আহা জলপ্রপাত!

আহা জলপ্রপাত!

প্রচ্ছদ রচনা সেপ্টেম্বর ২০১২

মাহমুদ হাসান..

তোমাদের অনেকেই হয়তো আমাদের দেশের জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড দেখেও এসেছো। যারা সুযোগ পেয়েছো, তারা তো মনে হয় বিদেশের বিখ্যাত সব জলপ্রপাতও দেখে এসেছো। আর জানো তো, আমাদের দেশে যে নতুন একটা জলপ্রপাত আবিষ্কৃত হয়েছে- মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ওই জলপ্রপাতটির নাম ‘হাম হাম’ জলপ্রপাত। এবার পরিচিত হও পৃথিবীবিখ্যাত কয়েকটি জলপ্রপাতের সঙ্গে।
জলপ্রপাত কী
জলপ্রপাতের ইংরেজি প্রতিশব্দ ফলস। জলপ্রপাত হলো একটি নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে প্রাকৃতিকভাবে বহমান জলের প্রবল বেগে পতন। জলপ্রপাত সাধারণত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি অন্যতম নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হয়। পাহাড় থেকে বা অনেক উঁচু থেকে পানির এই স্রোত যখন হুড়মুড় করে নিচে এসে পড়ে, তখন তাকে বলে জলপ্রপাত। মানে অনেক উঁচু ঝরনা আরকি! নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে, এই পানিটা আসে কোত্থেকে? দাঁড়াও, বলছি। পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় বড় জলপ্রপাতের জন্ম হয়েছে কোনো না কোনো নদী থেকে। এই যেমন ধরো, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উৎপত্তি হয়েছে নায়াগ্রা নদী থেকে। আবার জাম্বেসি নদী থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের। তবে নদী ছাড়াও বরফগলা পানির স্রোত, হ্রদ অথবা মাটির নিচ থেকে উঠে আসা পানি থেকেও তৈরি হতে পারে জলপ্রপাত। আমাদের দেশের জলপ্রপাতগুলো একেবারেই ছোট আকৃতির জলপ্রপাত। সারা পৃথিবীজুড়ে এর চেয়েও আরো কতো বিশাল বিশাল জলপ্রপাত যে আছে! সে সব জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। দানবের মতো গর্জন করে এসব জলপ্রপাতের পানি আছড়ে পড়ছে অ-নে-ক নিচে। আর ঝাঁপিয়ে পড়া পানির কণাগুলো বাষ্পে পরিণত হয়ে নয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সৃষ্টি করছে ধোঁয়া। অসাধারণ সে সব দৃশ্য! কী, আর লোভ সামলাতে পারছো না? তাহলে আর দেরি করে লাভ কী? চলো এবার ঘুরে আসি পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত এমনি কয়েকটি জলপ্রপাত থেকে।

এঞ্জেল জলপ্রপাত
প্রথমেই তোমাদের নিয়ে যাবো পৃথিবীবিখ্যাত ‘এঞ্জেল ফলস’-এ। আর এটি দেখতে হলে যেতে হবে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলায়। ভেনিজুয়েলার দক্ষিণে অবস্থিত ‘কানাইমা ন্যাশনাল পার্ক’, একে আবার ইউনিসেফ রীতিমতো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষণা দিয়েছে। সেই পার্ক যে রেইনফরেস্টে, সেখানে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। ভাবছো, রেইনফরেস্টটা আবার কী? রেইনফরেস্ট হচ্ছে চিরসবুজ বৃক্ষের বন। অর্থাৎ এখানকার গাছগুলো সারা বছরই সবুজ থাকে। আর পুরো বছরজুড়েই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়।
