আমার মা’র গল্প

আমার মা’র গল্প

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১৪

ইব্রাহীম বিন রশীদ

Amar-mar-golpoসুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা রূপ মনোহর আমাদের এই দেশ। হাজারো গ্রামের মধ্যে চরগাজীপুর তার মধ্যে একটি গ্রাম। গ্রামের শেষ মাথার উত্তর কিনারায় ছোট্ট একটি নদী। সে নদী দিয়ে ঢাকাগামী লঞ্চ চলাচল করে প্রতিনিয়ত। নদীর একটু দূরেই খাল আর সেই খালের পাশে আমাদের বাড়ি। আশপাশের সব ছেলেপেলে মিলে গোসল করা, সাঁতার কাটা আর মাছধরা ছিলো নিত্যদিনের কাজ। আমাদের বাড়ির আশপাশে যেসব ঘরবাড়ি ছিল, তার বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা তখন অশিক্ষিত ছিল। ছোটবেলায় সেসব ডানপিটে দুষ্টু ছেলেদের সাথে চলাফেরা করার কারণে মায়ের হাতে কত দিন মার খেতে হয়েছে তা গুনে বের  করতে পারব না। প্রায় দিনই যখন মাগরিবের আজান হতো, তখন ঘরের পাশে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে লাঠি নিয়ে কড়া শাসন করতেন মা। ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ডটা থর থর করে কাঁপতো। আসলে তখন না বুঝলেও এখন ঢের বুঝতে পারছি আমার মায়ের শাসন ছিল ন্যায় ও আদর্শ মানুষ হওয়ার শাসন। এক দিনের ঘটনা। সেদিন সকালবেলা মা বললেন, মাদরাসায় একদিন যাও তো অন্যদিন যাও না। তোমার আব্বা গত বুধবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ছেলে যেন ঠিকমতো লেখাপড়া করে। আজ থেকে আর একদিনও মাদরাসা কামাই দেবে না বাপু। আর ঐসব ছেলেদের সাথেও মিশবে না। গোসল করে ভাত খেয়ে মাদরাসায় চলে যাও। কথা শেষ করে মা পুকুরে থালা-বাসন ধুতে গেলেন। মায়ের চোখ আড়াল করে আমার সমবয়সী রিপন নামে একটি ছেলে এসে বলল, চল মারবেল খেলি। তখন মারবেল খেলাই ছিল আমার খুব পছন্দের। মা পুকুর থেকে আসার আগেই রিপনের সাথে চলে যাই বাড়ির পশ্চিম পাশে সুপারি বাগানে। সেখানে গিয়ে দেখি আরো তিন-চারজন মারবেল খেলছে। তাদের সাথে আমরা দু’জনও যোগ দিলাম। মারবেল খেলা শেষ করে দেখি মাদরাসায় যাওয়ার সময় শেষ। কী আর করা, বুঝলাম আজকেও মায়ের মার খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই মুহূর্তে ঘরে যাওয়া যাবে না। সারা দিন এদিকে সেদিকে ঘুরে ঘুরে বিকেল বেলা খালি পেটেই এক ছেলের বুদ্ধিতে চলে যাই বাজারে। বাজার থেকে যখন বাড়ি আসি তখন মাগরিবের অনেক পর। নিমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে দেখি ঘরের দরজা বন্ধ। তখন ঘরের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। মা আমার উপস্থিতি কিভাবে যেন টের পেলেন। ছোট বোন আমেনার সাথে আমাকে শুনিয়ে বলছেন, আজ ও আসুক বাড়ি। লেখাপড়া ফেলে সারা দিন কাজের ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর মজা বোঝাবো। এই আমেনা আলহামদু থেকে যে কয়টা সূরা পারো আমাকে শোনাও। নইলে এই লাঠি তোমার পিঠে ভাঙবো। আমেনা আস্তে আস্তে সূরা শুনাচ্ছে, ঠিক তখনি আমি দরজা নক করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর হয়তো মায়ের ইশারায় ছোট বোন দরজা খুলে দিলো। ঘরের বারান্দার এক কোণে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি। মিনতির সুরে মাকে বললাম, মা আর কোনো দিন মাদরসায় যাওয়া বন্ধ করব না এবং ঐ ছেলেদের সাথেও ঘুরবো না। ‘না’ শব্দটা শেষ না করতেই মা আমার হাত ধরে চকির নিচে বসিয়ে রাখলেন। আর বললেন, আজকের অপরাধের জন্য এটাই তোমার শাস্তিÑ অন্ধকারে চকির নিচে বসে মশার কামড় খাওয়া। শত হলেও মায়ের মন, মিনিট দশেক থাকার পর মা বললেন, আমেনা নবাবকে ভাত খেয়ে পড়তে বল। আজকের পর থেকে আর কোনো দিন এসব ছেলেদের সাথে যেন না মিশে। মায়ের এই কথাগুলোর মধ্যে অনুমান করলাম রাগটা একটু শিথিল হয়েছে। সেদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আর  কোনো দিন এসব দুষ্টু ছেলেদের সাথে চলবো না এবং নিয়মিত মাদরাসায় যাবো। আসলে এখন বুঝতে পারছি তখন মা আমাকে কেন কড়া শাসনের মধ্যে রাখতেন। মায়ের একটাই চিন্তা আর ভয় ছিল, আমি যেন অন্যদের সাথে মিশে খারাপ হয়ে না যাই। সে সময় যেসব ছেলেমেয়েদের সাথে চলতাম আজ তারা বিভিন্ন কষ্টকর পেশায় নিয়োজিত। দুষ্টুমি আর পড়া ফাঁকি দেয়ার কারণে আজ তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আমার লেখাপড়ার জন্য মা-বাবা দু’জনই অনেক কষ্ট, ত্যাগ ও পরিশ্রম করেছেন। শুকরিয়া মাবুদের দরবারে, তিনি হয়তো তাদের কষ্ট বিফল হতে দেননি। নিজের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর ওপরে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে আজ হয়তো তাই দুই কলম লিখতে পারছি এবং অন্যকে দুই কলম শিক্ষা দিতে পারছি। আজ যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার কাছে পড়তে আসে, তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে যায়। পরম মমতায় তাদের পড়ানোর ওপরে ওঠার সিঁড়ি দেখানোর চেষ্টা করি। চেষ্টা করি তারাও যেন মা-বাবার দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্নার দিনগুলোর কথা মনে রেখে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায় সম্মুখ পানে। অন্ধকার ভেদ করে শিক্ষার আলোয় ভাসবে ভুবন। ধরার মাঝে বিভেদ ভুলে একই সারিতে দাঁড়িয়ে গাইবে বিপ্লবী সব গান। প্রতিদিন পড়া শুরু করার পূর্বে রবের শেখানো সেই মহান বাণী দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়া শুরু করিÑ ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