উপলব্ধি    -ফাতেমা নার্গিস

উপলব্ধি -ফাতেমা নার্গিস

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সকালে উঠেই রান্নাঘরে ঢোকেন নিশাত। ছেলেদের কলেজ ইউনিভার্সিটি যাওয়া। বাড়ির কর্তার অফিস যেতে হবে সুতরাং ভোরে উঠেই সকলের নাস্তার ব্যবস্থা করতে হয়। রান্নাঘরে ঢুকেই দেখেন ময়লা রাখার বালতিটা কাত হয়ে আছে। দ্রুত হাতে বালতি তুলে ময়লাগুলো তুলে ফেলেন। কালও ময়লা নিতে আসেনি। অথচ ময়লা নিতে আসা ছেলেটিকে তিনি খুবই স্নেহ করেন। দ্রুত হাতে নাস্তা তৈরি করেন। ছেলেরা রান্নাঘরে ঢুকেই বিরক্তি প্রকাশ করে -
-আম্মু কালও কি ময়লা নিয়ে যায়নি?
- ছেলেটি কাল আসেনি হয়তো বা কোন সমস্যায় পড়েছে।
- আম্মু তুমি তো সবারই সমস্যা দেখ শুধু। অথচ মাস যেতে না যেতেই তো বিলের টাকার জন্য হাজির হয়।
-তা বাবা। তাদের তো মানুষের প্রাণ। আর একবার ভাবো তো ওরা যদি না থাকে তবে - তোমাদের মতো ভদ্রলোকেরা এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে কী করে?
-না আম্মু তোমার সাথে কথা বলে পারা যাবে না। আমার নাস্তাটা দিয়ে দাও। আমি খেয়ে চলে যাই। একে একে সবাই নাস্তা করে চলে যায়। বাসায় নিশাত একাই থাকে। এমন সময় কলিংবেল বাজলো। নিশাত দ্রুত হেঁটে দরজা খুলেন। ময়লা নিতে এসেছে। ছেলেটির জামা প্যান্ট সবই নোংরা। চেহারা মলিন। ঠোঁটের কোনে ঘা। চোখ দুটো বিষণ্ণ। নিশাত প্রশ্ন করেন-
- কিরে কাল যে ময়লা নিতে আসলি না?
-আমি তো কাইলকা আইতে পারি নাই খালা। তয় অন্য কেউ আসে নাই? নিশাত জিজ্ঞেস করেন তোর নাম কি বাবা?
- জাহাঙ্গীর।
-বাহ! ভারি সুন্দর নাম তো। বাড়িতে কে কে আছেন?
-মা আর নানী।
-বাবা নাই তোর?
বাবারে দেখি নাই। হে নাকি আমারে মায়ের কোলে রাইখ্যাই মইরা গেছে।
-আহা! তাহলে তো তোর মায়ের ভারি কষ্ট। খালা ময়লাগুলা দেন তাড়াতাড়ি আমার তো খাড়ানোর সময়ও নাই।
নিশাত তাড়াতাড়ি ময়লা নিয়ে আসেন আর সাথে নিয়ে আসেন দুটো রুটি আর ডিম ভাজি। ছেলেটি নাস্তা দেখে খুশি হয়ে হাসে।
-খালা হাতে তো ময়লা। আপনি আমারে একটা পলিথিনের ব্যাগে দিয়া দেন। আমি পরে খায়া লমুনে।
-নিশাত তাড়াতাড়ি করে নাস্তাটা একটি ব্যাগের মধ্যে দিয়ে দেন।
-এই হাত ধুয়ে খাস কিন্তু। আর কখনো কোন দরকারে যদি মনে হয় যে আমি সাহায্য করতে পারবো তবে তুই লজ্জা না করে চলে আসিস। সরল হাসি হাসে জাহাঙ্গীর।
দ্রুত পায়ে ময়লা নিয়ে চলে যায় ছেলেটি। নিশাত ভাবেন এই যে হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো পর পর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে কত বিত্তশালী মানুষ বসবাস করেন। কিন্তু এই দরিদ্র অসহায় ছেলেগুলো যদি ময়লা আবর্জনাগুলো পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত না থাকতো তবে এই শহরের অবস্থা কেমন হতো?
হঠাৎ একদিন দুপুরে বই পড়ছিলেন। কলিংবেল বাজলো। দরজা খুলে দেখেন জাহাঙ্গীর। বিস্মিত হন নিশাত-কিরে জাহাঙ্গীর? কোথায় ছিলি এতদিন?
-খালা নানী মইরা গ্যাছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে জাহাঙ্গীর। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যান নিশাত।
-সে কি! কখন মারা গেল?
-এই তো সকালে। মায়েতো খালি কানতাছে আর ঘরে তো টাকা পয়সা কিছু নাই।
তোদের কোন আত্মীয়-স্বজন কেউ নাই? পাড়া প্রতিবেশী তারা কি করছে?
-খালা আমাগো তো কেউ নাই। নানী গো বাড়ি আছিল মানিকগঞ্জ। আমার মায়ে যখন নানীর কোলে আছিল তখন থাইক্যা আর নানার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই।
-কেন? নানা কোথায় থাকতো?
