আগুনঝরা ফাগুন

আগুনঝরা ফাগুন

প্রচ্ছদ রচনা ফেব্রুয়ারি ২০১২

মঈনুল হোসাইন..

ফুল ফুটবার দিন বসন্ত। বিবর্ণ প্রকৃতিতে জাগে নবীন জীবনের ঢেউ। বনে বনে ফুলে ফুলে খেলা করে রঙিন প্রজাপতি। শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে এখন প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচিপাতা। ধীরগতিতে চলা বাতাস জানান দিচ্ছে নতুন কিছুর। শীতে খোলসে ঢুকে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া এখন অলৌকিক স্পর্শে জেগে উঠেছে। পলাশ, শিমুলে লেগেছে আগুন রঙের খেলা।
এই যে আমরা বসন্ত ঋতুর কথা বলি এটা ফাল্গুনেরই সুবাদে উচ্চারিত হয়। এ মাসে গরম পোশাক ‘ছাড়ি ছাড়ি’ করেও শরীরে ধরে রাখতে হয়। তা না হলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আসলে ফাল্গুন একটা অতি স্বল্পকালীন নাতিশীতোষ্ণ মাস মাত্র। এতে শীত যায় না, গ্রীষ্মের তাপও স্পষ্ট হয় না। বলা হয়, কোকিলের ভাঙাগলা সুস্থ হয় এ মাসে। তার ডাক তীক্ষè হয়ে ওঠে।
আর ফাগুন এলেই মনে পড়ে যায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা। এটি আমাদের ভাষা শহীদদের তপ্তশোনিত্যক্ত মাস। আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা' প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জববার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত। শোক নয়, সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী মোকাবেলার দুর্বিনীত সাহস আর অপরিমেয় শক্তি নিয়ে। নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা। প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে উদার সড়কের বুকে। দেয়ালগাত্র থেকে লোহিত ধারার মোহনা শহীদ মিনার পর্যন্ত।
অবশ্য ফেব্রুয়ারি মাসের সাথেই এখন বিষয়টা বেশি জড়িয়ে গেছে। যে বাংলাভাষার জন্য ১৯৫২ সালে আন্দোলন হলো, তাকে সরিয়ে জায়গাটা দখল করে নিল ইংরেজি ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ। দিনটা কিন্তু ছিল ৮ ফাল্গুন। আর এখন তো ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে।
যা-ই হোক, সময়টা এলেই বিভিন্ন ফুলের সাথে আমরা পরিচিত হয়ে উঠি। আজ সেসব ফুলের মধ্য থেকেই কয়েকটির ব্যাপারে কিছুটা জানার সুযোগ পাবো।
এমনিতে এ সময়ের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। আবহাওয়াতে যে পরিবর্তনটা ঘটে, সেটাও কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। তবে সম্ভবত এ মাসে অনেক পুষ্পের উদ্যানে ফুল ফোটার একটা আবহাওয়া বিরাজ করে। এ জন্যই হয়তো ফাল্গুন কুসুমের মাস। পলাশ-শিমুলের ডালে ডালে রক্তিম উচ্ছলতা। বনের নিভৃত কোণে, মেঠোপথের ধারে কারও দেখার অপেক্ষা না করেই পাপড়ি মেলে আরও কত নাম না-জানা ফুল। কোকিলের কুহুতান আর মৃদুমন্দ বাতাসও মনে করিয়ে দেয় সে কথা। এ সময় মহান আল্লাহপাকের অপার সৃষ্টি মহিমায় দক্ষিণ গোলার্ধ পরিভ্রমণ শেষে সূর্য তার কক্ষপথে উত্তর-অভিমুখে ধাবিত হতে থাকে। আপনা হতেই প্রকৃতিতে লাগে পরিবর্তনের হাওয়া। উত্তরী বায়ুর যাত্রাপথ রুদ্ধ হয়ে দখিনা মৃদুমন্দ সমীরণ লহর তোলে। তরুলতা পুরনো পাতা ঝেড়ে ফেলে মুকুলিত হয়। পত্রপল্লবে সুশোভিত হয় সবুজ উদ্যান। আগেই অবশ্য আমমঞ্জরি কোষগুলো পরিণত হতে থাকে। কাঁঠাল গাছের শাখায় শাখায় ধরে মুছি (মুকুল)। লিচু গাছগুলোও ফলবতী হয়ে ওঠে। কাঞ্চন, পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদুগন্ধের ছোট ছোট বরুণ ফুল ফোটে। এছাড়া গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়াসহ হাজারো নামের বর্ণালি ফুল তো আছেই।
শিমুল
লাল টকটকে ফুল শিমুল। যেন ভাষাশহীদদের বুকের রক্তে রঞ্জিত। বীজ থেকে প্রাকৃতিকভাবে চারা গজানোর ৯-১০ বছরের মধ্যে শিমুলগাছে ফুল ফোটে। দৃষ্টিনন্দন শিমুল ফুলের টকটকে লাল পাপড়িগুলো মানুষের নজর না কেড়ে পারে না। শিমুলগাছ ৬৫ থেকে ৭৫ হাত লম্বা ও ৬-৭ হাত মোটা বা তার চেয়েও বেশি আকারের হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে শিমুলগাছ শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এর শাখারা কাণ্ডে এলোমেলো বিক্ষিপ্ত নয়, স্থানে স্থানে ঘূর্ণিত ভঙ্গি নিলেও সুবিন্যস্তভাবেই বাড়ে। শিমুল উপকারী হওয়া ছাড়াও সুশ্রী এবং সুন্দর। উঠতি শাখাগুলো ঊধ্বর্মুখী হলেও পরিণত অবস্থায় তারা ভূমুখী। অল্পবয়সী শিমুলগাছের গায়ে কাঁটা থাকে। বয়স্ক গাছ মসৃণ, গোড়ায় বড় বড় চ্যাপ্টা খাঁজ থাকে।
শিমুলপুষ্প বৃহৎ, স্থূল এবং সাধারণত রক্তবর্ণ। এত বড় ফুলের এমন উদার প্রাচুর্য এ দেশের অন্য বৃক্ষে অনুপস্থিত। পুষ্পিত শিমুল যেন নিপুণ প্রকৃতির স্বহস্তে রচিত বৃহত্তম পুষ্পস্তবকটি।
কয়েক প্রজাতির শিমুল গাছ আছে। যেমন- সোনারি শিমুল। অন্যান্য স্থানীয় নাম Buttercup tree, Yellow slik cotton tree, Golden silk cotton tree. বৈজ্ঞানিক নাম Cochlospermum religiosum.  শ্বেত শিমুল। স্থানীয় নাম Kapok, Ceiba, White Silk-Cotton Tree, Safed semal, Kutashalmali.
বৈজ্ঞানিক নাম Ceiba pentandra. এবং আমাদের পরিচিত শিমুল। স্থানীয় নাম  Silk Cotton Tree, Kapok Tree, Dumboil.
বৈজ্ঞানিক নাম Bombax ceiba. অন্যনান প্রজাতির মধ্যে আছে  Salmalia malabarica.
এই সময় শিমুল গাছের পাতাঝরা ডালে অসংখ্য ফুল ফোটে। কাক, শালিক, ফিঙে সেখানে ভিড় করে। তাদের মারামারি আর চেঁচামেচিতে আশপাশ পরিবেশ মুখরিত হয়। ফুল ঝরে গিয়ে যে ফল হয় তাতে ঠাসা থাকে তুলা যা শিমুলতুলা নামে পরিচিত। সাধারণ একটি গাছ থেকে ১০-১৫ কেজি তুলা পাওয়া যায়। শিমুল কাঠ হালকা ও নরম, দেশলাইয়ের বাক্স ও কাঠি বানাতে ব্যবহৃত হয়।

