আমাদের পৃথিবী আমাদের পরিবেশ
নাটিকা জুন ২০১৫
হুসনে মোবারক প্রথম দৃশ্য অন্ধকার মঞ্চ ধীরে ধীরে আলোতে ভেসে উঠলে দেখা যাবে অনেক ধরনের গাছ দুলছে। গুন গুন কোরাস সুর ভেসে আসছেÑ প্রাণের ভিতর আছে প্রাণ সুর তুলে গাই, গাই যে গান পাখির গানে শুনি কথা মন ভরে যায়, ঘুচে ব্যথা মনের কথা বলো তারে হয়তো পাবে খুঁজে তুমি সঠিক জায়গা, সঠিক স্থান॥ ব্যাট-বল হাতে কয়েকজনের আগমনে গাছগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে কোরাসও বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে যায়। বালক-১ : তুমি দাঁড়াও আমি দেখি কোন ডালটা বেশি শক্ত। শক্ত ডাল না হলে ভেঙে যাবে। বালক-২ : তুমি পারবে না। তুমি বরং আমাকে ধাক্কা দাও আমি বড় গাছটাতে উঠি। একেবারে মগডাল থেকে শক্ত ডাল ভেঙে নিয়ে আসব। বালক-৩ : সাবধান পড়ে যেও না যেন। ওরে বাপরে এত বড় গাছে কেমন করে উঠবে। বালক-২ : কেমন করে উঠবো। এই দেখ....অবশ্য তোমার মতো শরীর নিয়ে গাছে ওঠাটা একটু কষ্টকরই বটে। বালক-৩ : তুমি কিন্তু আবারো আমাকে খোঁচা মেরে কথা বললে। বালক-১ : সময় নষ্ট করো না, তাড়াতাড়ি উঠো। বালক-২ : হ্যাঁ তুমি আমাকে একটু ধাক্কা দাও। সামান্য একটু, এই যে, আর লাগবে না। ...ওরে বাবারে, মরে গেলামরে...। (বালক-২ একটি গাছের ডাল ভাঙতে গিয়ে পড়ে যায়। বিকট শব্দে ডাল ভাঙার আওয়াজ হয়। বাকি দু’জন বন্ধু মনে করে ভূতটুত হয়তো ধাক্কা মেরে তাকে গাছ থেকে ফেলে দিয়েছে এই ভেবে তারা ভয়ে পালায়।) দ্বিতীয় দৃশ্য (বালক-২ এর নিথর দেহ পড়ে আছে মঞ্চে, অনেকটা অচেতন অবস্থায়।) শিমুল গাছ : এই বালক! বালক! উঠো, উঠে এসো বলছি, নতুবা আরেকটা ডাল তোমার ঠিক মাথার ওপর ফেলবো। তখন আর বাঁচতে পারবে না। উঠো, উঠো..। কড়ই গাছ : আহ্হা শিমুল, তুমি ঐরকম ভয় দেখাচ্ছ কেন? দেখতেই তো পাচ্ছো, ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। শিমুল গাছ : ভয় দেখাবো না। আসলে মানব সম্প্রদায়টাই হচ্ছে দুষ্টু প্রকৃতির। ওদের আঘাত সহ্য করতে করতেই আমাদের জীবন শেষ। সবাই মিলে মনের সুখে একটু গান গাচ্ছিলাম। এটাই ওদের সহ্য হলো না। এসেই কোপ বসিয়ে দিলো। কুল গাছ : বনের সকল গাছের এই বিষয়ে ঐক্যের ভিত্তি হয়েছিল যে কেউ যদি অপ্রয়োজন অথবা ছোট কোন গাছ কাটে অথবা গাছের ডাল ভাঙে প্রথমে তাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে সতর্ক করবো। তারপর না হয় ঝটকা মেরে ফেলে দেবো। কিন্তু তুমি তো ভাই কড়ই, সতর্ক করা ছাড়াই তাকে ফেলে দিলে। কড়ই গাছ : আমি ফেলিনি তো। সে এমন ডাল ধরেছিলো যা খুবই নরম। তার ওজন আমার শাখা সহ্য করতে পারছিলো না। অমনি ভেঙে পড়লো। শিমুল গাছ : আমি হলে তো আছাড় মারতাম। এক্কেবারেই খতম। কুল গাছ : তুমি তো আছ শুধু নিয়ম ভাঙার মধ্যে। সতর্ক করা ছাড়া কাউকে আঘাত করা যাবে না। এটাই নিয়ম। শিমুল গাছ : রাখো তোমার নিয়ম। জীবনই বাঁচে না, আবার নিয়ম। (বাগানে গাছের তর্কাতর্কি আর কথোপকথনে বালকটি জেগে ওঠে। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সে গাছগুলোর কথা শুনে।) দেবদারু গাছ : এই দেখো দেখো, বালকটি জেগে উঠেছে। কড়ই গাছ : ব্যথা পেয়েছো বালক? আহা! তুমি আমার নরম ডাল ধরতে গেলে কেন? নিম গাছ : আমার শরীর থেকে কয়েকটা পাতা নিয়ে কচলে পাতার রসটা তোমার শরীরের ব্যথার জায়গায় লাগাও। দেখবে আরাম পাবে। বালক : তোমরা! তোমরা কথা বলতে পারো! অবিকল মানুষের মতো! কুল গাছ : তুমি খুব দুর্বল। এই নাও এখান থেকে কতগুলো কুল খেয়ে নাও। খুব মিষ্টি। খাও খাও। শক্তি পাবে। বালক : তোমরা কী করে কথা বলছো? শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারো? তোমাদের জীবন আছে? কড়ই গাছ : হ্যাঁ আমাদের জীবন আছে। প্রাণ আছে। আমরা অনুভূব করতে পারি। নিম গাছ : তোমাদের মানুষরাই আবিষ্কার করে দেখিয়ে ছো আমাদের প্রাণ আছে। কি যেন নাম...। শিমুল গাছ : জগদীশ চন্দ্র বসু। বেটা আস্তো পাগল। একবার পেলে মজা বুঝাতাম। আমাদের প্রাণ আছেÑ এ আবিষ্কারের পর থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ বেড়ে গেছে। মানুষই হচ্ছে যত গন্ডগোলের মূল। বালক : মানুষ! কেন? এরাতো সৃষ্টির সেরা! কড়ই গাছ : সেরা বলে এদের দায়বদ্ধতাও তো বেশি। পরিবেশ রক্ষা করাও এদেরই দায়িত্ব। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গাছপালা কাটা হচ্ছে কারণে- অকারণে। কলকারখানার বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে মিশছে পানির সাথে। দূষিত হচ্ছে পানি। এতে তো মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে বেশি। পরিবেশ হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। কুল গাছ : গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পৃথিবীর মানুষকে। এভাবে তো পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। শিমুল গাছ : ওর কাছে এসব বলে লাভ নেই। অরণ্যে রোদন। এই যে সুন্দরবনের পাশে তেলের জাহাজ ফুটো হয়ে সব তেল ছড়িয়ে পড়লো নদীতে। মাছ মরে গেলো, গাছ মরে গেলো। কই, কারো কোনো মাথাব্যথা আছে? সব মরে যাবে সব। শুধু তোমরাই বেঁচে থাকবে। বালক : হ্যাঁ, আমরাই আমাদের পরিবেশটাকে নষ্ট করছি। ধ্বংস করছি আমাদের সুন্দর চারি পাশ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি এখন যাচ্ছি। আমার বন্ধুদের বলবোÑ এই পৃথিবীটা আমাদের। আমাদের পৃথিবী আমাদেরই বাঁচাতে হবে...। (দৌড়ে বের হয়ে যায়। লাইট অফ)তৃতীয় দৃশ্য (অচেতন অবস্থায় আগের কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে থাকে। বন্ধুরা এসে দাঁড়ায় পাশে।) বালক-১ : কী হয়েছে তোমার? অমন বিড়বিড় করছ কেন? বালক-৩ : চোখ খোলো, এই পানিটুকু খেয়ে নাও। বালক-২ : কী হয়েছিলো আমার? শরীরটা ব্যথা করছে। কোথায় ছিলাম আমি? বালক-৩ : তুমি স্বর্গে ছিলে। এখন মর্তে এসেছো। এবার বাড়ি চলো। কত করে নিষেধ করলামÑ তুমি পারবে না গাছে উঠতে, পড়ে যাবে। নাহ বীর! সাহস দেখায়। বালক-২ : চলো...। দু’জনের কাঁধে ভর করে বালক মঞ্চ থেকে বের হয়। যাওয়ার সময় পেছনে তাকিয়ে স্যালুট জানায় হিতাকাক্সক্ষী পরম বন্ধু গাছগুলোকে। বাগানের সব গাছ আপন মনে আবার গাইতে শুরু করে... প্রাণের ভিতর আছে প্রাণ সুর তুলে গাই, গাই যে গান..
আরও পড়ুন...