ইশকুল

ইশকুল

নাটিকা জুলাই ২০১৫

হুসনে মোবারক#

১ম দৃশ্য
(সবুর মাতব্বরের বাড়ির উঠানে মিটিং বসেছে। স্কুল বানানোর মিটিং। উজান চরে স্কুল নির্মাণের এই প্রচেষ্টায় শরিক হয়েছেন গ্রামের গণ্যমান্য সবাই। সবার একটাই দাবি যেকোনো মূল্যে স্কুল করা চাই।)

সবুর মাতব্বর : ওই মিয়ারা গন্ডগোল বন্ধ কইরা, থামো সবাই। মনোযোগ দিয়া শোনো। শোনো কইতাছি- কার কি কথা আছে শোনা হইবো। এক এক কইরা বলবা সবাই। তবে তার আগে আমার কথা শোনো। শিক্ষা, পড়ালেহা করা সবার অধিকার। যেখানে ইন্টারনেট-মোবাইল ঘরে ঘরে। সেখানে শিক্ষা থাকব না, তা অয় না। তাই তোমাগো হগ্গলের মতের মত আমারও একমত, এইবার এই উজান চরে ইশকুল বানাইতে অইবই।
কিসমত মিয়া : স্কুল ঘর বানানোর আগে আমার কিছু কথা আছে। আমাগো গেরামের পোলা মাইয়ারা রহিমপুরের ইশকুলে পড়তে গিয়া যে অপমান অইছে তার প্রতিশোধ আগে নিতে অইবো। কঠিন প্রতিশোধ। এর বাইরে কোন কথা নাই।
(হট্টগোল শুরু হয়। সবাই উত্তেজিত। প্রতিশোধ নিতে চায়)
কুদরত উল্লাহ : বিশেষ কইরা আমার ভাতিজি আসমা খাতুনরে ওরা যাচ্ছে তাই অপমান করছে। ওর একটাই দোষ চেয়ারম্যানের মাইয়্যার ওপরে সে ভালা রেজাল্ট করছে। আমার ভাতিজির কারণে চেয়ারম্যানের মাইয়্যা ফার্স্ট অইতে পারে নাই।
সবুর মাতব্বর : কুদরত, তোমার ভাতিজি মানে আমাগো মাইয়া। আসমা উজান চরের গর্ব। আর কয়দিন বাদেই যে মেট্রিক পাস দিবো। আমরা তারে চাঁদা তুইল্যা উপজেলার কলেজে ভর্তি করামু।
তোমার বিষয়ডা নিয়াইতো আমরা বইছি। তয় প্রতিশোধের চেয়ে বেশি জরুরি এই সমস্যার সমাধান। আর এই জন্যই ইশকুল বানানোর কথা অইতাছে।
সাদেক মেম্বার : ইশকুল ঘর বানানোর কথা যেহেতু উঠছেই, এই বিষয়ে আমার কিছু কথা আছে। ইশকুল অইবো আমাগো বাড়িতে। আমার মরহুম আব্বার নামে। হেইর লাইগ্যা তোমরা চাইলে আমার উত্তরের ভিটা আমি ইশকুল ঘর বানানোর জন্য লেইখ্যা দিতে পারি।
সবুর মাতব্বর : জায়গার অভাব নাই। ইশকুল অইবো আমাগো পাড়ায়। সবার আসতে যাইতে সুবিধা। তাছাড়া ঘাটও এই পাড়ায়। এই ঘাট দিয়াই সকলের যাতায়াত, চলাফেরা।
গ্রামবাসী-১ : মেম্বার অইলো এই গেরামের মাথা। মেম্বার যা কইছে তাই অইবো। ইশকুল মেম্বারের বাড়িতেই অইবো।
গ্রামবাসী-২ : ইশকুল বানানোর মিটিং কার বাড়িত অইতাছে, মাতব্বরে বাড়িতে। সুতরাং কথাবার্তা সাবধানে কইয়ো।
গ্রামবাসী-৩ : সাবধান মানে। মাতব্বরে বাড়িতে বইছি দেইখ্যা আমরা কি ভাইসা আইছি।
(মেম্বার আর মাতব্বর এর দুই পক্ষের লোকেরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। কথাকাটাকাটি থেকে একপর্যায়ে হাতাহাতি এমনকি মারামারিতে রূপান্তর ঘটে। দুই পক্ষের অনেকেই আহত হয়।)

