ইঁদুর ও লোভী বুড়ো   -হুসনে মোবারক

ইঁদুর ও লোভী বুড়ো -হুসনে মোবারক

নাটিকা জুন ২০১৬

(অনেক অনেক দিন আগের একটি ঘটনা। থুরথুরে এক বুড়ো আর বুড়ি একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে খুবই কষ্টে দিন কাটাতো। খুবই অভাবী ছিল তারা। তিন বেলা ঠিকমতো খাবারও জুটতো না। একদিন বুড়ো লোকটা তাদের ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল।)
বুড়ো    :    বাহ্ এটা কী পড়ে আছে! কেমন সোনালি রঙের, ঝকঝকে, বুকটা সাদা! ভুট্টার দানা! হুম! দানাটি বেশ বড়সড়। ভালো করে দেখি একবার। বুঝেছি-
(বুড়ো লোকটা ভুট্টার দানাটি হাতে নিয়ে ইঁদুরের গর্তের কাছে গেল)
ইঁদুর বন্ধু! ইঁদুর বন্ধু! কোথায় তুমি! উপরে এসো.. তোমার জন্য মজার একটি খাবার এনেছি। খুবই মজার খাবার! ভুট্টাদানা! এই নাও..। আমার পেটে ক্ষুধা আছে তো, তাই আমি আরেকজনের ক্ষুধার কষ্টটাও বুঝতে পারি। বেশ বড়সড়। মজা করে খেতে পারবে। পেটও ভরবে। ইঁদুর বন্ধু! ইঁদুর বন্ধু..!
ইঁদুর-১    :    (ইঁদুরের গর্ত থেকে ছোট্ট কয়েকটি ইঁদুর বেরিয়ে এসে বুড়ো লোকটাকে বলল)
বন্ধু! তুমি তো প্রতিদিন আমার জন্য কোনো না কোনো খাবার দিয়ে যাও। একেবারে আমার বাড়ির দরজায়। এ জন্যই ইঁদুর রাজ্যের সবাই তোমাকে ভালোবাসে। তুমি যাবে আমাদের রাজ্যে।
ইঁদুর-২    :    আমরা কিন্তু ভাই তোমার বাড়ি পাহারা দেই। তোমার ঘরের চাল-ডাল, খাবার যাতে কেউ খেতে না পারে  সে জন্য আমরা খুব খেয়াল রাখি। কেউ এলে দল বেঁধে তাড়িয়ে দেই। শুধু ঐ বিড়ালটাকে একটু ভয় পাই। ম্যাও ম্যাও ডাকটা শুনলে কলজেটা কেঁপে ওঠে। ওরে বাপরে.. কেমন করে তাকিয়ে থাকে..!
ইঁদুর-৩    :    আমরা এসেছি ইঁদুরদের পক্ষ থেকে তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে... আর আমাদের দেশে তোমাকে আমন্ত্রণ জানাতে। আমাদের রাজাও তোমাকে অনেক পছন্দ করেন, ভালোবাসেন।
বুড়ো    :    সত্যিই! সত্যিই বলছো? তোমাদের রাজা আমাকে খুব ভালোবাসেন? সত্যিই আমি আজ ভীষণ খুশি! অনেক খুশি! ধন্যবাদ ইঁদুর বন্ধুরা, ধন্যবাদ। কিন্তু কিভাবে আমি তোমাদের দেশে যাবো?
ইঁদুর-৩    :    তুমি যদি তোমার চোখ দুটো বন্ধ করো, তাহলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইঁদুরদের দেশে চলে যাবে।
(বুড়ো চোখ বন্ধ করতে না করতেই ইঁদুরদের চেঁচামেচি শুনতে পেল। চোখ খুলতেই বুড়ো তো হতবাক হয়ে গেল!)
বুড়ো    :    সত্যিই অবাক ব্যাপার! বাহ! ফুলে ফুলে ভরপুর কী চমৎকার বাগান! এতো সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বাগান আমি জীবনেও দেখিনি!
