একচোখা খরগোশ    -ফজলে রাব্বী দ্বীন

একচোখা খরগোশ -ফজলে রাব্বী দ্বীন

গল্প মার্চ ২০১৭

বাদলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
এ তল্লাটের অলি-গলি কোন জায়গাতেই খোঁজা বাদ নেই। অবশেষে পত্রিকাতে নিখোঁজ সংবাদ পর্যন্ত ছাপা হয়ে গেল। আজ নিয়ে সাত দিন চলছে। তবুও তার কোন হদিস নেই। ছেলেটা আসলেই বেহিসাবি আর খামখেয়ালি। যা মন চায় তাই করে। একবারের জন্যও বাড়ির কথা চিন্তা করে না। ভেবে দেখে না তার বাবা-মায়ের অবস্থা কী হতে পারে! বয়স কি কম হয়েছে নাকি? ক্লাস ফাইভ থেকে এইবার ক্লাস সিক্সে উঠেছে। মা সবসময় বকত বলে সমাপনী পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ জেলায় ফার্স্ট হবার স্বপ্নপূরণের সার্টিফিকেট এনে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো আর কেউ তাকে বকে না। সবাই বুঝতে পেরেছে যে ছেলেটা যা চায় তাই তাকে করতে দেওয়া উচিত।
কিন্তু সেই ছাড় দেয়াটাই কি তাহলে সব থেকে বড় ভুলের পর্যায়ে পড়ে নাকি তার উধাও হওয়ার পেছনে অন্য কোন গুপ্ত ঘটনা লুকিয়ে আছে? মাথাটা ঝিমঝিম করছে সবার। নাকি বাদলকে খুঁজে না পাওয়ার পেছনে কোন ছেলে ধরার হাত রয়েছে? তাছাড়া তো এরকম হওয়ার কথা নয়। এমনটা অবশ্য এর আগেও একবার হয়েছিল। তা প্রায় আজ থেকে মাস ছয়েক আগে। বাদল একবার তার স্কুলের ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে গিয়েছিল। মানে কেউ বুঝতে পারেনি যে ল্যাবরেটরির ভেতরে কেউ থাকতে পারে। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার আর শনিবার ছিল ছুটির দিন। ঠিক রোববার দিন সকাল ৯টার দিকে স্কুলের দপ্তরি যখন স্কুলে এসে সকল ক্লাসরুমের দরজা এক এক করে খুলে শেষমেশ ল্যাবরেটরির রুমে গিয়ে ঢুকেছে অমনি দেখে বাদল ছেলেটা টেবিলে বসে কি যেন তৈরি করছে। দপ্তরি আর কিছু বলতে পারে না। সোজা তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করতে হয়েছিল। আর এদিকে তিন দিন ধরে উধাও হওয়া বাদলের খোঁজ পেয়ে মা-বাবা যেন নতুন এক পূর্ণিমার চাঁদ হাতে পেয়েছিল। কিন্তু বাদল কেন ল্যাবরেটরিতে থেকেও কাউকে ডাক দেয়নি বা চেষ্টা করেনি সেখান থেকে বের হয়ে আসার এই উত্তরটা আর পাওয়া যায়নি। তবে বাদল শুধু হেসেছিল কারণ তার হাতে ছিল একটা রঙ পেন্সিল। সেই রঙ পেন্সিল কিন্তু যেমন তেমন পেন্সিল নয়। বাদল সেই রঙ পেন্সিলটাকে তৈরি করেছে মোট তিনদিনে। তার মুখ থেকে শোনা যায় সে এই পেন্সিলটাকে বানানোর জন্য অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছিল যা এতদিন পরে এসে সফল হলো।
কিন্তু সেই পেন্সিলটার আসলে কাজ কী? দাদুর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বাদল পেন্সিলটাকে সোজা দাদুর দিকে মুখ করে ধরল। এবার কি যেন একটা লেখার চেষ্টা করল। তারপর মাত্র দশ সেকেন্ড পরেই দাদুর শার্টের ওপর দিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত আকৃতির লেখার আবির্ভাব ঘটল। চমকে উঠল সবাই। লেখাটা এই ‘স্যরি’। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব হলো আর কি করেই বাদল এটা করল সেই রহস্যটা অজানা। তবুও সেদিন বাদল বলেছিল, ‘এটা এক ধরনের ম্যাজিক। ল্যাবরেটরিতে অনেক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। কয়েকটার মিশ্রণ ঘটিয়ে এটি তৈরি করেছি। একদিন বড় হয়ে আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে দেখাব।’
‘আমার অত বড় বড় অদ্ভুত সব জিনিস আবিষ্কারের দরকার নেইরে বাপ। তুই ফিরে আয়। মায়ের কোলে সেই ছোটবেলায় যেভাবে থাকতি এখনও সেইভাবে মায়ের কোলে ফিরে আয়।’ মায়ের কান্না আকাশ পাতালকে যেন দ্বিখন্ডিত করে দিচ্ছে, বাতাসে সৃষ্টি করছে শোকের আবরণ। বিজ্ঞ ছেলেটাকে চেনে না এমন মানুষ হয়ত খুঁজেই পাওয়া যাবে না বৃহত্তর এই চট্টগ্রামে। তবুও দিন কাটতে থাকে। ...
