ইঁদুরের লোহা ভোজ -সাদমান সাদী
নাটিকা সেপ্টেম্বর ২০১৬
(এক ব্যবসায়ী দেশে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে বেড়াতো। প্রায়ই তাকে সফরে থাকতে হতো। একদিন এ রকম এক অজানা দেশে সফরে যাবার আগে ওই ব্যবসায়ী ভীষণ চিন্তায় পড়লো) ব্যবসায়ী : পথে যদি তার মালামাল চোর ডাকাত লুট করে নিয়ে যায়- তাহলে তো তাকে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। তা ছাড়া এই সফরে কত দীর্ঘ সময় লাগতে পারে জানি না। কী করা যায়। পয়সাপাতি যা আছে সেগুলো কোনো বন্ধুর কাছে রেখে গেলে কেমন হয়...। কিন্তু, কারো হাতে আস্ত টাকা রেখে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না...যদি ভেঙে ফেলে কিংবা যদি কোনো বাহানায় ফেরত না দেয়...! এক কাজ করি, লোহা! কিছু লোহা কিনবো। লোহা বেশ ভারি! চাইলেই হুট করে কোনো চোর এসে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। লোহা ক্ষয়েও যাবে না, নষ্টও হবে না। আগুনেও পুড়বে না, ভেঙেও যাবে না, পুরনোও হবে না। যখন ফিরে আসবো, লোহাটা আবার বিক্রি করে দিলেই টাকা হয়ে যাবে। বাহ! এই বুদ্ধিটা তো আগে আসেনি। (তিনশ কেজি লোহা কিনে রেখে গেল তার এক বন্ধুর কাছে।) বন্ধু : দ্যাখ, তুমি আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু বলেই তোমার এই লোহার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। না হয় কত কাজ আমার পড়ে আছে। তোমার লোহা দেখার সময় আমার কই! ব্যবসায়ী : ধন্যবাদ! এই শহরে তুমিই আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কাছের বন্ধু। সুতরাং তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। তা ছাড়া আমি কখন ফিরে আসবো তারও কোনো ঠিক নেই। এক বছরও লাগতে পারে, আবার দুই বছরও লাগতে পারে। আমার বন্ধু হিসেবে তোমার কাছে আমার লোহাগুলো থাকলে বরং আমি নিশ্চিন্তই থাকবো। বন্ধু : তুমি চিন্তা করো বন্ধু, এটা আমার কাছে আমানত। তুমি যখন চাইবে তখনই ফেরত পাবে। ব্যবসায়ী : নিশ্চিন্ত হলাম। এখন আমি উঠি। দোয়া করো যেন ভালোয় ভালোয় ফিরতে পারি। বন্ধু : ভালা থাকো! নিরাপদে ফিরে এসো। এরপর প্রায় এক বছর কেটে গেল। সফর শেষে দেশে ফিরে গেল বন্ধুর বাড়ি) ব্যবসায়ী : কেমন আছ? নিশ্চয়ই তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আসলেই বন্ধু বলেই তোমাকে এই কষ্টটা করতে হলো। শুনেছি লোহার দাম ব্যাপক বেড়ে গেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার কাছ থেকে লোহাগুলো বুঝে নিয়ে বিক্রি করে দেবো। বন্ধু, এবার আমার লোহাগুলো ফেরত দাও। এ সময় পুরনো বন্ধু কোনো কথা না বলে ব্যবসায়ীকে নিয়ে গেল গুদামে, যেখানে লোহাগুলো রেখে গিয়েছিল।) বন্ধু : এখানেই তোমার লোহাগুলো ছিল, কিন্তু.. এখন..। ব্যবসায়ী : এখানে তো কিছুই দেখছি না, লোহাগুলো কোথায়? বন্ধু বলল : কী আর বলব দোস্ত! আমি তো এই গুদাম ঘরেই তোমার লোহাগুলো রেখে তালা দিয়ে রেখেছিলাম, তুমিও তা দেখে গেছ। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো- তুমি সফরে যাবার কয়েক মাস পর আমি গুদামের দরোজা খুলে দেখতে চাইলাম সব ঠিকমতো আছে কি না; দরোজা খুলে তো আমি অবাক হয়ে গেলাম। ব্যবসায়ী : কেন, কী হয়েছিল! বন্ধু : কী আর হবে, দেখলাম ইঁদুরের দল লোহাগুলো সব খেয়ে ফেলেছে। আমি দুঃখিত, তোমাকে এই অশুভ সংবাদটি দেয়ার জন্য। জানি না এখন কী করব! ব্যবসায়ী : কিন্তু এতো অবিশ্বাস্য ঘটনা! কী করে সম্ভব! বন্ধু : আমিও কি বিশ্বাস করতাম! যদি না নিজের চোখে