অ্যা.. আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
বাহ! কী সুন্দর প্রাসাদ! উনি কে? ইঁদুরদের বাদশাহ হবেন।
ইঁদুরের বাদশা    :    ইঁদুর রাজ্যে তোমাকে স্বাগতম! তুমি বুড়ো মানুষ। একজন গরিব মানুষ। তারপরও ইঁদুরদের প্রতি যে দয়া তুমি দেখিয়েছ, সেই দয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ বুড়ো।
বুড়ো    :    আমাকে তোমাদের রাজ্যে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ! তবে একটা কথা, আমাকে বুড়ো বলবে না। আমার বয়স মাত্র সত্তর বছর তিন মাস। এই বয়সেও আমি নিজের হাতে সব কাজ করি।
ইঁদুরের বাদশাহ    :    দুঃখিত বন্ধু! সত্যিই তো! নিজের কাজ যে নিজে করে সেতো বুড়ো হত পারে না! আমাকে মাফ করে দাও বন্ধু! তবে! তুমি কিন্তু আজ সারাদিন আমাদের সাথে কাটাবে। তোমার যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াবে।
বুড়ো    :    ধন্যবাদ বন্ধু! আমি তোমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম।
(রাত। বুড়োর ফেরার সময় হয়ে  গেল।)
ইঁদুরের বাদশাহ    :    বন্ধু ! এটা হচ্ছে আমাদের পক্ষ থেকে তোমাকে উপহার। তবে একটা অনুরোধ। বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত থলিটির মুখ খুলবে না।
(এরপর বুড়ো চোখ বন্ধ করল আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কানে শুনতে পেল বুড়ির কথা। বুড়ো খুশিতে চোখ মেলে দেখল তার কুঁড়েঘরে এসে গেছে সে।)
বুড়ো    :    জানো! খুবই আনন্দের একটি সংবাদ আছে! অ্যাই দ্যাখো, এই থলের মধ্যে কী চমৎকার মুক্তা! এগুলো আমি উপহার পেয়েছি।
বুড়ি    :    অবাক ব্যাপার তো! কোত্থেকে পেলে? কী সুন্দর! আমাকে দাও আমি এই মুক্তাগুলো সবাইকে দেখিয়ে আসি। আমরা আর গরিব থাকবো না গো!
বুড়ো    :    অ্যাই খবরদার! একদুম চুপ! এই খবর কাউকে জানানো যাবে না।
বুড়ি    :    কী বলছো? এত বড় একটা সুসংবাদ, কাউকে না জানালে হয়?
(বুড়ো-বুড়ির চেঁচামেচিতে পাশের বাড়ির এক ধনী লোক বিষয়টি জেনে যায়। লোকটি তাদের ঘরের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। এবং পুরো ঘটনা সে শুনে ফেলে)
প্রতিবেশী বুড়ো    :    ঐ লোকটা  তো এখন আমার চেয়ে ধনী হয়ে যাবে। সবার সাথে তার সম্পদের বাহাদুরি। আমাকে সে এখন আর পাত্তাই দেবে না। আমিও ছাড়বো না। যে করেই হোক ঐ ইঁদুরের বাড়ি যেতেই হবে। গরিব বোকাটা আর কয়টা মুক্তা এনেছে। একবার যেতে পারলেই হয় ইঁদুর রাজ্যে। সব মুক্তা বস্তা ভরে নিয়ে আসবো। আমিই হবো সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী।
বুড়ো    :    বললাম তো, এই কথা বেশি জানাজানি করো না।
বুড়ি    :    তুমি আরেকবার যাও না গো। মাত্র দুই টুকরো মুক্তা দিলো তোমাকে। ইঁদুরের রাজা আসলেই একটা কিপ্টে লোক। না হয় মাত্র দুই টুকরো মুক্তা কেউ কাইকে উপহার দেয়।
বুড়ো    :    আহা চুপ করো।
বুড়ি    :    এই এর পরেরবার যখন তুমি যাবে তখন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেও। থলে ভরে মুক্তা নিয়ে আসবো। আমি তোমার মত এতো বোকা নই।