যাই হোক, এঞ্জেল ফলসের আরও কয়েকটি নাম আছে। এই যেমন স্প্যানিশ ভাষায় এর নাম হচ্ছে ‘সালতো এঞ্জেল’। স্থানীয় লোকেদের ব্যবহৃত ‘পেমন’ ভাষায় এই জলপ্রপাতের নাম হচ্ছে ‘কেরেপাকুপাই ভেনা’, মানে ‘গভীরতম স্থানের জলপ্রপাত’। এই ভাষাতেই আবার এঞ্জেল ফলসকে ডাকা হয় ‘পারাকুপা ভেনা’ নামে, যার অর্থ ‘সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত’। নিশ্চয়ই ভাবছো, সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত আবার কেন ডাকা হয়? এই নামে ডাকা হয় কেননা এঞ্জেল ফলস সত্যি সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জলপ্রপাত। পৃথিবীর উচ্চতম এই জলপ্রপাতে প্রায় ৯৭৯ মিটার বা ৩,২১২ ফুট উঁচু থেকে পানি নিচে পড়ছে। এই এঞ্জেল ফলস উচ্চতায় প্রায় ৩২১ তলা বা প্রায় ১ কিলোমিটার উঁচু! আর যে উঁচু পাহাড় থেকে এই এঞ্জেল ফলসের পানি গড়িয়ে পড়ছে তার নাম ‘আওয়ানতেপুই’। এই নামের অর্থ কী জানো? ‘শয়তানের পাহাড়’! আসলে পাহাড়টা এতোই দুর্গম জায়গায় যে সেখানে যাওয়া যেমন কষ্টকর, ফিরে আসাটা আরো কষ্টকর। এজন্যই বোধহয় সেখানকার অধিবাসীরা পাহাড়টিকে এই নামে ডাকে।
এবার শোনো একটা মজার জিনিস। যদিও একটু আগেই বলেছি যে, যে কোনো জলপ্রপাতের উৎস হচ্ছে কোনো নদী,  হ্রদ, বরফগলা পানির স্রোত অথবা মাটির নিচ থেকে উঠে আসা পানি। তবে এঞ্জেল ফলসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। সত্যি কথা বলতে কী, এঞ্জেল ফলসের পানির সে রকম কোনো উৎসই নেই! রেইনফরেস্ট অঞ্চলে সারাবছর যে বৃষ্টিপাত হয়, সেই বৃষ্টির পানিই পাহাড় থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে সৃষ্টি করেছে এই জলপ্রপাতের। ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর, তাই না? প্রায় এক কিলোমিটার উঁচু থেকে এই বৃষ্টির পানি গিয়ে পড়ে নিচের ‘কেরিপ’ নদীতে। সেখান থেকে গিয়ে মেশে ‘চুরুন’ নদীতে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত আর মজার বিষয়টি হচ্ছে প্রায় এক কিলোমিটার উঁচু থেকে পড়া এঞ্জেল ফলসের বেশির ভাগ পানিই নিচে পড়ার আগেই বাষ্প হয়ে যায়। আর এই বাষ্পই জলপ্রপাতটির চারিদিকে একটা কুয়াশার আস্তরণ সৃষ্টি করে। কী অবাক কাণ্ড, তাই না?
এতক্ষণে বোধহয় একটা প্রশ্ন তোমাদের মনে এসেই গেছে, এতো গভীর দুর্গম জঙ্গলে এরকম একটা জলপ্রপাত মানুষ খুঁজে পেল কী করে? সেও এক ভীষণ প্রশ্ন বটে। আর সত্যি সত্যিই এঞ্জেল ফলসের আবিষ্কারের ঘটনাটাও বেশ মজার। অনেক আগে থেকেই মানুষ ওই পাহাড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো, কিন্তু কেউ-ই যেতে পারছিলো না। যারাও বা গিয়েছিলো, তারা আর ফিরেও আসেনি। অবশেষে ১৯৩৭ সালে জিমি এঞ্জেল নামের আমেরিকার এক পাইলট একটা ছোট্ট বিমানে করে সেখানে গিয়ে পৌঁছান। তিনি, তাঁর স্ত্রী আর তাঁর দুই বন্ধু আওয়ানতেপুই পাহাড়ে অবতরণ করলেন। আর সেখানেই তারা আবিষ্কার করলেন পৃথিবীর উচ্চতম এই জলপ্রপাতটিকে। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসার সময়ই ঘটলো বিপত্তি। কোনোভাবেই জিমি সাহেব তার ছোট্ট প্লেনটি ওড়াতে পারলেন না। শেষে আর কী করা, পায়ে হেঁটেই তারা রওয়ানা দিলেন! আর টানা ১১ দিন ধরে হেঁটে তবেই এই ভয়ঙ্কর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছালেন লোকালয়ে। এরপর তাঁর কাছে থেকেই মানুষ জানলো এই জলপ্রপাতের কথা। তাঁর নামেই জলপ্রপাতটির নাম রাখা হলো ‘এঞ্জেল ফলস’।
নায়াগ্রা ফলস
