এলো খুশির ঈদ

এলো খুশির ঈদ

বিশেষ রচনা আগস্ট ২০১২

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম..



‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ॥
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ॥”
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গানের উপরের ক’টি লাইনে ঈদের আনন্দ তথা ঈদুল ফিতরের আনন্দ মুসলিম চেতনায় যে জাগরণের সূচনা করে তা তিনি উজ্জীবিত করেছেন পথ চলার নির্দেশনা হিসেবে। জাতীয় কবি আমাদেরকে ঈদের আনন্দের মাঝে বিলিয়ে দিতে বলেছেন। আসলে রোজার ঈদের আনন্দ এমনই যা উপভোগ করা যায়, এ আনন্দের মাসে বিলীন হওয়া যায় কিন্তু লিখে তার ভাব প্রকাশ করা যায় না।
ঈদ অর্থ আনন্দ উৎসব। জীবনের মহান আনন্দের দিন। সন্ধ্যায় এক ফালি বাঁকা চাঁদ দেখার সাথেই ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায়। ফিতর অর্থ না খেয়ে থাকার পর খাবার গ্রহণ করা। ইৎবধশ ভরৎংঃ বা প্রাতঃরাশ বলতে যা বুঝায় আরবি ফিতর অর্থ প্রকৃতপক্ষে তাই। ঈদ প্রত্যেক মুসলিমের তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পর সব সাফল্যের জন্য উৎসব পালন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে দীর্ঘ এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিনরা যে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্র গঠনের অনুশীলন করে থাকেন, তার সমাপনী উৎসব ঈদুল ফিতর নামে অভিহিত। ঈদুল ফিতর হচ্ছে রমজানের রোজা রাখার দায়িত্ব পালনে সাফল্যের জন্য। ঈদুল আযহা হচ্ছে মক্কায় হজ পালন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার, যে হজ আল্লাহর আহ্বানের দিকে সাড়া দেয়ার শিক্ষা দেয়। ঈদের আনন্দের উৎস মুমিনের মনে, হৃদয়ে। মুমিনের মনের বা হৃদয়ের যিনি একমাত্র অধিকারী মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই মুমিনের মনে ঈদের আনন্দ সংস্থাপিত করে দিয়েছেন। ঈদ এলেই সকল ব্যথা, দুঃখ ভুলে ঈদের আনন্দে মুমিনরা অবগাহিত হয়। এ যেন এক সিস্টেমিক উচ্ছ্বাস, অন্তর্নিহিত উচ্ছ্বাস প্রকৃতিগত অনাবিল এক আনন্দ। ঈদের আনন্দের সাথে দুনিয়ার কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। ইসলামী উম্মাহর ঈদ আনন্দ উৎসব অন্য জাতির আনন্দ উৎসব থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। একেবারেই আলাদা।
মুসলিমদের ঈদের একটি দিক এই যে, এই দু’টি ঈদ বিরাট ইবাদত সম্পন্ন করার পর তার শোকরানা স্বরূপ পালন করা হয়। আর এ জন্য সমবেতভাবে কোনো উন্মুক্ত মাঠে দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করা হয়। এর দ্বারা এই স্বীকৃতি আদায় করা হয় যে, একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর তওফিক ও ক্ষমতা বলেই আমরা দু’টি বড় ইবাদত করে নিজেদেরকে ধন্য করছি এবং দৈহিক ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করেছি। 
ইসলামী ঈদের একটি পৃথক বৈশিষ্ট্য এই যে, এর মাধ্যমে বিশেষভাবে আল্লাহর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়। ঈদের দিন চতুর্দিকে আল্লাহু আকবর (আল্লাহ মহান) এই ঈমান বর্ধক ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। এরূপ করার জন্য ইসলামে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ঈদগুলোকে তাকবির (আল্লাহু আকবার) ধ্বনি দ্বারা সুসজ্জিত কর।’ অর্থাৎ তোমরা নিজেদের ঈদের আনন্দ প্রকাশের জন্য তাকবিরকে নিজেদের রীতিতে (রেওয়াজে) পরিণত কর, যাতে সমগ্র আকাশ বাতাস আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মাহাত্ম্য ও পরাক্রমের ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিতে প্রকাশিত হয়ে ওঠে, আর চতুর্দিকে কেবল এই কথাই শোনা যায় যে, যাবতীয় গৌরব ও মাহাত্ম্য কেবল সেই সত্তার জন্য, যিনি সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা। যাবতীয় মহত্ত্ব ও সম্মান প্রতিপত্তির অধিকারী এবং এ ক্ষেত্রে তিনি এক ও একক, তার কোনো শরিক নেই।
ঈদ একতা ও ঐক্যের অতুলনীয় বহিঃপ্রকাশ
ঈদের দিন প্রত্যেক মুসলিম গোসল করে পবিত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে এবং সুগন্ধি মেখে পবিত্র অন্তর পবিত্র নিয়তের সাথে তাকবির ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে সমবেত হয় এবং নিজের মালিক ও মালিকের সামনে সিজদাবনত হওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। তখন তারা এক অতুলনীয় একতা ও ঐক্যের বাস্তব রূপ তুলে ধরে এবং আপন প্রভুর ইবাদত বন্দেগির জন্য পরিপূর্ণ নীরবতা ও নিস্তব্ধতার সাথে সমবেতভাবে একটি বিরাট ইবাদতের মধ্যে মশগুল হয়ে পড়ে। অতঃপর সে তার সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করে। সমস্ত চিন্তাচেতনাকে জাগরুক রেখে ঈমানের উপদেশপূর্ণ ভাষণ শ্রবণ করে এবং ইমাম সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের সাফল্য এবং শান্তি ও মঙ্গল লাভের যে দোয়া করেন তাতে সকলে অত্যন্ত বিনীতভাবে আমিন আমিন (হে আল্লাহ কবুল করুন) উচ্চারণ করে। এই সমস্ত কার্য সম্পাদনের পর তারা পবিত্র ঈদের আনন্দ প্রকাশের জন্য পরস্পর পরস্পরকে দান খায়রাত, উপহার উপঢৌকন প্রদান করে, যার মধ্যে তাদের আদর্শিক ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতাবোধ প্রতিবিম্বিত হয়। এভাবে এক মুসলমান চাই সে যে কোন স্থানের হোক বা যেখানেই থাকুক নিজেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উম্মতে মুসলিমার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং একান্ত আপনজন বলে মনে করে। এতে একজন মুমিনের অন্তরে এক বিরাট শক্তি, সাহস ও আত্মপরিচয়ের প্রবল অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরে আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ঈদের জামায়াতে শরিক হয়। নামাজের পর মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ মোলাকাত করে আত্মীয় বন্ধুদের বাড়িতে যায়। নিজেদের মধ্যে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা ঈদ যেন এক জাতীয় মিলনমেলা মুসলমানরা তাদের দ্বীনী আদর্শ ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির খোলামেলা বাহ্যিক রূপ তারা ঈদের প্রাক্কালে প্রত্যক্ষ করে। মুসলিমরা স্বীয় জাতিসত্তা, তাদের আত্মপরিচয় এ সময় উপলব্ধি করে। মুসলিম সমাজে ঈদের সময় ধনী-গরিবে কোনো ব্যবধান থাকে না। গোটা ইসলামী উম্মার জন্যই ঈদ খুশির দিন তবে ব্যক্তির জন্য দিনটি আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের দিনও ঘটে। এটিই ঈদের বিশেষত্ব।


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