পলাশ
ফুলটা দেখতে খুব সুন্দর। প্রকৃতিতে পলাশ ফুলের এই শোভাবর্ধন বসন্ত ঋতুর আগমনের ইঙ্গিত বহন করে। বসন্তের আরেক সংবাদবাহক এই পলাশ। মূলত শীতে যখন গাছগুলো তাদের পাতা হারিয়ে দৃষ্টিকটুতায় আক্রান্ত হয়, তখনই প্রকৃতি তার আপন লীলায় মত্ত হয়ে দৃষ্টিকটু গাছে উজ্জ্বল লাল বা গাঢ় কমলা রঙের এই পলাশ ফুল ফুটিয়ে পলাশগাছের কদর বাড়িয়ে দেয়। সবুজের সমারোহে লালের কোলাহল। উজ্জ্বল বর্ণের জন্য অনেক দূর থেকেই আমাদের নজর কাড়ে। গাঢ় কমলা রঙের ফুলগুলো বেশ লম্বা, সামনে একটি চওড়া পাপড়ি, পেছনে কয়েকটি একত্রে বাঁকানো, পাখির ঠোঁটের মতো। মৌগ্রন্থি আছে বলেই পাখিরা মধুর লোভে ভিড় জমায়। এর সংস্কৃত নামটিও সুন্দর, কিংশুক। শহরাঞ্চলে এ ফুল অপ্রচুর হলেও গ্রামেগঞ্জে প্রচুরই বলতে হবে। ‘ফ্লেইম অব দ্য ফরেস্ট’ বা ‘অরণ্যের অগ্নিশিখা’ নামে অভিহিত পলাশ দূর থেকেই দ্রষ্টব্য, বিশেষত গ্রামে- ঘন সবুজের বুকে কমলা-লাল হয়ে ফুটে থাকে বলে।
পলাশের বিচি থেকে দেশীয় ভেষজ ঔষধ তৈরি করা হয়। একসময় পলাশ গাছের শিকড় দিয়ে মজবুত দড়ি তৈরি করা হতো। সেই সাথে পলাশের পাতা দিয়ে তৈরি হতো থালা। পলাশের আরও কিছু প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়, যেমন Butea frondosa, Erythrina monosperma, Plaso monosperma। এরকমই আরেক প্রকার পলাশ দেখা যায় যার বাংলা নাম রুদ্রপলাশ। এটি আমাদের পরিচিত পলাশ ফুল থেকে একটু ভিন্ন।
কৃষ্ণচূড়া
কৃষ্ণচূড়া ফুলের রঙ উজ্জ্বল লাল। বলা যায় বাংলাদেশে ফাগুনের প্রধান ফুল। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়ি যুক্ত। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মত লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট।
কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা একে অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন করে তোলে। কৃষ্ণচূড়া মাদাগাস্কারের শুষ্ক পত্রঝরা বৃক্ষের জঙ্গলেও পাওয়া যায়। যদিও জঙ্গলে এটি বিলুপ্ত প্রায়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি জন্মানো সম্ভব হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধক গুণ ছাড়াও এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় কম (সর্বোচ্চ ১২ মিটার) হলেও শাখা-পল্লবে এটি বেশি অঞ্চল ব্যাপী ছড়ায়। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ। ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, আফ্রিকা, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে এটি জন্মে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণচূড়া শুধুমাত্র দক্ষিণ ফ্লোরিডা, দক্ষিণ পশ্চিম ফ্লোরিডা, টেক্সাসের রিও গ্রান্ড উপত্যকায় পাওয়া যায়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় বিভিন্ন-
দক্ষিণ ফ্লোরিডা - জুন
ক্যারাবিয়ান - মে থেকে সেপ্টেম্বর
ভারত-এপ্রিল থেকে জুন
অস্ট্রেলিয়া-ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি
আরব আমিরাত-সেপ্টেম্বর
অঞ্জন
ফাগুনের মন মাতানো ফুলের মধ্যে এটির বৈশিষ্ট্যই আলাদা। খর্বাকৃতির বৃক্ষে (৮-১৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে) বছরে একবার বা দু’বার চমৎকার নীল রঙের ফুল ফোটে। অঞ্জনের বৈজ্ঞানিক নাম Memecylon umbellatum. এটি Memecylaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য নামের মধ্যে Delek air tree, Ironwood tree, Kaya, Mandi, Lakhonde প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অন্য প্রজাতি  Memecylon edule।
অঞ্জনের পাতা গনোরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায়ও এর ব্যবহার হয়ে থাকে।

