আত্মত্যাগ
গল্প ডিসেম্বর ২০১০
এইচ এম মুনীর আল হাদীআজ জুমাবার। গাঁয়ের মসজিদে মধুর সুরে ধ্বনিত হচ্ছে জুমার আজান। আহ কী মায়াবী সুর! আমজাদ সাহেব ওজু গোসল সেরে মসজিদের দিকে রওনা দিলেন। সঙ্গে একমাত্র আদরের ছেলে নাঈমও আছে।জুমার নামাজের খুতবায় ইমাম সাহেব কোরবানির মাহাত্ম্য সম্পর্কে আলোচনা করলেন। নাঈমের পিতা আমজাদ সাহেব মনে মনে স্থির করলেন, বাড়ির পোষা নাঈমের আদরের লাল গরুটা এবার কোরবানি করবেন।আমজাদ সাহেব বাড়ি ফিরে নাঈমের মা নাজমা বেগমের কাছে তাঁর মনের কথাটা ব্যক্ত করলেন। নাজমা বেগম জবাবে বললেন, কোরবানি করবে ভালো কথা কিন্তু নাঈমের এত আদরের লাল গরুটা! তুমি বরং হাট থেকে একটা গরু কিনে নিয়ে এসো। কেননা নাঈম শুনলে তার এ বন্ধুসুলভ গরুকে কোরবানি করতে দিতে চাইবে না।তোমারও কি কম আদরের? তুমিও কি মন থেকে কম ভালোবাস? আর তুমিও কি চাও গরুটাকে কোরবানি করি? চাও না! অনেকদিন যাবৎ গরুটা আমাদের সংসারে লালিত-পালিত হচ্ছে, এর প্রতি কি আমারকোন প্রকার মহব্বত পয়দা হয়নি? বেশ হয়েছে। শোন নাজমা নিজের অধিক পছন্দনীয় জিনিসটাকেই কোরবানি করতে হয়। কথাগুলো বললেন আমজাদ সাহেব।আচ্ছা দেখ নাঈমকে রাজি করাতে পার কি না। যেহেতু ওর আদরের জিনিস তাই ওকেও অবগত করা দরকার।আমজাদ সাহেব ছেলেকে ডেকে তাঁর ইচ্ছার কথা তাকে বললেন। কিন্তু ছেলেকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছেন না। তার বক্তব্যÑ সেই ছোট থেকে গরুটার সাথে খেলা করে। স্কুল থেকে ফিরে ঘাস-খড়-পানি খেতে দেয়। বন্ধুর মত মনে করে গরুকে। সুতরাং সেটাকে কিছুতেই কোরবানি করা যাবে না। সে বাবাকে বলল, তুমি বরং হাট থেকে একটা গরু কিনে আন। আমজাদ সাহেব নিরুপায় হয়ে অগত্যা গরু কেনারই সিদ্ধান্ত নিলেন। পরদিনই তিনি হাট থেকে একটি নাদুস-নুদুস গরু কিনে আনলেন।আর মাত্র মাঝে তিন দিন বাকি কোরবানির ঈদের। আজই নাঈমদের স্কুল ঈদের ছুটি হয়ে যাবে।ইতোমধ্যে স্কুল পিয়ন শফিকুল ঘোষণাও করে গেলেন। দশ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সবার মনেই খুশির ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এবার ঈদে খুব মজা হবে! আনন্দ করবে! উল্লাস করবে! ইত্যাদি ইত্যাদি।শ্রেণী শিক্ষক গোলাম কবির স্যার সবার উদ্দেশে বলতে লাগলেন, তোমরা মন দিয়ে শোন! বছরে মুসলমানদের ঘরে দু’টি খুশির দিন আসে। আর তা হলো একটি পবিত্র রমজানের রোজার পর আসে, যাকে আমরা ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ বলে থাকি। আর অন্যটি হলো জিলহজ মাসের দশ তারিখ যা ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। এই কোরবানির পেছনে একটা ঘটনা আছে তোমরা তা জানো?Ñ না স্যার! আপনি আমাদেরকে ঘটনাটা শোনান। Ñ শুনবে? তাহলে প্রথমে কোরবানি কাকে বলে শোন। কোরবানি শব্দটা আরবি কুরবান বা কুরবানুন থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ ত্যাগ, আত্মদান ইত্যাদি। আর পরিভাষায় মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে প্রিয় বস্তুকে (প্রাণীকে) আল্লাহর নামে জবেহ করে তা নির্দিষ্ট খাতে বণ্টন করার নামই হলো কোরবানি।কোরবানির প্রথা প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রচলিত ছিল। তবে তা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। আর বর্তমানে আমরা যে প্রক্রিয়ায় কোরবানি করে থাকি তা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ) এর কোরবানির অনুরূপ। মূলত তাঁদের সেই আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত যুগে যুগে স্মরণীয় করে রাখতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উম্মতে মুহাম্মদীর সামর্থ্যবানদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব করেছেন।