এঞ্জেল ফলস যেমন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত, তেমনি নায়াগ্রা ফলসও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত। তবে পার্থক্যটা হলো, এঞ্জেল ফলস সর্ববৃহৎ হচ্ছে উচ্চতার দিক থেকে, আর নায়াগ্রা ফলস সর্ববৃহৎ হচ্ছে পানি পতনের পরিমাণের দিক থেকে। অর্থাৎ উচ্চতায় মাত্র ১৬৫ ফুট হলেও পানি পড়ার দিক থেকে নায়াগ্রা ফলস পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ। শুনে তাজ্জব হয়ে যাবে যে, এই জলপ্রপাত থেকে প্রতি মিনিটে প্রায় ৬ মিলিয়ন ঘনফুট পানি নিচে পড়ছে। আর এই পানি এতোটাই জোরে আছড়ে পড়ছে, তুমি নায়াগ্রা জলপ্রপাতের আশপাশে থাকলে তোমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে কিছু বললে সে কিচ্ছুই শুনতে পাবে না। পানির এই দানবকে দেখতে হলে তুমি আমেরিকা অথবা কানাডাÑ যে কোনো দেশেই যেতে পারো। কেননা নায়াগ্রা ফলস এই দু’টি দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। আমেরিকায় গেলে তোমাকে যেতে হবে নিউইয়র্কে আর কানাডায় গেলে অন্টারিওতে।
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উৎপত্তি হয়েছে নায়াগ্রা নদী থেকেই। বরফ যুগের শেষের দিকে বরফ গলে সৃষ্টি হয় এই নায়াগ্রা নদী, আর তা থেকেই এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। নায়াগ্রা ফলস কিন্তু শুধুই একটি জলপ্রপাত নয়। এই জলপ্রপাতটিই আবার আমেরিকা আর কানাডার ভৌগোলিক সীমারেখা হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও এর বিশাল পরিমাণ পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ।
নায়াগ্রা ফলস প্রকৃতপক্ষে তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি; হর্সসু ফলস, আমেরিকান ফলস এবং ব্রাইডাল ভ্যালি ফলস। এর মধ্যে হর্সসু ফলস পড়েছে কানাডার মধ্যে আর বাকি দুটো ফলস অর্থাৎ আমেরিকান ফলস আর ব্রাইডাল ভেলি ফলস পড়েছে আমেরিকার মধ্যে। তবে তিনটি ফলসের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে হর্সসু ফলস; নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রায় ৯০% পানিই এই জলপ্রপাত দিয়ে পড়ে।
ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত
আমেরিকা থেকে এবার আমরা যাবো আফ্রিকায়। সেখানে আছে বিশ্বখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। নায়াগ্রা ফলস আর ভিক্টোরিয়া ফলসের মধ্যে আবার বেশ কয়েকটা মিলও রয়েছে। এই যেমন ধরো, নায়াগ্রা ফলসের মত ভিক্টোরিয়া ফলসের উৎপত্তিও হয়েছে নদী থেকে। নদীটির নাম জাম্বেসি। আবার নায়াগ্রা ফলসের মত ভিক্টোরিয়া ফলসও দু’টি দেশের সীমান্তরেখা হিসেবে কাজ করছেÑ জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ের। তবে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতটি প্রকৃতপক্ষে জাম্বিয়াতেই পড়েছে। কিন্তু জিম্বাবুয়ের কী ভাগ্য দেখো, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের আসল সৌন্দর্যটাই দেখা যায় সীমান্তের ওপারে জিম্বাবুয়ে থেকে।
১৮৫৫ সালে ডেভিড লিভিংস্টোন নামের বিখ্যাত স্কটিশ পর্যটক সর্বপ্রথম এই জলপ্রপাতটি দেখতে পান। আর তক্ষুণি তিনি ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার সম্মানে এই জলপ্রপাতের নাম দিয়ে দেন ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। তবে স্থানীয় ‘কলোলো’ আদিবাসীদের ভাষায় এই জলপ্রপাতের নাম ‘মসি-ওয়া-তুনয়া’। এই নামের অর্থ কী জানো? এই নামের অর্থ হচ্ছে ‘বজ্র সৃষ্টিকারী ধোঁয়া’। বেশ ওজনদার নাম, তাই না?
ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত উচ্চতার দিক থেকেও বড় নয়, আবার এর আয়তনও নায়াগ্রা ফলসের চেয়ে কম। তাহলে ভিক্টোরিয়া ফলস এতো বিখ্যাত হলো কেন বলোতো? কারণ হলো, ভিক্টোরিয়া ফলস পৃথিবীর সবচেয়ে চওড়া জলপ্রপাত। উচ্চতায় এটি মাত্র ১০৮ মিটার হলেও চওড়ায় এই জলপ্রপাত প্রায় ১,৭০৮ মিটার বা ৫,৬০৪ ফুট দীর্ঘ। আর পৃথিবীর সবচেয়ে চওড়া এই ভিক্টোরিয়া ফলস থেকে গড়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৮,০০০ ঘনফুট পানি নিচে পড়ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো? এই বিশাল পরিমাণ পানি প্রচণ্ড গতিতে নিচে আছড়ে পড়ে সৃষ্টি করছে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া আর কুয়াশা, যা কিনা প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। ভাবছো, এটা ওই এঞ্জেল জলপ্রপাতের মতোই ব্যাপার। উঁহু, ওখানে তো পানি বাষ্প হয়ে কুয়াশার মতো হয়ে যায়। আর এখানে পানি জোরে আছড়ে পড়ার কারণে পানির কণা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কুয়াশার মতো হয়ে গেছে।

কাইটার জলপ্রপাত
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজানের গুয়ানা পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এ জলপ্রপাতটি প্রকৃতির আর একটি সুন্দর উপহার। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জলপ্রপাতগুলোর একটি। এর রয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চতা এবং চিত্তাকর্ষক পানির আধার। পর্যটকরা এর চার পাশ ঘেরা রেইন ফরেস্টের মধ্যকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও বন্য প্রাণী দেখেও মুগ্ধ হন।

রাইন জলপ্রপাত
এটি হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। উত্তর সুইজারল্যান্ডের যেখান দিয়ে রাইন নদী প্রবাহিত এই জলপ্রপাতটি সেখানে অবস্থিত। কথিত আছে প্রায় ১৫০০০ বছর আগে এর উৎপত্তি। এটি ৪৯২ ফুট প্রশস্ত এবং ৭৫ ফুট উঁচু।

ইগুয়াজু জলপ্রপাত
ইগুয়াজু জলপ্রপাত দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। শুধু তাই না, নায়াগ্রা জলপ্রপাত আর ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের মতো ইগুয়াজু জলপ্রপাতও এই দু’টি দেশের সীমারেখা হিসেবেই কাজ করছে। তবে ইগুয়াজু জলপ্রপাতের উৎস ইগুয়াজু নদী আবার বেশির ভাগটাই ব্রাজিলের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। আর এই ইগুয়াজু ফলস ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রথম খুঁজে পান আলভার নুনেজ নামের এক স্প্যানিশ।
ইগুয়াজু জলপ্রপাতের নামটা এসেছে সেখানকার আদি অধিবাসী ‘গুয়ারানি’দের কাছ থেকে। তাদের ভাষায় এই নামের অর্থ হচ্ছে ‘বিগ ওয়াটার’ বা ‘প্রচুর পানি’। এখন তো নিশ্চয়ই তোমরা এটা জানতে চাইবে যে এই বিগ ওয়াটার নাম হওয়ার কারণটা কী? সত্যি কথা বলতে কি, এটা একটা-দুটো জলপ্রপাত না, একসাথে প্রায় ২৭৫টা ছোট ছোট জলপ্রপাত! আর এই বিশাল সংখ্যক জলপ্রপাতগুলো একত্রে প্রায় ৩ কিলোমিটার চওড়া। বছরের যে সময়টায় বৃষ্টি হয় না তখনও এই জলপ্রপাত থেকে প্রতি মিনিটে গড়ে প্রায় ১,০০০ ঘনমিটার পানি গড়িয়ে পড়ে। সুতরাং বুঝতেই পারছো, কেন এই জলপ্রপাতের নাম ‘ইগুয়াজু’ রাখা হয়েছে।
ইয়োসেমাইট ফলস
