উৎসবে আনন্দে  বাংলা নববর্ষ

উৎসবে আনন্দে বাংলা নববর্ষ

প্রচ্ছদ রচনা এপ্রিল ২০১৪

মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

Prochchedবাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করায় আমাদের কিছু জাতিগত গৌরব এবং অহঙ্কার রয়েছে যেগুলো অনেক দেশেরই নেই। এর একটি হলো আমাদের জাতিসত্তার আলাদা পরিচয়, আমাদের নিজস্ব উন্নত বর্ণমালা, শব্দসম্ভারে সমৃদ্ধ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা, আমাদের নিজস্ব সন বাংলা সন ইত্যাদি। একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন আমাদের ভাষার স্মারকস্তম্ভ তেমনি পয়লা বৈশাখ আমাদের বাংলা সনের বছর গণনার শুরুর দিন। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি আনন্দের দিন, উৎসবের দিন, পূত-পবিত্র হওয়ার দিন, পুরাতনের খোলস ঝেড়ে ফেলে নতুনের যাত্রা শুরুর দিন। বছর ঘুরে ফাল্গুনের হালকা গরমে যখন শীত বিদায় নিতে শুরু করে এরপরই চৈত্রের কাল বৈশাখী এসে ধূলাবালি সব উড়িয়ে প্রকৃতিকে সাফ-সোতর করে নতুন দিনের যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি নেয়। নতুনের আহ্বান নিয়ে আসে বৈশাখ। আমাদের আর্থসামাজিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও নীতি-নৈতিকতার ইতিহাসের পাতায় তাই দেখতে পাই পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। মানুষ তার প্রয়োজনে সময় ও কাল গণনার এই যে রীতি আবিষ্কার করে নিয়েছে এটি মানবজাতির আদিম কালের প্রবৃত্তি এবং মানুষের সহজাত সংস্কৃতির অংশ। পৃথিবীর দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে নানা সন গণনার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে এর পেছনেও রয়েছে স্বয়ং আল্লাহপাকের বিশ্বজনীন নিয়ম। পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বছর গণনার মাস বারটি।’ কুরআনের সে শাশ্বত ঘোষণার আলোকেই পৃথিবীর দেশে দেশে সন এবং বছর গণনার নানা পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। আর পৃথিবীতে যত দেশে যত সন আছে সবগুলোরই ১২ মাসে বছর। অবশ্য সৌরমাসভিত্তিক এবং চান্দ্রমাস ভিত্তিক গণনার ভিন্নতায় এসব সনের পরিধিগত বেশ-কমও রয়েছে। সন গণনার সে বিশ্বজনীন সংস্কৃতির পথ ধরেই আমাদের বাংলাদেশেও নানা যুগে নানা সন প্রবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন শক সনের পথ ধরে এখানে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বৎ, মঘী সন, নেপাল সম্বৎ, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ সম্বৎ, পরগনাতি সন, শাহুর সন, হিজরি সন, ঈসায়ি বা খ্রিষ্টীয় সন, বাংলা সন, জালালি সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে আবার কোন কোনটা চান্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে। বাংলা সন প্রবর্তিত হয়েছে সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ ঈ.) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলি সন নামে যে সন প্রবর্তন করা হয় কালে তাই বাংলাদেশে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মূলত জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এ সন প্রবর্তন করা হয়। এর আগে এ দেশের দেশীয় সন হিসেবে শকাব্দের প্রচলন থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরি সন চালু ছিল গোটা ভারতবর্ষে। আর এ কারণেই হিজরি সনকে ভিত্তি বছর ধরে এ বাংলা সনেরও প্রবর্তন করা হয়। অন্য দিকে এ সনের মাসের নামগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। এভাবে দেখা যায় সনটি প্রবর্তনে এখানকার প্রধান দু’টি ধর্ম অর্থাৎ হিন্দু এবং ইসলাম উভয় ধর্মের একটি প্রভাব সনটির ওপর পড়েছে। এ ক্ষেত্রে হিজরি সনকে যদি আমরা বাংলা সনের মায়ের মর্যাদা দেই তাহলে শকাব্দকে দিতে হয় মাসীর মর্যাদা। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রেই এ ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিমের এ মিলিত স্রোত সনটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সন প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফলে সন প্রবর্তনের সময় থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজও গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষের কাছে আপনি যদি আজ কত তারিখ জানতে চান তাহলে তিনি হাতের আঙুলে গুনে আপনাকে আজ বাংলা সনের কোন মাসের কত তারিখ তা বলে দেবে। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর দ্বিতীয় গুরুত্ব হচ্ছে হিজরি সন বা চান্দ্র মাসের হিসাব। ইংরেজি সন গ্রাম্য মানুষের কাছে আজও ব্যাপক হারে স্থান করে নিতে পারেনি। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে এ সনের হিসাবে এবং তা আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই চলছে। সমাজের সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত বাংলা সন ব্যবহৃত হবার কারণে মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সাথী হয়েছে এ সনটি। এ কারণেই দেখা যায় বাংলা সনের প্রথম দিনটি অর্থাৎ পয়লা বৈশাখকে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়ে থাকে। এবার পয়লা বৈশাখ উদযাপন এবং বাংলা সনকেন্দ্রিক যেসব উৎসব আয়োজন আছে সেগুলোর দিকে একটু নজর দেয়া যাক।

পুরাতন বর্জন আর নতুনের আহ্বান পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের অংশ এটি। একজন মানুষ যাতে সারা বছর তার নিজের এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পারে সে জন্য পয়লা বৈশাখে নেয়া হয় বিশেষ আয়োজন। এটি একটি ধারণা যে বছরের শুরুর দিনটি যদি সুন্দরভাবে করা যায় তাহলে হয়তো সারাটি বছর তার সুন্দর যাবে। তাই পয়লা বৈশাখের দিনে সবাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করে। কৃষক পরিবারের মেয়েরা ঘরের মাটির ভিটা এবং দুয়ার লেপে-পোঁছে সুন্দর করে রাখে। হিন্দু পরিবারে কাদামাটির সাথে গোবর মিশিয়ে লেপা-পোঁছা করা হয় এবং তুলসী গাছের গোড়ায় ফুল রাখা হয়। মুসলমান পরিবারের লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে হাত-মুখ ধোয় এবং অজু সেরে নামাজ পড়ার পর কুরআন তেলাওয়াত করে। কৃষক তার কৃষির সরঞ্জাম লাঙ্গল-জোয়াল-মই ইত্যাদি ধোয়। গরুকে গোসল করায় এবং ভাল খাবার দেয়। গরুর গোশালা পরিষ্কার করে। মাছি যাতে গরুর কাছে না ভিড়তে পারে সে জন্য প্রয়োজনে ধোঁয়া দেয়। ছেলে মেয়ে যাতে নিজ নিজ কাজ যথাসময়ে এবং যথানিয়মে করে সে দিকে অভিভাবকগণ একটু আলাদা নজর রাখে। ধূপ দুরস্ত পরিষ্কার পোশাক পরে একে এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। মিথ্যা বলা বা কাউকে ঠকানো থেকে বিরত থাকে। ইচ্ছে করেই এদিন মানুষ কারও বাড়ির অতিথি হয় না। মনে করা হয় তাহলে সারা বছরই পরের বাড়িতে বেড়াতে বেড়াতে কাটবে। মানুষ একে অন্যের সাথে আচার আচরণে সতর্কতা অবলম্বন করে যেন বছরের প্রথম দিনে কোন অনাকাক্সিক্ষত কিছু না হয়। এ উপলক্ষে কোন কোন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মিছিল, শোভাযাত্রা, বর্ষবরণ ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষজনও কর্মছুটির সুযোগে এদিন নানা রঙের পোশাক পরে ব্যাপক হারে বাজারে, মেলায় ও পার্কগুলোতে ভিড় জমায়। খাবারের আয়োজন পয়লা বৈশাখের সংস্কৃতির একটি