একটু খুশি একটু মন খারাপ

একটু খুশি একটু মন খারাপ

গল্প ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ এপ্রিল ২০২৩

মাখন মাখানো মুচমুচে পাউরুটির প্লেটটা শাহানা কুট্টুসের সামনে রাখেন। টোস্টের পাশে সেদ্ধ ডিমও রয়েছে। 

টোস্টার থেকে লাফিয়ে উঠছে আরও পাউরুটি। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, কুট্টুস ডিম পোচ পছন্দ করে, তা করেই দিতে পারতিস শিরীন। 

মেয়ে কিছু বলার আগেই রহিমার মা বলে, পোচ দিলে আপনার নাতি সোয়েটার জামা সব ছ্যাড়াব্যাড়া কইরা ফালায় খালাম্মা। 

শিরীন আর আমাদের কথা বলার সময় নেই। রোববার, অফিস যেতে হবে। 

আজ ইংরেজি নববর্ষ, বিছানায় থাকতেই কুট্টুসের কানে কানে শাহানা বলে দিয়েছেন, হ্যাপি নিউ ইয়ার কুট্টুস ভাইয়া।

আম্মু আব্বু ফিরে আসবে সেই বিকেলে। খেতে খেতেও ভাবে, বিকেল তো নয়, শীত ঋতু বলে সন্ধ্যে হয়ে যায়। রাতে আম্মু ভালো কিছু রাঁধবে ও ঠিক জানে। একটা সুন্দর দিন এলেই শিরীন বাড়ির সবার প্রিয় খাবারগুলো রাঁধে। 

এবার অবশ্য মায়ের খুশির আরেকটি কারণ রয়েছে। শাহানা রয়েছেন বাড়িতে। মায়ের আম্মু, কুট্টুসের নানীদিদা। উফফ্- দারুণ, ফ্যানটাসটিক- মনে মনে বলেও। 

শীতের সময় তাড়াতাড়ি বেলা ফুরিয়ে যায়। তারপরও কুট্টুসের মনে হয় সময় যেন আর কাটছে না। সেই কোন সকালে শিরীন আর আসাদ অফিসে গেছে, আজ দুপুরটা যেন ফুরাতেই চাইছে না। 

নানীর হাতে মাছ-ভাতের লোকমা খেতে খেতে কুট্টুস জিজ্ঞেস করে আজকের দুপুরটা অনেক বড়-তাই না নানুদিদা? 

হেসে ফেলেন শাহানা। 

-না ভাইয়া, দিনটা যেমন ছিল তেমনই আছে। তুমি আম্মু আসার অপেক্ষা করছো তো, তাই মনে হচ্ছে সময়টা আর চলছে না। 

তাই হবে। 

নানীদিদা আর দশটা নানীদের মতো নন। তিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতেন। বিনুনী ও খোঁপা বেঁধে খোঁপায় ফুল খুঁজে দেন। বাংলা ইংরেজি দু’টি ভাষাতেই চমৎকার কথা বলেন। মোটা মোটা বই পড়েন। পৃথিবীর অনেক খবরা খবর রাখেন। মিষ্টি করে হাসেন। নানী যা বলবে তাই ঠিক। 

নানীর ওপর একটু রাগও আছে। ওর নাম কুট্টুস এটি তারই দেয়া। কেন নানীদিদা বুঝি এ বিচ্ছিরি নামটি ছাড়া আর কোনো নাম খুঁজে পায়নি? 

নানী মিষ্টি হেসে বলেন, ওমা তুমি তো বাচ্চা বয়সে কুটুস কাটুস করে সব কামড়ে দিতে। তাইতো কুট্টুস নামটি রাখলাম। 

হ্যাঁ ওর ইশকুলের নামটি চমৎকার। আব্বু আসাদ এর নামের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে আতিফ। তা বেশ, তবে বন্ধুরা এলে সে আম্মু আর নানীদিদাকে সাবধান করে দেয়- তোমরা কখনো আমাকে কুট্টুস বলে ডাকবে না। 

তবে নানী তো সব সময় ওদের বাসা কাকরাইলে থাকেন না। নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে নিউ ইস্কাটনে। তবে মাঝে মাঝে আম্মু গিয়ে নিয়ে আসেন তাকে। 

খুব ভালো লাগে তখন কুট্টুসের। ইশকুল থেকে ফিরে ওর একা একা থাকতে হয় না। খুব মজার নাশতা বানিয়ে দেন। প্যান কেক, ফ্রুট কেক, পুডিং ওর জন্যই তৈরি করেন। বুয়া খালা তো সেই নুডুলস, রুটি-ভাজি, টোস্টে মাখন মাখিয়ে খেতে দেয়। ওসব খেতে একদম ভালো লাগে না ওর। 

