেই যুগ আর নেই। আমরা ইন্টারনেটে এসব খবর পেয়েছি। ফেসবুক, টুইটারের নাম শোননি?

: আমার কিন্তু ভাল মনে হচ্ছে না। আরো কঠোর হবে সরকারি বাহিনী, নির্যাতন, জেল-জুলুম বাড়বে- এই হবে আখেরে। আব্বার সাফ কথা।

: না ভাইয়া, না। এবার একটা কিছু হবে। বেন আলী ভেগেছে, মোবারককেও যেতে হবে। কাল ২৫ জানুয়ারি, দেখবে তাহরির স্কোয়ার ভরে যাবে প্রতিবাদী মানুষের ভিড়ে। কয় জনকে বন্দী করবে ওরা?

জাওয়াদ চুপ চাপ শুনে যাচ্ছিল। বলছিল না সে কিছুই। চাচার কথায় তার কিশোর মনও আশ্বস্ত হলো।

সত্যি সত্যি ২৫ জানুয়ারি কায়রোসহ বড় বড় সব শহরে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছে। দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত মিসরবাসী জেগে উঠেছেন। শুধু ইখওয়ান কর্মী-সমর্থক নয়, ছুটে আসছে হাজার হাজার মানুষ, সাধারণ মানুষ। তারাও পরিবর্তন চায়। চায় মোবারকের শাসনের অবসান। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে হতাহত কম হয়নি কিন্তু এর পরও তারা দমবার পত্র নয়।

দেখতে দেখতে আরো ক’টি দিন কেটে গেল। তাহরির স্কোয়ারসহ সমগ্র মিসরে সংঘর্ষ চলছেই।

মায়ের কড়া পাহারা ও চোখ রাঙানির ভয়ে ক’দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারলো না জাওয়াদ। কিন্তু তার মন পড়ে রয়েছে সেখানে।

চার.

তাহরির স্কোয়ারের ব্যস্ত গোলচত্বরটা পেরিয়ে একটু উত্তরেই ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম। মিসরীয় সভ্যতার সব চিত্র ও নিদর্শন ধারণ করে আছে এই জাদুঘর।

তার পাশে হোসনি মোবারকের দল ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এনডিপি সদর দফতর। একই পাশে সরকারি মোগাম্মা ভবন। এর লাগোয়া আরব লিগ ভবন ও নাইল হোটেল। এলাকাটি সদা ব্যস্ত- যেমন যান চলাচল তেমনি লোক সমাগম।

রোদ জলমলে দিন আজ। আস্তে আস্তে রোদের তেজ বাড়ছে। নাইল হোটেলের এক পাশে খান আল খলিল বাজার।

টুইটারে যোগাযোগ করে এই বাজারের সামনে একটি সমাবেশের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এর দায়িত্ব পড়েছে ঘানিম আল ফাইয়াজের ওপর। হঠাৎ করে সবাই সেখানে সমবেত হয়ে ঝটিকা মিছিল নিয়ে ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম এনডিপি ভবন ও নাইল হোটেলের সামনে গিয়ে কাসর আল আইনি স্ট্রিট হয়ে তাহরির স্কোয়ারে মিলিত হবে। আগুন ঝরা এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ছিল তারা।

তাহরির স্কোয়ারের উত্তর-পূর্ব প্লাজায় জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর মাকরামের ভাস্কর্য।

এটি এখনো এই বীরের মর্মগাথা প্রচার করছে। নেপোলিয়ানের বিজয় অভিযান প্রতিরোধ করে মিসরকে রক্ষা করেছিলেন ওমর মাকরাম। তাই এই বীরকে স্মরণে রেখেছেন মিসরবাসী।

পাশেই ওমর মাকরাম মসজিদ। এত লোকের ভিড় দেখে বীর ওমর মাকরামের ভাস্কর্যটাও যেন চকচক করে উঠেছে। বীর তো বীরত্বই দেখতে চায়, পরাজয় নয়। সেও আগুন ঝরা দিনের প্রত্যাশী। ওমর মাকরামের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা সে রকমই মনে হলো জাওয়াদের।

জরুরি কাজে মামার বাসায় যাওয়ার কথা বলে আজ বেরিয়ে পড়ছে সে, মায়ের কোনো বাধাই শোনেনি।

মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে গেছে তাহরির স্কোয়ার। তাহরির মানে স্বাধীনতা। মুক্তি আর গণতন্ত্রের জন্য এত মানুষের আকুলতা ছিল- তা আগে বুঝতে পারেননি কায়রোবাসী। মিছিলে মিছিলে, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর তাহরির স্কোয়ার। জনগণের আন্দোলনের মুখে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী আর আগের মতো মারমুখী নয়। তবুও প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রান্তে সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ ও রক্তপাত হচ্ছেই।

