ঈদ : সর্বজনীন উৎসব   -মাহবুবুল হক

ঈদ : সর্বজনীন উৎসব -মাহবুবুল হক

বিশেষ রচনা জুলাই ২০১৬

স্কুল ছুটির পর সোহেল, কামাল, ইমরান ও নোবেল খেলার মাঠের পাশে পাকা বেঞ্চে এসে বসে। সোহেলের বাসা ধানমন্ডিতে, কামালের বাসা  স্কুলের পাশে লালমাটিয়ায়, ইমরানের বাসা আজিমপুরে আর নোবেলের বাসা মোহাম্মদপুরে। স্কুল ছুটির পর ওরা আধা ঘন্টার জন্য এখানেই বসে। ওরা পরস্পরের বন্ধু। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। সোহেল ও ইমরানের গাড়ি আসে। কামালতো হেঁটেই যায়। নোবেল সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় চাপে।
বসেই প্রতিদিন ওরা যার যার টিফিন বক্স খোলে। দুপুরে ওরা বক্সের সব কিছু একসাথে খেয়ে ফেলে না। সবাই অল্প কিছু রেখে দেয়। বিকালে একে অপরেরটা মজা করে খায়। মা-খালাদের প্রশংসায় ওদের মুখে খই ফোটে। ওদের মায়েরাও জানে ওরা একে অপরের টিফিন খায়। সে জন্য সবাই চেষ্টা করে একটু বেশি করে টিফিন দিতে।
কামালের আম্মার দেয়া গাজরের হালুয়া খেতে খেতে সোহেল বলে, এ দেশের লেখকগুলো না সব পাগল হয়ে গেছে। এদের এখন পাবনায় পাঠানো দরকার!
কামাল : পাবনায় তো জায়গা নেই! অন্য কোথাও জায়গা করে দিতে হবে।
ইমরান : তা না হয় করা গেল, কিন্তু ঘটনা কি বলতো!
সোহেল : গতকাল এক সংবাদপত্রে একজন লিখেছেন, ঈদ সর্বজনীন উৎসব নয়, পয়লা বৈশাখই বাঙালির সর্বজনীন উৎসব!
নোবেল : কথাটাতো ঠিকই লিখেছে। ঈদতো মাত্র মুসলিমদের উৎসব। এটাতো আর হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের উৎসব নয়। ওরা ঈদ-উৎসবে অংশগ্রহণও করে না।
কামাল : কে বলেছে করে না। নামাজ ছাড়া ঈদের সব অনুষ্ঠানেইতো সব ধর্মের লোকেরা অংশগ্রহণ করে। অনেকেইতো নতুন জামা-কাপড়ও পরে।
ইমরান : সে জন্যই তো কেউ কেউ বলেছেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।
সোহেল : সেটা কি করে হয়! ধর্মের সাথে উৎসবও তো জড়িত। প্রত্যেক ধর্মের উৎসব তো আলাদা। যেমন, মুসলিম পুরুষরা মহিলাদের গান-নাচের আসরে যেতে পারে না, ধর্মে নিষেধ  আছে। কিন্তু অন্য ধর্মে এ ধরনের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। চৈত্রসংক্রান্তি হিন্দু ধর্মের একটি পার্বণ। এর মধ্যে পূজা জাতীয় অনেক কিছু আছে। মুসলিমরা তো পূজা করতে পারে না।
নোবেল : মোশারারফ স্যার তো সেদিন ক্লাসে বললেন, পয়লা বৈশাখে আগে এসব ছিলো না। মুসলিমরা দিবসটি পালন করতো হাল-খাতা করে আর মিলাদ অনুষ্ঠান করে। এখন চৈত্রসংক্রান্তি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, গান-নাচ এবং দিনভর আউটিং, কত কিছু যোগ হয়েছে। এসব তো মুসলিম সংস্কৃতি নয়। এসব তো আমরা করতে পারি না।
সোহেল : ঠিক বলেছিস, স্যারতো আরও বলেছিলেন, বিবাহ-বন্ধন ছাড়া কিশোর কিশোরী, যুবক-যুবতী, বয়স্ক-বয়স্কা, পৌঢ়-পৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কেউ একসাথে উঠা-বসা বা চলাফেরা করতে পারে না। ধর্মে এসব নিষেধ আছে। এসব হারাম। বড় গুনাহ্। তওবা না করলে মহান আল্লাহ এসব গুনাহ্ ক্ষমা করেন না। পরকালে এসব গুনাহের জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। অথচ দ্যাখ আমাদের পাড়ার সিনিয়ররা প্রায় সবাই এখন এসব করছে।
কামাল : কথা হচ্ছিল আমাদের দেশে ঈদ সর্বজনীন না বৈশাখ সর্বজনীন, তোরা না অন্য দিকে চলে গেলি। আসলে সে অর্থে কোনোটাই সর্বজনীন নয়। আমাদের দেশে বহু হিন্দু এবং বহু মুসলিম আছে যারা পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন করে না। তারা বলে আমাদের জীবনের সাথে পয়লা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। জীবনের সাথে সম্পর্ক খ্রিস্টান মাসের। শুধু শহর বা নগর নয়, গ্রামের মানুষের সাথেও সম্পর্ক খ্রিস্টান মাসের। গ্রামে যারা চাষ-বাস করে তাদের যারা ঋণ দেয়, তারাও তা খ্রিস্টান মাস বা তারিখ দেখে। এখন আর কেউ খাজনাও দেয় না বৈশাখ মাসে। সে সব রীতিতো শেষ হয়েছে ইংরেজ আমলের শুরুতে।
