আব্বুর জন্য প্রতীক্ষা

আব্বুর জন্য প্রতীক্ষা

গল্প আগস্ট ২০১২

হারুন ইবনে শাহাদাত..

‘আপু, আব্বু আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে, কী মজা।’ ফাতেমা খুশিতে লাফাতে লাফাতে জান্নাতের কাছে যায়। জান্নাত ওর মায়ের কাছে বসে হোমওয়ার্ক করছিল। সে ছোট বোনের দিকে চোখ তুলে তাকায়। বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে, এ উৎসাহে আবারও ফাতেমা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘আপুমণি আব্বু আমার জন্য চকলেট আনবে, বিস্কুট আনবে...’
জান্নাত বলে, আমাকে দেবে তো?
‘হ্যাঁ, আমি আর তুমি মজা করে খাবো।’
জান্নাত আর ফাতেমা জুলফিকার সাহেবের দুই মেয়ে। ফাতেমা কেজি টুয়ে পড়ে। জান্নাতের এখনো স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। জুলফিকার সাহেব একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন এক্সিকিউটিভ। তার স্ত্রীও কর্মজীবী। তিনি একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। জান্নাত আর ফাতেমাকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরতে জুলফিকার সাহেবের প্রায়ই রাত হয়। জান্নাত আর ফাতেমা বাবার জন্য অপেক্ষা করে। বাবা না এলে ওদের ঘুম আসে না। সারাদিনের কত কথা, কত গল্প জমিয়ে রাখে ওদের ছোট বুকে! দোয়েল পাখিটা কয়বার ওদের বারান্দায় এসে ছোট ফুল গাছটার ডালে বসে নেচেছে। জান্নাত আপু তার বই থেকে কী কী মজার মজার গল্প শুনিয়েছে। আম্মু স্কুল থেকে আসার পথে তাদের জন্য কী নিয়েছে এসেছে। বাড়িওয়ালি আন্টি কী পিঠা পাঠিয়েছিলেন। বুয়ার মেয়েটি বিড়ালকে বিলাই বলেছে। কিছুই বাদ পড়ে না। ওদের বলা শেষ হলে ফাতেমা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘আব্বু গল্প বলবে।’ আব্বু গল্প বলেন। জান্নাত ওর বাবার মাথার চুলে বিলি কাটে। গল্প শুনতে শুনতে ফাতেমা ঘুমিয়ে যায়। ছোট এ সুখী পরিবারের এটা প্রতিদিনের রুটিন।
আজ কী হলো আব্বু কেন আসছে না? ফাতেমা বারবার ওর আম্মুর কাছে জানতে চাচ্ছে। কিন্তু ওর আম্মু কিছু বলছেন না। আঁচলে মুখ ঢাকছেন। মামা, নানু, চাচুদের ফোন করছেন। মায়ের কাছে উত্তর না পেয়ে জান্নাতের কাছে ফাতেমা জানতে চাচ্ছে আব্বুর কথা। সেও কিছু বলতে পারছে না। ওদের দু’বোনের ছোট্ট মনে একটাই প্রশ্ন আব্বু আসছেন না কেন?
ফাতেমা কান্নাকাটি শুরু করে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আব্বুকে ডেকে বলে, আমি চকলেট চাই না, বিস্কুট চাই না। আব্বু তুমি আসো... আব্বু আসো... কিন্তু না আব্বু আসে না।
কাঁদতে কাঁদতে ওরা দু’বোন ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের আম্মুর চোখে ঘুম নেই। তিনি ভাবছেন, মেয়ে দু’টিকে কী বলবেন? সকালে ঘুম ভাঙলেই তো আবার ওরা ওদের বাবার কথা জানতে চাবে। এ কথা ভাবতে ভাবতে তন্দ্রা আচ্ছন্নতায় দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে তার রাত কেটে যায়।

দুই.
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার... ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে জেগে ওঠে নগরবাসী। জান্নাত, ফাতেমা আর ওদের মায়েরও ঘুম ভাঙে। ফাতেমা ঘুম থেকে জেগেই এ রুম থেকে পাশের রুমে যায়। ওর আব্বুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিন্তু না, সে তার আব্বুকে কোথাও খুুঁজে পায় না। বাথরুমে নেই, বারান্দায়, রান্নাঘরেও নেই। আম্মু আর জান্নাত নামাজ পড়ছে। ফাতেমার স্বস্তি ফিরে পায়। সে মনে মনে ভাবে, তার আব্বু নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। তার এ ভাবনার কারণ, জুলফিকার সাহেব প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন।
জান্নাত আর ওর মায়ের নামাজ শেষ হলে ফাতেমা দৌড়ে মায়ের কোলে গিয়ে বসে। তারপর বলে, ‘আম্মু, আব্বু কই? মসজিদে গেছে, তাই না?’ মায়ের মুখের কথা আটকে যায়। তার চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ফাতেমা আঁচল দিয়ে মায়ের চোখ মুছে দেয়। সে বলে, ‘আম্মু তুমি কাঁদছো কেন? আব্বু কী তোমার সাথে রাগ করে পালিয়ে গেছে। আম্মু তুমি কেঁদো না। আব্বু কোথায় লুকিয়ে আছে বলো, আমি তাকে নিয়ে আসবো। তাকে অনেক বকে দেবো।’
হঠাৎ ডোরবেল বেজে ওঠে।
‘আম্মু! আম্মু! আব্বু এসেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল।’ ফাতেমা চিৎকার করতে করতে লাফাতে থাকে। ওর আম্মু দরজা খুলে দেন।
‘আসসালামু আলাইকুম।’ বলে ঘরে প্রবেশ করেন জান্নাত ফাতেমার ছোট মামা।
‘মামা, আব্বু কই?’ ফাতেমা জানতে চায়।
‘আজ তোমাকে তোমার আব্বুর কাছে নিয়ে যাবো।’ মামা বলেন।
‘চলো আব্বুর কাছে যাবো, আব্বুর কাছে যাবো..’ ফাতেমা আবার চিৎকার শুরু করে। ওর আর তর সইছে না।

তিন.
কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বন্দীদের সাথে দেখা করার স্থান। দু’তলার এ অংশটার নাম নীল। মাঝে মোটা দেয়াল। দুই পরত নেটের ওপাশে আব্বুকে দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছে জান্নাত আর ফাতেমা। ওদের খুব ইচ্ছে করছে আব্বুকে একটু ছুঁয়ে দেখতে।
‘আব্বু আসো..’ এ কথা বলেই মায়ের আঁচলে মুখ লুকায় ফাতেমা। সে আর আব্বুর মুখের দিকে তাকাতে পারে না। জান্নাত বলে, ‘আব্বু তুমি কবে আসবে?’
জুলফিকার সাহেবের বুক ভারী হয়ে আসে। তিনি ভাবেন, ছোট্ট মেয়ে দু’টিকে কী বলবেন? কবে তার জামিন হবে, তিনি নিজেও জানেন না।
আব্বুর সাথে দেখা করে বাসায় ফিরেছে ওরা। ফাতেমা মুখে কিছু দিচ্ছে না। সে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠতেই চাচ্ছে না। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। আম্মু গায়ে হাত দিয়ে চমকে ওঠেন, হায় আল্লাহ! জ্বরে যে, শরীর পুড়ে যাচ্ছে!
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ফাতেমা জানতে চায়, ‘আম্মু, আব্বু কবে আসবে?’


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