দিক হলো এ দিনের খাওয়া দাওয়া। আমরা যারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করে নববর্ষের এ দিনটি বহুবার গ্রামে পালন করার সুযোগ পেয়েছি তারা দেখেছি এ দিন প্রত্যেকে তার নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা সম্ভব ভাল খাবারের আয়োজন করে। পারতপক্ষে এদিন আগের দিনের বাসি খাবার যাতে ঘরে না থাকে সেদিকে সকলেই একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখে কারণ বছরের প্রথম দিনটি যদি বাসি-পান্তা খাবার দিয়ে শুরু হয় তাহলে তার সারা বছরই হয়তো এরকম খারাপ খাবার খেয়ে কাটাতে হবে। এ জন্যই প্রত্যেক পরিবার সাধ্যমত ভাল খাবার পরিবেশনের চেষ্টা করে। সকাল সকাল গরম ভাতের সাথে বিশেষ করে নানা জাতের শাক এবং মাছ-গোশত খেয়ে থাকে। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে এসে এখন যা দেখছি তা কিন্তু মোটেও গ্রামের সংস্কৃতি নয়। শহরে বিশেষ করে রাজধানী শহর ঢাকার রমনা বটমূলে বা কোন কোন হোটেলে পান্তাভাত খাওয়ার যে দৃশ্য আমরা দেখি তা আমাদের সংস্কৃতি নয়। গ্রামে যেখানে ঐদিন খুব সতর্কতার সাথে পান্তাভাত পরিহার করে চলা হয় সেখানে শহুরে মেকি সংস্কৃতিজীবীরা ঐদিন পান্তাভাত খাওয়ার হেতুটি কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন। গ্রামে ঐদিন গরম ভাত এবং সাধ্যমত মাছ বা গোশত খাওয়া হয় এ আশায় যেন সারা বছর গরম ভাত এবং ভালো তরকারি চাষার ভাগ্যে জোটে। পয়লা বৈশাখে পান্তাভাত খাওয়া কোনো কালেই আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ ছিল না এবং আজও নেই। এটি শহুরে ‘পেঁচক সংস্কৃতির’ একটি উদ্ভট আবিষ্কার। যতদূর গবেষণা চালিয়ে জানা গেছে পুরান ঢাকার লোকেরা এ পান্তা সংস্কৃতিকেও কুসংস্কারবশত একটি ধর্মীয় বিষয় ভেবেই এর প্রচলন করেছিল। তারা আগের দিন রাতে যে খাবারটি রেঁধে রাখতো তাই পরদিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের দিন খেয়ে নিতো। তারা এটিকে আগের দিনের রান্না সাব্যস্তক্রমে পরদিন খেত এবং এ প্রসঙ্গে তাদের একটি বিশ্বাস রয়েছেÑ আগের দিনের ভাত যে পরের দিন খায় আল্লাহর কাছে যাই চায় তাই সে পায়। নিছক একটি কুসংস্কার ও ধারণার বশবর্তী হয়ে পুরান ঢাকার অধিবাসীরা এ ধারাটির প্রবর্তন করে। এটি একটি ঢাকাইয়া সংস্কৃতি। জাতীয়ভাবে এর কোন ভিত্তি নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালের ২ মে তারিখে ঢাকার ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার, শিল্পী, অভিনেতা জনাব খান আতাউর রহমান সাহেব তাঁর ‘জয়বাংলা’ নামক একটি লেখায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে পয়লা বৈশাখে পান্থাভাত খাওয়ার কথা এ দেশীয় সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেন। তিনি সম্ভবত ঢাকাইয়া স্থানীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ কাজটি করে থাকবেন। তার সে সময়ের এ লেখাটি ছিল নেহাতই রাজনৈতিক। কারণ সত্তরের দশকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের নিজস্ব চেতনায় জাগ্রত করার নানা প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। এটিও ছিল সে ধারারই একটি পদক্ষেপ। গ্রামের লোকেরা পয়লা বৈশাখে কখনোই পান্তা খাওয়ায় অভ্যস্ত নয়। তবে গ্রামের লোকেরা আগে ‘কাঞ্জি’ পেতে এবং ‘পঁছওয়া’ নামক এক ধরনের খাবার চাল এবং ভাত থেকে তৈরি করে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। এটি পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক কোন বিষয় ছিল না। বছরের যেকোনো দিন বা সময় তারা এটি তৈরি করতো এবং অনেকটা পথ্য ভেবে বা শখের বশে খেতো। কাজেই কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই ঢাকাইয়া এ কুসংস্কার ও খান আতার লেখাকে ভিত্তি ধরে পান্তা খাওয়ার সংস্কৃতিকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকতা দান করা হয়েছে তা মোটেও ঠিক হয়নি। হুজুগের বশে এটি এখন চলছে। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ তৎকালীন পাকিস্তান আমলে এগুলো ছিল রাজনৈতিক মতবাদপুষ্ট লেখা। এখন দেশ স্বাধীন। তাই এ ধরনের প্রবিষ্ট মতবাদ দিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা না করে আমাদের এখন উচিত হবে এ দেশের শেকড় থেকে উৎসারিত সত্যিকারের সংস্কৃতিকে জানা ও চর্চা করা। হাটবার গ্রামের কোন বটতলায় বা নির্দিষ্ট কোন মাঠে বা রাস্তার মোড়ে সপ্তাহের নির্দিষ্ট কোনো বারে বা একাধিক নির্দিষ্ট বারগুলোতে বেচাকেনার যে আয়োজন হয় তাকেই বলে হাট। সপ্তাহের সাত দিনই যদি বেচাকেনা হয় তাহলে তাকে বলে বাজার। বাংলাদেশের এ হাটগুলো বসে বাংলা মাসের বারগুলোর হিসাবে। এটি বাংলা সনের একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব। গ্রামের মানুষের একত্রে মিলনের এটি একটি প্রাচীন চলমান ধারা। মেলা এবং বৈশাখী মেলা হাটের বিপরীতে মেলা হলো আরেকটু ভিন্ন মেজাজের। হাট যেখানে সপ্তাহের কোন নির্দিষ্ট দিনে বসে সেখানে মেলা বসে বছরের কোন নির্দিষ্ট দিনে বা নির্দিষ্ট একাধিক দিন ধরে। বিভিন্ন বিষয়কে উপলক্ষ করে মেলা বসে থাকে। এসব উপলক্ষের মধ্যে বছরের শুরুর দিন হিসেবে পয়লা বৈশাখ দেশের বিভিন্ন যায়গায় মেলা বসে থাকে যাকে বলা হয় বৈশাখী মেলা। মেলায় বিশেষ করে হাতে তৈরি কুটির শিল্পের নানা জিনিস যেমন- চেয়ার, টেবিল, চৌপায়া, বেলাইন, পিঁড়ি, রেহেল, লাঠি, ইঁদুর ধরার ফাঁদ, নারিকেল কুড়ানি, গাঁইল, চেগাইট, খড়ম, পাউডি, ডালঘুটনি, ঘুড়ির নাটাই, মাটির তৈরি রকমারি জিনিস, খেলনা, মুড়ি, খৈ, মণ্ড, মিঠাই, জিলাপি, বাতাসা, তিল্লা ইত্যাদি খাবার দ্রব্য, ঘুড়ি, বাঁশি, পুতুল, পাখি ইত্যাদি বেচা কেনার পাশাপাশি এবং হাট-বাজারে বেচা কেনার জিনিসপত্রও বিক্রি হয়। এসব মেলার মাধ্যমে মূলত দেশীয় দ্রব্যাদি বেচাকেনার কারণে দেশীয় শিল্প বিশেষ করে কুটির শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয় এবং দেশীয় চেতনা জাগ্রত হয়। এসব মেলায় চরকগাছ, নাচ, গান, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, সার্কাস ইত্যাদির আয়োজনও হয়ে থাকে। হালখাতা আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা:) বলেছেন ‘সেই লোকই ভালো যার লেনদেন ভালো।’ এ কথাটি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের লোকই কম-বেশ পালন করার চেষ্টা করে। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার হিসাব রাখে খাতায়। ব্যবসা চালাতে গিয়ে অনেক সময় বাকিতে মালামাল বিক্রয় করতে হয়। কিন্তু এটি সকলেরই জানা যে, পয়লা বৈশাখের আগে যার কাছে যা পাওনা আছে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। কেননা ব্যবসায়ী পুরনো খাতার বকেয়া নতুন খাতায় তুলতে চান না। বছরের প্রথম দিন থেকে খোলা হয় নতুন খাতা যাকে বলে হালখাতা। আর এ খাতাখোলার দিনই আয়োজন করা হয় হালখাতা নামক অনুষ্ঠানের। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ের সাথে জড়িত লোকজন সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়। যাদের বকেয়া আছে তারা বকেয়া পরিশোধ করেন আর যাদের বকেয়া নেই তারাও কুশল বিনিময় করতে আসেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আগতদের মিষ্টিমুখ করা হয়। মিলাদ মাহফিল ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’ আল্লাহর রাসূল নিজে ছিলেন ব্যবসায়ী। এ জন্যই মুসলমান মাত্রই ব্যবসাকে হালাল রুজির একটি পবিত্র মাধ্যম মনে করে। বাংলাদেশে বাংলা মাসের হিসেবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলার কারণে অনেক নতুন ব্যবসায়ী তার ব্যবসা শুরুর দিন হিসেবে বেছে নেয় পয়লা বৈশাখকে। এ দিন ঐ দোকানে আয়োজন করা হয় মিলাদের। মিলাদ মানে হলো নবীর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনা। যেহেতু নবী নিজে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন তাই ব্যবসা শুরুর দিন নবীর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনার মাধ্যমে পবিত্র জ্ঞানে ব্যবসা শুরুর জন্যই আয়োজন করা হয় মিলাদ অনুষ্ঠানের। এ ধরনের অনুষ্ঠানে নবীর জন্মবৃত্তান্ত আলোচনার পাশাপাশি তাঁর সিরাত বা জীবনীও আলোচনা করা হয় এবং মিলাদের আলোচনার পর দোয়া ও মুনাজাত করে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে শেষ হয়। পয়লা বৈশাখে এ ধরনের অনুষ্ঠান একটি পবিত্রতার আমেজ এনে দেয়। বইমেলা, বই উপহার বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গত কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন ধারা আর তাহলো বইমেলা। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নানা স্থানে বিভিন্ন ক্লাব বা পাঠাগারের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বইমেলার। এ ছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী নববর্ষ উপলক্ষে প্রিয়জনকে বই উপহার দেবার যে আহ্বান জানিয়েছেন তার দ্বারাও লোকেরা অনুপ্রাণিত হয়েছে। ফলে ঐদিন বই কেনা এবং প্রিয়জনকে বই উপহার দেয়া একটি রীতিতে পরিণত হতে চলেছে। নববর্ষের শুভেচ্ছা নতুন বছর একজন লোকের ভালো যাক এটা তার বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাক্সক্ষীরা অবশ্যই কামনা করে। আর এ শুভ কামনা আমরা লক্ষ করি নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড বিতরণের মাধ্যমে। নববর্ষের আরও আগেই দোকান থেকে বিষয়ভিত্তিক শুভেচ্ছা কার্ড সংগ্রহ করে আপনজনের ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠানো হয়। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে শুভেচ্ছা বাণী দিয়ে থাকে যা পত্রপত্রিকায় এবং রেডিও- টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। আধুনিক কালে মোবাইল ফোনে এসএমসের মাধ্যমে এবং ইন্টারনেটে ইমেলের মাধ্যমে এবং কেউ কেউ সরাসরি ফোন করেও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোর অনুষ্ঠান পয়লা বৈশাখ উদযাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐদিন সরকারি ছুটি থাকে। ফলে লোকেরা ছুটির দিন কাটানোর আমেজ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আবার রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনে এবং বেসরকারি চ্যানেলগুলো ও পত্রপত্রিকায় ঐদিন নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পত্রপত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশের সুবাদে লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণ নানা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি রচনা করে থাকেন। বিশেষ সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হয় এ উপলক্ষে। বেতার-টিভিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্যে টকশো, আলোচনা, গান, আবৃত্তি, সরেজমিন প্রতিবেদন ইত্যাদি নানা মাত্রার আয়োজন থাকে। পুইনাহ এটি পয়লা বৈশাখকেন্দ্রিক একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান। বাংলা সন প্রবর্তনই করা হয়েছিল জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। একটি