ইমরান : তুইতো একেবারে সেমিনার করে ফেললি। ওতো ডিপে না গেলেও বলা যায় ঈদ বা পয়লা বৈশাখ, কোনোটাই সর্বজনীন উৎসব নয়। সনাতন ধর্মের লোকেরা ১৪ই এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ই এপ্রিলে নববর্ষ পালন করে। এবার পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা ১৬ই এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ পালন করেছে। বিভিন্ন দিনে বাংলা নববর্ষ পালন করলে এর সর্বজনীনতা থাকে কোথায়?
নোবেল : সব কথা বাদ। আমরাতো ঐ সময় দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামে-গঞ্জে ছিলাম। চৈত্রসংক্রান্তি ও চড়ক পূজার মেলা ছাড়া তেমন কিছুতো দেখলাম না। আব্বাজান খালি আফসোস করছিলেন। বলছিলেন, আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসতো স্থানভেদে ৩ দিন বা ৭ দিনের জন্য। বড় গেরস্থ বা জোতদারদের বাড়িতে মিলাদ হতো। হিন্দু বা মুসলিম সবার দোকানে হালখাতা হতো। যে বাকি করেনি, সেও হালখাতার দাওয়াত পেতো। সবাই দাওয়াতে যেতো। ১ টাকা বা ২ টাকা উপহার দিয়ে মিঠাই-মন্ডা খেতো। যারা এর বেশি দিতো তাদের অঙ্কটা অ্যাডভান্স হিসেবে খাতায় লেখা থাকতো। পরে অন্য সময় ঐ টাকার পরিমাণে পণ্য সরবরাহ করা হতো। এই ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়ীদের হাতে কিছু পুঁজি জমা হতো, যা তাদের ব্যবসায় কাজে লাগত।
কামাল : ধুরো, রাখ এসব, কোথায় ঈদ আর কোথায় পয়লা বৈশাখ! কোথায় আসলাম খান, আর কোথায় সিংগেল পান। কোথায় সাকিব, আর কোথায় বদ নসিব (সবাই হো হো করে হেসে ওঠে)। আরে, মেয়ে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় এবং পার্কে পার্কে ঘুরে বেড়ালেই জাতীয় উৎসব হয় না। জাতীয় উৎসব হওয়ার জন্য ‘কজ’ লাগে, ব্যাকগ্রাউন্ড লাগে, সূত্র লাগে। যেমন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শাহাদাত দিবস! ‘কোথায় কি, পান্তা ভাতে ঘি!’
সোহেল : খুব খারাপ বলিস্নি। আব্বা বলেছেন, আগে রমনা পার্ক ও শিশুপার্কসহ ভোরে ও সকালে গান হতো। তারপর সারাদিন মহল্লায় মহল্লায় বা বাড়িতে বাড়িতে নিজেদের রুচিমত আনন্দ-উৎসব হতো। গার্মেন্টস হওয়ার পর থেকেই নাকি মেয়েদের হাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শুরু হয়েছে। এরা সব গ্রামের অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত ছেলে-মেয়ে। শহরে এসে এরা নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে। আব্বা বলেছেন, আগে কোনো ভদ্রঘরের ছেলে-মেয়ে এভাবে হাত ধরাধরি করে সারাদিন রাস্তা-রাস্তায় ঘুরতো না। এখন বুঝে না-বুঝে হাওয়ার টানে অনেকেই ঘুরছে।
ইমরান : তোদের কথা বুঝলাম। এবার সরকারের পজেটিভ  উদ্যোগের কারণে হোক বা বিবেকের কারণে হোক রাস্তা-রাস্তায় ঢল্ বা পাগলামি কম ছিলো। ঢাকা মহানগরীর ৫০ ভাগ লোক এবার ঘর থেকে বের হয়নি। গরমও ছিলো খুব। মনে হয় ধীরে ধীরে উৎসবের নামে পাগলামি কমে আসবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বা চৈত্রসংক্রান্তির পরিবর্তে শোভন-সুন্দর কোনো অনুষ্ঠান সামনে চলে আসবে।
নোবেল : কেন, মঙ্গল শোভা-যাত্রা আর চৈত্রসংক্রান্তি কি দোষ করলো? ওটা হিন্দুদের অনুষ্ঠান, ওটা তারা জাঁকজমকের সাথে পালন করবে। প্রয়োজনে সরকার তাদেরকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করবে। ওরাতো নববর্ষ পালন করে একদিন পর অর্থাৎ ১৫ই এপ্রিলে। এতে অন্যদের তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
সোহেল : সবতো হলো, ঈদের কথাতো হলো না। আমার তো গাড়ি এসে গেছে। আমাকে এখনই উঠতে হবে। কাল ঈদের কথা হবে। আল্লাহ হাফেজ।
ইমরান : আমারও গাড়ি এসে গেছে। যাই। ওরা হ্যান্ড-শেক করে যার যার মতো বিদায় নেয়।

দুই.