ইয়োসেমাইট ফলস আমেরিকার উত্তর অংশে অবস্থিত ইয়োসেমাইট ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। আদতে এই পার্কের সবচেয়ে বড় আকর্ষণই হচ্ছে এই জলপ্রপাত। আর বসন্তের শেষের দিকে যখন কিনা পুরো জলপ্রপাত পানিতে টইটম্বুর থাকে, তখন তো কথাই নেই। মানুষ শুধু এই ইয়োসেমাইটকে দেখতেই এখানে ভিড় জমায়।
ইয়োসেমাইট জলপ্রপাতটা কিন্তু বেশ উঁচুও বটে। যদিও এঞ্জেল ফলসের মত পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু নয়, তবে উচ্চতায় নেহাতই কম নয় এই ফলস। সত্যি কথা বলতে কী, এই ইয়োসেমাইট হচ্ছে পৃথিবীর ষষ্ঠ উচ্চতম জলপ্রপাত। আর এর উচ্চতা প্রায় ৭৩৯ মিটার বা ২,৪২৫ ফুট। পুরো জলপ্রপাতটা আবার তিনটা স্তরে বা ধাপে বিভক্ত। অবশ্য কেউ নিজে থেকে গিয়ে জলপ্রপাতটাকে ভাগ করে দিয়ে আসেনি। প্রাকৃতিকভাবেই জলপ্রপাতটা তিনটি স্তরে বিভক্ত। সবচেয়ে নিচের স্তরটা মাটি থেকে শুরু করে ২৩০ ফুট বা ৯৮ মিটার পর্যন্ত উঁচু। মাঝের স্তরটা প্রথম স্তরের পর থেকে শুরু করে পরের ২০৬ মিটার বা ৬৭৫ ফুট পর্যন্ত। আর সবচেয়ে উপরের স্তরটার পরিধি একদম চূড়া থেকে ৪৪০ মিটার বা ১,৪৩০ ফুট পর্যন্ত।
ইয়োসেমাইট উপত্যকায় বাস করা ‘আহওয়াহনিচি’ আদিবাসীরা ইয়োসেমাইট ফলসকে ডাকে ‘চলোক’ নামে। এই জলপ্রপাতকে নিয়ে তাদের মাঝে আবার বেশ মজার মজার গল্পও প্রচলিত আছে।

বাংলাদেশের জলপ্রপাত
হ্যাঁ, এবার বাংলাদেশের কয়েকটি জলপ্রপাতের বিষয়ে জেনে নেয়া যাক। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত সম্পর্কে তোমরা কমবেশি সবাই জানো। তাই এটা নিয়ে আজ কোনো আলোচনা নয়। অন্য কয়েকটি জলপ্রপাত সম্পর্কে তোমাদেরকে বলবো।

হাম হাম
হাম হাম কিংবা হামহাম বা চিতা ঝরনা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝরনা। দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝরনাটি ১৩৫ মতান্তরে ১৪৭ কিংবা ১৬০ ফুট উঁচু, যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ঝরনা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা ১৬২ ফুট। তবে ঝরনার উচ্চতা বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত কিংবা পরীক্ষিত মত নেই। সবই পর্যটকদের অনুমান। তবে গবেষকরা মত প্রকাশ করেন যে, এর ব্যাপ্তি মাধবকুণ্ডের ব্যপ্তির প্রায় তিন গুণ বড়।
নামের উৎপত্তি : হাম হাম জলপ্রপাতে গবেষকদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি। সাধারণ পর্যটকেরা জলপ্রপাতটির নামকরণ সম্পর্কে তাই বিভিন্ন অভিমত দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ এর সাথে গোসলের সম্পর্ক করে ‘হাম্মাম’ (গোসলখানা) শব্দটি থেকে ‘হাম হাম’ হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, সিলেটি উপভাষায় ‘আ-ম আ-ম’ বলে বোঝানো হয় পানির তীব্র শব্দ, আর জলপ্রপাত যেহেতু সে রকমই শব্দ করে, তাই সেখান থেকেই শহুরে পর্যটকদের ভাষান্তরে তা ‘হাম হাম’ হিসেবে প্রসিদ্ধি পায়। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি ‘চিতা ঝরনা’ হিসেবে পরিচিত, কেননা একসময় এ জঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ পাওয়া যেত।
