কথাশিল্পী জুবাইদা গুলশান আরা স্মৃতির বুদ্বুদ    -মোশাররফ হোসেন খান

কথাশিল্পী জুবাইদা গুলশান আরা স্মৃতির বুদ্বুদ -মোশাররফ হোসেন খান

স্মরণ এপ্রিল ২০১৭

১৯ মার্চ, ২০১৭। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমি কেবল রাতের প্রথম পর্বের ওষুধ হাতে নিয়ে খেতে যাব, ঠিক সেই সময়ই বেজে উঠলো মোবাইলটি। ওষুধ হাতের মুঠোয় রেখে কলটি রিসিভ করতেই অন্য প্রান্ত থেকে কিশোরকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক জানালেন, অধ্যাপিকা জুবাইদা গুলশান আরা নাকি ইন্তেকাল করেছেন? আমি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম খবরটি কে জানালো? তিনি বললেন ফেসবুকে দেখলাম। আমি তাকে বললাম, ঠিক আছে আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি!
ওষুধ কয়টি তখনো মুঠোর ভেতর। হাত কাঁপছে খবরটি শুনে। তবুও সেই কাঁপা হাতে ওষুধ খেয়ে ফোন করলাম কয়েক জায়গায়। তাদের কাছে কোনো খবর না পেয়ে সরাসরি ফোন করলাম গুলশান আরা ভাবীর বাসায়। ফোনটি রিসিভ করলো তাঁর ছোট মেয়ে মেহতাব আমিন। আমাকে জানালো, মামা আম্মুর জানাজা হচ্ছে মসজিদের সামনে। একটু পরেই বনানী কবরস্থানে নেওয়া হবে। আমি জানতে চাইলাম কখন ইন্তেকাল করেছেন? মেহতাব বললো, বেলা আড়াইটায় মনোয়ারা হাসপাতালে। আমি আর কোন কথা বলতে না পেরে ফোনটি রেখে দিলাম।
ইচ্ছে ছিলো খবরটি শুনে তাঁর বাসায় যাওয়া এবং জানাজায় অন্তত শরিক হওয়া। কিন্তু সেটাও যখন সম্ভব হলো না তখন মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ভাবীর জানাজায়ও শরিক হতে পারলাম না। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হলো।
কথাশিল্পী জুবাইদা গুলশান আরা শুধু তো একজন লেখিকাই ছিলেন না, তিনি একাধারে ছিলেন সাহিত্যের পথে নিরলস কর্মী, সমাজসেবিকা, তার চেয়েও বড় কথাÑতিনি ছিলেন শিশু-কিশোরদের একজন খুবই মমতাময়ী অভিভাবক। এর পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ এবং অগ্রন্থিত অসংখ্য শিশুতোষ লেখা থেকে। বড়দের চেয়ে ছোটদের জন্যই অনেক বেশি লিখেছেন তিনি। তাদের নিয়ে কাজও করেছেন গোটা জীবন। যখন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, তখনও তাঁর সাহিত্য, শিশুপ্রেম, সমাজসেবাসহ বহুবিধ ব্যস্ততার শ্রোতে ভাসতেন। এই আন্তরিক এবং অমায়িক দরদি লেখিকার সাথে আমার পরিচয় ঘটে সম্ভবত ১৯৮৯ সালে। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক জমজমাট সাহিত্য সমাবেশে। তিনি, কবি আবদুস সাত্তার ও আমি ছিলাম আলোচক। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক ও বাগ্মী সৈয়দ আলী আহসান। সাহিত্য সভা শেষে নাস্তার টেবিলে তাঁর সাথে আমার সম্যক পরিচয় ঘটে। এর আগে কয়েকবার ফোনালাপ হয়েছিল বটে, কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আমি তাঁকে বরাবরই ভাবী বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে ডাকতেন কবি ভাই বলে। কিন্তু সম্পর্কটা ছিলো একেবারেই ভাই-বোনের মতই। তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত। এখন আমি ভাবী নয়, ঠিক নিজের বোন হারানোর মতো বেদনায় কেবলই তড়পাচ্ছি!
