ইমাম আবু দাউদ রহ:

ইমাম আবু দাউদ রহ:

স্মরণ এপ্রিল ২০১৪

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

Abu-dawodআশা করি তোমরা ইমাম আবু দাউদ রহ:-এর নাম শুনেছো। হাদিসশাস্ত্রের সুবিশাল পরিমণ্ডলে তিনি এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি স্বীয় মহিমা ও স্বকীয়তায় সবিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। হাদিস সঙ্কলন ও গবেষণার ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের পরেই হাদিস বিশারদগণ তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন। ইলমে হাদিসে তার অবদান চিরদিন অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে। সাইয়্যিদুল হুফফাজ ইমাম আবু দাউদের আসল নাম সুলাইমান, উপনাম আবু দাউদ। তাঁর পিতার নাম আশয়াস। এ জন্য তার আসল নাম আল ইমাম আল হাফিজ আল হুজ্জাত আসসাবত সুলাইমান ইবনুল আশয়াস ইবনে ইসহাক ইবনে বশির ইবনে সাদ্দাদ ইবনে আমর ইবনে ইমরান আল আসাদি আল সিজিস্তানি। তাঁর বংশের পঞ্চম ঊর্ধ্বতন পুরুষ হযরত আমর ইবনুল ইমরান সিফফিন হযরত আলী (রা.)-এর পক্ষে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। ২০২ হিজরি মোতাবেক ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এ কারণে ইতিহাসে তিনি আবু দাউদ আস সিজিস্তানি নামে প্রসিদ্ধ। তবে এই সিজিস্তানের অবস্থান সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। আল্লামা জাহাবির মতে মারকান ও সিন্ধের পাশে হিরাতের পশ্চাৎভূমিতে যে সিজিস্তান অবস্থিত সেখানেই ইমাম আবু দাউদ জন্মগ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন, এই সিজিস্তান বসরার একটি গ্রামের নাম। আবার কেউ কেউ একে কান্দাহার ও চিশতের নিকটবর্তী একটি স্থান বলে উল্লেখ করেছেন। এই মতানুসারে তিনি নির্ভেজাল আরবি আযদি বা আসাদ গোত্রের সন্তান। তিনি যেখানেই জন্মগ্র্রহণ করুন না কেন ইবনে আসাকির ও অন্যদের মতে তিনি হিরাতে জীবনের এক পর্যায়ে বসবাস করেছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি তীক্ষè মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি মাতৃভূমির সিজিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর হাদিস শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। ইমাম আবু দাউদ জীবনের এক বিরাট অংশ জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যয় করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দূর-দূরান্ত ভ্রমণ করেন। দামেস্ক, মিসর, কুফা, সারব, ইসফাহান, বাগদাদ, খুরাসান প্রভৃতি স্থানে যেয়ে সেখানকার আলেম, মুহাদ্দিস ও ফকিহদের নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। একাধিকবার তিনি বাগদাদ গিয়েছিলেন। অবশেষে স্থায়ী আবাস হিসেবে তিনি বসরাকে বেছে নেন। ইমাম আবু দাউদের প্রখ্যাত কয়েকজন শিক্ষক হচ্ছেন মক্কায় আবু উমার আল দারির, মুসলিম ইবন ইবরাহিম, আল কা’নাবী প্রমুখের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। এ ছাড়াও তাঁর আরো কয়েকজন শিক্ষক হচ্ছেন আবদুল্লাহ ইবনে রাজা, আবুল ওয়ালিদ আততায়ালিসি, আহমদ ইবনে ইউনুস, আবু জাফর আন নফাইলি, আবু তাওবাহ আল জালাবি, সুলাইমান ইবনে হারব, আবদুল্লাহ ইবনে মাসলামা মুসাদ্দাদা ইবনে মুসারহাদ, মুসা ইবনে ইসমাইল, কুতাইবা ইবনে সাইদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হাজার আসকালানির মতে, তাঁর শিক্ষকের সংখ্যা তিন শতাধিক। খতিব আত তিবরিযি বলেন, তিনি অগণিত শিক্ষকের নিকট থেকে বিদ্যা অর্জন করেন। ইসহাক আস- শিরাযি তাবাকবুল ফুকাহা গ্রন্থে আবু দাউদকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের শাগরিদ বলে উল্লেখ করেছেন। হযরত ইমাম আবু দাউদের অসংখ্য ছাত্রের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজনÑ ইমাম তিরমিযী, ইমাম নাসায়ী, পুত্র আবু বকর ইবনে আবু দাউদ, আবু আওয়ানা, আবু বিশর আল দাওলাবি, আলী ইবনে আল হাসান, আবু উসামা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল মালিক, আবু সাঈদ ইবনুল আরাবি, আবু আলি আল লুলুয়াবি, আবু বকর ইবনে দাসসাহ, আবু সালেম মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আল জালুদি ও আবু আমর আহমাদ বিন আলি। শেষোক্ত সাতজন আবু দাউদের মুখ থেকে সরাসরি তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থখানি শোনেন। তাঁর পুত্র আবু বকর ইবনে আবি দাউদ ছিলেন তৎকালীন বাগদাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ, আলেম ও ইমাম। কিতাবুল মাসবিহ নামে তাঁর একখানি হাদিসগ্রন্থ আছে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু দাউদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ‘কিতাবুস সুনান’ নামক হাদিস গ্রন্থখানি। এটি ‘সিহাস সিত্তাহ’ বা ছয়খানি বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থের অন্যতম। বিশ্বের সর্বযুগের হাদিস শাস্ত্রবিদেরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রন্থখানি গ্রহণ করেছেন। অতীতের ন্যায় বর্তমানেও এ গ্রন্থের ওপর সমভাবে নির্ভর করা হচ্ছে। সুন্নাহর ভিত্তি যে গ্রন্থগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে আবু দাউদের সুনান গ্রন্থটির স্থান তৃতীয় বা চতুর্থ। এতে হাদিসের বিন্যাসপদ্ধতি অতি চমৎকার। এতে বর্ণিত হাদিসে কোনো মাসয়ালা উদ্ভাবিত হলে তিনি তা অধ্যায়ের শিরোনামে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে মাখলাদ বলেন, মুহাদ্দিসগণ বিনাবাক্য ব্যয়ে এই গ্রন্থখানি মেনে নিয়েছেন। সহীহ মুসলিম ভাষ্যকার ইমাম নববী বলেন, ফিকাহশাস্ত্র ও অন্যান্য বিষয়ের সাথে যারা জড়িত তাদের গভীরভাবে আবু দাউদের সুনান অধ্যয়ন ও গ্রন্থখানি প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা উচিত। কারণ আহকাম বা বিধিবিধানবিষয়ক হাদিসসমূহের অধিকাংশ যেগুলো দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয় তা এ গ্রন্থে এমন সুশৃঙ্খলভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যে, সেগুলো খুব সহজেই পাওয়া যায়। তার বিশুদ্ধতা স্বীকার করে হাফিজ আবু ইয়ালা আল খলিলি (মৃত্যু ৪৪৬ হিজরি) বলেন, তাঁর এ গ্রন্থটি বুখারী, মুসলিম এবং নাসায়ী এর তুলনায় অধিক হাদিস সংবলিত গ্রন্থ। হাদিস সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর অনুসৃত নীতির ওপর নির্ভর করা হয়। এটি সুনান গ্রন্থরাজির মধ্যে এক অনবদ্য গ্রন্থ। ৪৮০০ হাদিসের এই গ্রন্থে সর্বমোট ৩১টি কিতাব, ৬২৯টি অধ্যায় এবং ৫৮০টি পৃষ্ঠা আছে। বিভিন্ন যুগের পণ্ডিতরা ইমাম আবু দাউদের মেধা ও মনীষার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর তীক্ষè স্মরণশক্তির প্রশংসা সকলে করেছেন। হাফেজ আবু হাকেম আবদুল্লাহ বলেন, আবু দাউদ ছিলেন তাঁর যুগের হাদিস শাস্ত্রবিশারদদের অবিসংবাদিত ইমাম বা নেতা। অন্য একজন মনীষী মূসা ইবনে হারুন বলেন, ‘আবু দাউদকে দুনিয়ায় হাদিসের জন্য এবং আখেরাতে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আমি তাঁর থেকে উত্তম কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি।’ ইলমে হাদিসের এ মহান সেবক ২৭৫ হিজরির ১৬ শাওয়াল ৭৩ বছর বয়সে বসরা নগরে ইন্তেকাল করেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