মাধবী
কত কত তার নাম! বাসন্তি, পুণ্ড্রক, মণ্ডক, অতিমুক্ত, বিমুক্ত ও ভ্রমরোৎসব। এসব তার মনের ভাব প্রকাশক নাম। বাসন্তী বা হলদে রঙে রঞ্জিত বলে সে বাসন্তী, আবার বসন্তকালে ফোটে সেই ভাবপ্রকাশক। পুণ্ড্রদেশে জন্ম বলে পুণ্ড্রক। সম্পূর্ণ বিকশিত হয় বলে অতিমুক্ত। বন্ধনহীন বা নানা রোগের বন্ধন মোচন করে বলে বিমুক্ত। তার ফুল ফুটলে দলে দলে ভ্রমরেরা মধু সংগ্রহে আসে বলে ভ্রমরোৎসব নাম। আবার সমার্থবাচক নাম হলো- চন্দ্রবল্লী (চন্দ্রলতা), সুগন্ধা, ভৃঙ্গপ্রিয়া (ভ্রমরপ্রিয়া), ভদ্রলতা। আবার সুবসন্ত, পরাশ্রয়- এসবও মাধবীর নাম। মাধবী পিত্ত, কাশ, ব্রণ, দাহ,  তৃষ্ণা ও ত্রিদোষ নিবারক। ত্রিদোষ অর্থ বাত, পিত্ত ও কফ নিবারণ করে। ঔষধি গুণের জন্যও সে সবার কাম্য। মজার ব্যাপার হলো পুণ্ড্রক নামটি। এটি তার জন্মস্থান বা বাসস্থান বর্ণনাদ্যোতক। পুণ্ড্র বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক সময় মাধবীর প্রাচুর্য ছিল।
মাধবীর লতা লক লক করে বেড়ে চলেই। সকালে লম্বা লম্বা ডালের পর্বের মাথায় পাতা ও প্রায় তিন সেন্টিমিটার লম্বা ফুল ফোটে। ফুলের কোমল রোমশ পাপড়ির স্পর্শে প্রাণ নেচে ওঠে। এখন অবশ্য মাধবীর স্পর্শ পাওয়াটা দুর্লভ। কারণ মাধবীরা হারিয়ে যাচ্ছে। এখন সৌখিন ও সোন্দর্যপিপাসুরা ছাড়া মাধবীকে কেউ মনে করে না। মাধবীর দুধ-সাদা পেলব পাপড়িতে আছে হলুদ রঙের জ্বলন্ত বসন্ত-উদ্ভাস। তবে এদের প্রস্ফুটন স্বল্পকালীন। মাত্র কয়েকদিনেই এর সমস্ত উচ্ছ্বাস শেষ হয়ে যায়।
কাঞ্চন
কাঞ্চন ফুলের নাম করলে বসন্তের তথা ফাগুনের রক্তিম ফুলটির কথাই সচরাচর মনে পড়ে। তাকে নিয়ে কবিতাও আছে- “ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল”। গাঢ় মেজেন্টা, হালকা বেগুনি এবং সাদা- তিনটি প্রজাতি সংবলিত কাঞ্চন ফুলের গাছটির পাতা শীতের শেষে ঝরে যায়। তবে ফাল্গুনেই নিষ্পত্র শাখাজুড়ে প্লাবন আসে ঘন মেজেন্টা আর দুধ-সাদা কাঞ্চন ফুলের।
আমাদের দেশে সাধারণত তিন ধরনের কাঞ্চন চোখে পড়ে- দেবকাঞ্চন, রক্তকাঞ্চন ও শ্বেতকাঞ্চন। দেবকাঞ্চন অবশ্য বসন্তের ফুল নয়, হেমন্তের। বর্ণেও আকাশ-পাতাল তফাৎ। এর বর্ণ শ্বেত-শুভ্র। বৈজ্ঞানিক নাম Bauhinia purpurea। দেবকাঞ্চন মাঝারি আকারের গাছ। উচ্চতা গড়পরতা ৮-১০ মিটার। পাতা একটু বড়, গাছটিও। ফুল ছয় থেকে আট সেন্টিমিটার চওড়া, পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি। ঠিক গুচ্ছ আকারে নয়, তবে একটি ডাঁটায় কয়েকটি করে ফুল ফোটে। ফুলে মিষ্টি সৌরভ। সেই সৌরভে মুগ্ধ হয়ে কীটপতঙ্গ উড়ে আসে। তাতেই পরাগায়ণ। হেমন্তের মাঝ নাগাদ শাখা ফুলে ভরে ওঠে। এ সময় পাতাও থাকে অল্প। তখন খুবই চমৎকার দেখায় গাছগুলো। শীতের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফুল থাকে। ফুল ফোটা শেষ হলে শিমের মতো আকৃতির ফল ধরে। ভেতরে বীজ থাকে ১২ থেকে ১৬টি। বীজ থেকে সহজেই এর চারা উৎপন্ন করা যায়। হিমালয়ের পাদদেশ ও আসাম দেবকাঞ্চনের আদি নিবাস। বাংলাদেশে এর বংশবিস্তার বহুকাল থেকে।
শ্বেতকাঞ্চনের অন্য নাম কানারাজ। এটি সাধারণত বাগান ও কোনো স্থাপত্যের শোভাবর্ধনের জন্য বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অন্যান্য নামের মধ্যে White Orchid, Mountain-ebony
উল্লেখযোগ্য।
বসন্তের কাঞ্চনের নাম রক্তকাঞ্চন। ফোটে বসন্তের শুরুতে। আর নাম থেকেই অনুমান করা যায় এর রঙ কেমন। শীতের শেষে রক্তকাঞ্চনের পাতা ঝরে যায়। এর পাতাগুলোও চমৎকার। ডগার দিকটি দ্বিধাবিভক্ত। পাতাবিহীন বা অল্পকতক পাতাকে ছাপিয়ে শাখাগুলো ভরে ওঠে গাঢ় বেগুনি রঙের ফুলে ফুলে। ফোটেও প্রচুর। এর আদিনিবাস ধরা হয় দক্ষিণ এশিয়া।

