ঈদগল্প ঈদের দিনে নতুন কিছু

ঈদগল্প ঈদের দিনে নতুন কিছু

গল্প মাহমুদ শরীফ জুন ২০২৩

সাব্বির, সাদেক ও সাগর তিন বন্ধু। শুধু বন্ধুই নয়, ‘নতুন কিছু করি’ খুদে সংগঠনের তিন লিডার। যেমন ছটফটে, তেমন রশিক ও হাস্যোজ্জ্বল স্বভাবের। ওদের চেনে না বা জানে না এমন একজন ব্যক্তি কুমারখালীর হাঁসদিয়া গ্রামে পাওয়া যাবে না। ‘নতুন কিছু করি’ খুদে সংগঠনের দামালিপনা আর আশ্চর্যজনক কর্মকা- সবার মুখে মুখে। ওরা একই বয়সী। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মোটামুটি মেধাবী। কখনো দুষ্টুমি, কখনো দামালিপনা কিংবা সমাজসেবামূলক কাজে স্বেচ্ছ্য়া ওরা অংশ নিয়ে খ্যাতি কুড়িয়েছে। সুন্দর ব্যবহার আর কথা-বার্তার জন্য মাঝে মধ্যে ছোটখাটো অন্যায় অপরাধ করলেও কেউই রাগ করে না। অবশ্য বড় ধরনের অন্যায়-অপরাধ ওদের দ্বারা হয়নি কোনদিন। গ্রামের মুরুব্বিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘এই পিচ্চি ছেলেরা আগামীতে ইতিহাসের পাতায় স্থান পাওয়ার মতো যুগান্তকারী কিছু একটা করবে, যা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি।

এই তো সেদিন তিন বন্ধু ভাবলো গড়াই নদী সাঁতার দিয়ে পাড়ি দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ঝুপঝাঁপ ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীর বুকে। স্রােতকে তোয়াক্কা না করে পাড়ি জমালো ওপাড়ে। সেদিনই হাঁসদিয়া গ্রামবাসী বুঝে নিয়েছে ছেলেগুলোর সাহস আছে বটে! 

‘নতুন কিছু করি’র সদস্যরা প্রত্যেকেই দামালিপনার সাথে ভালো-খারাপ দু’টোই করে। নদীতে মাছ ধরায় বেশ পটু। আর স্কুলের পক্ষ হয়ে হাডুডুসহ যে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ওরা। বিজয়ী হয়ে পুরস্কার নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ওদের জুড়ি নেই।

সবদিক বিবেচনা করে ‘নতুন কিছু করি’ সংগঠনকে সবাই ভালোই বলে। আর বলবেই বা না কেন? গত সপ্তাহে কৃষক হাতেম আলী দাদুর কী অসুখ! কয়েকদিন ক্ষেত খামারে কাজে যেতে পারেনি বেচারা। হালের গরু দুটো ঘাস বিনে শুকিয়ে যাচ্ছিলো। খিদের জ্বালায় ডাকছিলো হাম্বা হাম্বা করে। তিন কিশোর ছুটে যায় মাঠে। তিন বোঝা শ্যামা ঘাস কেটে এনে খেতে দিয়েছিল গরু দু’টিকে। গতকাল ময়ান গাড়িয়ালের গরুর গাড়ি ঠেলে রাস্তায় তুলেও দিয়েছে। আজ সকালে মোল্লাদের পাগলা কুকুরকে ওরাই মাথা ফাটিয়ে হত্যা করে কুকুরের কামড় থেকে রক্ষা করেছে গ্রামবাসীদের। এ জাতীয় কাজ করতে ওরা বেশ পটু। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোই ওদের যেন প্রতিদিনের রুটিন।

আজ ঈদ। ঈদগাহ থেকে ফিরে তিন বন্ধু মিলিত হয় স্কুল মাঠে। সবার ইচ্ছে আজকে নতুন একটা কিছু অবশ্যই করতে হবে। এ নিয়ে পরামর্শ চলছিল। সাগর বললো-

আমরা তো তিনজন কোন দিন মারামারি করিনি, এমনকি রাগারাগি-অভিমানও হয়নি। তাই আজকে মারামারি করবো। অবশ্য এটা হবে মিছামিছি। স্রেফ অভিনয়। গ্রামের সকলেই ভাববে সত্যিই মারামারি করছি। কিন্তু তা নয়, এটা...।

সাগরের কথায় সাদেক সম্মতি জানালেও সাব্বির বললো- ধ্যাৎ! এটা আবার একটা চমকপ্রদ নতুন কিছু হলো নাকি? তারচেয়ে চল তিনজন রঙ মেখে সং সেজে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করি গে...

সাদক বাধা দিয়ে বললো কী! কী বললি! ভিক্ষে? না তা পারবো না। অন্তত আজকের আনন্দের দিনে। আর ...

সাদেকের কথা সাব্বির কেড়ে নিয়ে আবার মতামত দেয়- ঠিক আছে বুদ্ধি একটা খুলেছে। তোরা যদি মেনে নিস ভালোই হবে বোধ হয়। এতে একজন নতুন বন্ধুও জুটতে পারে, তবে কিছু টাকা লাগবে। বেশি না। সবাইকে একশ করে টাকা খসাতে...

