ইমাম তিরমিজি (রহ)

ইমাম তিরমিজি (রহ)

স্মরণ জানুয়ারি ২০১৪

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

Tirmiziইমাম তিরমিজির প্রকৃত নাম মুহাম্মদ, উপাধি আবু ঈসা, কুনিয়াত আল ইমাম। পিতার নাম ঈসা, নিসবতি নাম তিরমিজি। পূর্ণনাম ইমামুল হাফেজ আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সাওরাহ ইবনে মুসা ইবনে দাহহাক আল সুলামি আল বুগি আল তিরমিজি। তিনি জিহুন নদীর বেলাভূমে অবস্থিত উজবেকিস্তানের তিরমিজ নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরি সনে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান শহরের দিকে সম্বন্ধ করেই তাঁকে তিরমিজি বলা হয়। তিরমিজ শহর যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও প্রখ্যাত ওলামায়ে কেরামের জন্মগ্রহণের কারণে শহরটি ‘মদিনাতুর রিজাল’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জন্মের পর তিনি নিজ গৃহেই পিতা-মাতার স্নেহমমতায় লালিত পালিত হন। নিজ গৃহেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার্থে তদানীন্তন মুসলিম বিশ্বের বড় বড় জ্ঞানকেন্দ্রে গমন করেন। অতি অল্প বয়স থেকেই তিনি হাদিস অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। হাদিস সংগ্রহে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদিস কেন্দ্রসমূহ সফর করে তিনি হাদিস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। কুফা, বসরা, রাই, বাগদাদ, খুরাসান, ওয়াসিত ও হিজাজে গমন করে তিনি হাদিস অধ্যয়ন, শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। হাদিস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বছরের পর বছর ভ্রমণ করেন। ইমাম তিরমিজি তাঁর সময়কার বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদিস শ্রবণ ও গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় এক হাজার হাদিসের উস্তাদ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেন। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন ইমাম বুখারী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, ইমাম আবু দাউদ সিজিস্তানি, ইমাম আহমদ, মুহাম্মদ ইবনে গিলান, আলি ইবনে হাজার, কুতাইবা ইবন সায়িদ, ইসহাক ইবনে মুসা, সায়িদ ইবনে আবদুর রহমান, মাহমুদ ইবনে গিলান, মুহাম্মদ ইবনে বিশ্বার, আহমদ ইবনে মুনি, মুহাম্মদ ইবন মাসান্না, সুফিয়ান ইবনে তকি প্রমুখ। ইমাম তিরমিজির দরসে হাজার হাজার জ্ঞানপিপাসু উপস্থিত হতেন। এক বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম তিরমিজি (রহ)-এর নিকট ৯০ হাজার মুহাদ্দিস তিরমিজি শরীফ শ্রবণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন : মুহাম্মদ ইবনে সাহর, আহমদ ইবনে ইউসুফ আন নাসাফি, দাউদ ইবনে নসর আল বায়দভি, মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ, আবু হামেদ আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ মারুফি, মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ প্রমুখ। ইমাম তিরমিজি অসামান্য স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। কোনো হাদিস একবার শুনলে দ্বিতীয়বার শোনার প্রয়োজন হতো না। সাথে সাথে হাদিসটি তার স্মৃতিপটে গেঁথে যেত। আবু সাইদ ইদরিস বলেন, ইমাম তিরমিজির স্মরণশক্তি সম্পর্কে একটি ঘটনা আছে। একদা তাঁর বাসনা জাগল যে, তিনি এমন একজন মুহাদ্দিস থেকে হাদিস শুনবেন, যার সাথে ইতঃপূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেনি। এরপর তিনি তেমনি একজন মুহাদ্দিসের খেদমতে হাজির হন। অতঃপর বিশেষ অনুরোধ করে ঐ মুহাদ্দিস অনেক হাদিস মুখস্থ পাঠ করেন। এসব হাদিস শ্রবণ মাত্রই তাঁর মুখস্থ হয়ে যায়। এটি দেখে উক্ত মুহাদ্দিস বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাঁর মেধা পরীক্ষার জন্য তিনি আরো ৪০টি হাদিস পাঠ করেন। এগুলো সাথে সাথে ইমাম তিরমিজির মুখস্থ হয়ে যায় এবং পুনরায় সেগুলোও উস্তাদকে শুনিয়ে দেন। এমনই ছিল তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয়। অসাধারণ মেধাশক্তির জন্য ইমাম বুখারী (রহ) তাঁর সম্পর্কে অনেক প্রশংসাসূচক কথা বলতেন। ইমাম তিরমিজির সঙ্কলিত বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ জামে তিরমিজি নামে খ্যাত। এর অপর নাম সুনান। ইমাম তিরমিজি তাঁর এ গ্রন্থ প্রণয়ন সমাপ্ত করে তদানীন্তন মুসলিম জাহানের হাদিসবিদদের নিকট যাচাই করার জন্য পেশ করেন। জামে তিরমিজির মধ্যে ৪৬টি অধ্যায় এবং ২১১৪টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। মোট হাদিস সংখ্যা ৪৪১৫টি। তিমমিজি শরীফ সাধারণ পাঠকদের জন্য একখানি সুখপাঠ্য ও সহজবোধ্য হাদিস গ্রন্থ। এটি সিহাহ সিত্তাহ গ্রন্থসমূহের মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করে আছে। এর মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। ইমাম তিরমিজি হাদিসে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বর্ণিত হাদিসসমূহ নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাস্য ও দলিল হিসেবে গণ্য। হাদিস গ্রহণে ইমাম তিরমিজির শর্তাবলি ছিলÑ ১. তিনি হাদিসের বিশুদ্ধতা নিরূপণে ইমাম বুখারী ও ইমাম আবু দাউদের অনুসৃত নীতিমালা অবলম্বন করেন, ২. ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম যে সমস্ত হাদিসকে সহীহ বলেছেন সেগুলোকে বিশুদ্ধ হিসেবে গণ্য করেছেন, ৩. হাদিস সমালোচনা বিজ্ঞানের নিরিখে বর্ণনাকারীদের চরিত্র বিশ্লেষণপূর্বক হাদিস গ্রহণ, ৪. প্রসিদ্ধ ফকীহগণ যে সমস্ত হাদিসের ওপর আমল করেছেন সেগুলো গ্রহণ করেছেন, ৫. সে সমস্ত বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদিসের সমালোচনা করা হয়েছে এবং ঐগুলোর বিশুদ্ধতাও প্রমাণিত হয়েছে, তাদের বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করেছেন, ৬. যদি দুর্বল হাদিসের সমর্থনে অপরাপর ত্রুটিমুক্ত হাদিস থাকে, তাহলে তা-ও গ্রহণ করেছেন। তিরমিজি শরীফ ছাড়াও তিনি আরো কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সামায়েলে তিরমিজি, কিতাবুল আসমা, আল কুনি, তাওয়ারিখ, কিতাবুল জহুদ তাঁর অনবদ্য রচনা। তিনি ফকীহও ছিলেন। ২৭৯ হিজরির ১২ রজব তিরমিজ থেকে ১৮ মাইল দূরে বুগ নামক স্থানে ৭০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইমাম তিরমিজি নিঃসন্দেহে একজন প্রথিতযশা, অসামান্য প্রতিভাধর ও ক্ষণজন্মা মহামনীষী ছিলেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