২য় দৃশ্য
(দ্বিতীয়বারের মত বসেছে স্কুল বানানোর মিটিং। তবে এবারে মিটিংয়ের জায়গা মাতব্বরের বা মেম্বারের কারো বাড়িতে নয়; মিটিং বসেছে মসজিদের বারান্দায়। ইমাম সাহেবের মধ্যস্থতায়। মূল উদ্যোগটাও নিয়েছেন মসজিদের ইমাম মাওলানা আলফাজ হোসেন। কথার সূচনাও তাই তিনিই করলেন।)

মাওলানা আলফাজ : কথার শুরুতে সবার প্রতি আমার সালাম। আসসালামু আলাইকুম। আশা করি আপনার সবাই আজকের এই বৈঠকের উদ্দেশ্য জানেন। একটা মহৎ কাজ করার জন্য আমরা সবাই একত্র হইছি। জ্ঞান হইলো আলো। এই আলো জ¦ালানোর কাজ যারা করবেন তারাও আলোর মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইতে অইবো। মনের মইধ্যে কালিমা রাইখ্যা আলোর কাজ করণ যায় না। সুতরাং মন আগে পরিষ্কার করতে অইবো। ইশকুল বানানো শুভ কাম। এই গেরামে একটা ইশকুল হইলে সবারই উপকার।
সবুর মাতব্বর : এই উপকারটাই আমি নিজে থেইক্যা শুরু করতে চাই। মাওলানা সাব, আমার বেশি কথা না। এই ইশকুলের জন্য যত জায়গা লাগব তার সব আমি দিমু। আপনি সম্মানিত মানুষ। গেরামের সবাই আপনেরে সম্মান করে। আপনি এই কথায় সম্মতি দিলে আর কেউ কোনো কথা কইবো না।
সাদেক মেম্বার : আমাগোতো কিছু কওয়েনের আছে। সব কথা মাতব্বরই কইবো নাকি। এই গেরামে তো আরো মানুষ আছে। সবাই ভালা থাকতে চায়। ইশকুল বানানোর সব জায়গা আমি দিমু। আমার পুরান বাড়িটা আমি লেইখ্যা দিমু।
কয়েকজন গ্রামবাসী : আমরা মেম্বার সাহেবের কথায় একমত।
অন্য কয়েকজন গ্রামবাসী : আমরা মাতব্বর সাবের কথার সাথে একমত।
(কিছুটা হট্টগোলে সৃষ্টি হবে। ইমাম সাহেব সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করবেন)
মাওলানা আলফাজ : থামেন আপনেরা সবাই। থামেন কইতাছি। থামেন। মসজিদ পবিত্র জায়গা। এইখানে এই রকম ঝগড়া-ঝাঁটি ঠিক না। আমরা বইছি মীমাসংসার জন্য।
গ্রামবাসী-১ : মিমাংসা পড়ে অইবো। আগে বিচার হউক বিচার। আমার হাত ভাঙছে মেম্বারের লোকেরা। আমি এর বিচার চাই।
গ্রামবাসী-২ : এর আগে মাতব্বর-এর লোকদের বিচার করতে অইবো। আমার মাথায় বারডা সিলাই লাগছে, সদর হাসপাতালে যাওন লাগছে।
সাদেক মেম্বার : ইমাম সাব। আমার লোকদের মাথা ফাটানোর জন্য আমি চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই বিচারের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু সমাধান হউক। নইলে একজনের বদলে দুইজনের মাথা এতদিন আমার লোকেরা ফাডাইয়্যা দিত।
সবুর মাতব্বর : এ রহম শক্তি হগ্গলেরই আছে। ইমাম সাব ইশকুলের কাম নাই। আমিও দেইখ্যা লমু কে কার মাথা ফাডাইতে পারে। ওই চল সবাই।
(হট্টগোল আবারো শুরু হবে। মাতব্বর আর তার লোকেরা বেরিয়ে যাবে। ইমাম সাহেব থামানোর চেষ্টা করেও সফল হবে না)
মাওলানা আলফাজ : দেখ মিয়ারা, আমি তোমাগরে নিয়া বসলাম মীমাংসার লাইগ্যা আর তোমরা বিবাদ আরো বাড়াইয়্যা দিলা। কারো মধ্যেই কোনো সবুর নাই। সবাই একটু বুঝার চেষ্টা করো.. কেউ আমার কথা শুনো না, আমি কাগরে বুঝামু।
(এর মধ্যে মেম্বারের লোকেরাও চলে যাবে। শুধুমাত্র বসে থাকবে পনের ষোল বছরের চার-পাঁচ জন বালক)
কি মিয়ারা সবাই চইল্যা গেল, তোমরা বইসা আছ ক্যান যাও, তোমরাও যাও টেডা, বল্লম লইয়া মারামারির প্রস্তুতি নেও। য্দ্ধু করো। সব শেষ কইরা দেও।
সফিক : চাচা, আপনার সাথে আমাগো কিছু কথা আছে।
মাওলানা আলফাজ : তোমরা আর কি কইবা। যুদ্ধ শুরু অইছে, যুদ্ধ করো।
সফিক : আমরা কইছিলাম কি..।
মাওলানা আলফাজ : আচ্ছা ঠিক আছে। বিহানে বাড়িতে আইস। অহন কথা কইতে আর ভাল্লাগতাছে না।

