কবি সাহিত্যিক হচ্ছেন জাতির শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক

কবি সাহিত্যিক হচ্ছেন জাতির শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক

সাক্ষাৎকার আবদুল হালীম খাঁ এপ্রিল ২০২৩

আধুনিক বাংলা কাব্যে আবদুল হালীম খাঁ এক অনন্য নাম। আমাদের কাব্য কলায় বিশ্বাসের পক্ষে, শিকড়ের সন্ধানে, ঐতিহ্যের শাশ্বত পথে যে কাব্যধারা বিকাশমান, আবদুল হালীম খাঁর কবিতা তাতে নবসংযোগ। আবদুল হালীম খাঁ অনেকের ভিড়ে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। একটি ইনস্টিটিউশন। প্রতিভার বহু মাত্রিকতায় তাঁর রয়েছে এক স্বতন্ত্র অধিষ্ঠান। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, জীবনীকার, সম্পাদক ও সংগঠক।

আবদুল হালীম খাঁ ১৯৪৪ সালের ১৭ই জুলাই বুধবার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য আর লোক-সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার বামনহাটা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম বাহাদুর আলী খাঁ ও মাতা মরহুমা মরিয়ম বেগম। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে কবি দ্বিতীয়।

কবি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শুরু করে ১৯৬০ সালে হেমনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন করটিয়া সা’দত কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৬৭ সালে বিএ পাস করেন এরপর ১৯৬৯ সালে বিএড করেন।

আবদুল হালীম খাঁ ১৯৬০ সালে নিজ গ্রামের আবদুল মজিদ খাঁর কন্যা রওশনারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৪ পুত্র সন্তানের জনক।

১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক জাহানে নও ও দৈনিক সংগ্রামে সংবাদদাতা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সাংবাদিকতায় রয়েছে তার অনেক অবদান। তিনি ভূঞাপুর প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি পেশাগত জীবনে শিক্ষক ছিলেন। ২০০২ সালে বাগবাড়ী উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।

কবি আবদুল হালীম খাঁ বিশ্বাস ও মূল্যবোধের চরম সঙ্কটের সন্ধিক্ষণে বিশ্বাসের সপক্ষে সাহিত্যাঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬১ সালে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হৃতকরী পত্রিকায় প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘বর্ষার আনন্দ’। এরপর তিনি আর থামেননি। একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তার লেখা। তিনি কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে বিচরণ করতে থাকেন সাহিত্যের সব ক’টি শাখায়। আজও তার কলম চলছে দুর্বার গতিতে।

পৃথিবীর সব কবিই কম বেশি যুদ্ধ করেন। তারা যুদ্ধ করেন অসুন্দর, অকল্যাণ, অমানিশা আর অন্ধকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ানো অধিকাংশ কবির অভ্যাস হলেও সত্যবাদী কবির সন্ধানও আমরা পাই। কবি আবদুল হালীম খাঁ তেমনি চোখে বিপ্লবের স্বপ্ন লালিত এক সাহসী কলমযোদ্ধা। মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠের পাঠকদের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন- কবি ও ছড়াকার আবদুল হাই ইদ্রিছী।

আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি?

- ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি।

আপনার সময় কীভাবে কাটে?

- সময় কাটে পড়া আর লেখায়।

এই সময়ে চলার পথে আপনার বড়ো প্রতিবন্ধকতা কী?

- আলহামদুলিল্লাহ চলার পথে আমার কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

জীবনে সফলতার জন্য কোন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

- জীবনে সফলতার জন্য প্রয়োজন শুধু কাজ আর কাজ করা। আর সে কাজটা হওয়া চাই মহৎ আদর্শকে ধারণ করে।

একটি শিশুকে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হলে কী করতে হবে?

- তাকে আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।

তরুণরা আদর্শ হিসেবে কী গ্রহণ করতে পারে?

- আদর্শ শিক্ষা।

ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?

- ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অভাব, সন্ত্রাস, সমস্যা ও পরনির্ভরতামুক্ত সুন্দর সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ দেখতে চাই।

শিশুসাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা কী?

- শিশুসাহিত্য নিয়ে আমার নিজস্ব একটা চিন্তা আছে যাকে বলা যায় শিশুজগৎ। যে জগতের শিশুরা হবে আদর্শ ও উন্নত মানুষ।

তরুণ ও কিশোর লেখকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

- তাদের উদার মন মানসিকতা নিয়ে বিভিন্ন ভাষার উন্নতমানের সাহিত্য পাঠ করা উচিত।

আপনার শিশুকাল এবং এখনকার শিশুকালের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কি?