আরে বল না গুরু! কী হবে? অধৈর্যের ভঙ্গিতে এক সাথে বাক্য ছুঁড়লো সাদেক ও সাগর। 

সাব্বিরের নির্দেশ মতো দু’জন একশ’ করে টাকা পকেট থেকে বের করতে করতে যাত্রাভিনেতার স্টাইলে বলল- আদেশ করুন জনাব! কী করতে হবে এই বান্দাকে। আপনার আদেশ পালনে এ বান্দারা কসুর করবে না। আদেশ করুন! হিমালয় পর্বতকে ধাক্কা মেরে উল্টে দিই। গড়াই নদীর সব পানি সেচে দেশের পুকুরগুলো ভরিয়ে তুলি। ঐ তাল গাছটা এক টানে উপড়ে ফেলি। পুরাতন এই স্কুল ভবনটা এক ধাক্কায়-

ইশারায় ওদের থামিয়ে সাব্বির কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে ধমকের সুরে বলে- আরে থাম থাম! অত ডায়ালগ দিতে হবে না। যা বলি শোন, এই নে ধর আরো দু’শ টাকা। মোট চারশ টাকা দিয়ে কুমারখালী বাজার থেকে সুন্দর একটা পাঞ্জাবি কিনে আনবি, কেমন! 

সাগর ও সাব্বিরের চোখ ছানাবড়া। আজকের দিনে পাঞ্জাবি!(?) কিছু আপত্তি জানাতে চাচ্ছিলো। কিন্তু সাব্বিরের কথার উপর যুক্তি দেয়া মানেই ঝাড়ি খাওয়া। তাই সিদ্ধান্ত কবুল!

যা বললাম জলদি কর। হু- কুইক। আমি ঠিক বিকেল চারটায় এখানে হাজির হবো। বলেই নেতা ভাব নিয়ে সাব্বির গ্রামের দিকে পা বাড়ায়। সাদেক ও সাগর জো হুকুম জনাব! বলতে বলতে খেয়াঘাটের দিকে হাঁটা দেয় শহরের উদ্দেশে।

সাব্বির গ্রামে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করতে থাকে তাদের বয়সী কোন ছেলেকে এবারের ঈদে বাবা-মা নতুন পাঞ্জাবি কিনে দিতে পারেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পেয়ে যায় সাজ্জাদকে। খুবই গরিব ওরা। বাবা শফিউল হক বিনা চিকিৎসায় ক্যান্সারে মারা গেছে ৫ বছর হলো। মা রাজিয়া বানু অন্যের বাড়ি কাজ করে। সাজ্জাদ এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। বেশ মেধাবী। সাব্বিরের ভালোই লাগছে। ওদের ‘নতুন কিছু করি’ সংগঠনের তিন কর্ণধারের নামের সাথে প্রথম অক্ষর সাজ্জাদের ‘স‘ মিলে গেছে।

সাজ্জাদকে সাথে করে সাব্বির নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলের মাঠে হাজির। সাগর ও সাদেক ইতোমধ্যেই শহর থেকে পাঞ্জাবি কিনে এনেছে। তারা সাব্বিরের সাথে সাজ্জাদকে দেখেই বুঝে নিয়েছে পাঞ্জাবি কী হবে। দু’জনই মনে মনে সাব্বিরকে ধন্যবাদ জানায়। গুরু তোমার তুলনা হয় না!

না, কোনো কথাবার্তা নয়। সাব্বির ‘মনোরমা গার্মেন্টসে’র প্যাকেট খুলে সুন্দর রংয়ের এমব্রয়ডারি করা পাঞ্জাবিটা সাজ্জাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়। সাজ্জাদের চোখে নোনা পানির বন্যা। কথা নেই যেন মুখে! সে ভাবতেও পারে না- এমন একটা নতুন পাঞ্জাবি পাবে। সাজ্জাদ আনন্দে কেঁদে ফেলে। আনন্দ অশ্রু দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে টপাটপ। সাব্বিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তার পর সাগর ও সোহাগকেও।

সাজ্জাদের চোখের পানি মুছে দেয় তিনজনে। আনন্দ, তৃপ্তি আর হাসির আভা ফুটে ওঠে সাজ্জাদের মুখে। সাজ্জাদ বলে-

বুঝেছি, এটা নিশ্চয় ‘নতুন কিছু করি’র ঈদের দিনের নতুন কিছুর চমক! আমিও এখন থেকে তোমাদের দলের নতুন সদস্য (বন্ধু) হয়ে গেলাম। 

সাব্বির সাদেক ও সাগরের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ঢেউ খেলে। হাসিতে যোগ দেয় সাজ্জাদও। একে অপরের হাত ধরে এক সাথে বলে ওঠে, ই য়া হু উ- উ- ঈদের দিনে নতুন কিছু! ঈদের দিনে নতুন কিছু! ঈদের দিনে নতুন কিছু!

এবার চার বন্ধু ঈদের দিনে নতুন কিছু! ঈদের দিনে নতুন কিছু! ম্লোগান দিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। গ্রামবাসী ওদের কা- দেখে আদর, ভালোবাসা, স্নেহ আর শুভ কামনার বহিঃপ্রকাশ করে বলে- পাগল ছেলেরা! পারেও বটে!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