৩য় দৃশ্য
(মেম্বার পক্ষের কয়েক জন গ্রামবাসী রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছে।)

বজলু : মাতব্বর মনে করছে তার বাড়িতে মিটিং অইছে বইল্যা সবাই তার কথা মাইন্যা নিবো।
রশিদ : আরে ওরা মেম্বারের আসল রূপ দেহে নাই। মেম্বার যেইডা কয় হেইডা কইরাই ছাড়ে।
বজলু : ইশকুল অইলে মেম্বারের বাড়িতেই অইবো। প্রয়োজনে আমরা জান দিমু তারপরও মাতব্বরের বাড়িতে ইশকুল অইতে দিুম না।
হিরু : তোমরা এইহানে বইসা আছ। মাতব্বরের লোকেরা নাকি সব প্রস্তুতি নিতাছে।
রশিদ : কি কও হিরু ভাই।
হিরু : কম্মু নিজে দেইখ্যা আইছে।
বজলু : তাইলে তো অহনই মেম্বার সাবরে খবরডা দেওন লাগে।
রশিদ : খাড়াও, আমিও যামু।

৪র্থ দৃশ্য
(মাতব্বরের বাড়ি)

মাতব্বর : কি কইতাসস্। সামান্য বিষয় নিয়া তারা এত বাড়াবাড়ি করতাছে। কালু শেখরে খরব দে। মনে অইতাছে বিষয়ডা সহজে সমাধান অইবো না।
ফজলু : খরব পাইলাম। মেম্বারের লোকেরা নাকি রহিম নগর যাওনের পথে বেড়া দিয়া হেই পথ করতেছে মেম্বারের বাড়ির পাশ দিয়া।
মাতব্বর : বিষয়ডা আমিও ছাইড়া দিমু না। এই চরের মধ্যে কার শক্তি এইডা প্রমাণ অইবো।
ফজলু : আপনি খালি কন ঐ মেম্বারের গোষ্ঠী সুদ্দা শেষ কইরা দেমু।
মতব্বর : ঠান্ডা মাথায় ভাইব্যা চিন্তা কাজ করতে অইবো। ভুল করণ যাইবো না।

৫ম দৃশ্য
(মাতব্বরের ছেলে সফিকসহ ১০-১২ জন কিশোর মাঠের একটি কোণে বসে আছে। তাদের গুরুজনদের এই ধরনের যুদ্ধ যুদ্ধ প্রস্তুতিতে তারা বেশ অস্বস্তিতে আছে।)