নানীকে কথাটি বলেছিল একদিন। 

হাসতে হাসতে শাহানা বলেছেন, ওরে পাগল-এও বুঝিস না? আমি তো ওসব নাশতায় আদর মাখিয়ে দেই, ভালোবাসা খাবারে মাখিয়ে দেই তো, তাই তোমার ভালো লাগে। 

ভালোবাসা আর আদর- এই দুটি শব্দ নিয়ে অনেক ভেবেছে কুট্টুস। জিনিসগুলো দেখা যায় না। তাহলে নানী কিভাবে খাবারে মিশিয়ে দেয়? 

শাহানা বলেন, আরে বোকা, বাতাস কি দেখা যায়? ফুলের গল্প কি দেখতে পাও? পাও না তো, ভালোবাসা আর আদর এমনই জিনিস। দেখতে পাওয় যায় না, কিন্তু পৃথিবীতে এ দু’টি জিনিস রয়েছে। 

শুধু কি এই? নানীদিদা চমৎকার সব গল্প শোনান। রূপকথার গল্প, ঈশপের গল্প, আইনস্টাইন, আলভা এডিসন, চার্লি চ্যাপলিনের গল্প। শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। 

দেখে রাজপুত্র-রাজকন্যা আর ময়ূরপঙ্খী নাও। ঈশপের গল্পের কুকুর-বেড়াল-কচ্ছপ, খরগোশ সবগুলো মিছিলের মতো ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে আবার ছোট্ট চার্লিকেও দেখে কুট্টুস। 

স্বপ্নের মাঝে হাসির রাজা চার্লি চ্যাপলিন চলে আসেন। বাড়িতে খাবার কিছুই নেই, মা বলছেন তার বান্ধবী ম্যাকার্থির বাড়িতে যেতে। সেখানে গেলে ওর ছেলের সাথে খেলার পর চা ও খাবার খেতে পেতেন চার্লি। একদিন তার যেতে মন চাইছিল না। মা বললেন, ঘরে তো কিছুই নেই, ওদের বাড়িতে গেলে তোকে খেতে দেবে বাবা। 

ঘুমের মাঝে ফুঁপিয়ে সে কেঁদে উঠেছিল চার্লির জন্য। 

নানীদিদা এলে কত কিছু জানতে পারে ও। 

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি তো চার বছর পর্যন্ত কথা বলেননি। কেন? এর কারণটা বলবেন কি? তার শান্ত জবাব, দরকার পড়েনি তাই বলিনি। 

কথাটি মনে আসতেই হেসে ফেলে সে। নানী না থাকলে এতসব গল্প কোত্থেকে সে জানত? 

এত ভালোবাসে যে মানুষটি, তার বিরুদ্ধে কমপ্লেনও আছে। ওদের বাড়িতে কদিন থাকার পর শাহানা বলতে থাকেন, ও শিরীন, কদিন তো থেকে গেলাম রে, এবার যেতে হবে।

শিরীন মন খারাপ করা সুরে বলে, সে বাড়িতে কেউ নেই আম্মু, তুমি একা একা কি করবে সেখানে গিয়ে?

শাহানা বিব্রত মুখে হাসেন। 

আমার ফুলের টবে কে পানি দেবে রে? যতবার তোদের বাড়িতে আসি ততবারই গাছগুলো মরে যায়। বল কেমন লাগে!

নানী যখন হাসিখুশি থাকেন তখন কুট্টুসের সঙ্গে খেলা করেন। অভেনে কেক বানান, নাতির জন্য ডিমে ডুবিয়ে মাছের ফ্রাই করেন। কী আনন্দ তখন কুট্টুসের!

রহিমার মা একা থাকলে খুব খবরদারি করে ওর ওপর। ফ্রিজ থেকে কোক খাবানা, খালি ছবি আকতাছো ক্যান? ইশকুলের পড়া করো। বিছানার ওপুর লাফালাফি করতাছো ক্যান? আম্মারে কইয়া দিমু। আপিস থাইকা আউক আম্মা। 

রহিমার মায়ের নালিশ চলতেই থাকে। নানী এলে ও আর সারাক্ষণ খবরদারি করে না। শাহানা আদরে ভালোবাসায় একেবারে জড়িয়ে রাখেন ওকে। তা কি বুঝতে পারে না-নানীদিদা? 

ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ আর দূরের দু’একটা গাছগাছালির দিকে তাকায় ও। শীতের কমলালেবু রং বিকেল আবছা হয়ে এসেছে। 

ভোরে বেল বেজে ওঠে। আব্বু আর আমিন চাচ্চু এসেছে। খুশিতে লাফাতে থাকে কুট্টুস। হলে থাকে চাচ্চু, মাঝে মাঝেই আসে। আজ ইংরেজি বছর শুরু হয়েছে তো তাই হয়তো এসেছে। 

চাচ্চু ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাপি নিউ ইয়ার। 

কুট্টুস খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে, হ্যাপি নিউ ইয়ার টু চাচ্চু। 

একটু পরেই ফিরে এল শিরীন। অফিসের কাপড়-চোপড় ছেড়ে ম্যাক্সি পরে নিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে একটু বিশ্রাম, ব্যস এই টুকুই। রহিমার মায়ের সাথে কিচেনে ঢুকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কুট্টুস চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, কি রাঁধছ আম্মু? 

-তুমি যা পছন্দ করো তাই। 

জবাব শুনে দারুণ খুশি সে। আব্বু-চাচ্চুর গল্প জমে উঠেছে। হাতা-বেড়ির আওয়াজ শুনতে শুনতে আমিন বলে, ও ভাবী, তোমার এবারের নববর্ষের খেতাব হলো- হাতা-বেড়ি-খুন্তি ভাবী। খুন্তি হাতে ডাইনিং স্পেসে এসে হাসিমুখে শিরীন বলে, বেশ, তাই সই। 

কুট্টুস বলে, নতুন বছরে নানীদিদাকে একটা খেতাব দিতে হবে না? কি দেয়া যায় বলো তো? 

আব্বু বলেন, তুমি কি দিতে চাও, দাও। 

কুট্টুস ঘোষণা দেয়, এবারের হ্যাপিড নিউ ইয়ারে নানীদিদার খেতাব হলো-একটু খুশি একটু মন খারাপ। 

খল খল করে হেসে ওঠে ছেলে। হাসিতে কুট্টুসের সাথে গলা মেলায় শিরীন। 

বছরের প্রথম রাতে খাওয়া-দাওয়া, খুব গপ্পো ও মজা হলো অনেক। একগাদা বাসন মাজতে গিয়েও রহিমার মায়ের মন খারাপ হয় না। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলে, কুট্টুস ভাইয়া জব্বর খেতাব দিছে নানীরে। 

শুতে যাবার আগে শাহানা মেয়েকে বলেন, খুব তো হাসলি আমাকে নিয়ে। এই যে আমি নেই, কে আমার টবগুলোতে পানি দেবে বল? গোড়ার মাটি শুকিয়ে গাছের পাতাগুলো রোদের ঝাঁঝে শুকিয়ে যাবে তাই না? 

শাহানার দু’চোখ ছল ছল করে ওঠে। 

শিরীন মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, মন খারাপ করো না আম্মা, নার্সারি থেকে অনেকগুলো চারা এনে দেব। 

বালিশে মাথা রেখে চোখ ভিজে যায় শাহানার। ভাবেন, সত্যি এ দুনিয়াটাই যেন মায়ার সুতোয় বাঁধা। ফ্ল্যাটবাড়িতে তেমন আর বাগান করার সখ মিটে কই? ব্যালকনিতে গুটি কয়েক টবে অপরাজিতা, টগর, নয়নতারা, সবুজ-হলুদে ছোপ ছোপ দেয়া পাতাবাহার, মানিপ্ল্যান্ট-এই কটা ফুলের টবের জন্য বুকের ভেতরটা পুড়তে থাকে শাহানার। 

দেড় মাস থাকার পর অবশেষে কুট্টুস বলল, নাও নানীদিদা, এবার তোমার নিজের বাসায় যেতে পার। 

আসাদ অবাক হয়ে বলল, আম্মা চলে যাবেন? 

শিরীন অবাক হয়ে বলল, আম্মা চলে যাবেন? শিরীন অবাক কুট্টুসকে বলে, তুই আম্মাকে চলে যেতে বললি? যাবার পারমিশান দিলি? 