১৯৮৯ পর থেকে ভাবীর সাথে আরও বেশি বেশি ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয়েছে। সাহিত্য সভা, সাহিত্য সেমিনার, সাহিত্য সম্মেলন, সাহিত্য পুরস্কার বিতরণ, ইফতার মাহফিল প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আমরা একত্রিত হয়েছি। বরাবরই তাঁর ভদ্রজনিত শালীন আলোচনা ও আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝেই ভাবীর সাথে মোবাইলে সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হতো। পত্রিকায় লেখালেখির বিষয় নিয়েও তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। তিনি হাসিমুখে আমার সকল অত্যাচার সয়ে নিতেন এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই লেখা দিতেন।
এমনটিতোই দেখে এসেছি এতোটা কাল। আমি যখন মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক, তখন থেকে ভাবীকে এই কিশোর পত্রিকাটির জন্য লেখালেখির ব্যাপারে অবিরত কষ্ট দিয়ে এসেছি। পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার পর তো সেই কষ্ট আরও অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছি। প্রতিটি ঈদসংখ্যায় ভাবীর উপন্যাস অথবা ভ্রমণবিষয়ক লিখা নিয়েছি। এর জন্য তাঁর কোনো অজুহাতই আমি গ্রহণ করতাম না। কিশোরকণ্ঠে তাঁর উপস্থিতি ছিলো যেন অনিবার্য। কিশোরকণ্ঠের বিভিন্ন সাহিত্য সভা, সাহিত্য সেমিনার, সাহিত্য সমাবেশ, লেখক সম্মেলন, ইফতার মাহফিলসহ প্রতিটি অনুষ্ঠানে ভাবীর উপস্থিতি ছিলো অবধারিত। তাকে না বলার কোনো সুযোগই আমি দিতাম না।
ভাবীর সাথে শেষ সাক্ষাৎ ঘটে ২০১৫ সালে কিশোরকণ্ঠের ইফতার মাহফিলে। তিনি ছিলেন ওই মাহফিলের বিশেষ অতিথি। এরপর তাঁর সাথে সাক্ষাৎ না ঘটলেও লেখালেখির ব্যাপারে ফোনালাপ হয়েছে বহুবার। গত বছর ঈদ সংখ্যায় শারীরিক অসুস্থতার কারণে লিখতে পারবেন না বলে জানালে আমি অভিমানে মোবাইলের লাইন কেটে দিয়েছিলাম। ১০ মিনিট পরেই দেখি ভাবী কল ব্যাক করেছেন, বললেন ভাই আপনি তো নাছোড়বান্দা! ঠিক আছে উপন্যাস না পারি অন্য কিছু একটা লিখে দেবো। তিনি কথা রেখেছিলেন।
এবারও ঈদ সংখ্যার অগ্রিম আয়োজন চলছে। আমার ভেতরে ভেতরে। মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে ভাবীকে ফোন করলাম। ধরলো তাঁর ছোট মেয়ে। বললো মামা, আম্মুর স্যালাইন চলছে। আমি বললাম ঠিক আছে, পরে কথা বলবো। ১০ তারিখ রাতে আমি আবার কল দিলাম। এবার ভাবী খুব অসুস্থ অবস্থায় দুর্বলকণ্ঠে বললেন, ভাই আমিতো খুব অসুস্থ! তারপরও আপনি ফোন করলে আমি অসহায় হয়ে পড়ি। ঠিক আছে দোয়া করুন আল্লাহ একটু তৌফিক দিলেই আপনাকে কিছু না কিছু লিখে দেবো ইনশাআল্লাহ!
ব্যস, ভাবীর সাথে আমার এটাই ছিলো শেষ ফোনালাপ।
আজ বুকের ভেতর এক গভীর শূন্যতা এবং বেদনা অনুভব করছি। তাঁকে আর কোন সাহিত্য সভা কিংবা কোন অনুষ্ঠানে দেখতে পাবো না! তাঁর নতুন নতুন লেখার সাথেও আর পরিচয় ঘটবে না! আর কোনো দিন ফোনালাপ হবে না!-এযে আমার জন্য কত বড় কষ্টের, কত বড় যন্ত্রণার সে কথা কাউকে বুঝানো যাবে না!