বরুণ
ফাগুনে সবুজ পাতার কোলে অজস্র সাদা বরুণ ফুল সবার দৃষ্টি কেড়ে নেবেই। বরুণকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহে বলে বন্যা। আর হাওরাঞ্চলে এটি আড়িবিষুসংক্রান্তি নামে পরিচিত।
গাঁদা
গাঁদা Compositae পরিবারের একটি সদস্য। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রঙের দেখা যায়। এই ফুল সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ ও কমলা হলুদ হয়ে থাকে। সাধারণত এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে এটি বসন্তে দেখা যায়। বাগানের শোভাবর্ধন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও গৃহসজ্জায় এর ব্যাপক ব্যবহার ফুলটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। গাঁদা বাংলাদেশে যশোরের গদখালী, ঝিকরগাছা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর জেলার সদর উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী ও পটিয়া, ঢাকা জেলার সাভার এলাকায় অধিক হারে চাষ হয়।
বাংলাদেশে প্রধানত দুই ধরনের গাঁদা পাওয়া যায়। যথা- আফ্রিকান গাঁদা। এই শ্রেণীর গাঁদা হলুদ রঙের, গাছের আকৃতি বেশ বড়। উল্লেখযোগ্য জাতসমূহ হল ইনকা, গিনি গোল্ড, ইয়েলা সুপ্রিম, গোল্ডস্মিথ, ম্যান ইন দি মুন ইত্যাদি। অন্যটি ফরাসি গাঁদা। এই শ্রেণীর গাঁদা কমলা হলুদ হয়ে থাকে। এ জন্য এদের রক্তগাঁদাও বলা হয়। এর গাছ ক্ষুদ্রাকৃতির। পাপড়ির গোড়ায় কালো ছোপ থাকে। উল্লেখযোগ্য জাতসমূহ হল মেরিয়েটা, হারমনি, লিজন অব অনার ইত্যাদি। এছাড়াও সাদা গাঁদা, জাম্বো গাঁদা, হাইব্রিড এবং রক্ত বা চাইনিজ গাঁদার চাষ হয়ে থাকে।