বালিশে মুখ গুঁজে কুট্টুস বলে, তোমার মায়ের তো একটু একটু খুশি, বেশি বেশি মন খারাপ। এমন করলে কি ভালো লাগে বলো। তা ছাড়া নানীর প্রিয় ফুল গাছগুলো রয়েছে যে। 

আজ শাহানা নিজের বাসায় ফিরে যাবেন। শিরীন খুব কেঁদেছে। চোখ লাল, চোখের পানির দাগ সারা মুখে। 

ঢাউস ব্যাগে শিরীন মায়ের জন্য হরলিকস, ফল, বিস্কিটের প্যাকেট টুকিটাকি সব গুছিয়ে দেয়। 

কুট্টুসের মুখও মলিন। সে ব্যাট আর বল দিয়ে আজ খেলছে না। জানালা দিয়ে আকাশ দেখার তার এতটুকু ইচ্ছে নেই। সে ভাবছে, নানুদিদার বাড়িতো বেশি দূরে নয়, তারপরও কি তেমন যাওয়া হয়? হয় না। আব্বু-আম্মু দু’জনেই অফিস নিয়ে ব্যস্ত। দু’দিন ছুটি আছে সত্যি, কিন্তু বাড়িতে কাজকর্ম থাকে বলে মা কুট্টুসকে নিয়ে যেতে পারে না। শুক্রবার, ছুটির দিন। ছেলে আর আম্মাকে নিয়ে শিরীন মায়ের বাড়ি আসে। 

-নাও মা, এবার তোমার শান্তি তো, একা একা থাকতে যে কী আনন্দ পাও বুঝি না। 

শাহানা জবাব দেন না। কি করে মেয়ে আর নাতিকে বোঝাবেন, আমি যে সবাইকে ভালোবাসি। নিজের বাড়ির আলমারিতে রাখা থরে থরে কাচের বাসন, টুকিটাকি জিনিসপত্র। কিচেন কেবিনেটে রাখা মুগডাল, মসুর ডাল, ফ্রিজে রাখা জিনিসপত্র- সব কিছু আবার পরখ করতে হবে। ভালো জিনিস রেখে খারাপ হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো ফেলতে হবে। 

কেউ বুঝবে না। এই বাড়িতে অগণিত স্মৃতি ছড়ানো। 

শিরীনের আব্বার ছবি-চশমা-ডায়েরি, নিজের পুতুল, কত খেলনা। ছোটখাটো জিনিসগুলোও তার কাছে সাত রাজার ধন মানিকের মতো। দরজা খুলে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান শাহানা। 

-ইস্স। টবগুলোর দিকে চোখ পড়তেই মন খারাপের মেঘ এসে জমা হয় বুকের ভেতর। 

কুট্টুস বলে, এবার তো নিজের বাড়িতে এসেছ, তাও তোমার মন-খারাপ? 

কি হলো রে? 

বলতে বলতে শিরীনও এসে দাঁড়ায়। সেও টবের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। 

অপরাজিতার লতাটি গ্রিল পেঁচিয়ে অনেকখানি লতিয়ে উঠেছিল। নীল রঙ ফুলে ভরে থাকত লতা গাছটি। পানির অভাবে শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। নয়নতারা, পাতাবাহার, টগর কোনো গাছ আর বেঁচে নেই। 

শাহানা বেগমের বুকের ভেতরটা গুমরে কেঁদে ওঠে। এ আমি কী করলাম? কেন আমি ওদেরকে ফেলে মেয়ের বাড়িতে গেলাম? সেই ছোটবেলায় পড়েছি, গাছেরও প্রাণ আছে। ওদের যত্ন করতে হয়, ভালোবেসে আলতো হাতে ওদের পাতায় হাত বুলিয়ে দিতে হয়। খুরপি দিয়ে শিকড়ের মাটি আলগা করতে হয়, তবেই তো গাছগুলো সতেজ আর সবুজ থাকে।

ঝরঝর করে তার চোখ দিয়ে কান্নার ফোঁটা ঝরতে থাকে। 

মন খারাপ নানীকে জড়িয়ে ধরে কুট্টুস। মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত¡না দেয় শিরীন। 

মন খারাপ করো না আম্মা আমাদের বাড়িতে গিয়ে এতদিন আর থাকতে হবে না। তবে কি জানো তুমি বাড়িতে থাকলে কুট্টুস ভালো থাকে, আমরাও খুব ভালো থাকি মা। শোনো, আজই নার্সারি থেকে অনেকগুলো চারা এনে দেব। পানি আর যত্ন না পেলে কি গাছ বাঁচে? 

ছুটির দিন বলে মায়ের সাথে সারাদিন থাকে শিরীন। বিকেলে চা-নাশতা খেয়ে তবেই বাড়ি যায় মা আর ছেলে। 

ওদের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। ফুল গাছটির জন্য যেমন কষ্ট, তেমনই ওদের জন্য হাহাকার করতে থাকে মন। তোরা সবাই যে আমার আপন রে, একসাথে সব আপনজনকে পাওয়া যায় না কেন- বলতো!

