ঈদ : সার্বজনীন উৎসব

ঈদ : সার্বজনীন উৎসব

বিশেষ রচনা সেপ্টেম্বর ২০০৯

মাহবুবুল হক

[caption id="attachment_203" align="alignleft" width="250" caption="ঈদ : সার্বজনীন উৎসব"]Eid_3[/caption]

ঈদ! আহ কী সুন্দর একটা শব্দ! ‘আল্লাহ’, ‘রাসূল’ ও ‘মা-বাবা’র পরই যেন এ শব্দটি এক উদ্দাম ব্যঞ্জনাসহ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। কী মধু আছে এ শব্দের সাথে? কী মায়া আছে এ শব্দের সঙ্গে? কেন আমরা এমন অনুরণিত হই এ-শব্দের গুঞ্জনে? কেন আমরা এত উল্লসিত হই এ-শব্দের বেড়াজালে? মাত্র একটি শব্দ জীবনে আনন্দ আনে, আনে সুখ, শান্তি এবং অনাবিল স্বস্তি! খুব আশ্চর্য তাই না? 

আর মাত্র তো ক’টা দিন, এরপরই তো ঈদ! আমাদের মনে এখন কতো আনন্দ, কতো আশা এবং কতো উদ্দীপনা! আমরা সবাই এখন থেকে ভাবছি, পরিকল্পনা করছি, কে-কিভাবে ঈদ-উৎসব উদযাপন করবো। না আমরা শুধু আমাদের কথা ভাবছি না। ভাবছি, পরিবার-পরিজনের কথা। ভাবছি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-পড়শির কথা। সত্য কথা বলতে কী, ভাবছি, গ্রামের মানুষের কথাও। আরও চুপিসারে বলি ভাবছি, ‘সিডর’ ও ‘আইলায়’ ক্ষতিগ্রস্ত বিপন্ন মানুষের কথাও- আহা! ওরাও তো আমাদের ভাই-বোন, আমাদের আত্মীয় এবং আমাদের আত্মার আত্মীয়। ভাবছি তো ঠিকই, কিন্তু আমাদের সাধ্য কতটুকু! সামর্থ্য কতটুক! তবুও ওদের কথা এবার বিশেষভাবে ভাবতে হবে, ওদের জন্য এবার অবশ্যই কিছু করতে হবে। কারণ, ওদেরকে বাদ দিয়ে ঈদ যে আমরা করতে পারি না। ঈদতো সার্বজনীন উৎসব। সবার জন্য উৎসব। কেউ বাদ গেলে ঈদতো হবে না।

শুধু সিডর বা আইলায় আক্রান্তরা যে নিঃস্ব বা হত-দরিদ্র, তা’তো নয়, আমাদের আশপাশে, আমাদের গ্রামে, আমাদের মহল্লায়, এমনকি আমাদের পরিবারেও দরিদ্র লোক আছে। তাদেরকে আমরা চিনেও চিনি না, জেনেও জানি না। আমরা হয়তো ধরেই নিয়েছি ওটাই ওদের বিধিলিপি, ওটাই ওদের ভাগ্য! ওরা আমাদের মতো খাবে না, আমাদের মতো পরবে না, আমাদের মতো আনন্দ করবে না। ওদের কাজ শুধু আমাদেরকে সাহায্য করা, সহযোগিতা করা এবং আনন্দ দান করা। বুঝতেই পারছো, কাদের কথা আমরা বলার চেষ্টা করছি। এরা আর কেউ নয়- এরা আমাদেরই পরিবারের সদস্য, আমাদেরই গৃহকর্মী। এদেরকে নিয়েও আমাদের সমানভাবে ভাবতে হবে। ঈদে আমরা পাঁচশত টাকা দামের জামা গায়ে দেব, আর ওদেরকে দেব একশত টাকা দামের জামা, তা কি হয় বলো? এতে কি ওরা খুশি হয়? আনন্দিত হয়? আসলে হয় না। কার না ইচ্ছা করে ভাল খেতে, ভাল পরতে? ওদেরও ইচ্ছা করে, কিন্তু ওরা বলে না, বলতে পারে না। তোমার আমার ভাল জামা-কাপড় দেখে ওরা দুঃখ পায়। এই দুঃখ ও কষ্টের কারণে ওদের মনে হিংসা জাগে, প্রতিহিংসা জাগে। এসব কারণে পরিবারে পরিবারে শান্তির বদলে অশান্তির সৃষ্টি হয়। আনন্দের বদলে নিরানন্দের পরিবেশ তৈরি হয়। এবার আসো, এদের দিকে আমরা একটু তাকাই। এদের প্রতি মমতাসুলভ ব্যবহার করি। আমরা বলছি না, তুমি পাঁচশা টাকা দামের জামা গায়ে দিয়েছ বলে তোমার গৃহকর্মীকেও পাঁচ শ’ টাকা দামের জামা কিনে দিতে হবে। আমাদের সমাজে এখনই হয়তো এ কাজটা বড়-সড় আকারে শুরু করা যাবে না। সময় ও পরিবেশ-পরিস্থিতি বলে কথাতো আছে। তবুও শুরুতো করতে হবে কাউকে না কাউকে। তোমরাই শুরু কর না! তোমরা যে রাসূল (সা)-কে প্রাণের চেয়েও ভালবাস, সে রাসূল (সা) বিদায় হজে বলেছেন, তোমরা যা খাবে, তোমাদের অধীনস্থদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও তা পরাবে। এরপর কি আর কোন কথা থাকে? কথাগুলো কতো যুক্তিপূর্ণ, কতো শোভন এবং কতো মানবিক, তাই না?