ছুটির ঘন্টা পড়তেই ওরা চার বন্ধু নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বসে। রুটিন মতো টিফিন বক্স অদল-বদল করে। নাস্তা শেষ করতে ওদের তেমন দেরি হয় না। নাস্তা শেষ করেই ওরা সমস্বরে বলে ওঠে : ‘থ্রি-চিয়ার্স ফর আওয়ার আন্টিস’।
সোহেল : গতকালের আলোচনায় তো বুঝা গেল নববর্ষ সর্বজনীন উৎসব নয়। ধর্মের কারণে এবং বাস্তবতার কারণে এই উৎসব যার যার মতো পালন করা হয়। মুসলিমরা সবাই একভাবে এই উৎসব উপভোগ করে না। আবার শহরের মুসলিম আর গ্রামের মুসলিম একভাবে এই উৎসব পালন করে না। অন্য গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের কথাতো আরো ভিন্ন। ১২টি উপজাতি ১২ রকমভাবে এই উৎসব পালন করে থাকে। ‘বৈশাবির’ কথা মাত্র শুনেছি আমরা। আরো কতো বৈচিত্র্য যে আছে।
ইমরান : সেদিক থেকে ঈদ উৎসব অনেকটা সর্বজনীন। এ দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম। এই মুসলিমরা প্রায় একইভাবে ঈদ-উৎসব পালন করে থাকে। এখানে ভিন্নতা বলতে কিছু নেই। ঈদের পূর্বে সবাই সাধ্যমত বাজার করে আপনজনদের খুশি করতে চায়। ঈদের দিন সবাই মিলে নামাজ পড়ে। সবাই মিলে স্বাদের খাবার খায়। প্রায় সবাই গরিবদের ফেতরা, জাকাত ইত্যাদি প্রদান করে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেরাও নতুন জামা-কাপড় পরে। কেউ নিজে কেনে কেউ মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে উপহার বা গিফ্ট পায়। আর উৎসবটা গ্রামমুখী হওয়ায় উৎসবের আমেজটাও একই ধরনের থাকে। শহরে এসে ঈদ-পুনর্মিলনী হয়, তারও ধরন প্রায় এক। পুনর্মিলনীতে সবাই সেমাই খেতে চায়।
কামাল : কাল রাতে আব্বা ও আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঈদ ও নববর্ষের কথা। তাঁরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে এবং ভক্তির সাথে ঈদুল-ফিতরের কথা স্মরণ করলেন। বললেন : ঈদুল-ফিতর তো আল্লাহর দেয়া সর্বজনীন উৎসব। আর নববর্ষতো মানুষের গড়া উৎসব। দুটো সমান হয় কি করে? দুটোর পবিত্রতা আলাদা, মেজাজ আলাদা, প্রেক্ষাপট ও পটভূমি আলাদা। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী ঈদ উৎসব পালন করা ইবাদত। সে অর্থে নববর্ষ পালন করাতো ইবাদত নয়। হ্যাঁ নববর্ষ উৎসবকেও ইবাদতে পরিণত করা যায়, যদি এ জন্য আমরা ভাবি, গবেষণা করি এবং পরিশ্রম করি। সে জন্য স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে হবে।
নোবেল : তোর বাবা-মা খুব ভালো বলেছেন। বিষয়টি আমাদের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। দুটোই আমাদের উৎসব। দুটোই জাতীয় উৎসব। তবে ঈদ- উৎসবটা সুপ্রাচীন, শাশ্বত, চিরকালীন এবং আকাশের মতো উদার।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