কথা বলে রাখা ভালো আমাদের প্রাচীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সরকার চলতো কৃষকের দেয়া খাজনার টাকায়। আজকাল আয়কর, সম্পদকর, নানা রকম শুল্ক, উন্নয়ন কর, শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদি নানা খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়ে থাকলেও জমির খাজনা কিন্তু এখনো জারি আছে। প্রাচীনকালে যেহেতু মোটামুটি জমির খাজনার ওপরই জমিদার, সুবাহদার, সরকার সবাইকে নির্ভর করতে হতো তাই খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বছরের প্রথম দিন আয়োজন করা হতো পুইনাহ নামক অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে রায়ত বা প্রজা রাজাকে তার প্রাপ্য খাজনা পরিশোধ করে দিত। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের এ পুইনাও এখন পরিবর্তিত হয়েছে। এখন নানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের পাওনা আদায়ের জন্য হালখাতা অনুষ্ঠানের ন্যায় পুইনাহ অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। এ অনুষ্ঠানেও মিষ্টি বিতরণের এবং ক্ষেত্রবিশেষে আরও ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখন পুইনার স্থান দখল করে নিয়েছে করমেলা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়োজনে ঢাকায় এবং সারাদেশে এখন সেপ্টেম্বর মাসে হয় করমেলা। বৈশাখী উৎসব এটি মূলত নবান্নের উৎসব। প্রাচীনকালে পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে ‘বৈশাখী’ নামে একটি উৎসব আয়োজন করা হতো মূলত নতুন ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে। এতে হিন্দু, মুসলমান, শিখ সবাই অংশ নিতো। দাক্ষিণাত্যে এখনো এ উৎসব জারি আছে। আমাদের বাংলাদেশেও বৈশাখ মাসে বোর ফসলের ধান ঘরে তোলে কৃষক জুমা মসজিদে ক্ষির বিতরণের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। বৈশাখ মাসের পুরো মাসই এ ব্রত পালন করা হয় তবে বাংলাদেশে এর কোন আলাদা নাম নেই। বৈশাবী উৎসব আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী পাহাড়ি জনগোষ্ঠী পয়লা বৈশাখে এ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কাদা ছোড়াছুড়ি, পানি ছিটানো এবং নানা নৃত্য, গান ইত্যাদির মাধ্যমে নারী-পুরুষ সবাই এ উৎসবে মেতে ওঠে। বেঙ্গাবেঙ্গির বিয়ে চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদে মাঠ-ঘাট যখন চৌচির তখন প্রকৃতি কামনা করে বৃষ্টি। চৈত্রের শেষে পয়লা বৈশাখে তাই শিশুরা মেতে ওঠে বেঙ্গাবেঙ্গির বিয়ে খেলায়। কারণ এর মাধ্যমে খুদে পুকুর খনন করে এর চার কোনায় চারটি ছোট কলাগাছ গেড়ে খুদে পুকুরে পানি দিয়ে তাতে বেঙ্গ বেঁধে রেখে গীত গাওয়া হয়। গীতের মাধ্যমে কামনা করা হয় বৃষ্টি। ‘বেঙ্গাবেঙ্গির বিয়ে-গো, মাথায় সিন্দুর দিয়ে-গো। ‘আল্লাহ মেঘ দেয়, ছায়া দে, পানি দে-রে তুই । আল্লাহ মেঘ দেয়। গম্ভীরা আমাদের লোকজ গানের এক বিশেষ ধারা গম্ভীরা। বাংলাদেশের রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় এক ধরনের গান পয়লা বৈশাখে এবং সারা বৈশাখ মাসজুড়ে গাওয়া হয় তারই নাম গম্ভীরা। বিশেষত রাত্রি বেলায় গাওয়া এ গানে নানা-নাতির চরিত্রে অথবা কোন কোন সময় মূল গায়েন এবং কয়েকজন দোহার নিয়ে অংশ নিয়ে থাকে। সারা বছরের ভাল কাজের প্রশংসা এবং মন্দ কাজের সমালোচনা অর্থাৎ সামাজিক আত্মসমালোচনার এক সুন্দর অনুষ্ঠান এটি। তা কোন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরও হতে পারে বা কোন পরিবার বা প্রতিষ্ঠানেরও হতে পারে। অনেক সময় শাসকদের মন্দ কাজের সমালোচনা করার কারণে গম্ভীরা শিল্পীরা