মতিউর : যাদের জন্য ইশকুল। যারা এই হানে লেখাপড়া করবো। তাদের বিষয়ডা কেউ ভাবলো না। দুর, হেইডাই ভাল আছিলো কষ্ট কইরা অইলেও দূরের ইশকুল যাইতাম। এহন তো ইশকুলে যাওয়াই বন্ধ।
সফিক : আমরা না হয় কষ্ট কইরা স্কুেল গেলাম। কিন্তু চার মাইল রাস্তা হাঁইট্টা ছোড ছোড ছেলেমেয়েরা কেমনে অতদূরের স্কুলে যাইবো, তাদের জন্য অইলেও ইশকুলডা হওন দরকার।
সফিউল্লাহ : হু- ইশকুল আর হইছে। দুই পক্ষ যেভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতাছে। ইশকুল ঘর বানানোর কাম আর অইবো না। এহন কাম অইবো গিয়া কামান, ট্যাংক বন্দুক বানানের। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার লাইগ্যা এসব যুদ্ধের যন্ত্র বানানো নিয়াই ব্যস্ত। ইশকুল বানাইবো কেডা।
মতিউর : ইমাম চাচার কাছে তো কইলাম। কিন্তু তিনিও তো কোনো সমাধান করতে পারলেন না
সফিক : তিনি তো চেষ্টা করতাছেন।
আবসার : আমার মনে হয় না কেউ তাদের থামাইতে পারবো। ইশকুল নিয়া বড় ধরনের একটা ক্ষতি অইয়্যা যাইবো মনে হয়। আমরাও চেষ্টা কইরা কোনো বুদ্ধি বাইর করতে পারতাছি না।
সফিউল্লাহ : আমার মনে হয়, চাচার লগে আমাগো আবার দেহা করণ দরকার। এই একটা মানুষই আছে যিনি আমাগোর কথাডা একটু মনোযোগ দিয়া শোনেন।
আবসার : আসলে ছোডরে কেউ দাম দেয় না। আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না, আমরা সবাই একসাথে গিয়া যদি বড়গো বুঝাই। তাইলে তো মনে হয় শুনতেও পারে।
মতিউর : কোনো লাভ নাই। নিজেরা পারলে কিছু করবো। না পারলে নাই।
সফিউল্লাহ : তয় একটা কাজ করা যায়। আমাগো মধ্যে আরো ছেলেমেয়ে এই গেরামে আছে। তাগরে আমরা একসাথ করতে পারি।
সফিক : সফিউল্লাহ ঠিকই বলছে। তবে এর জন্য কৌশল করতে অইবো। বাড়ি বাড়ি গিয়া বুঝাইতে গেলে হয়তো বড়দের সামনে আমাদের পরিকল্পনাডা ফাঁস অইয়া যাইতে পারে। চলো সবাই মিল্যা একটা কৌশল খুঁজি। কিভাবে সবাইরে আমরা একসাথে করবো।
মতিউর : আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। তয় আমি আরেকটু ভাইবা কমু। এর জন্য একদিন সময় লাগব।
সফিউল্লাহ : সবাই ভাবো। আমরা কাইল বিকেলে আবার এক জায়গায় বসমু।
সফিক : ঠিক আছে।

৬ষ্ঠ দৃশ্য
(মাতব্বরের বাড়িতে মাওলানা আলফাজ)

মাওলানা আলফাজ : মাতব্বর সাহেব, আপনি তো বুঝের মানুষ। যা হইছে, এইবার বিষয়ডা একটা মীমাংসায় আনেন। উপজান পুরে, আমরা সবাই মিইল্যা মিইস্যা থাকতে চাই। নিজেরা নিজেরা মারামারি করলে মাইনসে কি কইবো।
মাতব্বর : দেখেন মাওলানা সাব। আমারে বুঝাইয়্যা কোনো লাভ নাই। আপনি গিয়া ছটকু মেম্মররে বুঝান। হেইদিনের পুলাডা মেম্বার হইয়া বেশি বাইরা গেছে।
মাওলানা আলফাজ : আমি মেম্বারের কাছে গেছিলাম, আপনার কাছেও আইলাম। আমার কাজ দুই পক্ষরে বুঝানো। এখন আপনারা যা ভালা বুঝেন তাই করেন। আমি যাই মাতব্বর সাহেব। আল্লাহ হাফেজ। আল্লাহ আমাদের সকলের মঙ্গল করুন। আমিন।

৭ম দৃশ্য
(ফুটবল খেলার মাঠ। কিশোরদের দু’টি দল ফুটবল খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু দর্শকও আছে। তবে কিশোর ও তরুণদের সংখ্যাই বেশি।)

