ইচ্ছা পূরণ - জাহেদুল ইসলাম

ইচ্ছা পূরণ - জাহেদুল ইসলাম

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০২০

পরিবারের বড় ছেলে আব্দুল করিম। তিন ছোট ভাই-বোনকে রেখে মাঝবয়সী পিতা এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর সময় আব্দুল করিম ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া এক কিশোর। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে ভালো একজন ডাক্তার হবে যেন মানুষের সেবা করতে পারে। কারণ, তার চোখের সামনেই চিকিৎসার অভাবে তিলে তিলে মারা গিয়েছিল তার দাদী। তাই সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ডাক্তার হবে যাতে তার দাদীর মতো আর কোনো মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় আব্দুল করিমকে। এই দায়িত্ব নিতে গিয়ে তাকে ছাড়তে হয় স্কুলের ক্লাসরুম, ভুলে যেতে হয় তার স্বপ্নকেও। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে যায় আব্দুল করিম। কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর অবশেষে পার্শ্ববর্তী লালমিয়া কাকুর মুদির দোকানে তার একটা কাজ মিলে। স্বল্প পরিমাণ বেতন ঠিক করে কাজ শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যেই লালমিয়া কাকুর আস্থা কুড়াতে সক্ষম হন আব্দুল করিম। তারপর থেকে আব্দুল করিমের বেতন বৃদ্ধি পায়। বেতনের টাকাগুলো পাঠাতে লাগলো বাড়িতে মায়ের কাছে। সংসার চালানোর পাশাপাশি ছোট ভাইকে পড়াশোনা করে মানুষের মত মানুষ করা আর দুই বোনকে সম্মানের সাথে বিয়ে দেয়ার চিন্তা মাথায় নিয়ে আব্দুল করিম সময় পার করতে লাগলো।

লাবলু। আব্দুল করিমের ছোট ভাই। দুই ভাইকে একসাথে দেখলে আব্দুল করিমকে বড় ভাই বলে কেউ ভাববে না। মেলা চিন্তাভাবনা, কঠোর পরিশ্রম আব্দুল করিমের শরীরকে বেড়ে উঠতে দেয়নি। ছোট ভাই-বোনদের দিকে তাকিয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। কিন্তু যে চিন্তা ভাবনা নিয়ে আব্দুল করিম সব সুখ-শান্তি ত্যাগ করেছিলেন তা আজ নিষ্ফল হয়ে গেছে। লাবলুকে কখনো কোনো কষ্ট বুঝতে দেয়নি আব্দুল করিম। সে নিজের ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছাটা ভাইকে দিয়ে পূরণ করাতে চেয়েছিল। লাবলু মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিল বটে, কিন্তু সে ডাক্তারি শেষ করার পূর্বেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যায়। লাবলুর চলে যাওয়াটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। এ রকম একটা ভদ্র ছেলে সমাজে পাওয়াটা খুবই দুষ্কর। বড়জনদের সম্মান করতে ভুলে যাওয়া এই সমাজে লাবলুরা যেন একেকটি মডেল। মেডিক্যাল পড়ুয়া একটা ছেলে কখনো কারো সাথে বড় করে কথা পর্যন্ত বলেনি। এমন ছেলেটার বিদায়ে গোটা এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।

এ ঘটনাটির পর কয়েকবার স্ট্রোক করছে আব্দুল করিম। নিজের আদরের ছোট ভাইকে হারিয়ে আব্দুল করিম যেন দ্বিতীয় বারের মতো আবার এতিম হয়ে গেছে। কোনোভাবেই লাবলুর বিদায় মেনে নিতে পারছে না। সেদিন সে নতুন করে আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের ছেলেকে ডাক্তার বানিয়ে সে তার ইচ্ছা পূরণ করবেই। অতীতের সব কিছু ভুলে গিয়ে নতুন করে কাজ শুরু করেছে আব্দুল করিম। বৃদ্ধ মায়ের সেবা করার পাশাপাশি নিজের ছেলে রাহুলকে একজন মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টায় রত। সে একজন ডাক্তার হয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করার পাশাপাশি ভালো নৈতিক চরিত্রবান একজন মানুষ হিসেবেও গড়ে উঠবে। এটাই তার ইচ্ছা। তাই নিজের কাছে থাকুক বা না থাকুক ছেলের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য সব সময় চেষ্টা করতেন আব্দুল করিম। রাহুলও তার বাবার অবস্থা বুঝতো। নিজের ভাইকে ডাক্তার বানাতে না পারা এবং অল্প বয়সে ছোট ভাইকে মানুষ করতে না পারার বেদনা তাকে এখনো নাড়া দেয়। তাই রাহুল বাবার ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করত। বাবা কষ্ট পায় এমন কাজ থেকে বিরত থাকত। সর্বদা পড়াশোনা নিয়ে লেগে থাকত। এভাবেই তার ছাত্রজীবন পার করতে লাগলো। অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাহুল দেশের নামকরা একটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি শেষ করে তার বাবার ইচ্ছা পূরণ করলো। এখন আব্দুল করিম অনেক খুশি। তার ছেলে ডাক্তারি পাস করেছে। এখন তার মায়ের মতো আর কাউকে চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে হবে না। তাই, ছেলের প্রতি আব্দুল করিমের এখন একটাই উপদেশ মাত্র। সে যেন নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। গ্রামে-গঞ্জ থেকে যেসব দরিদ্র, বৃদ্ধ মানুষ চিকিৎসার জন্য আসে, তাদের প্রতি যেন খেয়াল রাখে। তার দাদীর মত আর কোন আদম সন্তান যেন চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। রাহুল তার বাবার এই উপদেশ শুনে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার মহান ব্রতী নিয়ে পথ চলা শুরু করলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