বিবরণ : জলপ্রপাতের যৌবন হলো বর্ষাকাল। বর্ষাকালে প্রচণ্ড ব্যাপ্তিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে তা মিইয়ে মাত্র একটি ঝরনাধারায় এসে ঠেকে। ঝরনার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছড়া তৈরি করে বয়ে চলেছে। এরকমই বিভিন্ন ছোট বড় ছড়া পেরিয়ে জঙ্গলের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই ঝরনার কাছে পৌঁছতে হয়। এই জলপ্রপাতে যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চম্পারায় চা বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা বাগান থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরিপথ ও ছড়ার কাদামাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরিপথে কদাচিৎ চোরাবালুও তৈরি হয়, কিন্তু সে সকল স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়। বর্ষাকালে হাম হামে যাবার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝরনার। হাম হামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে। ঝরনার নিকটবর্তী বাসিন্দারা আদিবাসী ত্রিপুরা।
প্রকৃতি : হাম হাম যাবার পথ এবং হাম হাম সংলগ্ন রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রঙবেরঙের প্রজাপতি। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমাপরা হনুমানের। এছাড়াও রয়েছে ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি ইত্যাদি বিচিত্র নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।
পরিবেশ বিপর্যয় : পর্যটকরা অত্যন্ত দুর্গম পথ পাড়ি দেবার জন্য খাবার এবং প্লাস্টিকের পানির বোতল সঙ্গে করে নিয়ে থাকেন এবং খাবারকে পানির স্পর্শ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায়ই পলিথিন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটকরা প্রায়ই সেসব ব্যবহৃত জিনিস বহন করে আবার নিয়ে আসতে আগ্রহ দেখান না এবং যত্রতত্র ফেলে নোংরা করেন জলপ্রপাতের নিকট-অঞ্চল। যা জলপ্রপাত এমনকি জঙ্গলের সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর।
পরিকুণ্ড জলপ্রপাত
অনেকেই হয়তো জানি না যে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের খুব কাছেই লুকিয়ে আছে আর এক বিস্ময়, একটি বুনো ঝরনাÑ পরিকুণ্ড জলপ্রপাত। সবুজে আবৃত আর পাহাড়ে ঘেরা এই জলপ্রপাতটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হতে মাত্র ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পথ। তার পরেই নীরবে-নিভৃতে ঝরে পরা এই দৃষ্টিনন্দন ঝরনাটি। তেমন কোন পর্যটক এখানে যায় না বলে ঝরনা এলাকাটি নীরবই থাকে সারা বছর। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে এর চারপাশ, যেন সবুজের মেলা বসেছে এখানে। আর ঝরনার ঝরে পড়ার শোঁ শোঁ শব্দ সে মেলাকে দিয়েছে ভিন্ন সুর। মধুর সে শব্দ আর পাখির কলতানই এখানে কেবল নিঃশব্দতার ঘুম ভাঙায়। প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু থেকে পাথরের খাড়া পাহাড় বেয়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে জলধারা নিচে আছড়ে পড়ছে। নিচে বিছানো পাথরের আঘাতে পানির জলকণা বাতাসে উড়ে উড়ে তৈরি করছে কুয়াশা। ঝিরি ঝিরি সে জলকণা চারপাশের পরিবেশকে যেমন শীতল করে তেমনি সিক্ত করে প্রকৃতিকে। ঝরনার পানি নিচে পড়ে ছোট বড় পাথরের ফাঁক গলিয়ে মিশে যাচ্ছে বড় একটি ছড়াতে গিয়ে।

নাফাখুম জলপ্রপাত