২০০২ সালে তাঁকে কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করার সময় বলেছিলেন, ‘কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার আমার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। কারণ আমি কিশোরকণ্ঠকে ভালোবাসি। শিশু-কিশোরদের অত্যন্ত ভালবাসি। তাদের জন্য গোটা জীবনই কাজ করে গেয়েছি এবং যাব।’ সত্যিই তাই! ভাবী জীবনের শেষ পর্যন্ত কিশোরকণ্ঠের একজন অভিভাবকের মতো পরামর্শ দিয়েছেন, লিখেছেন এবং ভালোবেসেছেন। কিশোরকণ্ঠ প্রকৃত অর্থে তাঁর কাছে অনেক ঋণী।
কথাশিল্পী এবং একজন লেখিকা হিসাবে তিনি অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করেছেন। অন্যান্য সামাজিক কাজের পাশাপাশি তিনি ক্রমাগত লিখেছেন। শিশুদের জন্য প্রচুর লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে- বসতি, আলোটুকুর হাতছানি, নদী তুই কোনঘাটে যাবি, মধ্যরাতের তারা, সাগর সেচার স্বাদ, তখনো ঘুম ভাঙেনি, ভোরের হিরণয়, আঁধারে নক্ষত্র জ্বলে, অগ্নিস্নান, কায়াহীন কারাগার, বাতাসে বারুদ রক্ত নিরুদ্ধ উল্লাস, হৃদয়ে বসতি, বিষাদ নগরে যাত্রা, দাওদানবের মালিকানা, প্রমিথিউসের আগুন, ঘৃণার জঠরে জন্ম, উষারাগ, অশ্রু নদীর ওপারে, কি লিখেছ তরবারি তুমি, পদ্মা আমার পদ্মা, হৃদয়ে নীল নাম, চৈতী তোমার ভালোবাসা, বিবর্ণ নগরী, মন্দাকিনী, উপন্যাস নদী, ভালোবাসার স্বভাব এমন, সোনালী রংয়ের নদী প্রভৃতি।
ছোটদের জন্য রচিত ছড়া কবিতা নিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে মজার ছড়া, ছানাপোনাদের ছড়া, কলকাকলির গান, নিঝুম দ্বীপের গল্প কথা, ঘুম ভাঙ্গানো নদী, গল্প তবু গল্প নয়, রূপমের ছিরা খানা, তোমাদের জন্য গল্প, পরিচয় হোক বন্ধুর সাথে, শিশু তোর খেলার সাথী, ছোটদের নাটক মেলা প্রভৃতি।
উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, শিশুতোষ ছড়া মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০-এর উপরে। তার বেশ কিছু গল্প উপন্যাস টিভি নাটকে রূপ দেয়া হয়েছে। ষাটের দশক থেকে লেখালেখিতে যুক্ত জুবাইদা গুলশান আরা একুশে পদক, কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন পদকসহ আরো বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন।
তিনি বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। জাতীয় মহিলা সংস্থা, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, পেন বাংলাদেশ, ঢাকা লেডিস ক্লাব, বাংলাদেশ মহিলা সমিতিসহ প্রভৃতি সংস্থার সদস্য ছিলেন তিনি। সাহিত্য, সমাজ এবং নারীবিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে তিনি নারীদের অগ্রগতি এবং নারী জাগরণের পক্ষে কাজ করেছেন। এভাবেই তিনি ব্যস্ত রেখেছেন সকল সময় নিজেকে।
তিনি ১৯৪২ সালে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোঃ ইউনুস, মায়ের নাম আঞ্জুমান আরা।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। তার স্বামী অধ্যাপক (মরহুম) মাহমুদ-উল-আমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের খ্যাতিমান প্রফেসর ছিলেন। ভাবী ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা। অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘকাল।
এই সামান্য লেখার ভেতর ভাবীর সাথে আমার সুদীর্ঘ সম্পর্কের স্মৃতিচারণের সুযোগ নেই। এখানে যেটুকু বলা হলো সেটুকু কেবল স্মৃতির বুদ্বুদ। অসীম সাগর তো পড়েই রইলো!
এই খ্যাতিমান কথাশিল্পী ও সমাজসেবিকার ইন্তেকালে জাতি এক অমূল্য রত্ন হারালো। এতে জাতির যে ক্ষতি সাধিত হলো সেটা সহসা পূরণ হবার নয়। বিশেষ করে আমার জন্য তো আরও বেশি কষ্টের বিষয়! আমি এবং আমরা যেন এক অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ অভিভাবককে হারালাম। এই বেদনার ভার হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে দীর্ঘকাল যাবৎ।
আমি তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাঁর ভালো কাজগুলোকে কবুল করুন এবং যথাযথ পুরস্কার দান করুন। এটাই আজকের দিনে আমার একান্ত কামনা।    ২০.৩.২০১৭
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