কালও ৩ জন শহীদ হয়েছেন। এ নিয়ে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। না না এতেও দমবার পাত্র নয় তারা। এবার মোবারককে বিদায় নিতেই হবে।

দুপুরে কড়া রোদের মধ্যেই বাতাসের একটা ঝাপ্টা নাকে-মুখে এসে লাগে জাওয়াদের। এর মধ্যে তার কয়েকজন সঙ্গী জুটেছে। সবাই কিশোর। হামিম, কাহলিল আর জারওয়ান। সবাই বাড়ি থেকে পালিয়ে ছুটে এসেছে তাহরিরে।

শুধু কিশোর কেন, নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুরাও যোগ দিচ্ছে এতে।

জাওয়াদ তার চাচার কথা ওঠাতেই জারওয়ান বললো, তার মামার দুঃখের কাহিনী। তার মামা আর বেঁচে নেই। মোবারকের পুলিশ বাহিনীর নির্যাতনে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়েছে।

এই খবরে মনটা ভারী হতে ওঠে জাওয়াদের। জানতে চায় কেন তাকে হত্যা করা হলো।

: তেমন কোনো কিছু নয়। বলতে শুরু করে জারওয়ান।

: মামা ছিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির আশা বাদ দিয়ে নিজেই একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছাত্রাবস্থায় ইখওয়ানের সমর্থক ছিলেন। একবার কী এক সামান্য অভিযোগে পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়। কয়েক বছর আটক থেকে অত্যাচার-নির্যাতনে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। দোষ স্বীকার করানোর শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি স্বীকার করেননি। তার এক কথা, আমি কোনো অন্যায় করিনি। ক্ষমা ভিক্ষা চাইব কেন?

: আফসোস! ছল ছল চোখে বলল কাহলিল।

: আর নয়, এসব হত্যা-নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়ার দিন এসে গেছে। জারওয়ানের বজ্রমুষ্টিতে দৃঢ়তা।

এ সময় উত্তর দিক থেকে একটা বড় মিছিল আসতে থাকে তাহরির অভিমুখে। জানা গেল, নাইল হোটেলের কাছে পুলিশের সাথে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়েছে- গুলিতে কয়েকজন হতাহত হয়েছে। হঠাৎ বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে জাওয়াদের। তার মামা ফাইয়াজের সে দিক থেকেই মিছিল নিয়ে তাহরিরে আসার কথা। টুইটারে সে রকমই নির্ধারিত ছিল। ভিড় ঠেলে বের হয়ে উত্তরমুখী পাগলের মতো দৌড়াতে থাকে জাওয়াদ। পেছনে পেছনে জারওয়ান ও কাহলিল। ঝড়োগতিতে পাশ দিয়ে একটি সেনা পিকআপ বেরিয়ে গেল। সেদিকে কারো ভ্রƒক্ষেপ নেই। কয়েক হাজার লোকের মিছিল তাহরির অভিমুখে এগিয়ে আসছে- তা থামানোর শক্তি পুলিশ বা সেনা পিকআপের নেই। তাই দ্রুত সেটা সরে পড়ছিল। আরেকটু এগোতেই জানা গেল, এনডিপি অফিসের সামনে মিছিলে গুলি চালিয়েছে মোবারকের দলের লোকেরা। আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটি হাসপাতালে। কেউ কেউ বলছেন, এখানে দু’জন শহীদ হয়েছেন, আহত অনেক।

খুঁজে খুঁজে সেই হাসপাতালে হাজির হলো তিন কিশোর। আহতদের এবং তাদের স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। সাদা কাপড়ে ঢাকা দু’টি নয়, তিনটি লাশ। একটি লাশের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরাতেই হিম হয়ে গেল জাওয়াদের হাত-পা। যা শঙ্কা করেছিল তা-ই। চাচা চাচা বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো জাওয়াদ। তার দুই সঙ্গীরও একই অবস্থা। চাচার লাশ জড়িয়ে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠলো জাওয়াদ।

কতক্ষণ এইভাবে ছিল সে জানে না। মামা এক সময় তাকে লাশের ওপর থেকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

দেখতে পেল তার আব্বা, আম্মা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, অশ্রুসজল। মা পাথর হয়ে গেছেন, আব্বার মুখে কোনো কথা নেই। মামার কোনো প্রবোধই মানতে পারছিল না জাওয়াদ। চোখের পানিতে আর চাচার জামা থেকে লেগে থাকা রক্তে তার নিজের জামাও লাল হয়ে গেছে। সেই রক্ত হাতে ছুঁয়ে মুঠি শক্ত করে জাওয়াদ মামার সাথে পথে নেমে পড়ে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না, দেশকে এক নায়কের হাত থেকে, জালেমের হাত থেকে মুক্ত করতেই হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