সফিউল্লাহ : সবাই শোন। আমরা দুইটা দল ফুটবল খেলতে এইখানে একত্রিত হইছি। দল দুইটা। একে অপরে বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য খেলবো। কিন্তু আমরা এক গেরামের মানুষ। এক গেরামেই বসবাস করি। এই খেলায় একদল জিতবো, আরেক দল হারবো। কিন্তু আমরা চাই না এইডা লইয়্যা আমাগো মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হউক। খেলা খেলাই।
অধিনায়ক-১ : আমি আমার দলের পক্ষ থেইক্যা কথা দিতে পারি যে আমরা হারি বা জিতি কোনো ঝগড়া করুম না।
অধিনায়ক-২ : আমিও কথা দিলাম। হারজিৎ খেলার অংশ। খেলা খেলাই। আমরা মিইল্যা মিইস্যা থাকুম।
সফিউল্লাহ : আমরা তোমাগো কাছ থেইক্যা ঠিক এই কথাই শোনাবার চাইছি। তোমাগো দুই অধিনায়করেই ধন্যবাদ। তবে এই ফুটবল ম্যাসের আরো একটা উদ্দেশ্যে আছে। এই বিষয়ে কথা কইবে সফিক।
সফিক : দেখ ভাইয়েরা। আমার কথা বেশি না। তোমরা জানো আমাগো গেরামে ইশকুল বানানো লইয়্যা বিবাদ চলতাছে। এই বিবাদে তোমাগো আমাগো বাপ চাচারাই আছে। কিন্তু আমরা, যাদের জন্য এই ইশকুল তারা কিন্তু এই বিবাদে নাই। আমরা চাই না ইশকুল বানানো নিয়া ঝগড়া-ঝাঁটি, মারামারি, কাটাকাটি হউক। আমরা এর সমাধান চাই। আমরা সবাই যদি একত্রে থাকি, তাইলে এই ঝগড়া বিবাদও আমরা থামাইতে পারুম।
খেলোয়াড়-১ : আমাগো কথা কি মরুব্বিরা হুনবো।
খোলোয়াড়-২ : এই বিষয়ে কথা কওনের কোনো চান্সই দেয় না তারা। কিছু কইলেই কয়, তোরা ছোট্ট, কিছু বুঝবি না।
সফিক : আমরা ছোড ঠিক আছে। কিন্তু একত্রে থাকলে আমরাই একটা শক্তি হইবার পারি। ঠিক আছে অহন খেলার আগে রেফারি আমাগো প্রতিজ্ঞা করাইবো।
রেফারি : সদা সকল ভালো কাজ
একসাথে করবো মোরা-
নাহি কোনো লাজ।
(রেফারি বাঁশি ফুঁ দিয়ে খেলা শুরু করে। খেলা চলতে থাকে। দূর থেকে হইচই শোনা যাবে। যেখানে মারামারি এবং ব্যাপক গন্ডগোলের শব্দ ভেসে আসবে। খেলা বন্ধ হয়ে যায়। যে যার মত ছুটতে থাকে)

৮ম দৃশ্য
(মেম্বার আর মাতব্বর দুই পক্ষের একজনের মধ্যে তুমুল মারামারি চলতে থাকে। মাওলানা আলফাজ ও কিশোরদের একটি দল চেষ্টা করবে এই ধরনের ভয়ঙ্কর কাজ থেকে গ্রামবাসীকে নিবৃত্ত করার। কিন্তু এতে ফল হবে শুন্য। স্কুল নির্মাণের এই মহৎ উদ্যোগের সমাপ্তি হবে দুই পক্ষেরই নিষ্ঠুর হতাহতের মধ্য দিয়ে। )

মাওলানা আলফাজ : কেউ বুঝলো না, কেউ বুঝতে চাইলো না। হায় আফসোস! আমার কথা কেউ হোনল না। সব শেষ অইয়্যা যাইবো। কাউরে বাঁচাইতে পারুম না, কাউরে না।
(মাওলানা আলফাজের আফসোসের সাথে সফিকসহ সকল কিশোর একাত্ম হবে। আশু প্রলয়ের সম্ভাবনায় কিশোরদের চোখে পানি টলটল করবে। কিন্তু হতবাক হয়ে এসব নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।)