গ্লিরিসিডিয়া
এটি আমাদের দেশী না হলেও আমাদের দেশে এর অভিযোজন এতই চমৎকার যে এখন একে আপন করে নিতেই হয়েছে। ফাগুন আসার আগেই এটি প্রাচুর্যের ঝাঁপি উন্মুক্ত করে দেয়। গাছটি ১৫-২০ মিটার উঁচু, ডালপালা ছড়ানো-ছিটানো ধরনের। পৌষের শেষ দিকে পাতা ঝরিয়ে নির্জীব হয়ে ওঠে। পরিপূর্ণ প্রস্ফুটিত গ্লিরিসিডিয়া যেন একটি বিশাল পুষ্পস্তবক। গড়ন শিমের ফুলের মতো, ঈষৎ সুগন্ধি।
উদাল
এ ফুলটি বুনো ধরনের। এ কারণে শহুরে উদ্যানে খুব একটা দেখা যায় না। তবে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক গার্ডেনে কয়েকটি গাছ আছে। লম্বা ও ঝুলন্ত ডাঁটায় অনেক ফুল থাকে, চওড়া, হলুদ রঙের, ভেতরটা বেগুনি। চটজলদি ফুলগুলো ঝরে পড়ার পর রোমশ ফলগুলো আসতে শুরু করে। গাঢ় লাল রঙের পাকা ফলগুলো যেন আরেক বিস্ময়।