Ñ নাঈম বলল, স্যার কী সেই ঘটনা?Ñ শোন তাহলে। মহান আল্লাহ হজরত ইবরাহিম (আ) কে অনেক অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছেন। আর তিনিও তাতে পাস করেছেন ফার্স্ট ডিভিশনে। তেমনি একটি পরীক্ষা হচ্ছে আল্লাহ পাক হজরত ইবরাহিম (আ) কে বৃদ্ধ বয়সে একটি পুত্রসন্তান দান করলেন। তাঁকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। পুত্রটি তোমাদের বয়সী হলে একদিন আল্লাহ তাঁকে স্বপ্ন দেখালেনÑ “হে ইবরাহিম! তুমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি কর।” নবীদের স্বপ্ন তো সত্য। অতএব তিনি কোরবানি করতে প্রস্তুত। তিনি ভেবে দেখলেন পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর একমাত্র কলিজার টুকরা, নয়নের পুতলি শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ)। কোরবানির আগে তাই তিনি ছেলেকে অবহিত করতে মনস্থির করলেন। কেননা তাঁর অভিব্যক্তি জানা দরকার।আশ্চর্যের বিষয় শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ) ঠিক তোমাদের বয়সী কিশোর বালক। তিনি এ কথা শোনা মাত্র কোনো দ্বিমত বা দ্বিধাবোধ নয়, একবাক্যে বলে উঠলেন আমার আল্লাহ যদি এতে খুশি হন তাহলে এক্ষুনি আমাকে কোরবানি করুন। পিতা ইবরাহিম (আ) নিজের চোখ বেঁধে পুত্রকে কোরবানি করতে ছুরি চালিয়ে দিলেন। কোরবানি হয়েও গেল।চোখ খুলে দেখলেন একি দৃশ্য! একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে পড়ে আছে আর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে শিশুপুত্র ইসমাঈল। আল্লাহ পাক অহির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন তোমার কোরবানি কবুল হয়েছে। এটা ছিল তোমার পরীক্ষাস্বরূপ। সেই থেকে আজ অবধি মুসলিম জাতির ওপর জিলহজের ১০ তারিখ পশু কোরবানি করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।ঠিক শিশুপুত্র ইসমাঈল থেকে তোমাদেরও শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তিনি নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত আর তোমরা নিজের প্রিয় পশু কোরবানি দিয়ে নিজের মনের পশুত্বকে দূর করবে না!টিং টিং টিং। স্কুল ছুটি হয়ে গেল।নাঈম বাড়ির দিকে ফিরছে আর মনে মনে ভাবছে প্রিয় জিনিস ছাড়া যদি কোরবানিই না হয় তাহলে আমি আমার আদরের লাল গরুটাই কোরবানি করবো। কিন্তু বাড়ি ফিরে কাউকে কিছুই বললো না।ঈদের দিন খুব সকালে নাঈম তার বাবার সাথে হাট থেকে কেনা গরু এবং তার পোষা গরু দুটোকেই উত্তমরূপে গোসল করালো। নিজেরা গোসল করে উত্তম পোশাক পরে ঈদের নামাজে গেল। নামাজ শেষে ইমাম সাহেবকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। গরু কোরবানি করার জন্য আনতে বলায় নাঈম তার আদরের পোষা গরুটাকে নিয়ে এলো। আমজাদ সাহেব বললেন, কী করছো, এটাতো তোমার আদরের পোষা গরু!Ñ হ্যাঁ বাবা! এটা আমার আদরের! অতি আদরের! আর তাই আমি এটাকে আল্লাহর নামে কোরবানি করবো। কেননা আল্লাহর কাছে রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছে না তাকওয়া ছাড়া। ইমাম সাহেব বললেন, ঠিক বলেছো বাবা নাঈম।নাঈম নিজে সাথে থেকে গরু কোরবানি করলো। নিজেদের খাবার জন্য অল্প কিছু রেখে বাকি গোশত নিজের হাতে আত্মীয়স্বজন ও গরিব মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিল।বাবা-মা খুশি হয়ে বললেন, আমাদের ইসমাঈল আল্লাহকে সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজ প্রিয় প্রাণী কোরবানির মাধ্যমে করলো ‘আত্মত্যাগ’
আরও পড়ুন...