-নানা তো শুনছি ঢাকায় হকারি করতো। তখন নাকি ঢাকা শহরে ভাষা আন্দোলন চলতেছিল।
পুলিশ নাকি মানুষের উপর গুলি করছিলো নানায় নাকি তখন গুলি খাইয়া মরছে। নানার লগে পাশের গ্রামের আর একজন ছিলো। হে কইছে, হে নাকি দেখছে পুলিশে নানার লাশ ট্রাকে তুইল্যা লইয়া গেছে। এরপর তো নানার ভাইয়েরা আর নানীরে তাগো বাড়ি থাইক্যা বাইর কইরা দিছে। নানী তো মারে কোলে কইরা তার বাপের বাড়িতে আইয়া পড়ছিল। যতদিন নানীর বাপ আছিলো ততদিন নানীরে আর মায়েরে দেখছে। হের পর নানায় মইরা যাওনের পর নানীর ভাইয়েরা আর নানীরে থাকতে দিলো না। একজন অসুস্থ মানুষের লগেই মায়ের বিয়া দিয়া হেগো দায় শেষ করলো।
-তা তোর আর ভাই বোন নাই?
-আছে তো। তারা তো এখন বড় হইয়া বিয়া শাদি কইরা আলাদা হইয়া গেছে।
-তারা কি আর তোর মায়ের খোঁজ খবর নেয় না?
-খালা খোঁজ খবর নিলে কি আর আমি ময়লার গাড়ির কাম করি? আর মা এই বয়সে মানুষের বাসায় বাসায় কাম করে?
এই ক্রন্দনরত ছেলের দিকে তাকিয়ে নিশাত গভীর মমত্ব অনুভব করেন। বলেন-
-আর কাঁদিস না জাহাঙ্গীর। চল তোর নানীর তো দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। বলে ঘরে যা টাকা পয়সা ছিলো তা নিয়ে জাহাঙ্গীরের হাত ধরে তাদের বস্তিতে যান নিশাত। জাহাঙ্গীর তার মাকে ডাক দেয়।
-মা এই দ্যাখ। এই খালায় আইছে নানীরে দেখতে। জাহাঙ্গীরের মায়ের হাত ধরে তোলেন-
-কাঁদছো কেন? তোমার মাতো ভাষা সৈনিকের স্ত্রী। তাকে যোগ্য মর্যাদায় দাফন করতে হবে। নিশাত কে দেখে দ্রুত পাড়ার ছেলেরা একত্রিত হয়। নিশাত বলেন-দ্যাখ তোমরা জান না এই বৃদ্ধা মহিলা যিনি আজ ইন্তেকাল করেছেন তিনি ভাষা শহীদের স্ত্রী। অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা সয়েছেন সারা জীবন। এখন তাকে দাফন করতে হবে। এই সময় একজন ব্যক্তি প্রশ্ন তোলেন-শুনেছি এই বৃদ্ধার স্বামী হকার ছিলেন তিনি কিভাবে ভাষা শহীদ হলেন?
-ভুল শুনেছেন। ঐ আন্দোলনে যারাই পুলিশের হাতে শহীদ হয়েছে তারা সবাই ভাষাশহীদ।
-নিশাত জাহাঙ্গীরের মায়ের হাতে টাকা তুলে দেন। ঠিকমতো যাতে দাফন সম্পন্ন হয় সে জন্য নিজেই সব কিছুর তদারক করলেন। দাফন করতে করতে বেলা ৫টা হয়ে গেলো। জাহাঙ্গীর আর তার মাকে সান্ত¡না দিয়ে নিশাত ফিরে আসেন বাসা। ছেলেরা বাড়ি ফিরে আসে। মাকে বিমর্ষ দেখে বলে-কী হয়েছে আম্মু?
গভীর বেদনায় মুহ্যমান নিশাত সম্পূর্ণ ঘটনা ছেলেদের বলেন। ছেলেরা মাকে বলে-আম্মু তোমার জন্য আমাদের গর্ব হয়। তুমি মানুষের জন্য কত ভাবো। কিন্তু যাদের অর্থ বিত্ত ব্যাংক ব্যাল্যান্স প্রচুর তাদের অধিকাংশই কোন দিন সাধারণ মানুষের খবরও রাখে না। অথচ তুমি একজন মধ্যবিত্তের সংসার কত কষ্ট করে পরিচালনা কর। তবু তুমি মানুষের জন্য কত কিছু করো। নিশাত ছেলেদের কথা শুনে হাসেন। বলেন- এ মানব জীবন সফল কিসে হবে জানো বাবা?
কেন আম্মু? কিভাবে সফল হবে।
- হ্যাঁ বাবারা জেনে রেখ “পুষ্প নিজের জন্য ফোটে না। তোমার হৃদয় কুসুম পরের জন্য প্রস্ফুটিত করো।”
-এ ঘটনার কিছু দিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি। বাড়ির কর্তা তখনো পত্রিকা পড়ছেন। কলিংবেল বাজলো নিশাত দ্রুত পায়ে দরজা খুললেন। দেখলেন জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে অনেক ফুল।
-কিরে হাতে ফুল কেন?
-আমি এই ফুল আপনার লাইগ্যা লইয়া আইছি। আপনিই তো আমাগো এত সম্মান দিলেন। আপনি না কইলে কেউ জানতো না আমার নানা ভাষাসৈনিক আছিলো। তাই তো আমি যতদিন বাঁচমু ততদিন আপনার লাইগ্যা ফুল লইয়া আমু। এসব কথা শুনে আবেগে-আপ্লুত হন নিশাত। জাহাঙ্গীরকে জড়িয়ে ধরেন। জাহাঙ্গীরের চোখের পানি আর নিশাতের চোখের পানি একই সমান্তরালে পড়তে থাকে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