ডালিয়া
বাংলায় নাম ডালিয়া। বৈজ্ঞানিক নাম Dahlia variabilis এবং এটি Asteraceae পরিবারের অন্তর্গত। ৩৬ প্রজাতির ডালিয়া আছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই আমাদের দেশে দেখা যায়। এর আদি নিবাস ধরা হয় মেক্সিকো, সেন্ট্রাল আমেরিকা ও কলম্বিয়াকে। নানান রঙ আর আকারের এই ফুল সাধারণত বাগানের শোভা বাড়ানোর কাজেই ব্যবহৃত হয়।
মর্যাদা, সুরুচিপূর্ণতা ইত্যাদি মনোভাব প্রকাশের জন্য ডালিয়া ফুল প্রচলিত। মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য এ ফুলকে ব্যবহার করা যায়। ইউরোপের বিজ্ঞানীরা ডালিয়াকে খাবারের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন ১৮৪০ সালে যখন রোগের কারণে ফ্রেন্স পটেটো শস্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মেক্সিকোর জাতীয় ফুলের মর্যাদায় থাকা ডালিয়ার বিশ্বজয়ের যাত্রা খুব মসৃণ ছিল না। মূলত সতেরশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই ডালিয়া এর সৌন্দর্য দিয়ে বিশ্ব যাত্রা শুরু করে। বীজ কিংবা শিকড় উভয় ভাবেই এর বংশবিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়।
গোলাপ
গোলাপ এক প্রকারের গুল্ম জাতীয় Rosaceae পরিবারের Rosa গোত্রের কাঁটাযুক্ত কাণ্ডবিশিষ্ট গাছের ফুল। এর পাতার কিনারাতেও ক্ষুদ্র কাঁটা রয়েছে। গোলাপের আদি নিবাস এশিয়া মহাদেশে। অল্প কিছু প্রজাতির আদি বাস ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা মহাদেশে। ফুলের রানী গোলাপ সৌন্দর্য ও সুবাসের জন্য সারাবিশ্বে পরিচিত। ফুলের জগতে বর্ণে-গন্ধে-আভিজাত্যে এর সমাদরই সবচেয়ে বেশি।
গোলাপের আছে অসংখ্য জাত। পৃথিবীতে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ প্রজাতির বিভিন্ন বর্ণের গোলাপ ফুল আছে। এই সমস্ত প্রজাতির মধ্যে আছে বিভিন্ন উপ-প্রজাতি। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫০টি আলাদা আলাদা গোলাপের অস্তিত্ব রয়েছে পৃথিবীজুড়ে। এর কোনোটা বুনো, ছোট ছোট প্রচুর ফুল ফোটে। কোনোটার ফুল অনেক বড়। এগুলো হাইব্রিড ‘ট্রি’ শ্রেণীর। কোনোটার গাছ লতানো, কোনোটার ঝোপালো। গোলাপি, গাঢ় গোলাপি, লাল, মেরুন, খয়েরি, ঘিয়া, হলুদ, সাদা, দুই রঙা, মিশ্রবর্ণ অনেক প্রকারের গোলাপ আছে।
লাল গোলাপ ভালোবাসা, স্মৃতিচিহ্ন, গভীর আবেগের প্রতীক। অন্য দিকে, সাদা গোলাপ পবিত্রতা, গোলাপি গোলাপ সুখ, হলুদ গোলাপ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে সুপরিচিত।