হেনস্তার শিকারও হয়ে থাকেন। কিন্তু একটি আত্মসচেতন জাতি হিসাবে নিজেদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে গম্ভীরা গান সারাদেশেই প্রচলন হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে গোটা জাতি তার আত্ম সমালোচনা করতে পারবে যা হবে সুস্থ জাতি গঠনে সহায়ক। বলীখেলা শৌর্য-বীর্য বা শক্তিমত্তা পরীক্ষার জন্য কুস্তিখেলা একটি প্রাচীন খেলা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ খেলা আছে। আমাদের দেশেও কুস্তি খেলা হয়। কিন্তু পয়লা বৈশাখ উদযাপনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে প্রাচীনকাল থেকেই এক ধরনের কুস্তি খেলা হয় যাকে বলে বলী খেলা। প্রধানত বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে এটি হয়ে থাকলেও খেলাটি সারা বৈশাখ মাসের যে কোন দিনও হতে পারে। চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আয়োজিত এ বলী খেলা পরবর্তীতে ‘জব্বারের বলীখেলা’ নামে নামকরণ হয়। পয়লা বৈশাখ উদযাপনে এ খেলাও জাতীয় পর্যায়ে একটি আলোড়ন তুলে থাকে। এ ছাড়াও পয়লা বৈশাখে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি, চারঘর‌্যা, ছি ইত্যাদি খেলাও হয়ে থাকে। মইদৌড় ও লাঙল দৌড় গরু দিয়ে হাল চাষ করা কৃষকের কাজ। কৃষিভিত্তিক সমাজে তাই গরু এবং কৃষকের মধ্যে রয়েছে একটি সখ্য। আর এর ওপর ভিত্তি করেই কৃষিভিত্তিক কৌমে গড়ে উঠেছে এক ধরনের খেলা যার মাধ্যমে কৃষক তার লাঙল ও মই নিয়ে অংশ নেয়। একজন ভালো কৃষক ভাল হাল-চাষ করবে এটাই স্বাভাবিক। আবার জমি চাষ করার পর জমিতে মই দেয়াও একটি কাজ। এই চাষ করা এবং মই দেয়ার দক্ষতা কে কতটা রপ্ত করলো তারও একটা প্রতিযোগিতা থাকলে কৃষিভিত্তিক সমাজের চাষারা চাষাবাদে আরও দক্ষ হবে। এ আশাকে সামনে রেখেই মইদৌড় এবং হালদৌড়ের প্রবর্তন। একজোড়া গরুকে সুন্দর করে সাজিয়ে লাঙল বা মই জুড়ে দিয়ে লাঙল দৌড় এবং মইদৌড় খেলা হয়ে থাকে। এটি পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলার পাশের কোন মাঠে বা বৈশাখ মাসের অন্য কোন দিন কোন বড় জমিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর মাধ্যমেও কৃষক আনন্দ উপভোগ করে থাকে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অধিবাসী হিসেবে আমরা এখন আমাদের আত্মপরিচয় ও সংস্কৃতিকে জানা ও চর্চা করা দরকার। বাংলা সন, পয়লা বৈশাখ আমাদের জীবনে জাগরণের এক মন্ত্র। একে নিয়ে ইদানীং ষড়যন্ত্র চলছে। কতিপয় লোক নববর্ষ পালনের নামে এমন সব উদ্ভট জীব জন্তুর ছবি নিয়ে শোভাযাত্রা বেশ করে যা আমাদের দেশের সংস্কৃতির কোন পরিচয় বহন করে না। এগুলো সম্বন্ধে আমাদের আরও জানতে হবে এবং সতর্ক হতে হবে। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নিষ্কলুষ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আমরা দেশের সংস্কৃতির লালনের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে করতে পারি দৃঢ়। সরকারের উচিত হবে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে ভালো অনুষ্ঠানগুলো পালনে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। বাংলাদেশের যেকোন বিষয়ে যারা ভালো করে, ভালো অবদান রাখে তাদেরকে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে পুরস্কৃত করা যায়। জমির খাজনা বাংলা মাসের হিসেবে কয়েক শ’ বছর ধরে চালু আছে। এ ব্যবস্থাকে বাতিল করা যাবে না। জমির খাজনা আদায়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত তহসিল অফিসের নাম পরিবর্তন এবং তহসিলদারের পদবি পরিবর্তন আমাদের সনকেন্দ্রিক ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