আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা - এস. এম রুহুল আমীন

আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা - এস. এম রুহুল আমীন

প্রচ্ছদ রচনা ফেব্রুয়ারি ২০২০

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ৮ ফাল্গুন। আমাদের আরেকটি স্বাধীনতা দিবস। আর সেটি হলো ভাষার স্বাধীনতা দিবস। পৃথিবীর প্রায় চার হাজার ভাষার মধ্যে এটিই একমাত্র ভাষা যা আদায়ের জন্য আমাদের জীবন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের যেন আর শেষ নেই। ব্রিটিশ বেনিয়া থেকে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম ১৯৪৭ সালে। শাসন করার দায়িত্ব নিলো পাকিস্তান। আমাদের মনোবেদনা বুঝার সামান্য চেষ্টাটুকু তারা করলো না। কেড়ে নিলো ভাষার স্বাধীনতা। আমরা জন্ম নিয়ে ধন্য হয়েছি এই দেশে। এ দেশের আলো বাতাসে বেড়ে উঠছি। আমরা মায়ের কোলে বসেই শিখছি ভাষা। যে ভাষাটা শিখলাম সেটিই আমাদের মাতৃভাষা, মায়ের ভাষা মানে বাংলা ভাষা। আর এটি আমাদের দান করেছেন মহান আল্লাহ। আজব ব্যাপার কি জানো? এ ভাষাটির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছিল না। ছিল না সামান্যতম মর্যাদা। মায়ের কোলে শিখছি মাতৃভাষা অথচ আমাদের শিক্ষার মাধ্যম হলো ইংরেজি ও উর্দু। এ যেন কাকের বাসায় কোকিলের ছানা! ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পরপরই জেগে উঠলো আবার স্বাধীনতাকামী জনগণ। জেগে উঠলো বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম বাংলা ভাষার দাবি করলো তমুদ্দন মজলিশ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু থোড়াই কেয়ার! দাবি নাকচ করলো পাকিস্তানিরা। আজগুবি এবং অবান্তর প্রশ্নের সৃষ্টি হলো। আম গাছে আম ফলবে কি না? অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষীদের ভাষা কী হবে? বাংলা না উর্দু? পাকিস্তানিরা গায়ের জোরে চাপিয়ে দিতে চাইলো। আমাদের ওপর বাংলার পরিবর্তে উর্দু। স্পষ্টত তারা সাফ জানিয়ে দিলো। Urdu, Urdu and Urdu will be, shall be and Must be state language of Pakistan. জেগে উঠলো আবার বাংলার আমজনতা। বজ্র কঠিন শপথ নিলো। বিক্ষোভে ফেটে পড়লো তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হলো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। সাড়া পড়লো সবখানে। ব্যাপক সাড়া মাঠে-ঘাটে, অফিস-আদালতে। সম্পৃক্ত হলো সকল জনতা। ছাত্র-শিক্ষক কৃষক মজুরসহ সাধারণ মানুষ। স্বৈরশাসকরা সব সময় জনগণের আন্দোলনকে ভয় পায়। ভিত নড়ে ওঠে তাদের অবৈধ মসনদের। সত্যিই কেঁপে উঠলো পাকিস্তানিদের তখতে তাউসও। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ওপর নেমে এলো খড়গ। ব্যাপক ক্ষোভের মুখে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জারি করলো ১৪৪ ধারা। ন্যায্য দাবি আর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের দাবানল কি কোনো আইন মানে? না, মানে না। ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল নিয়ে বেরুলো সবখানে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মিছিল এগিয়ে চললো ঢাকা মেডিক্যালের দিকে। শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া পেটুয়া বাহিনী পুলিশ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরপরাধ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর। টিয়ার শেলের শব্দে ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হলো ঢাকার রাজপথ। কয়েক ঘণ্টা চললো ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া। শেষ বিকেল। ক্লান্ত-শ্রান্ত ছাত্র-জনতা। ফাঁকা গুলি ছুড়লো পুলিশ। আবার ছড়িয়ে পড়লো উত্তেজনা। গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন রফিকুর রহমান। আহত হওয়ার পর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন আবুল বরকত। শতাধিক ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। তরুণ যুবাদের লাল রক্তের রং ছড়িয়ে পড়লো রক্ত জবা আর শিমুলের গায়ে। সিক্ত হয়ে ধন্য হলো রঙিন ফুলগুলো। আমরা অর্জন করলাম আমাদের ভাষার স্বাধীনতা অর্থাৎ আমরা পেলাম মাতৃভাষা বাংলা। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা নিজদেশে এখন পরবাসী। তোমরা অবাক হলে নাকি? ভাষার স্বাধীনতা পেয়েও যেনো আমরা স্বাধীন নই। কথা ছিলো আমরা নির্ভুল মাতৃভাষা চর্চা করবো। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, অফিস-আদালতে সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার করবো। কিন্তু আজও কি তা হয়েছে? হয়নি। বিদেশী ভাষা ব্যবহার ও চর্চা ফ্যাশন ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ভাষা দিবস আর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঠিকই পালন করা হয় ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে। তবে এটা ছিলো আমাদের দেশে এবং বাংলা ভাষাভাষীদের দিবস। খুশির খবর কি জানো? এখন এ দিবসটি আর শুধুমাত্র আমাদের নেই। এটি হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পালন করা হচ্ছে বিশ্বের সব ক’টি দেশে। প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে বাংলা। আমরা এটি পেয়েছি কানাডাভিত্তিক সংগঠন Mother language lovers of the world এর আবেদনে এবং ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর UNESCO-এর সিদ্ধান্তের কারণে। বাস্তবতা হলো আমাদের অনেক ত্যাগের ফসল এই মাতৃভাষা। আমরা গভীরভাবে ভালোবাসি আমাদের এ ভাষাকে। কিন্তু আমাদের দেশেই রয়ে গেছে অবহেলিত আর অনাদরে। বাংলা ভাষা যথাযথভাবে এখনও ব্যবহার হচ্ছে না অফিস আদালতের সবখানে। আমরা উদার। আমাদের ভালোবাসা সর্বজনীন। আমরা যেমন ভালোবাসি আমাদের ভাষাকে তেমনি ভালোবাসি অন্যান্য ভাষাকেও। কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ নেই আমাদের। আমাদের সংগ্রামটা ছিলো আমাদের ভাষার জন্য। আমরা বিশ্বাস করি ভাষা মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আমাদের আরবি ভাষা শিখতে ও জানতে হবে। মহানবী সা.-এর বাণী অনুযায়ী আরবি আল্লাহর ভাষা। আল কুরআনের ভাষা। নবীর ভাষা। ইংরেজিও শিখতে হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউরদের রক্তদান আমাদের ঋণী করে গেছে। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখা। আর বাঁচিয়ে রাখতে করণীয় হলো- বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা করা। শুদ্ধ ভাষায় বাংলা শেখা ও শেখানো। বাংলায় রচিত সাহিত্য পড়া এবং পড়ানো। বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যবস্থা করা। সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। তাই এসো আমরা শপথ করি, আমাদের ভাষার মান আমাদেরই রাখতে হবে। ভাষা-শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। একদিনের বাঙালি সাজবো না। সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার করবো। ভুল বানান শেখাবো না এবং শিখবো না। বেশি বেশি বাংলা সাহিত্য পড়বো। বাংলা সাহিত্য পড়াবো। বাংলা সাহিত্য শেখাবো। যদি আমরা এটা করতে পারি তা হলেই রক্ষা পাবে আমাদের ভাষার মান। ভাষা বেঁচে থাকবে আজীবন। আমরা সগৌরবে আনন্দচিত্তে কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারবো- ‘মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা/ খোদার সেরা দান’।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