- আমার শিশুকাল আর একালের শিশুদের মধ্যে দেখছি আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেকাল ছিল যেন অন্ধকার আর একালটা আলোয় আলোয় ভরা।

আপনার প্রিয় মানুষ কে?

- আমার মা-বাবা। 

প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ও আপনি একই উপজেলার লোক, তাঁর সাথে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিল?

- প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাদের বাড়িতেও এসেছেন এবং আমার কবিতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তাকে নিয়ে লেখা “জনমানুষের বন্ধু প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ” নামে আমার একটি গ্রন্থও আছে।

আপনার কবি হওয়ার অনুপ্রেরণা জাগলো কীভাবে?

- আমার ভেতরে কবি হওয়ার অনুপ্রেরণা মূলত কবিতা পড়ে পড়েই জেগেছে।

আপনার কোন কাজে আপনি বেশি খুশি হন?

- লেখালেখি ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই তো। ভালো একটা লেখা এবং ভালো একটা বই প্রকাশিত হলে বেশি খুশি হই।

জীবনে বড়ো হতে হলে কোন কোন বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হয়?

- বড়ো হওয়ার পথ অনেক দিকে রয়েছে। যার যে দিকে ঝোঁক বেশি, যে দিকে যার প্রতিভা রয়েছে সে দিকে তার বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।

ছোটবেলায় আপনার লক্ষ্য কী ছিল? তার কতটুকু পূরণ হয়েছে?

- ছোটবেলা থেকেই কবি হওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল ছিল কিন্তু তা কতটুকু হলো আপনারাই বিচার করুন।

আপনার জীবনে কিছু কি অপূর্ণ আছে বলে মনে করেন?

- জীবনে কত সাধ স্বপ্ন ছিল কিন্তু সবই তো অপূর্ণই রয়ে গেল!

আপনার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত কী?

- জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত আছে এর মধ্যে পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হলে সেই কবিতা পড়ে আমার বাংলা স্যার ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হেসে বলেছিলেন- “এই তো আমরা একজন কবি পেয়েছি” সেই মুহূর্তটি।

আপনার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা বলুন।

- কবিতা লিখে আমি প্রথম ১০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলাম। এটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম রোজগার। পোস্ট অফিসের পিওন এসে হাতে দিয়েছিল। খুশি হয়ে ভাবছিলাম এটাকা কীভাবে খরচ করবো? মিষ্টি কিনে বাড়ি ও পাড়ার সবাইকে খাওয়াবো নাকি ভালো জামা জুতো কিনবো। আরো কিছু ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, এ টাকা আমি খরচ করবো না। আমার মাকে দেবো। তাই করলাম। দৌড়ে বাড়ির ভেতর গিয়ে মাকে ডেকে বললাম- এই যে মা, কবিতা লিখে আমি ১০ টাকা পুরস্কার পেয়েছি তুমি নাও। মা বলেছিলেন তোর ইচ্ছা মতো খরচ কর। তখন বলেছিলাম- তোমাকে দেওয়াই তো আমার ইচ্ছে...। মা টাকাটা হাতে নিয়ে দারুণ খুশি হয়েছিলেন। মায়ের হাসি উজ্জ্বল সেই সুন্দর মুখটি আজো আমার হৃদয়ে ফুুল হয়ে ছবির মতো ফুটে রয়েছে। আজো তা নিয়ে ভেবে আনন্দ পাই। এটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।

জাতিগঠনে সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের ভূমিকা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?

- জাতিগঠনের যতগুলো দিক রয়েছে- শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবগুলোর মূল উৎস সাহিত্য। এবং সাহিত্যিকগণই দেখাতে পারেন সঠিক সুন্দর আদর্শিক পথ। কবি সাহিত্যিক হচ্ছেন জাতির শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক। তাই সাহিত্যিক ও সাহিত্যের ভূমিকা অনেক।

লেখালেখিতে আসলেন কেন?

- লেখালেখিটা অন্য পেশার মতো আয় রোজগারের পেশা নয়। ইচ্ছে করে এতে প্রবেশ করা যায় না আবার ছাড়াও যায় না। ভেতরের জাগ্রত প্রেরণাই আমাকে লেখালেখিতে টেনে এনেছে।

একজন ছাত্রের পড়াশুনার পাশাপাশি আর কী কী কাজ করা উচিত?