আগের নিয়মে আবার বয়ে চলে শাহানার দিন-রাত। শীতের ভোরে শাল গায়ে চাপিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসেন। এক সময় আদাকুচো দিয়ে চায়ের পানি চাপান চুলোতে। এরপর টবগুলোতে পরম যত্নে পানি দেন। গাছগুলো মরে গেছে, তবু অভ্যেসেই এসব করেন। 

বুয়া বলে, টবে হুদাহুদিই পানি দ্যান ক্যান খালাম্মা? ফুলগাছ তো নাই, মইরা গ্যাছে। বিরক্তমাখা গলায় শাহানা বলেন, মইরা গেছে বলিস কেন? নাই বলতে পারিস না?

মইর‌্যা গেছে তো মইর‌্যা গেছে। এর আবার আরেক রহম কথা আছে নি? শিক্ষিত মাইনষের যত্ত সব নয়া বুলি। 

আপন মনে বিড়বিড় করে বুয়া। 

শাহানা রোজ ভোরে তারপরও নিয়ম করে পানি দেন। তিনি জানেন, গাছের শিকড় মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকে। যদি ওরা আবার বেঁচে ওঠে। 

সত্যি তাই হলো। একদিন সোনা রঙ বিকেলে ব্যালকনিতে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখেন, সবগুলো টবে ছোট্ট চারাগুলো উঁকি দিয়েছে। তিরিতিরি কাঁপছে পাতাগুলো। পরম আনন্দে চোখে পানি এসে যায় তার। এ আনন্দ তিনি কোথায় রাখবেন? 

ইশকুলে যখন পড়াতেন ছোট্ট শিশুরা ভালো কিছু লিখলে খুশি হয়ে বলতেন, ওয়াও, হাউ ওয়ান্ডারফুল। 

আজও তার তেমন করেই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। ফ্রক পরা বালিকার মতো ছুটতে ইচ্ছে করছে। 

এ আনন্দ কার সাথে ভাগ করবেন শাহানা? কুট্টুসের সঙ্গে? মোবাইলটি তুলে নিয়ে বলেন, কুট্টুস কুট্টুস ভাইয়া- টবের গাছগুলো আবার বেঁচে উঠেছে রে। 

-তাই নানী? ভেরি ভেরি গুড নিউজ। 

-তাইতো কুট্টুস। গুড নিউজটা তোমাকেই প্রথম দিলাম। কুট্টুস তাজ্জব। 

-শুধু পানি দিয়েছ, তাতেই বেঁচে উঠেছে? হাও মিরাকল নানীদিদা। 

-ইয়েস কুট্টুস। 

অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে শিরীন। ছেলেকে বলে, খুব খুশির খবর, তাই না কুট্টু!

আনন্দে-আবেগে ভাসতে ভাসতে কুট্টুস বলে, হ্যালো নানীদিদা তুমি তাহলে নানুভাইয়ের ওপর এটা অ্যাপ্লাই করতে পারতে। নানুভাই বেঁচে উঠত- তাই না? এমন করে আমাদের ছেড়ে চলে যেত না। 

-কুট্টুস-করুণ সুরে উচ্চারণ করে শাহানা ফোন রেখে দেন। শিরীন ছেলেকে বুকের কাছে টেনে আদর করে। ওর কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে বলে, এভাবে আর কক্ষনো বলো না সোনা। মানুষ হলো জীব, আমার-তোমার সবারই প্রাণ আছে। এক সময় সবারই চলে যেতে হয়। 

-পশু-পাখিরও তো প্রাণ আছে আম্মু। 

-হ্যাঁ আছে। তাইতো প্রাণীরা একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। 

-ইশকুলে ম্যাম যে পড়ান, গাছেরও প্রাণ আছে। 

-হ্যাঁ, তা তো আছেই। তবে মরে গেলেও মাটির ভিতর ওদের প্রাণ অনেক দিন বেঁচে থাকে। পানি পেলে আবার জেগে ওঠে ওরা। 

শিরীন বলে, চলো-অফিস যাবার আগে তোমাকে আম্মুর কাছে দিয়ে আসি। আম্মুর আজ মন খারাপ। 

কুট্টুস মায়ের পাশে রিকশায় বসে ভাবে, নানীদিদা আজ ভীষণ খুশি। তার সখের গাছগুলো যে বেঁচে উঠেছে। আবার ওর কথা শুনে নানাভাইয়ের কথাও মনে পড়েছে। তাইতো খুব মন খারাপ হয়েছে তার। 

কুট্টুস বলে, সব মানুষেরই একটু খুশি একটু মন খারাপ হয়-তাই না আম্মু? 

বিষণœ শীতের হাওয়া ছুঁয়ে যেতে থাকে কুট্টুস আর ওর আম্মুকে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