একজন সুখীর কথা

একজন সুখীর কথা

গল্প আগস্ট ২০১৪

এনায়েত রসুল

Sukhiনিজের নামটা নিজের কাছে এখন দুঃসহ মনে হয়। সুখীর ভাবতে অবাক লাগে, প্রাচুর্যের সাথে সম্পৃক্ত এ নামটা ওর বাবা রেখেছিলেন। সুখীর নাম আর বাবার আদর্শÑ এ দুটোকে কখনো এক সঙ্গে মিলাতে পারে না সুখী। শুধুই মনে হয়, নামটা যেন বাবা নন, অন্য কেউ রেখেছেন। আবার পরক্ষণেই সুখী ভাবে, এমন নাম রাখার পেছনেও হয়তো বাবার একটা উদ্দেশ্য ছিলো। হয়তো তার বিশ্বাস ছিলো এই সুখী শব্দটার কল্যাণে তার মেয়ের জীবন সুখের বন্যায় থই থই করবে। সুখী শুনেছে, যেদিন ওর পনের দিন বয়স, সেদিন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। আর যেদিন একুশ দিন বয়স সেদিন যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বাবা। স্ত্রী আর সদ্যোজাত সন্তানকে নিজের জীবনের চেয়েও ভালো বেসেছিলেন যে মানুষটি, স্ত্রী আর সন্তানের ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেনি তাকে। বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই রাতের স্মৃতি আজও চকচকে ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে মায়ের মনের কোণে। সুখীর বাবা মুক্তিযুদ্ধে যাবার রাতে মা যখন সুখীকে নিয়ে বাবার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, বাবা তখন বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়েছিলেন মায়ের দিকে। অসহায় কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাকে এভাবে বাধা দিও না নীলা। তুমি জানো তো শত্রুরা আজ জেঁকে বসেছে এ দেশের ওপর। এই সঙ্কটে আমি যদি দেশের পাশে গিয়ে না দাঁড়াই, তবে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাবো। মা বলেছিলেন, তোমার এ কথা যেমন সত্য, তুমি পাশে না থাকলে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবো, সে কথাও তেমন সত্য। আমাদের নিরাপত্তার কথা ভাববে না? বাবা বলেছিলেন, নিরাপত্তার কথা ভেবেই তো যুদ্ধে যাচ্ছি। শত্রু ধ্বংস করে এক নিরাপদ স্বাধীন দেশ এনে দেবো তোমাকে। এসেই দেশে নতুন করে শুরু করবো আমাদের জীবন। সমস্ত দুঃখ মুছে, পরাধীনতার লজ্জা মুছে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবো আমরা। আমার মেয়ে সুখী হবে এক স্বাধীন দেশের সন্তান। আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতি শুনিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন বাবা। আর সত্যি সত্যিই তিনি ফিরে এসেছিলেন এক স্বাধীন দেশ নিয়ে। বড় হয়ে সুখী সে সব কথা শুনেছে মায়ের কাছে। মায়ের মুখে বাবার বীরত্বের কথা শুনে শুনে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো আজ জীবন্ত ছবির মতো অনুভব করে সুখী। গর্বে গর্বে কানায় কানায় ভরে থাকে সুখীর বুক। কিন্তু যাকে নিয়ে সুখীর এতো গর্ব, সেই বাবা কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেননি সুখীকে। বরং সুখী যখন সে কথা শুনতে চেয়েছে, বাবা তখন কৌশলে এড়িয়ে গেছেন প্রসঙ্গটাকে। খুব চেপে ধরলে বলেছেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করার প্রয়োজন ছিলো যুদ্ধ করেছি। হাজারো রকম বৈরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছি। এসব তো যে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রেই এক সাধারণ ঘটনা। এর মাঝে বুক ফুলিয়ে বলার মতো কোনো উপাদান আছে, আমার তো তা মনে হয় না। বাবা যতই বলতেন বুক ফুলিয়ে বলার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি তার মুক্তিযোদ্ধা জীবনে, মা ততই দ্বিমত পোষণ করতেন বাবার এ কথার সঙ্গে। মা বলতেন, নিজের অবদানকে ছোট করে দেখো না। তুমি যেভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছো, তা বুক ফুলিয়ে বলার মতোই ঘটনা। যা সত্য তা বলতে এতো দ্বিধা কেন বুঝি না। বাবা ম্লান হাসতেন মায়ের কথা শুনে। বলতেন, দ্বিধা না নীলা প্রবৃত্তির অভাব। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। : কেন? বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইতেন মা। বাবা বলতেন, কী করে প্রবৃত্তি হবে? কিছু কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে এতো কথা বলছে, আমি তার উৎস খুঁজে পাই না। তবে একটা কথা বুঝতে পারি, আমি কিছু বললে সেসব কথা পানসে হয়ে যাবে। কিছু কথা মিথ্যে হয়ে যাবে। তাই ভাবী, নিজের কথা নিজের কাছেই সঞ্চিত থাক। কী লাভ তা অন্যকে বলে? মা বলতেন, কী ক্ষতি তাও তো বুঝি না! বাবা বলতেন, আচ্ছা বুঝিয়ে বলছি। মুক্তিযুদ্ধটা যুদ্ধই ছিলোÑ রূপকথার মতো অবাস্তব কিছু ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের যে অংশের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম সে অংশেই যুদ্ধই হয়েছে। কল্পকাহিনীর মতো চমকপ্রদ কিছু ঘটেনি। অথচ আমার সহযোদ্ধারা কতো কিছু বলে বেড়াচ্ছেন! মানুষজনও তা শুনে রোমাঞ্চিত হচ্ছে। গর্ব বোধ করছে। আমি সত্য কথা বললে সেসব মিথ্যে হয়ে যাবে। মুক্তযুদ্ধ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে যাবে। কী দরকার মানুষের মনে অঙ্কিত সেই রঙিন ছবির গায়ে আঁচড় কেটে? মা বলতেন, মানুষের কথা বাদ দাও। আমার কথা ছেড়ে দাও। সুখীর কথা ভাবো। সুখীর তো অধিকার রয়েছে বাবার মুখে তার বীরত্বের কথা শোনার। কেন তাকে বঞ্চিত করবে? বাবা বলতেন, বঞ্চিত করছি বলছো কেন! আমার তেমন কোনো সম্পদ থাকলে তো বঞ্চিত করবো! আচ্ছা, তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও। কে বলেছে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়েছি আমি? না নীলা, কোনো বীরত্ব দেখাইনি! বীরত্বই যদি দেখাতাম তাহলে তো বীরপ্রতীক, বীর উত্তম খেতাবই পেয়ে যেতাম। কিন্তু কেন তা পাইনি জানো? : কেন? কৌতূহল ছড়িয়ে মা তাকাতেন বাবার দিকে। বাবা বলতেন, কারণ আমার জীবনে বীরত্ব বলে কিছু নেই। তোমরা যাকে বীরত্ব ভাবছো, আসলে তা টিকে থাকার প্রচেষ্টা। : মানে? এবার বিরক্তি ঝরতো মায়ের কণ্ঠে। বাবা বলতেন, মানে হলো, শত্রুরা আমার দিকে রাইফেল তাক করেছেÑ আমিও ওদের দিকে তাক করেছি। ওদের গুলি আমার গায়ে লাগেনিÑ আমার গুলি ওদের গায়ে লেগেছে। এর মাঝে বীরত্বের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। ছিলো লক্ষ্যভেদ আর ভাগ্যের খেলা। তাকে কী করে আমি বীরত্ব বলে চালাবো, বলো? বাবার এমন কথার পর রণে ভঙ্গ দিতেন মা। অভিমানে ভেঙে পড়ে বলতেন, তোমাকে আর তোমার বীরত্বের কথা বলতে হবে না। সুখীকে যা বলার তা আমিই বলবো। মুক্তিযুদ্ধ আর বাবার বীরত্ব সম্পর্কে যতোটুকু জানে, তা মায়ের কাছ থেকেই জেনেছে সুখী। শুনেছে, বাবা চিত্তরঞ্জন কটন মিলে কাজ করতেন। সুখী জন্ম নেবার পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন। তার পরপরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিলো। বাবা যোগ দিয়েছিলেন সেই যুদ্ধে। আশপাশ গ্রামের যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনী। তাদের নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতনে বাবা। সে কারণে শত্রু সৈন্যরা