ঈদের আনন্দ

ঈদের আনন্দ

বিশেষ রচনা সেপ্টেম্বর ২০১০

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান

‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ। এর বিপরীত শব্দ ‘অঈদ’ অর্থাৎ নিরানন্দ। সারা বিশ্বে মুসলমানগণ প্রতি বছর হিজরি সনের অষ্টম মাস অর্থাৎ ‘রমজানে’ পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে ঈদ উৎসব পালন করে থাকে। এ আনন্দ কীসের, তা ভেবে দেখা উচিত। মানুষ সাধারণত কোন কিছু অর্জনের পর আনন্দ করে থাকে। যেমন সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে লেখাপড়া করে পরীক্ষায় ভাল ফল করার পর ছাত্রছাত্রীরা আনন্দ প্রকাশ করে। অথবা, কৃষক অনেক কষ্ট করে কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে চাষাবাদ করে যখন ফসল ঘরে তোলে তখন তার আনন্দের সীমা থাকে না। অনুরূপভাবে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিশ্রম করে যখন কিছু অর্জন করি তখন মনে এক গভীর আনন্দের অনুভূতি জাগে।

ঈদের আনন্দও তেমনি একটি অর্জন। এ অর্জন শুধুমাত্র রোজাদারদের জন্য। এটা কোন ছোটোখাট অর্জন নয়, কঠোর আত্মসংযমের মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করতে হয়। আর এ গুণটি হলো প্রকৃত মনুষ্যত্ব অর্জনের গুণ। অতএব, এর চেয়ে বড় কোন অর্জন হতে পারে না। রমজানের পূর্ণ এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার দ্বারা রোজাদারেরা এ গুণ অর্জনের চেষ্টা করেন। রোজা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কুরআনে উল্লেখ করেছেন : ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূববর্তী উম্মতদের জন্য দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে পার।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত : ১৮৩) এখানে ‘তাকওয়া’ অর্থ কী, তা জানতে হবে। এক কথায় ‘তাকওয়া’র অর্থ বলা কঠিন। অনেকে তাকওয়ার বাংলা অর্থ করেছেন ‘পরহিজগারি’, যার অর্থ পাক-পবিত্র থাকা। তাকওয়ার এটাও একটি অর্থ। কিন্তু এর দ্বারা তাকওয়া শব্দের পরিপূর্ণ অর্থ পাওয়া যায় না। তাকওয়ার অর্থ আরো ব্যাপক ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। মহান রবকে সর্বদা, সর্বাবস্থায় সকল কাজ, কথা, চিন্তা ও আচরণে স্মরণ করা, তাঁর আদেশ-নিষেধ নিষ্ঠার সাথে মেনে চলা, তাঁর কঠোরতার বিষয়ে ভীত থাকা ও তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করাÑ এটাই তাকওয়া। এভাবে আল্লাহকে যে স্মরণ করে, প্রকৃতপক্ষে সে কখনো কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে না। অবৈধ-অনৈতিক চিন্তাও তার মাথায় আসতে পারে না। তার কথা ও আচরণ হয় নম্র-ভদ্র, মার্জিত ও বিনয়পূর্ণ। সকল পাপ-পঙ্কিলতা ও অন্যায় আচরণ থেকে সে নিজেকে সর্বদা পবিত্র রাখতে সচেষ্ট হয়। উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে বোঝা গেল, তাকওয়া এমন একটি মানবিক গুণ যা মানুষকে আল্লাহর নির্দেশ মতো পরিচালিত করে এবং মানবীয় সৎ-গুণাবলি অর্জন ও সকল মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। রোজা কীভাবে তাকাওয়া অর্জনে সাহায্য করে, এবারে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই রোজা রাখার নিয়ম-পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। রোজাদার সূর্যোদয়ের পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকম পানাহার পরিত্যাগ করেন। কিন্তু শুধুমাত্র পানাহার পরিত্যাগ করার নাম রোজা নয়। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন : “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, তার শুধু খানাপিনা পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী) উপরোক্ত হাদিস থেকে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার পরিত্যাগ করার নাম রোজা নয়। রোজাদারের পক্ষে মিথ্যা কথা বলা এবং সকল অবৈধ-অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যাবশক। হাদিসটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি যে, মিথ্যা কথা বলা ও অন্যায় কাজ করার ফলে মানুষ দুরাচারগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে অমানুষ হিসেবে গণ্য হয়। অতএব, ভাল মানুষ হওয়ার জন্য মিথ্যা কথা বলা ও অন্যায়-অবৈধ কাজ পরিহার করা অপরিহার্য। রোজা এভাবে আমাদেরকে সৎ ও ভাল মানুষ হতে সাহায্য করে। আল্লাহর রাসূল (সা) অন্য আরেকটি হাদিসে বলেন : ‘রোজা ঢালস্বরূপ।’ তোমাদের কেউ কখনো রোজা রাখলে তার মুখ থেকে যেন খারাপ কথা বা গালিগালাজ বের না হয়। কেউ যদি তাকে গাল-মন্দ করে বা ঝগড়া বিবাদে প্ররোচিত করে তবে সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’ (সহীহ বোখারী ও মুসলিম) এ হাদিসটিতেও আল্লাহর রাসূল (সা) মানবীয় দুর্বলতার একটি বিশেষ দিকের উল্লেখ করেছেন। খারাপ কথা বলা, গালিগালাজ করা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া অত্যন্ত অভদ্র ও গর্হিত কাজ। এর দ্বারা মানুষে মানুষে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, পরিবারে ও সমাজে বিবাদ-বিসংবাদ ও ফাসাদ সৃষ্টি হয়। সমাজে শন্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। সাধারণত আমরা জানি, যে ব্যক্তি ফাহেসা কথা বলে, গালিগালাজ করে, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়, তাকে কেউ ভদ্র বা ভাল মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না। মোটকথা, আত্মসংযম ও তাকাওয়া (আল্লাহসচেতনতা) অর্জন হলো রোজার প্রকৃত শিক্ষা। এ শিক্ষার দ্বারা শুধু রমজান মাসেই অনুপ্রাণিত হতে হবে তা নয়, বছরের বাকি এগারটি মাস তথা সমগ্র জীবনই এ শিক্ষা অনুযায়ী চলা বাঞ্ছনীয়। রমজানের রোজা রোজাদারদেরকে সে প্রশিক্ষণই দান করে। কোন মু’মিন ব্যক্তি কঠোর সাধনার মাধ্যমে রমজান মাসে যেসব মহৎ গুণাবলি অর্জন করে, রমজান মাস শেষ হলেই সে সব গুণাবলি সে পরিত্যাগ করবে এটা কাম্য নয়। কোন মু’মিন কখনো তা করতে পারে না। আল কুরআন হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির জন্য এক পরিপূর্ণ হিদায়াত তথা গাইড বুক। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতার মাধ্যমে মহানবীর (সা) কাছে ওহি হিসেবে এটি অবতীর্ণ হয়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় তথা বৈশ্বিক জীবনের সকল দিক ও পর্যায়ের এক পরিপূর্ণ, নির্ভূল ও সর্বোত্তম গাইড লাইন প্রদান করেছে আল-কুরআন। একমাত্র এ গাইড লাইনের অনুসরণেই সামগ্রিক মানবজীবনের সকল পর্যায়ে শান্তি, কল্যাণ ও সাফল্য অর্জন সম্ভব। এ গাইড লাইন ব্যতিরেকে অন্য কোন দর্শন, জ্ঞন ও প্রযুক্তিই যে পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নয়, পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের কাছে তা বারবার প্রমাণ করেছে। তাই এ মহান আসমানী কিতাবকে ধারণ, উপলব্ধি ও সঠিকরূপে তা অনুসরণের জন্য এ রমজান মাসকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কেননা এ মাসেই কঠোর সিয়াম-সাধনার দ্বারা মানুষ সে গুণাবলি অর্থাৎ তাকাওয়া অর্জনে সক্ষম হয়, যে তাকওয়ার গুণ ব্যতীত আল-কুরআন বোঝা ও অনুসরণ করা সম্ভব নয়। অতএব, রমজান মাস মানবজাতির নিকট নানা দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিসীম নিয়ামতপূর্ণ মাস। এ মাসে সঠিকভাবে ইবাদত করতে পারলে মানুষ তার পূর্বকৃত সকল গুনাহ মাফ পেয়ে এক উন্নত মহৎ-জীবনের অধিকারী হতে পারে। রমজান মাসের এ প্রাপ্তিকে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলা যায়। কেননা মানবিক সর্বোচ্চ গুণাবলি অর্জনের চেয়ে বড় কোন প্রাপ্তি জীবনে থাকতে পারে না। সকল প্রাপ্তির মধ্যে এক অনাবিল আনন্দ রয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন রমজানের এ প্রাপ্তির পরে আনন্দ প্রকাশের জন্য একটি দিন ধার্য করেছেন। সে দিনটির নাম ঈদুল ফিতর। রমজান মাস অতিক্রান্ত হয়ে শাওয়ালের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়ে থাকে। এ গুণ অর্জনের উদ্দেশ্যেই রোজাকে ফরজ করা হয়েছে। এবং এ গুণকে সমৃদ্ধ, স্থায়ী ও সমগ্র মানবজাতির মধ্যে বিস্তৃত করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই রমজানে আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। এ সকল মহান প্রাপ্তির শুকরিয়া স্বরূপ ঈমানদারগণ ঈদের আনন্দে শরিক হয়ে থাকে।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