- লেখাপড়া করার তো একটা মহৎ উদ্দেশ্য আছে। আর সে উদ্দেশ্য হতে হবে সুন্দর জীবন গড়া এবং দেশ ও জাতির জন্য ভালো কাজ করা।

শিশু-কিশোরদের জন্য আপনার উপদেশ কী?

- মনে সদা সর্বদা মহৎ ও উচ্চাশা পোষণ করতে হবে এবং তার ওপর মজবুত বিশ্বাস রাখতে হবে।

সুস্থ সংস্কৃতি কীভাবে বিস্তার করা যায়?

- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদর্শ শিক্ষা, আদর্শ সামাজিক পরিবেশ এবং কাব্য সাহিত্যের মাধ্যমে।

আপনার প্রিয় শখ কী?

- বই ও পত্রিকা পড়া।

বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে কিছু বলুন।

- বাংলাদেশে ক্রমশই শিশুসাহিত্য উন্নত হচ্ছে এবং তা আরো উন্নত হবে বলে আশা করছি।

মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠ সম্পাদক কবি মোশাররফ হোসেন খানের সাথে আপনার কখন থেকে ও কীভাবে পরিচয় এবং আপনাদের সম্পর্ক কতটা গভীর? তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন করুন।

- মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠ সম্পাদক কবি মোশাররফ হোসেন খানের সঙ্গে প্রথম লেখালেখির মাধ্যমেই আমার পরিচয় হয় প্রায় ৪০-৪২ বছর আগে। তখন তিনি যশোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুজাহিদের সাহিত্য সম্পাদক ও নবীনের মাহফিলের পরিচালক ছিলেন। বাদশাহ ফয়সাল ইসলামী ইনস্টিটিউটের বাংলার ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। যশোর থেকেই দেশের অনেক পত্রপত্রিকায় লিখতেন। এসময়েই তাঁর ঠিকানা পেয়ে চিঠি লেখা শুরু করি। সপ্তাহে কমপক্ষে দুটি চিঠি বিনিময় হতো আমাদের। আর তাতে বাংলা কাব্য-সাহিত্যের নানা কথা, নবীন-প্রবীণ লেখক-লেখিকাদের কথা, আমাদের আশা-আকাক্সক্ষাসহ আরো কত কথা লিখতাম। আমরা কাব্য ভাবনায় ছিলাম ভীষণ উৎসাহী ও উজ্জীবিত। প্রচলিত কাব্যধারাকে পরিবর্তন করে নতুন ধারা নির্মাণে ছিলাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এরপর তিনি ঢাকা এলেন। তাঁর লেখার গতি আরো বেড়ে গেল। ঢাকায় প্রথমে আল ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর উম্মাহ ডাইজেস্ট-এর সম্পাদক হন। তারপর একে একে মাসিক নতুন কলমের সম্পাদক হলেন,  মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠের সম্পাদক হলেন। আমি ঢাকা গিয়ে তাঁর কাছে থাকতাম। সারারাত নানা গল্পে কেটে যেতো। কীভাবে তিনি শুয়ে শুয়ে কবিতা লিখতেন সারারাত তা বলতেন। তিনি তাঁর অনেক স্বপ্ন সাধের কথা বলতেন। তাঁর প্রায় সব বইই আমার কাছে আছে। আমি তাঁর কয়েকটি কবিতাগ্রন্থের আলোচনার সমন্বয়ে “কবি মোশাররফ হোসেন খান : তাঁর কবিতা” লিখেছি। তাকে নিয়ে এখানে সব লেখা সম্ভব নয়। কবি মোশাররফ হোসেন খান বর্তমানে বাংলা কাব্য সাহিত্যে প্রথম শ্রেণির কবিদের একজন। 

মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

- মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠ দেশের সব চাইতে উন্নতমানের আদর্শ একটি সাহিত্য মাসিক। এটি শিশু-কিশোরদের প্রাণপ্রিয় পত্রিকা। আদর্শ কাব্যসাহিত্য ও লেখক তৈরির উত্তম মাধ্যম।

লেখক জীবনের শেষ ইচ্ছা কী?

- একজন সমাজকর্মী মানুষের জীবনে সফলতা যেমন কাম্য তেমনি লেখক জীবনের শেষ ইচ্ছে তাই।

সময় দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞ।

- আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