খুব ভয় পেতো বাবার বাহিনীকে। এতোটাই ভয় পেতো, যে, সন্ধ্যার পর এ এলাকায় অভিযানে বের হওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলো ওরা। শুধু তাই নয়, বাবার ভয়ে এ অঞ্চলে কেউ রাজাকার বাহিনীতেও যোগ দেয়নি কখনো। দেশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়েছিলো ষোল ডিসেম্বরÑ বাবা তার এলাকা মুক্ত করেছিলেন আট ডিসেম্বর। নিজে উদ্যোগ নিয়ে তার বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা জমা দিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে। সেই বাবা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কেন? এ ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বাবা যেসব যুক্তি দেখাতেন, তাই কি প্রকৃত কারণ? নাকি স্বাধীন দেশটির ওপর বাবার কোনো অভিমান ছিলো? আজ বাবা নেই। কে দেবেন সুখীর এ প্রশ্নর জবাব? সুখীর বয়স বিশ। পাঁচ বছর আগে বাবাকে হারিয়েছে সুখী। উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটি চিরবিদায় নেয়ার পর অনভ্যস্ত হাতে মা তুলে নিয়েছেন সংসারের দায়িত্ব। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান ভেনে সুখীর পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাজের ক্ষমতাও কমেছে। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তবে সে জন্য খুব একটা চিন্তিত নন তিনি। খেয়ে না খেয়ে সুখীকে পড়িয়েছেন। এ বছর গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেছে সুখী। এখন একটা না একটা চাকরি পেয়েই যাবেÑ তেমনই ধারণা মায়ের। মায়ের এ ধারণাটা যে একেবারেই বাস্তবসম্মত নয়, চাকরি খুঁজতে গিয়ে দুই দিনেই তা বুঝতে পারে সুখী। চেনা-অচেনা কতজনকে যে চাকরির জন্য ধরেছে, তার হিসাব নেই। শেষমেশ কিছুটা আশ্বাস দিয়েছেন ওদের চেয়ারম্যান সাহেব। সেটাই সুখীর শেষ ভরসা। দুই. আজ ঘুম থেকে ওঠার পরপরই মা সুখীকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথাটি মনে করিয়ে দিলেনÑ আজ সোমবার। দিনের প্রথম ভাগে চেয়ারম্যান সাহেব সুখীকে দেখা করার জন্য বলেছেন। যতোই কাজ থাক, সুখী যেনো এ কাজটি অবহেলা না করে, তাই ছিলো মায়ের অনুরোধ। কারণ সুখীর একটা চাকরির ভীষণ দরকার। চাকরির যে ভীষণ দরকার এ কথাটা মায়ের মতো সুখীও জানে। তাই অনেক আশায় বুক বেঁধে সুখী গেলো চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে। তিনি তখন বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন। সুখীকে দেখেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, কে সুখী? এসো মা এসো। মনে মনে তোমার কথাই ভাবছিলাম। সুখী জিজ্ঞেস করলো, আপনি ভালো আছেন চাচা? চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, এ বয়সে যতোটুকু থাকা যায় ততটুকু আছি। তোমার কথা ভাবছিলাম কেন জানো? আমি গিয়াস সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। তোমার ব্যাপারে কথা হয়েছে। : গিয়াস সাহেব কে? জানতে চাইলো সুখী। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, উনি উপজেলা শিক্ষা অফিসার সহানুভূতিশীল মানুষ। বসো সব বলছি। বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা মোড়া ছিলো। ওটা এনে সুখী বসলো চেয়ারম্যান সাহেবের মুখোমুখি। চেয়ারম্যান সাহেব ততোক্ষণে কাগজের পাতা মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। তাই সুখীকেই আবার প্রশ্নটা তুলতে হলোÑ চাচা! গিয়াস সাহেবের কথা কী যেন বলছিলেন? চেয়ারম্যান সাহেব কাগজটাকে ভাঁজ করে রাখলেন হাঁটুর ওপর। তারপর বললেন, গতকাল আমি গিয়াস সাহেবের কাছে তোমার চাকরির কথা তুলেছিলাম। এতে তিনি বললেন, চাকরির ব্যাপারে তার কিছু করার নেই। চাকরি পেতে হলে নিজের যোগ্যতায়ই তা পেতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, এখন কোনো পোস্টও ভ্যাকান্ট নেই। সুখী বললো, পোস্ট ভ্যাকান্ট থাকলেও আজকাল ধরাধরি না করে কারো চাকরি হয় না। আমার খুব ভরসা ছিলো আপনার ওপর। ভরসা অবশ্য এখনো আছে। আমি জানি চেষ্টা করলে অবশ্যই একটা কাজ জুটিয়ে দিতে পারবেন। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, তোমরা ভরসা করো বলেই আমাকে ছোটাছুটি করতে হয়। তোমার বিশ্বাসের মূল্য দেয়ার জন্য গিয়াস সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম। তোমার চাকরির কথা বলেছিলাম। তিনি কী বলেছেন তা তো বলেছিই তোমাকে। আমি আর কী করতে পারি মা। সাধ্য সীমিত। কথা শেষ করে কাগজটাকে আবার মেলে ধরলেন চেয়ারম্যান সাহেব। সুখী বুঝলো, এ প্রসঙ্গে কথা বাড়াতে আগ্রহী নন তিনি। কিন্তু তার যেমন সাধ্য সীমিত সুখীরও তেমন ভরসাস্থল সীমিত। এতো সহজে সেই ভরসাস্থল থেকে সরে দাঁড়ালে তো চলবে না। তাই মরিয়া হয়েই সুখী বললো, আমাদের অবস্থা তো জানেন চাচা। বাবা কিছুই রেখে যেতে পারেননি। সারা জীবন একটা আদর্শ আঁকড়ে থেকেছেন। অন্যের খেতে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। সম্বল আর সামর্থ্য বলতে কিছুই ছিলো না তার। : কিন্তু তোমার মা তো কোথায় কোথায় কাজ করেন। তোমার চাচী বলেন, খুব কর্মঠ মহিলা তিনি। কাগজ থেকে চোখ তুলে চেয়ারম্যান সাহেব তাকালেন সুখীর দিকে। সুখী কী জবাব দেয় তা শোনার জন্য তৈরি হলেন তিনি। সুখী বললো, বাবা মারা যাবার পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান ভেনে মা সংসার চালিয়েছেন। আমাকে পড়িয়েছেন। কিন্তু এখন আর ঘোরাঘুরি করতে পারেন না। একদিন কাজ করলে দু’দিন অসুস্থ থাকেন। এ কারণেই একটা চাকরি ভীষণ প্রয়োজন। কিছু মনে করবেন না চাচা, আমার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আমি এখন যাই। : যাবে? আচ্ছা যাও। আমিতো আছিই। দেখি কী করা যায়। ও হ্যাঁ, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। গিয়াস সাহেব জানতে চেয়েছিলেন তোমরা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছো কি না। আমি বলেছি পাচ্ছো। না পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই, তাই না। যেনো একটা অতি সত্য কথা বলেছেন সুখীদের সম্পর্কে, এমন মনোভাব নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব তাকালেন সুখীর দিকে। সুখী সে কথা শুনে বিব্রত বোধ করলো। যে কথা এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব বলেছেন, কেমন করে সুখী তার বিরোধিতা করবে? কিন্তু ওকে তো তা করতেই হবে। নইলে একটা মিথ্যা কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাইবা কী করে মেনে নেবে সুখী? চেয়ারম্যান সাহেব তখনো জবাবের প্রতীক্ষায় তাকিয়েছিলেন সুখীর দিকে। তাই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবারও উপায় ছিলো না। সুখী বললো, আপনার ধারণা ঠিক নয় চাচা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাই না। : পাও না মানে? ভাতা পাবে না কেন? তোমার বাবা তো এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় যুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সবাই জানে তার অবদানের কথা। সেই পরিবারের সদস্য হয়ে তোমরা ভাতা পাচ্ছো না এ কেমন কথা! অবিশ্বাসের সুর ঝরে পড়লো চেয়ারম্যান সাহেবের কণ্ঠে। সুখী বললো, এটাই সত্য। সরকার থেকে কোনো ভাতা পাচ্ছি না আমরা। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ভাতা না পাওয়ার তো কারণ নেই মা। আর পাওয়াটা অসম্মানজনকও কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, এ কথা সত্য, ওই ভাতা পাওয়া আর না পাওয়া একই। ভাতার অ্যামাউন্ট এতোই সামান্য যে, তা উচ্চারণ করতেও খারাপ লাগে। ঠিক বলেছি না? ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব তাকালেন সুখীর দিকে। সুখী বললো, হয়তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ভাতার অ্যামাউন্টের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। বিশ্বাস করুন, আমরা ভাতা পাই না। পেলে মাকে এতো কষ্ট করে রোজগার করতে হতো না। চমশার কাচ দুটো পরিষ্কার করতে করতে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ভাতা পেলেও কষ্ট করে রোজগার করতে হয়। ওই যে বললাম পুউর অ্যামাউন্টের কথাÑ সে জন্যই রোজগার করে বেঁচে থাকতে হয়। তোমার মা-ও কষ্ট করছেন। সংগ্রাম করে টিকে আছেন, এটা গর্বের কথা। সে যাক, আজ মায়ের কাছে সত্য-মিথ্যাটা জেনে নিও। এতো বড় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-কন্যা হয়েও ভাতা পাচ্ছো না, এ কী করে হয়? সুখী বললো, কেমন করে হচ্ছে জানি না। তবে ভাতা পাচ্ছি না। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, আচ্ছা ধরে নিলাম পাচ্ছো না। সত্যিই যদি ভাতা না পেয়ে থাকো তবে চিন্তার কিছু নেই। ভাতা পাবার ব্যবস্থা করে দেবো। গিয়াস সাহেব বলেছেন, ভাতার ব্যাপারে কোনো সমস্যা থাকলে তিনি তা সলভ করতে পারবেন। এখনো যদি তোমরা ভাতা না পেয়ে থাকো তবে তোমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটা নিয়ে এসো। ওটার প্রয়োজন হবে। : আচ্ছা আনবো। তো আমি যাই। উঠে দাঁড়ালো সুখী। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, হ্যাঁ মা যাও। মনে সাহস রেখো। সমস্যা মানুষের জীবনে সব সময় থাকে না। আর আমি তো আছিই! তিন. এলোমেলো ভাবনা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো সুখী। মা দাওয়ায় বসে পান চিবুচ্ছিলেন। সুখী গিয়ে বসলো মায়ের পাশে। মা জিজ্ঞেস করলেন, দেখা হয়েছিলো চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে? সুখী বললো হ্যাঁ, হয়েছিলো। : কী বললেন চেয়ারম্যান সাহেব? : বললেন আপাতত চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবেন না। তবে চেষ্টা করবেন কিছু একটা করার জন্য। আর বললেন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাইয়ে দেয়ার কথা। এ জন্য আবার বাবার সার্টিফিকেটটা লাগবে। আচ্ছা মা, আমরা কি কখনো মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়েছি? মা বললেন, না। কখনো পাইনি। পাবো কেমন করে? ভাতা পাবার জন্য যে চেষ্টাটুকু করতে হয়, তোর বাবা তা করেননি। সবসময় বলতেন, নিজে খাটবো, নিজের সংসার নিজে চালাবো। ভাতা নেবো কেন? হঠাৎ ভাতার কথা জানতে চাইছিস যে? সুখী বললো, চেয়ারম্যান চাচা জানতে চেয়েছেন। তার ধারণা আমরা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছি। আমি অবশ্য জোরগলায় বলেছি ভাতা পাচ্ছি না। তবে তিনি তা বিশ্বাস করেননি বলে মনে হলো। : কেন? বিশ্বাস করবেন না কেন? : কী করে বিশ্বাস করবেন? সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দিচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবাও ভাতা নিচ্ছেনÑ এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ বাবা নাকি ভাতার জন্য চেষ্টাও করেননি! আসলে বাবার একবারেই বৈষয়িক জ্ঞান ছিলো না। তার ধারণ ছিলো, যে সময়টাতে তিনি বসবাস করেছেন, সেই সময়টা স্থির হয়ে থাকবে অনন্তকাল। কিন্তু সময় তো বয়েই চলে মা। সময় নদীর মতো গতিশীল থেমে থাকে না কারো জন্য। হয়তো বাবা তা মানতেন না। মা বললেন, কী কঠিন কঠিন কথা বলিস আজকাল! সব কথা বুঝি না। তোর বাবার সব কথাও বুঝতাম না। সুখী বললো, না বোঝার মতো কঠিন কথা বলিনি মা! একটু ভেবে দেখো, কতো দ্রুত বদলে যাচ্ছে সময়। কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে জীবন। তুমি আর আগের মতো কাজ করতে পারো না। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে। আমিও বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখন তো ভাতার কথা ভাবতেই হবে, মা। : ভাবতে তো হবে। কিন্তু ভাবলেই কি কেউ ঘরে এসে ভাতা দিয়ে যাবে? নিরাশা ঝরিয়ে বললেন মা। জবাবে সুখী বললো, ঘরে এসে ভাতা পৌঁছে দেবে না সত্য, তবে চেষ্টা করলে ভাতার ব্যবস্থা করা যাবে। এ জন্য শুধু বাবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটা লাগবে। ওটা বের করে রেখো মা। মা বললেন, সার্টিফিকেট থাকলে তো বের করে রাখবো! : থাকলে তো মানে? থাকবে না কেন? হারিয়ে ফেলেছো? জিজ্ঞেস করলো সুখী। মা বললেন, আমি হারাতে যাবো কেন? কখনো ছিলোই না ওটা। হারাবার প্রশ্নই ওঠে না। : কখনো ছিলো না ওটা মানে? মা প্লিজ ক্লিয়ার করে বলো। ব্যাকুলতা প্রকাশ পেলো সুুখীর কণ্ঠে। মা বললেন, তোর বাবার কোনো সার্টিফিকেটই ছিলো না। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের ওপর কোনো দুর্বলতা ছিলো না তার। সুখী বিস্মিত হলো মায়ের কথা শুনেÑ এ কী বলছো মা? মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বাবার দুর্বলতা ছিলো অথচ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের ওপর দুর্বলতা ছিলো নাÑ এ কেমন কথা? মা বললেন, আমিও একই প্রশ্ন করেছিলাম তোর বাবাকে। জবাবে তিনি কী বলেছিলেন জানিস? বলেছিলেন, দেশ আমাকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেনি। আমার স্বার্থেই আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। এক স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার দুর্বার সাধ্য ছিলো, সেই তাগিদ থেকে যুদ্ধ করেছি। স্বার্থটা যখন আমার ছিলো, তখন আর দেশের কাছ থেকে সাটিফিকেট নেবো কোন মুখে? : আর কী বলতেন বাবা? : বলতেন, যুদ্ধে আমি পঙ্গু হইনি। শত্রুরা আমার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়নি। কোনো আপনজনকে হারাতে হয়নি এ যুদ্ধে। বরং এ দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। অন্তত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার তো দিয়েছে। যে দেশ আমার জন্য এতো কিছু করেছে, সে দেশের কাছে আমি মুক্তিযুদ্ধের বিনিময় দাবি করবো কোন প্রবৃত্তিতে! সাটিফিকেট নেবো কেন? : আশ্চর্য! এসব কথা বলতেন বাবা? তুমি কিছু বলতে না? : কী বলবো? যেমন দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলতেন, মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে যাওয়া ছাড়া তখন আর উপায় থাকতো নাÑ আমার ভাষা হারিয়ে যেতো। মনে হতো বারবার এসব কথা তুলে আমি নিজেই নিজেকে ছোট করছি। : নিজেকে ছোট মনে হতো তোমার? : হ্যাঁ রে, ছোটই মনে হতো। তোর বাবার