মাদার
শিমুল ও পলাশের চেয়ে মাদার ফুলের কদর একটু কম হলেও এর জৌলুস কম নয়। এর গাছ কাঁটাযুক্ত হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Erythrina variegeta বা Erythrina orientalis। বইয়ের ভাষায় এর নাম পারিজাত আর আঞ্চলিক বা স্থানভেদে এর নাম মাদার, মান্দর, মন্দার, পালতে মান্দার, রক্তমান্দার ইত্যাদি।
পুষ্পমঞ্জরিতে অনেকগুলো ফুল থাকে। ফুল শিমফুলের মতো, ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, গাঢ় লাল।
এর গাছ মাঝারি আকারের। গাছ সাধারণত ১৫ মিটারের মতো উঁচু হতে দেখা যায়। গাছের গায়ে কালো কালো গোটা-গোটা কাঁটা থাকে। গোড়ার দিকের কাঁটাগুলো গাছ বড় হলে ঝরে যেতে দেখা যায় অনেক সময়। বীজ থেকে সহজেই চারা জন্মে। ডাল কেটে লাগালেও বাঁচে। অবহেলায় বেড়ে ওঠা এই গাছটি গ্রামাঞ্চলে আজো যত্রতত্র চোখে পড়ে।

পদ্ম
পদ্ম ফুল বড় পিংক বা সাদা পাপড়িযুক্ত। বাংলায় এর অন্য নাম কমল। পুকুর বা বিলের মাঝে যখন পাপড়ি মেলে ফুটে থাকে, তখন দেখতে অপূর্ব লাগে। অনেকগুলো নাম আছে এর। যেমন- শতদল, উৎপল, মৃণাল, পঙ্কজ, অব্জ, অম্বুজ, নীরজ, সরোজ, সরসিজ, সররুহ, নলিনী, অরবিন্দ, রাজীব, ইন্দিরা, কুমুদ, তামরস ইত্যাদি। পাপড়িগুলো ঝরে গেলে শুধু একটি বীজাধার থাকে, যার উপরিভাগ সমতল, কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট, অনেকটা মৌচাকের মতো দেখতে। প্রতিটি কক্ষে একটি করে বীজ থাকে। অনেকে এই বীজ খেয়ে থাকে। ভারতের জাতীয় ফুল পদ্ম।

গোলাপজাম
এটি দিয়েই আজকের মতো শেষ করতে চাই। মাঘের শীত উপেক্ষা করেই এরা ফুটতে শুরু করে। ফুল দেখতে অনেকটা জামরুলের ফুলের মতোই। দেখতে ভারী সুন্দর। সুতোর মতো ধূসর সাদা রঙের অসংখ্য পাপড়ি চারপাশে ঘন থাকে। অনেকটা ব্রাশের মতো। একই সময়ে ফুল ও ফল ধরে। ফুলটির চিরসবুজ গাছটি মাঝারি উচ্চতার। দেখতে অনেকটা ঝোপাল ধরনের।

বসন্ত বা ফাল্গুন আমাদের কাছে শুধু ফুল বা প্রাণের উৎসবের নামই নয়, ফাগুনের আগুনঝরা, রক্তলাল বসন্ত, এত আলো, হাসি, গান, সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি বিষাদের নাগিনী যেন সমান্তরালভাবে আমাদের চেতনায় প্রবাহিত। আমাদের কাছে ফাগুন আসে রক্তস্নাত ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে। তাই বসন্তের  তথা ফাগুনের আবেদন আমাদের হৃদয়ের গভীরে। চেতনার মর্মমূলে। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, মাদারসহ অসংখ্য ফুলের পাপড়িতে ভরে আসে আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ভাইটির হঠাৎ ছলকে দেয়া রক্তের মিশ্রণ। জানিয়ে দিতে হাজির হয় অধিকারকে আদায় করে নেয়ার শপথের। পাশাপাশি ওইসব ফুলের সৌন্দর্য ও বর্ণ-গন্ধ আমাদেরকে বিমোহিত করে, আপন বুলিকে বুকের গভীরে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রেরণা জোগায়। প্রেষণা দেয় দেশকে ভালোবাসার, দেশের কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