ঈদুল আজহা ও কোরবানির শিক্ষা    -নাসির উদ্দীন হেলাল

ঈদুল আজহা ও কোরবানির শিক্ষা -নাসির উদ্দীন হেলাল

বিশেষ রচনা আগস্ট ২০১৫

পৃথিবীতে যেসব জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে তাদের সবারই জাতীয় উৎসব বা ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। মুসলিমদেরও রয়েছে বছরে দু’টি জাতীয় আনন্দ উৎসব। তবে মুসলিমদের উৎসবে অন্যান্য জাতির আনন্দ উৎসব থেকে বিস্তর ফারাক রয়েছে। জাহেলি যুগে অর্থাৎ ইসলামের আগমনের আগে আরবের মানুষ উৎসব পালন উপলক্ষে খেল তামাশা, হাসি, ঠাট্টা ইত্যাদি করতো।
হজরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখলেন মদিনাবাসী (যাদের অনেকেই হিজরতের আগেই ইসলাম কবুল করে মুসলমান হয়েছিলেন) দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করে থাকে। এ উৎসব উপলক্ষে আগের প্রথা অনুযায়ী খেল-তামাশা ও বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
রাসূল (সা) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা যে দু’টি জাতীয় উৎসব পালন কর এর মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কী? জবাবে তারা বললো, ইসলামের আগে আমরা এই ধরনের উৎসব পালন করতাম, এখনো সেটাই চলে আসছে। এ কথা শুনে রাসূল (সা) বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এ দু’টি উৎসবের পরিবর্তে আরো দু’টি উত্তম উৎসব- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন। অতএব আগের দু’টি উৎসবের পরিবর্তে দুই ঈদের নির্দিষ্ট সময় উৎসব পালন করতে শুরু করো।’ (আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ)
আমরা সবাই জানি রমজান মাসের রোজা পালন শেষে ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতর পালন করা হয়। আর ৯ জিলহজ পশু  কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদযাপন করা হয়। আর কোরবানি হলো হজ পালনের পরদিন পশু কোরবানি করে ত্যাগের মাধ্যমে যে উৎসব উদযাপন করা হয় তা। আসলে মুসলমানদের দু’টি উৎসবই আনন্দ উৎসব হলেও তা গাম্ভীর্যপূর্ণ ইবাদতের উৎসব।
‘কোরবানি’ আরবি শব্দ যার অর্থ উৎসর্গ। ‘কোরবু’ ধাতু থেকে শব্দটি উৎপন্ন। অর্থ নৈকট্য। মূলত আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য তাঁর নামে যা কিছু উৎসর্গ করা হয়, ইসলামের পরিভাষায় তাকে  কোরবানি বলে। অবশ্য ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ ঈদুল আজহা উপলক্ষে যে পশু জবাই করা হয় শরিয়তের পরিভাষায় তাকে কোরবানি বলা হয়। কুরআন ও হাদিসে কোরবান শব্দটি উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
যদিও আমরা হজরত ইবরাহিম (আ)-এর সুন্নত হিসেবে  কোরবানি করে থাকি কিন্তু কোরবানির ইতিহাস আরো প্রাচীন।
আসলে মানব সৃষ্টির আদি থেকেই কোরবানির ইতিহাস রয়েছে।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনী শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুই ভাই কোরবানি করলো কিন্তু একজনের  কোরবানি কবুল হলো আর একজনের কোরবানি কবুল হলো না।’ (সূরা মায়িদা ২৭)
বিষয়টি তাওরাতে এভাবে বলা হয়েছে, ‘পরে এক সময় কাবিল তার জমির ফসল  কোরবানি করলো। হাবিলও তার পাল থেকে প্রথমে জন্মেছে এমন কয়েকটি ভেড়া নিয়ে  কোরবানি করলো। মাবুদ হাবিল ও তার কোরবানি কবুল করলেন কিন্তু কাবিল ও তার  কোরবানি কবুল করলেন না।’ (পয়দায়েনা-৩, ৪,: ৩, ৪)
তাওরাতে হজরত নূহ (আ)-এর কোরবানির কথাও উল্লেখ আছে। নূহ (আ) কোরবানি করেছিলেন এবং আল্লাহ তাতে খুশি হয়েছিলেন।
হজরত ইবরাহিম (আ)-এর কোরবানির ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘ইবরাহিম (আ) বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম, তিনি আমাদের পথ দেখাবেন, হে রব আমাকে সৎপুত্র দাও। সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহিম (আ) তাকে বললো, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী বলো। সে বললো, পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের সাথে পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য করলো এবং তার পুত্রকে কাত করে শুয়ালো, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম তুমি তো সত্যিই স্বপ্ন আদেশ পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। এ ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তদস্থলে এক হৃষ্টপুষ্ট জন্তু কোরবানি দিলাম। আমি তা পরবর্তীতে স্মরণ রেখেছি।’ (সূরা সাফফাত : ৯৯-১০৮)