প্রতিবেশী বুড়ো    :    ভাই কিছু মনে করো না। তোমরা আমার প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও একদিনও তোমাদের খবর নেইনি। কি নিষ্ঠুর আমি! আমাকে মাফ করে দিও। যাই হোক এই নাও। এখানে কিছু খাবার আছে। তোমাদের জন্য। শুধু তোমাদের জন্যই না, ইঁদুরের জন্যও এনেছি। এই এক ব্যাগ আমি নিজ হাতে ইঁদুরকে নিজ হাতে খাওয়াতে চাই। আহারে! তুমি গরিব মানুষ! তোমার কুঁড়েঘরেই শুধু ইঁদুর আর ইঁদুর। আমার বাড়িতে যদি আসতো পেট পুরে খাওয়াতে পারতাম।
বুড়ি    :    বসুন বসুন। আপনি কষ্ট করে আমাদের ঘরে এসেছেন। আপনি নিজ হাতে ইঁদুরদের ভুট্টা খেতে দিন।
প্রতিবেশী বুড়ো    :    ধন্যবাদ ধন্যবাদ! শুধু আপনিই কেবল আমার দুঃখটা বুঝতে পেরেছেন।
এই নাও ইঁদুর বাবাজি! পেট ভরে খাও! খাও খাও! শুধু একটা অনুরোধ। আমি তোমাদের দেশে যেতে চাই। তোমাদের রাজাকে নিজ হাতে ভুট্টা খাওয়াতে চাই। দোহাই তোমাদের, শুধু আমার একটা অনুরোধ রাখো।
ইঁদুর-৪    :    ঠিক আছে। তোমাকেও আমাদের রাজ্যে নিয়ে যাবো। আগে চোখ বন্ধ করো।
প্রতিবেশী বুড়ো    :    এই যে আমি চোখ বন্ধ করলাম।
(ইঁদুরদের শব্দ শুনে চোখ মেলতেই চমৎকার সেই রাজ্যটি  দেখতে পেল। কিন্তু বুড়োর সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। কেবল অপেক্ষায় ছিল কখন দিন শেষ হবে...রাত আসবে আর মূল্যবান উপহার-মুক্তাগুলো পাবে।)
ইঁদুরের বাদশাহ    :    আমাদের রাজ্যে স্বাগতম হে পৃথিবীর মানুষ! তুমি চাইলে আমাদের সারা রাজ্য ঘুরে দেখতে পারো। আশা করি আমাদের রাজ্য তোমার ভালো লাগবে।
প্রতিবেশী বুড়ো    :    ইয়ে একটু তাড়াতাড়ি করুন, আমার হাতে একদম সময় নেই, যদি কোনো উপহার থাকে, দিয়ে দেন আমি চলে যাই। ঘুরাঘুরির সময় আমার নেই।
(এ কথা বলে বুড়ো লোকটা বাদশাহর দিকে তাকাল। সে দেখল তার পাশে বড় একটা পাত্রে মুক্তা  ভর্তি করা। চোখ ধাঁধিয়ে গেল বুড়োর। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। হঠাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি খাটালো বুড়ো। বেড়ালের মতো করে ডাক দিতে শুরু করে দিলো সে।)
ম্যাও ম্যাও.. ম্যাও ম্যাও..। ম্যাও ম্যাও.. ম্যাও ম্যাও..।
ইঁদুরের বাদশাহ    :    পালাও, পালাও সবাই! পালাও, পালাও!
প্রতিবেশী বুড়ো    :    এই তো সব বেটা পালিয়েছে। এবার সকল মুক্তা আমার। কী ব্যাপার আলো কোথায়? একবারে অন্ধকার হয়ে গেল যে।
ইঁদুরগুলো চলে যাবার সাথে সাথে রাজ্যের সব আলো চলে গেল যে। পাখিদের ডাকাডাকিও তো বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে কেমন নিঃসীম অন্ধকার।
অদ্ভুত ব্যাপার! যেই পাত্রে এতো উজ্জ্বল মুক্তাগুলো ছিল, ওই পাত্র থেকে মুক্তাগুলোও উধাও হয়ে গেল। আমার আশাই পূরণ হলো না, বুদ্ধিটাও বিফলে গেল। শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ঘরে ফিরে যেতে হবে।
কিন্তু কিভাবে যাবো! ইঁদুরগুলো যেহেতু পালিয়ে গেছে তাই আমাকে আর পথ দেখিয়ে কে নিয়ে যাবে? কে চোখ বুজলেই জাদুর মতো বাড়িতে পৌঁছে দেবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে?
কাজটা আমি ঠিক করিনি। আমার লোভের কারণেই আজ আমার এই পরিণতি।  অন্ধকারের মাঝে কিভাবে আমি বাড়ি যাবো।
আমাকে সাহায্য করার মতো একটি ইঁদুরকেও তো দেখতে পাচ্ছি না। মুক্তার অতিরিক্ত লোভে এখন আমার জীবনটাই হারাতে হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