বছর পার হয়ে গেছে। বাদল না থাকায় এ বছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি আমি। বাদল যদিও আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল তবুও সেটা শুধু পড়ালেখার ক্ষেত্রেই। কে কাকে পেছনে ফেলে আগে যেতে পারে। কিন্তু বাহ্যিক সকল কাজের দিক দিয়ে ও ছিল আমার সবথেকে কাছের এবং প্রকৃত একজন বন্ধু। ওর মতো সাহসী আর বুদ্ধিমান বন্ধু একটিও পাইনি কোনদিন। আর কখনও পাবো কিনা তাও জানি না। ওকে হারিয়ে আমি যেন আমার অর্ধেক জ্ঞানের শক্তিই হারিয়ে ফেলেছি। এখন আর বিজ্ঞানবিষয়ক নতুন নতুন আবিষ্কারের কোনো খবর পাই না, কেউ বুঝিয়ে দেয় না, ‘এইভাবে কারেন্টের শক লাগাতে হয়।’ নতুন বছরে বিজ্ঞানমেলা শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতি বছর তো বাদলই আমাদের স্কুলের সুনাম বয়ে আনত আর আমাদের স্কুল শুধু নয়, পুরু দেশের ভেতরে একেকটা আলোড়ন সৃষ্টি করত যা সবার নজর কেড়ে নিত এক নিমিষে। দেশের বড় পর্যায়ের মানুষরা তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত আর ভাবতÑ ‘এই ছোট ছেলেটা একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে একদিন।’ কিন্তু সেই স্বপ্নচারী ছেলেটা যে আজ কোথায় হারিয়ে গেল তা এখনও কেউ বিশ্বাস করতে পারে না।
নতুন কোন প্রজেক্ট তৈরি করতে না পারলেও বুদ্ধি করে আজ সকালবেলা বাদলের রুমে ছুটে যাই। বাদল নিজের অজান্তেই রাত জেগে জেগে অনেক নতুন নতুন জিনিস তৈরি করার প্ল্যান আঁকত এবং সময় হলে সেগুলোর ভেতর থেকে যেকোনো একটা বানানোর কাজে হাত লাগাত। তাই বুদ্ধিটা কোনরকমের খারাপ হয়নি বোধ হয়। এবারের বিজ্ঞানমেলায় আশা করা যায় বাদলের তৈরি করা জিনিস দিয়েই তাক লাগিয়ে দেবো দেশের সবাইকে। ভাবতে ভাবতে বাদলের বাড়িতে গিয়ে যখন উপস্থিত হই তখন চারদিক কেমন যেন নীরবতায় ভরপুর। কোন সাড়া শব্দ নেই, নেই কোন কোলাহল। বাদলের মায়ের অনুমতি নিয়ে বাদলের রুমে যাই। সবকিছু আগের মতোই আছে শুধু ভাবনাময় সেই ছেলেটা নেই। রুমের চারপাশে, ফ্লোরে, বারান্দাসহ বিছানার চারপাশ সব খোঁজা শেষ। কিন্তু চেষ্টা সব বৃথা। শেষমেশ রুম থেকে যখন বের হয়ে আসতে যাবো এমন সময় দেয়ালের এক কোণায় ছোট্ট একটা ফুটো দেখতে পাই। ফুটোর ভেতরে কি আছে দেখতে গিয়ে যেই চোখ মেলে তাকিয়েছি অমনি চোখের পাপড়ি ধরে কে যেন দিল এক টান। ভয়ে বুকটা ধুকপুক করে উঠল। রহস্যটা বুঝার জন্য একটা ছোট্ট কাঠি এনে ছিদ্রটার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলাম। কিন্তু এবার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। মনের ভুল ভেবে এবার সেই ছিদ্রপথেই বা হাতের আঙুলটা তাক করে যেই ধরেছি অমনি কে যেন নরম করে বসিয়ে দিল এক কামড়। হালকা ব্যথা অনুভব করেছি ঠিকই কিন্তু ক্লান্ত হবার কোন নাম নেই। বড় একটা হাতল দিয়ে দেয়ালটা ঠুকে ঠুকে ভাঙতে যাবো এমন সময় লক্ষ করলাম ছিদ্রটা আসলে ছোট নয় অনেক বড়। মনে খটকা লাগল বেশ। রাগের মাথায় যতটুকু পারা যায় ভেঙে ফেললাম দেয়ালটা। এমন সময় চোখ দুটো যেন কপালে ওঠার উপক্রম। একটা খরগোশের বাচ্চা। কিন্তু দেয়ালের ভেতর ঢুকে কী করছে? কপাল দিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল। এ নিশ্চয় বাদলের কাজ। ব্যাপারটা আরও চমকাতে লাগল যখন খরগোশটা মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করল। ভালো