ঈদ নিয়ে বা ঈদের আনন্দ-উৎসব নিয়ে কথার তো শেষ নেই। অনেকেই বলেন, এ নিয়ে বাঙালি মুসলিমরা বেশি মাতামাতি করে, অন্যদেশের

[caption id="attachment_204" align="alignright" width="300" caption="ঈদ সবার উৎসব"]ঈদ সবার উৎসব[/caption]

মুসলিমরা এত হইচই করে না। কথাটা হয়তো ঠিক। কথাটার মধ্যে অনেক সত্যতা আছে। কিন্তু কেন? এরও হয়তো অনেক ব্যাখ্যা আছে। অনেক জবাব আছে। সব ব্যাখ্যা বা সব জবাব হয়তো এখনই আমাদের জানার দরকার নেই। বড় হলে ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারবো। তবে, এটুকু আমাদের জানা দরকার যে, ঐতিহাসিক ও মানসিক কারণে বাঙালি মুসলিমরা ঈদকে বরাবর জাতীয় উৎসব এবং সার্বজনীন উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে। এই পালন করাটা চাপিয়ে দেয়া কোন কর্মসূচি নয়। কেউ উদ্যোগ নিয়ে ঈদকে জাতীয় বা সার্বজনীন বানায়নি। এটা হয়েছে সহজ, সরল এবং সাবলীলভাবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

আমরা সবাই জানি, হাজার বছর আগে আমরা অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষরা মুসলিম ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন নানা ধর্মের অনুসারী। বিশেষ করে পৌত্তলিক বা সনাতন ধর্মের অনুসারী। সনাতন ধর্মে পালা-পার্বণের অন্তঃ ছিল না। বলা হয়ে থাকে বার মাসে তের পার্বণ। এখন অবশ্য সনাতন ধর্মে আগের সে অবস্থাটি নেই। তবুও কম নেই। অবস্থাটা এমন যে, আনন্দ উৎসবের নামই যেন সনাতন ধর্ম। সে ধর্ম থেকে আমাদের সাহসী ও বীর পূর্বপুরুষরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যাদের রক্তে ও মজ্জায় ছিল আনন্দ-উৎসব, তারা তা ছাড়া বাঁচে কী করে? ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও আনন্দ উৎসবকে আমাদের পূর্বপুরুষরা পরিত্যাগ করতে পারেননি। ফলে শুক্রবার, মহররম, রমজান, শবেমেরাজ, শবেবরাত, শবেকদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা থেকে শুরু করে ঈদে মিলাদুন্নবী, আখেরি চাহার শাম্বা, উরস, মিলাদ, এগার শরিফ, জলসা, খতনা, চল্লিশা ইত্যাদি ডজন-ডজন উৎসব মুসলিমরা নিজেদের জন্য বানিয়ে নিয়েছে। ধর্মের সাথে স্থানীয় রসম-রেওয়াজ এবং জীবনাচারকে তারা একাকার করে ফেলেছে। ইসলাম স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কখনো বাতিল করেনি। যা শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলময়, ইসলাম সেসবকে আদর ও সোহাগ ভরে ধারণ করেছে। ইসলাম শুধু দেখেছে বিষয়টি আল্লাহর একত্বের সাথে সাংঘর্ষিক কি না এবং ধর্মে নতুন কোনো প্রথা প্রচলন করা হচ্ছে কি না।

এসব না থাকলে এবং বিজাতীয় অশ্লীল, নোংরা ও কুৎসিত বিষয় না থাকলে ইসলাম মানুষের স্বচ্ছ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক প্রবণতার পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, স্বাভাবিক ধর্ম। সে কারণে বাঙালির উৎসব-প্রবণতার পক্ষে ইসলাম বাধা সৃষ্টি করেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসাহ জুগিয়েছে।

আবহমান কাল ধরে বাঙালিরা উৎসবপ্রবণ, প্রাণবন্ত, উচ্ছল এবং উজ্জ্বল আনন্দ তাদের জীবনের উৎস, সুখ ও শান্তি তাদের নিত্যসঙ্গী। অল্পে তুষ্ট এ ব-দ্বীপের মানুষগুলো আনন্দের অনুষঙ্গ পেলে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে যায়। সে কারণেই আমাদের কাছে ঈদ এতো আনন্দের এবং এতো উৎসবের।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