দেখতাম! ব্যবসায়ী : (রাগে কটমট করে) এগুলো সবই তোমার সাজানো নাটক। বন্ধু : কিছু বলছো বন্ধু? ব্যবসায়ী : না না কিছু না..। বন্ধু : আমি এখন কী করবো? তোমাকে এর দেনা পরিশোধ করবো এমন কিছুই তো আমার কাছে নেই? (হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো) ব্যবসায়ী : আরে দোস্ত! তোমার আর কী দোষ। আমিও শুনেছি ইঁদুরেরা লোহা পেলে খেয়ে ফেলে। ভীষণ ভালোবাসে লোহা। ওরা লোহার স্তূপ পেয়ে দলবল নিয়ে এসে খেয়ে ফেলেছে, তুমি তো আর জানতে না। তালা মারা ছিল, দেখবে কিভাবে। এটা কোনো ব্যাপার না। বাদ দাও! (এই বলে ব্যবসায়ী লোকটি বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।) বন্ধু : (আনমনে) কী বোকা ব্যবসায়ী রে বাবা! আমার বানানো ইঁদুরের গল্প কত সহজেই না বিশ্বাস করে ফেললো! বোকা কোথাকার! দোস্ত! এখন যেও না। বস, দুই বন্ধু একসাথে রাতের খাবার খাবো আর গল্পগুজব করব। ব্যবসায়ী : দাওয়াতের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। জানো তো, মাত্র বিদেশ থেকে এলাম। হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। আজ নয়। বরং কাল দুপুরে দেখি আসতে পারি কি না দেখি। বন্ধু : পারি কিনা না বলা যাবে না, কাল অবশ্যই আসবে। ব্যবসায়ী বেরিয়ে গেল। পরদিন ব্যবসায়ী তার কথামতো বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গেল। গিয়ে দেখে বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ- অস্থির, পেরেশান।) বন্ধু : (ব্যবসায়ীকে দেখেই সে কান্নার স্বরে বলল) আমার ছেলেটা গতকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না, হারিয়ে গেছে। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, কোনো হদিস পেলাম না। আমাকে ক্ষমা কর দোস্ত, বুঝতেই তো পারছো আজ মেহমানদারি করার মতো অবস্থা নেই আমার। ব্যবসায়ী : তোমার ছেলে? কালো রঙের জুতা আর সাদা প্যান্ট পরা ছিল? বন্ধু : হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালো জুতা সাদা প্যান্ট... কোথায় দেখেছো? ব্যবসায়ী : কাল তোমার বাসা থেকে বেরুবার সময় দেখলাম একটা কালো কাক আকাশে উড়ে যাচ্ছে। তার পায়ের নখে ঠিক ওইরকম একটা ছেলে ঝুলন্ত ছিল। বন্ধু : (চিৎকার করে বলে উঠল) এই পাগল, বোকা কোথাকার! মশকরা করছো, না? মিথ্যা কথা বলার আর জায়গা পাওনি। একটা দুই কেজি ওজনের কাক দশ কেজির বেশি ওজনের একটা ছেলেকে পায়ের নখে নিয়ে উড়ে যেতে পারে, না? ফাজিল কোথাকার! ব্যবসায়ী : আমার তো মনে হয় না অসম্ভব। কারণ যেই শহরে একটা ছোট্ট ইঁদুর তিন শ’ কেজি লোহা খেয়ে ফেলতে পারে, সেই শহরের কাক সামান্য দশ কেজি ওজনের একটা বাচ্চাকে নিয়ে উড়ে যেতে পারবে না কেন? বন্ধু : এ্যা..কি বলছো তুমি! বুঝতে পেরেছি দোস্ত! সব বুঝতে পেরেছি এখন। আসলে ইঁদুর তোমার লোহাগুলো খায়নি। আমি একটু মজা করলাম আর কি। ওটা আমার বানানো একটা গল্প ছিল। যাও! আমার ছেলেকে নিয়ে এসো, আর তোমার আমানত লোহাগুলো নিয়ে যাও। ব্যবসায়ী : আমি আমার কাজের জন্য অনুতপ্ত। তোমার ছেলেকে আমার বাড়িতে রেখে তোমাদের কষ্ট দিয়েছি ঠিকই, তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার লোহা ফিরে পাওয়া। আমার কাজের চেয়ে তোমার কাজ ছিল অনেক বেশি জঘন্য। কারণ তুমি আমার সঙ্গে খেয়ানত করতে চেয়েছিল, আমার হক মেরে দিতে চেয়েছিল। আশা করি আর কখনো এ রকম কাজ বরবে না। (ব্যবসায়ীর কথায় বন্ধুটির চোখে পানি চলে এলো। লজ্জা এবং ক্ষমার দৃষ্টিতে সে ব্যবসায়ীর দিকে তাকালো।)
আরও পড়ুন...