উল্লিখিত আয়াত কয়টিতে পরিষ্কার বোঝা যায় হজরত ইবরাহিম (আ)-এর প্রার্থনানুযায়ী আল্লাহ হজরত ইসমাইল (আ)-এর সুসংবাদ দেন অর্থাৎ হজরত ইসমাইল (আ)-এর জন্ম হয়। এরপর যখন তিনি কাজ করার বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইবরাহিম (আ) স্বপ্নে দেখলেন তিনি নিজ পুত্রকে জবাই করছেন। এ কথা ছেলেকে বলার পর ছেলে স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বললেন। সে মোতাবেক ইবরাহিম (আ) পদক্ষেপ নিলে আল্লাহর পক্ষ থেকে হৃষ্টপুষ্ট পশু কোরবানি হয়ে যায়। হজরত ইবরাহিম (আ)-এর ভূমিকায় আল্লাহ খুব খুশি হন।
হজরত ইবরাহিম (আ) সন্তান লাভ করেছিলেন ৮৬ বছর বয়সে। অর্থাৎ ইসমাইল (আ) ছিলেন তাঁর একেবারে বৃদ্ধ বয়সের সন্তান, যাকে আমরা বলি অন্ধের লাঠি। সেই সন্তানকে আল্লাহর রাহে বিনা বাক্যব্যয়ে তিনি তাঁর রবের মর্জিমাফিক জবাই করার উদ্যোগ নিলেন, এর থেকে বড় ত্যাগ আর কী হতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইবরাহিম (আ) পরবর্তীকালের মানুষের জন্য যে মহান শিক্ষা রেখে গেলেন সেটিই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে, যাতে মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত মহান রবের সন্তুষ্টির জন্য, তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার মতো অনুপ্রেরণা পেতে পারে।
অন্য দিকে কিশোর ইসমাইল (আ) পিতার কাছ থেকে স্বপ্নের কথা শুনে কোন বাদ-প্রতিবাদে না গিয়ে, কোনো জিজ্ঞাসায় না গিয়ে বললেন, ‘আপনি তাই করেন, যা আদিষ্ট হয়েছেন। আল্লাহ যদি চান, তাহলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত : ১০২)
সারা দুনিয়ার শিশু-কিশোরদের কাছে কিশোর ইসমাইলের এ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত অমর হয়ে আছে এবং থাকবে। আসলে পিতা-পুত্রের এ মহান ত্যাগের দৃষ্টান্তই কোরবানির শিক্ষা।
আল কুরআনে এ শিক্ষাকে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘বল, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু একমাত্র বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশে; আর তাঁর কোন শরিক নেই; আমাকে এরই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এবং সর্বাগ্রে আমিই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের শির নত করছি।’ (সূরা আনআম : ১৬৩-১৬৪)
আমরা যে কোরবানি করি, সে কোরবানি করাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বাস্তবে কিন্তু কোনো লাভ-লোকসানের কিছু নেই। কারণ কোরবানি করা পশুর গোশত, রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। আমরাই কোরবানির সমস্ত গোশত ভক্ষণ করে থাকি। আসলে কোরবানির মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি আমাদের ভক্তি, শ্রদ্ধা, আনুগত্য প্রভৃতির প্রকাশ ঘটে। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও তা-ই চান। কোরবানির অন্য শিক্ষা হচ্ছে এর মাধ্যমে মানুষ তার কুপ্রবৃত্তি অর্থাৎ যত ধরনের বদগুণ আছে তা দূর করার শিক্ষা পেয়ে থাকে। হজ ও কোরবানির মধ্য দিয়ে মানুষ নব জন্মলাভ করে।
আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখবো কোরবানির সময় ত্রুটিমুক্ত পশু কোরবানি করা হয়। যেনতেন পশু কোরবানি করলে কোরবানি হয় না। এখানেও শিক্ষা রয়েছে- আল্লাহর রাহে যে কোরবানি করা হচ্ছে তা ত্রুটিমুক্ত, নির্ভেজাল হতে হবে, কারণ তাঁর প্রতি আনুগত্য, বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা সহিহ হতে হবে।
কোরবানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ ইবাদতকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (আহমদ ও ইবন মাজা)
হজরত আয়েশা (রা) বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে রাসূল (সা) বলেন, ‘কোরবানির দিন রক্তধারা প্রবাহিত করার চাইতে বনি আদমের জন্য কোন কাজ আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়।’ (তিরমিজি ও ইবন মাজাহ)
কোরবানির পশুর ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বনের তাকিদ রয়েছে। যে কারণে যারা লোক দেখানোর জন্য পশু ক্রয় করে তাদের কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয় না। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করা যেতে পারে তবে তা মনে মনে। পশুক্রয়ের সময় হালাল পথে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সামর্থ্য মতো সর্বোত্তম পশু ক্রয়ের ক্ষেত্রে চেষ্টা করা যেতে পারে। বরং সেটাই ভালো। আর যদি তা নিজের ধন-ঐশ্বর্য প্রদর্শনের জন্য হয়, তবে তা থেকে বিরত থাকা একান্ত দরকার।
পরিশেষে বলা যায়, ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ আমাদেরকে সর্বস্ব ত্যাগের শিক্ষায় উদ্ভাসিত করে উদ্বোধিত করে, যাতে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সামর্থ্য, জ্ঞান-বুদ্ধি, অর্থ সম্পদ ব্যবহার করতে পারি। তাহলেই ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উদযাপন সার্থক ও সাফল্যমন্ডিত হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