মুখে যদি এসব কথা শুনতিস, তাহলে তোরও তাই মনে হতো। জানিস, একদিন মরিয়া হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট করার জন্য বলেছিলাম। বলেছিলাম, সবাই বলছে ভবিষ্যতে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটের খুব প্রয়োজন হবে। সুযোগ থাকতেও তুমি ওটা করে নিচ্ছো না কেন বুঝতে পারছি না! বলেছিলে এ কথা? : হ্যাঁ, বলেছিলাম। শুনে তোর বাবা বলেছিলেন, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট কেন নিচ্ছি না জানো? আমার বারবার শুধু মনে হয়Ñ এ দেশ আমার মাতৃভূমি। আমার মা। মা বিপদে পড়েছিলো, আমি তাকে সাহায্য করেছি। সেই সাহায্যের বিনিময়ে মায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতিপত্র আদায় করে নেবো, এতটাই কি বিবেকহীন আমি? বিপদের সময় মাকে সাহায্য করে তুমি কি পারতে তোমার মায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতিপত্র আদায় করে নিতে? কোনো সুসন্তান তা পারে? : একেবারেই অন্য রকম কথার তো! তুমি কী বলেছিলে? : আমি? আমি কোনো জবাবই দিতে পারিনি। আসলে এ কথা তোর বাবা এমন করে বলতেন যে, তা শুনতে শুনতে আমি তন্ময় হয়ে যেতাম। সার্টিফিকেটের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে আর মনেই থাকতো না। মনে থাকলেও আর প্রবৃত্তি হতো না। সুখী বললো, তুমি ঠিক কথাই বলেছো মা। বাবা যেসব যুক্তি দেখাতেন, তার ওপর কোনো যুক্তি চলে না। কিন্তু সময়টা এমন যে, একটা অবলম্বন ছাড়া মাথা তুলে দাঁড়ানোও যায় না! এ কারণেই সার্টিফিকেটের ভীষণ প্রয়োজন অনুভব করছি, মা। জানো তো সরকারি চাকরিতে যুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের জন্য একটা বড় কোটা ধরা আছে। ওটার সুবিধা নেয়া যেতো। মা বললেন, ওই সুবিধা নেয়াটাকে অনৈতিক কাজ মনে করতেন তোর বাবা। তোর বাবার ধারণা ছিলো এসব সুবিধা ভোগ করার মানে মায়ের রক্ত নিংড়ে নেয়া। দেশের প্রতি যার সামান্যতম কৃতজ্ঞতাবোধ আছে, সে তা পারে না। : বাবার সঙ্গে আমিও একমত মা। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এতোটা বিবেকহীন হওয়া উচিত নয় আমাদের। কিন্তু আমি এখন কী করবো মা? অসহায় শোনালো সুখীর শেষের কথাটা। মা বললেন, কী আর করবি। অন্য আর দশটা ছেলেমেয়ে যেভাবে চাকরি খুঁজে বেড়ায়, তুই সেভাবে খুঁজে বেড়াবি। এক সময় একটা না একটা কাজ পেয়েই যাবি। : তা হয়তো পাবো। কিন্তু সে জন্য তো অপেক্ষা করতে হবে। মা বললেন, আপাতত একটা কাজ করলে পারিস। দু-চারটা ছেলেমেয়েকে পড়ালে পারিস। তোর মিতা ফুফু জানতে চেয়েছিলেন কণাকে তুই পড়াবি কি না। বলেছি তোর সঙ্গে কথা বলে জানাবো সুখী বললো, তাই? অবাক কাণ্ড তো! কাল গিতাও ওর ভাইকে পড়াবার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিলো। আর মোনা বলেছে ওর বান্ধবীরা আমার কাছে গান শিখতে চাইছে। আমি কাউকে কথা দিইনি। : কোনো কথা দিসনি কেন? মেয়ের এই অপরিপক্বতায় একটু অখুশিই হলেন মা। জবাবে সুখী বললো, কী করে কথা দিই? তোমার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে কাউকে কথা দেবো, এতই কী অবাধ্য আমি? সুখীকে কাছে টেনে নিয়ে মা বললেন না, একেবারেই না। তুমি আমার বাধ্য মেয়ে। আমার লক্ষ্মী মেয়ে। সুখী কণ্ঠে কৃত্রিম অভিমান মিশিয়ে বললো, শুধু বাধ্য মেয়ে? শুধু লক্ষ্মী মেয়ে? না মা, বলো মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে। বলো মা, বলো ... মা বললেন, হ্যাঁ, তুই এক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