৯ম দৃশ্য
(সকালের আলো ফুটে উঠেছে। কিন্তু আজকের উজান চরের সকালটা অন্য দিনের মত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত উজান চরের সকালটা অনেকটাই বিষণœ। লড়াইয়ে কোন পক্ষ জয়ী হয়েছে, কোন পক্ষ হেরেছে সেই হিসেবের চেয়ে কার কতটুকু ক্ষতি এই নিয়েই ব্যস্ত সবাই। কিন্তু এর মাঝেও ভিন্ন এক সুর যেন চঞ্চল করে তোলে গ্রামবাসীকে। সফিক, সফিউল্লাহসহ সকল কিশোর মিলে ভাসমান স্কুল করেছে। যেখানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে। গাছের নিচেই চলছে তাদের ক্লাস।)

মতিউর : পড় সবাই। কথা বলো না- ‘অ’ তে অজু। অজু করে মসজিদের যাই। ‘আ’ তে আজান। আজান শুনতে ভালো লাগে...। এক একে এক, এক দ্বিগুণে দুই, তিন দ্বিগুণে ছয়..।
(ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ার আওয়াজ শুনে, মাতব্বর মেম্বারসহ গ্রামবাসী আস্তে আস্তে জড়ো হয়। অবাক বিস্ময়ে সবাই এগিয়ে আসে।)
সবুর মাতব্বর : থামো সবাই। কার কথায় তোমরা এই হানে ইশকুল করছো। কে তোমাগরে হুকুম দিছে।
সফিক : কারো কথায় না আব্বা। আমরা নিজেরাই এই ইশকুল দিছি। ইশকুলে যাওয়েনের আগে আর ইশকুল থেইক্যা আইসা আমরা ভাগ ভাগ কইরা এইখানে পড়ামু। বই-খাতার ব্যবস্থাও আমরা নিজেরাই করুম।
মাওলানা আলফাজ : দেখলেন মাতব্বর সাব। যেই কাম আপনেরা বড় বড় মানুষ অইয়্যা পারেন নাই। আপনেগো ছেলেপেলেরা, পুলাপাইন মানুষ হইয়্যা কি সুন্দর উদ্যোগ নিছে।
আসলে সৎ কাজ, ভালা কাজ করতে হইলে নিজেদের আগে ভালো মানুষ হইতে অয়। নিজেরা ভালা না অইলে ভালা কাম করুম কেমনে।
মেম্বার : ইশকুল চালাইতে টেহা লাগে।
মাওলানা আলফাজ : ভালা কাম টেকার লাইগ্যা আটকায় থাকে না। ইশকুল যেমন অইছে। টেকার ব্যবস্থাও অইবো, জায়গার ব্যবস্থাও অইবো। এক ইশকুল বানানো লইয়্যা সাত সাতটা মানুষ মরলো। অনেকেরই মাথা ফাটছে, হাত-পা ভাঙছে। এতে কার কি লাভ অইছে। এই উজান চরের মূল সমস্যা কি জানো। মূল সমস্যা হইলো শিক্ষা। সৎ শিক্ষা। আর এই শিক্ষার কাজটাই শুরু করছে আমাগো সন্তানের মত এসব ছেলেমেয়েরা। আমি প্রাণ ভইরা তাগো লাইগ্যা দোয়া করি। যে কাজটা তোমরা পার নাই হেই কাজটিই ওরা পারছে। এখন ওদেরকে সহযোগিতা করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।
(মাতব্বর, মেম্বারসহ সবাই তাদের ভুল বুঝতে পারে। কিছুটা অনুতপ্তও হয়।)
মেম্বার : আসলে মাওলানা সাব, আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারছি।
মাতব্বর : আমাগো আরো আগেই বুঝা উচিত ছিলো।
গ্রামবাসী-১ : আমরা পড়ালেখা শিখতে চাই তোমাদের স্কুলে আমরা পড়তে চাই। আমগোরেও পড়াও।
গ্রামবাসী-২ : হ হ চলো সবাই, বইসা পড়। মাতব্বর সাব, মেম্বর সাব, শরমের কিছু নাই। বইসা পড়েন।
(মাতব্বর মেম্বরসহ সবাই গাছতলার স্কুলে বসে। তাদের সন্তানতুল্য কিশোররা তাদের স্বর করে- পড়ায়। মাওলানা আলফাজ আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেললেন।)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