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি একটি মারমা অধ্যুষিত এলাকা। মারমা ভাষায় ‘খুম’ মানে হচ্ছে জলপ্রপাত। রেমাক্রি থেকে তিন ঘণ্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় আশ্চর্য সুন্দর এই জলপ্রপাতে, যার নাম ‘নাফাখুম’। রেমাক্রি খালের পানিপ্রবাহ এই নাফাখুমে এসে বাঁক খেয়ে হঠাৎ করেই প্রায় ২৫-৩০ ফুট নিচে পতিত হয়ে প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে চমৎকার এক জলপ্রপাত। সূর্যের আলোয় যেখানে নিত্য খেলা করে বর্ণিল রংধনু। আকাশে তৈরি হয় হাজার রঙের আলোকচ্ছটা। মেঘের আড়ালে যখন সূর্য হাসে আলোর সে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ে পুরো পাহাড়তলে। খরস্রোত নদীর জল সাঁই সাঁই করে ধেয়ে যায় কলকল শব্দে। ভয়ঙ্কর সে নদীর সৌন্দর্য যেন আরো ভয়ঙ্কর। যারা বিদেশের মাটিতে সুন্দরকে খুঁজে বেড়ান তাদের জন্য নাফাখুম চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ দেশে এমন সুন্দর থাকতে পারে তা বিশ্বাস করাই মুশকিল। পাহাড়, নদী আর পাথুরে খাল দেখে মনে হবে যেন কোনো এক ছবির পাতায় পাতায় হাঁটছি। অসাধারণ সুন্দর, অসহ্য সুন্দর। পানির গমগম করে ঝরে পড়ার শব্দে চারদিক মুখরিত। বর্ষার সময় এর আকার বড় হয়। আর শীতের দিনে তা ক্ষীণ হয়ে যায়। তবে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে নাফাখুমের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখা যায়। উপর থেকে আছড়ে পড়া পানির আঘাতে ঝরনার চারদিকে সৃষ্টি হয় ঘন কুয়াশার। উড়ে যাওয়া জলকণা বাষ্পের সাথে ভেসে ভেসে শরীরে এসে পড়ে। রোমাঞ্চকর সে অনুভূতি। একে বাংলার নায়াগ্রা বললেও ভুল বলা হবে না। দু’পাশের সবুজ পাহাড়ি বন আর পাথুরে ভূমি নাফাখুম ঝরনাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা, করেছে আরো আকর্ষণীয়। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে ছোপ ছোপ সবুজ ঘাসের থোকা সৌন্দর্যের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
তৈদুছড়া
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ছোট আকৃতির জলপ্রপাত দু’টির নাম তৈদুছড়া ঝরনা। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈদু’ মানে হলো ‘পানির দরজা’ আর ছড়া মানে ঝরনা। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতা এই ঝরনাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। খাগড়াছড়িতে যে কয়টি দর্শনীয় স্থান রয়েছে তৈদুছড়া তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানে পাহাড় আর সবুজ বুনো জঙ্গলের মাঝে আঁকা বাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে এর জলধারা। শীতল স্বচ্ছ টলমলে পানির কলকল করে ছুটে চলার শব্দে মুখরিত হয় চার পাশ। ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পড়ছে পাথুরে ভূমিতে। অন্য সকল ঝরনার মতো এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পড়ছে না। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো তৈরি হওয়া পাথুরে ধাপগুলো অতিক্রম করে নিচে পড়ছে।

তো কেমন শুনলে জলপ্রপাতগুলোর গল্প? শুনেই ওগুলো দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে? বেশ, সময়-সুযোগ পেলে খুব করে ঘুরে এসো। তবে সাবধান, ওই সব জলপ্রপাতে গিয়ে আবার গোসল করার বুদ্ধি করো না যেন। কেননা, পানি যেখানে পড়ে, সেখানে বেশ বড়ো রকমের একটা কুয়ার মতো গর্ত হয়ে যায়। আর সেই গর্তে কেউ যদি পড়ে যায়, তাহলে সেখান থেকে ফিরে আসা বেশ কঠিনই বটে। জলপ্রপাতে গোসল করতে চাইলে আমাদের দেশের জলপ্রপাতগুলোই ভালো। ওগুলো ছোট আকৃতির কি না! তবে হ্যাঁ, এখানেও কিন্তু ঐ গর্তের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেই হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