ঈদুল আজহা ও কুরবানি

ঈদুল আজহা ও কুরবানি

বিশেষ রচনা অক্টোবর ২০১২

ইকবাল কবীর মোহন..

বছর ঘুরে মুসলমানের ঘরে ঘরে আসে ঈদ। ঈদ দু’টি- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আমাদের অনেক ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান আছে। তার মধ্যে ঈদ সব চাইতে বড় উৎসব। ঈদ অর্থ আনন্দ, মিলন। আমরা প্রতি বছর আনন্দঘন পরিবেশে এই দু’টি ঈদ পালন করি। ঈদে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করার সাথে সাথে আনন্দ ও হাসি-খুশির এক মহামিলনে আমরা আপ্লুত হই। আমরা দুই ঈদ এমন নির্মল আনন্দের সাথে পালন করি যাতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ খুশি হন। ঈদে নতুন জামাকাপড় পরা আর ভালো ভালো খাবারদাবারের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বের মুসলমানরা এমনভাবে মেতে ওঠেন যেন মুসলিম সমাজে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এ সময় সবার কর্মস্থলে কাজকর্ম বন্ধ থাকে। ছুটিতে কাটায় মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা। ফলে আনন্দ ও খুশির আমেজটা হয় আরো বেশি সার্থক ও সফল। আমরা জানি আল্লাহর সন্তোষ লাভের জন্য মুসলমানরা সারা বছরের যে কোনো দিন নফল রোজা রাখতে পারে। কিন্তু ঈদের আনন্দ উৎসব যেন মনভরে পালন করা যায় তার জন্য মহান আল্লাহ দিয়েছেন সুন্দর এক বিধান। আল্লাহ পাক ঈদের এই দুই দিনসহ ঈদুল আজহার পরের তিন দিন মিলে মোট পাঁচদিন সিয়াম পালন বা রোজা রাখা নিষিদ্ধ করেছেন। এতেই বোঝা যায় ঈদের আনন্দকে আল্লাহ কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রিয় বন্ধুরা। আমরা এক মাস সিয়াম পালনের পর ঈদুল ফিতরের ঈদ উৎসব পালন করেছি বেশ আগে। এসে যাচ্ছে ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। এই ঈদের বড় কাজ হলো কুরবানি করা। আল্লাহ তাআলা কুরবানির জন্য বাড়তি আরো তিন দিন সময় ও সুযোগ করে দিয়েছেন। ঈদুল আজহার ঈদটি শুধুমাত্র ঈদের নামাজ ও কুরবানির মধ্যেই শেষ হয়নি। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে হজ, সামর্থ্যবান মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত ইবাদাত। ফলে জিলহজ মাসের মাহাত্ম্য ও ফজিলত অনেক বেশি। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান! আল্লাহ তাআলা জিলহজ মাসকে অত্যন্ত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। সুতরাং তোমাদের উচিত এ মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং হাঁটা-চলা-ফেরা, আরোহণ ও পদব্রজে অর্থাৎ জীবনের সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা।’ ঈদুল আজহা মানে বকরী ঈদ বা কুরবানির ঈদ। এই ঈদে কুরবানির যে বিধান তার সাথে জড়িত গৌরবময় ইতিহাস আমরা অনেকেই হয়তো জানি। জিলহজ মাসের এই দিনে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ) আল্লাহর আদেশ পেয়ে অনেক ছাগল ও মেষ কুরবানি করেন। আল্লাহর কী কুদরত! ইবরাহিম (আ)-এর এই কুরবানিতে আল্লাহ খুশি হলেন না। তাঁকে আবার পশু কুরবানি করার কথা বলা হলো। তিনি এবার উট কুরবানি করলেন। তাতেও আল্লাহ খুশি হলেন না। হযরত ইবরাহিম (আ)-কে তাঁর প্রিয় বস্তু কুরবানি করার আদেশ দেয়া হলো। আল্লাহর নবী চিন্তায় পড়ে গেলেন। এই রহস্যের কোনো কুলকিনারা তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ভাবলেন প্রিয় বস্তু তো কলিজার ধন শিশুপুত্র হজরত ইসমাঈল (আ)। তিনি তাঁকেই কুরবানি করার জন্য মনস্থির করলেন। তিনি পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর স্বপ্নের কথা বললেন। পুত্রও ছিলেন খোদভীরু অনন্য এক সাহসী বালক। তিনি অনায়াসেই পিতার স্বপ্নের কথা শুনে রাজি হয়ে গেলেন। পিতা ও পুত্রের কথাবার্তা আল্লাহ পাক কুরআনের সূরা সাফফাত-এর ১০২ নাম্বার আয়াতে বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতার (ইবরাহিম) সাথে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম বললেন, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ কুরবানির যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হলো। ইবরাহিম (আ) পুত্রকে শুইয়ে কুরবানি করার উদ্যোগ নিতেই ‘ইবরাহিম থামো’ বলে আওয়াজ এলো। আর তখন কুদরতিভাবে আসা একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে গেল। হজরত ইবরাহিম (আ) আল্লাহর আদেশ পালনে সফল হলেন। পুত্রকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত ও আয়োজনে আল্লাহ খুশি হলেন। হজরত ইবরাহিম (আ) ও ইসমাইল (আ)-এর আত্মত্যাগ ও আল্লাহভীতির মহিমাকে স্মরণ করেই ঈদুল আজহায় কুরবানির উৎসব পালন করা হয়। দুনিয়ার প্রতিটি সঙ্গতিপন্ন মুসলমান এ দিনটিতে আত্মত্যাগের উদাহরণস্বরূপ পশু কুরবানি করে থাকে। আর যাদের কুরবানি করার সঙ্গতি নেই তারা আল্লাহর বিধান মতে কুরবানির গোশত পেয়ে একইভাবে সাওয়াব ও আনন্দের সাথে ঈদুল আজহা পালন করে। ১০ জিলহজ সারা পৃথিবীতে মুসলমানেরা যখন ঈদ উদযাপনের জন্য নামাজ ও কুরবানি করায় ব্যস্ত তখন মক্কা মুয়াজ্জামায় চলে আরেক বড় ইবাদাত হজ পালন। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সমর্থ প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ করা হয়েছে হজ। এ সময় সারা দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে হাজিরা হজব্রত পালন করার জন্য মক্কায় হাজির হন। তারা ইহরাম বেঁধে আরাফাতে অবস্থান, তাওয়াফ, সাঈ (সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি), কুরবানি ও মাথা মুণ্ডন ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে হজ পালন করেন। এভাবে জিলহজ মাসে মুসলমানেরা ঈদুল আজহার নামাজ, কুরবানি এবং হজব্রত পালন করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার পথকে সুগম করে। ঈদুল আজহার সময়কালে মুসলমানরা আত্মত্যাগের যে শিক্ষা লাভ করে তা মুসলমানদের কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্তি দেয় এবং তাদের মধ্যে মানবীয় বৃত্তির উৎকর্ষ সাধনে সহায়তা করে। প্রিয় বন্ধুরা! আমরা ঈদুল আজহার উৎসব এবং কুরবানির মর্ম ও প্রকৃত শিক্ষা বোঝার চেষ্টা করব। বড় হয়ে আমরা আত্মত্যাগের এই মহান দিনটিকে আরো সুন্দর ও সার্থকভাবে পালন করব। ঈদ যেন কেবল খুশি আনন্দের উৎসবে পরিণত না হয়ে এটি আমল ইবাদাতের সমন্বয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের দিন হিসেবে পরিগণিত হয়। ত্যাগ ও কুরবানির সমন্বয়ে যে পবিত্র দিন ঈদুল আজহা আমাদের সামনে সমাগত তা সবার জীবনে বয়ে আনুক শান্তি ও সমৃদ্ধির অনাবিল আনন্দ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