করে খরগোশটাকে নেড়েচেড়ে দেখে বুঝতে পারলাম এটা আসলে কোন খরগোশ নয় বরং খরগোশরূপী এক ধরনের রোবট। যে মানুষের মত কথা বলতে পারে এবং এটি ওজনেও অনেক ভারী। কিন্তু এত বড় একটা জিনিস বাদল চুপি চুপি আবিষ্কার করছিল অথচ একবারের জন্যও আমার সামনে মুখ খুলেনি। কিন্তু সে এটা কিভাবে তৈরি করছিল? আর খরগোশটার বাম চোখটা কোথায়? ডান চোখটা দেখেই বুঝতে পারলাম এটা একটা মুক্তো দিয়ে তৈরি। সারা বাড়িতে হইচই পড়ে গেল যখন খরগোশটা মায়ের সামনে গিয়েই বলে উঠল-‘আম্মু, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ সারা দিনভর শুধু সেই এক কথা। আর কোন কথা যেন সে বলতে পারে না। হয়ত আর কোন নতুন কথা তাকে শিখাতে পারেনি বাদল। মাকে অনেক ভালোবাসার কথা শুনে সেই খরগোশটাকেই বুকের ভেতর চেপে ধরে বাদলের মা। আর চোখ দিয়ে ঝরে অঝোরের নোনাপানি। কিন্তু খরগোশটার বাম চোখের সেই মুক্তোটা কই। রহস্যটা এখানেই থামিয়ে রাখতে দেই না। বাদলের রুমে ফের অনুসন্ধান চালাই। নিশ্চয় আরও অনেক মূল্যবান কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু প্রায় তিন ঘণ্টা যাবৎ খোঁজাখুঁজি করেও কিছু আর পেলাম না। তবে তার নিত্য লেখা ডায়েরিটা দেখে কিছু একটা পাবার আশায় থাকি। ডায়েরিটা পড়া শুরু করি। তার শেষ দিনের লেখাটা ভারী অদ্ভুত ধরনের। সেই খরগোশটাকে নিয়ে লেখা। তার মা নাকি খরগোশকে খুব ভালোবাসে। ছোটবেলায় মায়ের নাকি একটা পোষা খরগোশ ছিল। কিন্তু একদিন বিড়ালের কারণে সেই খরগোশটা মারা যায় খড়ের স্তূপের নিচে এবং বড় হয়েও সেই খরগোশের গল্পটা বাদলকে মা শুনাত এবং বাদল সেই গল্পটা শুনেই রোজ রাতে ঘুমিয়ে যেত মায়ের কোলে। ধীরে ধীরে বাদল একদিন সিদ্ধান্ত নেয় এমন একটা জিনিস তৈরি করার যা তার মায়ের জন্মদিনে গিফট করা যাবে। তাই সে তার মায়ের জন্য রহস্যময় ছোট্ট তুলতুলে এই খরগোশটাকে নিজের হাতে বানিয়েছে। সব থেকে মূল্যবান মুক্তো দিয়ে চোখ বানানোর জন্য সে সাগরপাড়ের ঝিনুকের ভেতর মুক্তো খুঁজেছে এবং একটি পেয়েও গিয়েছে। গতবার তো পরিবারের সবাই মিলে সাগর সৈকতে গিয়েছিল কিন্তু এইবার সে কিভাবে যাবে? তাই চিন্তা ভাবনা করে স্কুল ছুটিতে কাউকে না বলেই একা একা ছুটে গিয়েছে সাগর সৈকতে এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেনি।
ডায়েরিটা পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। বাকি পৃষ্ঠাগুলো অনেক দিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ আর লেখে না সেখানে। মায়ের জন্য একটা ছেলে এতকিছু করতে পারে ভাবা যায়! মা সেই ডায়েরিটাকে যতœ করে বুকের ভেতর আগলে রাখে। পৃথিবীতে মায়ের প্রতি তার ছেলের যে কতটা ভালোবাসা থাকতে পারে তা গোটা দুনিয়াটাই অবাক হয়ে বাদলের সেই আবিষ্কার দেখে বুঝতে পারে।
তুলতুলে খরগোশটা মায়ের সামনে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে। মা যেন সেই খরগোশটাকে পেয়ে বাদলকেই ফিরে পেয়েছে। যখন আদর করে তুলতুলে খরগোশটাকে বুকের ভেতরে তুলে নেয় তখনি মিষ্টি স্বরে বলে উঠে, ‘আম্মু, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’
আম্মু বাদলের ফিরে আসার স্বপ্ন নিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন।... হ
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