করোনার চাবুক

করোনার চাবুক

গল্প কাজী শামীমা মিতা নভেম্বর ২০২০

রান্নাঘরে টুংটাং শব্দ শুনে মাহমুদ ঠিক বুঝতে পারে মা এখনো রান্নাঘরেই কাজ করছেন। নিশ্চয়ই রাতের থালা-বাটিগুলো ধুয়ে রাখছেন। আহ্ কেন যে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে গেলাম। ওটা নিয়ে বসলে আর বাকি দুনিয়ার খেয়াল থাকে না। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে মাহমুদ ভাবে- এত দিনতো এসব নজরেই আসেনি। করোনার কারণে ঘরবন্দী হয়ে আজ বুঝতে পারছি, সেই সকাল থেকে রাত অবধি মায়ের কী করুণদশা যায়। আহারে! কী ব্যস্ততাতেই না দিন কাটে মায়ের!
আচ্ছা, মা একাকী এত্ত কাজ কেমন করে সামাল দিত? আজ না হয় পনেরো দিনের জন্য বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডকে অগ্রিম বেতন দিয়ে ছুটি দিয়ে দিয়েছে কিন্তু হেল্পিং হ্যান্ডতো প্রায়ই এমন কতদিন স্বেচ্ছা ছুটি কাটায়- সেদিনগুলো মায়ের কিভাবে কাটতো?
মাহমুদের খুব অপরাধ বোধ জাগে। কখনো এভাবে খেয়াল করেনি মায়ের দিকে। অযথা কত অলস সময় কাটিয়েছে বা হেলায় ফেলায় চলেছে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার বাহানায়। তৈরি তৈরি খাবার খেয়েছে, পরিপাটি ঘর পেয়েছে-কিন্তু এর পেছনের নির্মাতা কে তা যেমন ভাবেনি। তেমনি তাকে কখনো মূল্যায়ন করেও দেখেনি।
নাহ্ এখন উঠে গেলেও লাভ হবে না। মা হাত বদল করতে দেবেন না। একবার যে কাজে হাত দিয়ে ফেলেছেন সেটি তিনি নিজ হাতেই সম্পাদন করবেন। এমনই আমার মা! ভাগ্যিস দুপুরের জমানোগুলো ধুয়ে ফেলেছিলাম মায়ের অগোচরে। মাহমুদ মনে করে তৃপ্তি পায়। মনে মনে ভাবে, মানুষ যদিও তিনজন তবু থালাবাটি, কাপ-পিরিচ, চামচ গ্লাস, হাঁড়ি কড়াই কম জমে না। ইদানীং মায়ের সাথে কিছু কিছু কাজ করে দিতে পেরে নিজকে ধন্য ধন্য লাগছে মাহমুদের। এই যেমন, প্রতিদিন ঘরের আসবাবপত্রগুলো মুছে ফেলা, ওয়াশিংমেশিন থেকে কাপড়গুলো বের করে নেড়ে দেওয়া, আবার সন্ধ্যায় ঘরে তোলা এসবই বা কম কিসে! বাবাও বসে নেই। ভালোই লাগছে আমার আইনজীবী বাবাকে এখন মক্কেল ছেড়ে মায়ের পাশে ঘুরঘুর করে এটাসেটা করে দিতে দেখে। মাহমুদ মনে করে- বাগানে পানি দেওয়া, ফিল্টারে পানি ঢালা, মশারি তোলা, টাঙানো এসবই বাবা স্বাচ্ছন্দ্যে করে যাচ্ছেন। কাজ খুব বড় না হলেও এটুকুন সহযোগিতায় মায়ের শরীরটাতো জুড়োয়!
তার ওপর মা আবার লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছেন আগের মতোই। এইতো এ সপ্তাহের পত্রিকাতেও মায়ের কবিতা ‘কোভিড-১৯’ প্রকাশিত হলো। এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। করোনাভাইরাস নামে খ্যাত এই ভাইরাসটির প্রকোপে বিশ্ব এখন প্রকম্পিত। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের দেশটিও এর হামলা থেকে মুক্ত নয়। জানা গেছে গেলো বছরের শেষের দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে এর উৎপত্তি। কিন্তু অচিরেই ছড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। বর্তমানে প্রায় ২০০টি দেশ আক্রান্ত। আমেরিকা, ইতালি, রাশিয়ার মত বড় বড় দেশগুলোও নাস্তানাবুদ। বিজ্ঞানী, চিকিৎসকসহ সকল বিজ্ঞজনরা বলছেন এ থেকে মুক্তিস্বরূপ কিছু নিয়ম মেনে চলা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নেই- তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্ব গ্রহণ অর্থাৎ সঙ্গনিরোধ জীবন।’ আমরা এখন সে নির্দেশনাই মেনে চলছি অন্তত দু’সপ্তাহের জন্য হলেও। এ এক ঘনঘোর দুর্যোগ! এর সাথে সাথে চলছে সঠিক পদ্ধতিতে যথারীতি হ্যান্ড স্যানিটাইজেশনসহ শরীরে ইমিউনিটি বাড়ানোর মতো খাবার-দাবার পদ্ধতি। এসবে মায়ের কাজ যেন আরো বেড়ে গেছে। যেমন গাজরের হালুয়া, বীটের জর্দা তৈরি করা- খাবারে বৈচিত্র্য আনতে মা এখন এ কষ্টটুকুও হাসিমুখেই করছেন।
হঠাৎ করে মাহমুদের বিজ্ঞানী বিজনকুমার শীল এর কথা মনে পড়ে গেল। আজকের একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা থেকেই জানা গেছে তার ভাষ্যমতে এই ভাইরাসটি নতুন নয় তবে পূর্বের চেয়ে জোরালো এ কথা সত্যি। তিনি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। তিনি তার দলকে নিয়ে খুব দ্রুত করোনা শনাক্ত করার কিট তৈরি করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। কারণ তাঁর দেওয়া তথ্যমতে জানা যায়, ২০০৩ সালে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায় প্রথম। ওই ভাইরাসটির নাম ছিল সার্স করোনাভাইরাস-১। এখন যেটা মহামারীতে রূপ নিয়েছে এটাও সার্সের মতোই যার নাম হওয়া উচিত ছিল সার্স করোনাভাইরাস-২। সার্সের সঙ্গে নাকি এটির ৮২% মিল রয়েছে। কিন্তু সার্স ভাইরাস নিয়ে জনমনে যে আতঙ্ক ছিল তা লাঘব করতেই নামটি পরিবর্তন করে করা হয় কোভিড-১৯।

মাহমুদ মুচকি হাসলো- এসব আমার মায়েরও জানা।
লেখালেখির জন্য প্রচুর পড়তে হয় মাকে। এত কাজের মধ্যেও ওসবে মায়ের কোনো ক্লান্তি নেই।
ওদিকে নামাজ-কালাম, তসবিহ্-তেলাওয়াত তো আছেই। যার ফলে মায়ের প্রতি মুহূর্তের ভাষণ- একদিকে প্রপার প্রোটেকশন নাও অন্য দিকে আল্লাহর সাহায্য চাও- যা রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ। উদাহরণস্বরূপ মা নূহ (আ.)-এর কিস্তির কথাও বলেন। নূহ নবী প্রোটেকশন নিয়েই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করেছিলেন যা তাঁর সন্তান করেনি। সে গর্বভরে পাহাড়ের ওপর উঠেছিল-পাহাড়ই তাকে বাঁচাবে আশা করে কিন্তু পাহাড় তাকে বাঁচায়নি।
হঠাৎ বাবার কণ্ঠস্বর কানে বাজায় ভাবনায় ছেদ পড়লো মাহমুদের। ল্যাপটপটা বন্ধ করে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো, বাবা বলছেন, ‘রাত বারোটা বাজে!’- হা হা হা মাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কৌশল! সরাসরি ডাকবেন না তবে একটা সঙ্কেত দিবেন। যাক বুঝা গেল মা এখনো শোবার ঘরে যাননি তাহলে। কিন্তু! মায়েরতো আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না! কোনো সাড়া নেই! তবে মা গেল কোথায়? মাথায় চিন্তা নিয়েই মাহমুদ বেরিয়ে এলো নিজ কক্ষ থেকে।
রান্নাঘরের দিকে যেতেই চোখে পড়লো মা ডাইনিংয়ের এককোণে একটি চেয়ারে বসে আরেকটি চেয়ারের ওপর বঁটি রেখে সবজি কাটছেন সন্তর্পণে। নির্ঘাত সকালের নাস্তার আয়োজন! একহাতে রুটি বানানো আর অন্য হাতে সবজি তৈরি করা আসলেই খুব কষ্টকর। অনেক সময় বাবা এসে রুটিগুলো সেঁকে দেন। মা তখন ওই ফাঁকে সবজি তৈরি করেন বা ডিম মামলেট করে নেন। মায়ের স্পাইনাল কডের সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমত মাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাজ করতে হয়- নুয়ে পড়া নিষেধ। তাই কাটাবাছা সবই ছুরি-কাঁচি আর বোর্ডের সাহায্যে চলে কিন্তু শব্দ হবে ভেবেই হয়তো মা এত রাতে ওই চেয়ারপদ্ধতি নিয়ে বসেছেন।
আচমকা মাহমুদের হাতটি মায়ের হাতটা চেপে ধরায় প্রথমে মা ভড়কে যান।
‘ওঠো। ওগুলো আমি কেটে দিচ্ছি।’
‘আরে না না, তুই পারবি না।’
‘তুমি পারলে আমি পারবো না কেন? আমিতো তোমারই ছেলে!’
‘আচ্ছা! এতদিন তাহলে কার ছেলে ছিলি?’ মা হেসে দিয়ে মাহমুদের দিকে তাকান। প্রশংসিত কণ্ঠে বলে ওঠেন: আমি জানি পারবে আমার ছেলে। যেমনি পারছে থালাবাসন ধুয়ে দিতে, হুইপার দিয়ে ঘর মুছে দিতে। চা-টা বানিয়ে নিতে। কিন্তু দেখিস হাত কেটে ফেলিস না যেন!
‘আচ্ছা আচ্ছা যাও। রাত বারোটা বেজে গেছে। বাবা তোমায় ডাকছে।’
একরকম জোর করেই মাকে উঠিয়ে দিয়ে সবজিগুলো কেটে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিলো মাহমুদ। হঠাৎ মনে পড়লো ফ্রিজটা আর ডাইনিং টেবিলের কভারটা একটু ডিটারজেন্ট দিয়ে মুছে রাখা দরকার। করোনাভাইরাস নাকি ধাতব পদার্থে ৪২ ঘণ্টা আর প্লাস্টিকে থাকে ৭২ ঘণ্টা। মারাত্মক!
মা বেসিনটা পরিষ্কার করাসহ সাবান দিয়ে নিয়মমাফিক হাতমুখ ধুয়ে নিলেন তৃপ্তির হাসি হেসে হেসে। আজ করোনা নিয়ে এসেছে সম্প্রীতি! যে ছেলে নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার চাপে আর কোনো দিক তাকিয়েই দেখেনি, পরীক্ষা শেষে এখনো নিজকক্ষের চৌহদ্দিতেই আবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে সেও কি না বেরিয়ে এসেছে মায়ের সাহায্যে! তবু একটা বিষণœ ভাবনায় মায়ের বুকটা ছেয়ে আছে। আজই পত্রিকা থেকে জেনেছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগী বলে শনাক্ত হবার আগেই সামান্য সর্দি-কাশির উপসর্গেই কোথাও কোথাও চলছে অচ্ছুত অভিযান। চলছে সামাজিক বৈরিতা, মানবিক বঞ্চনা। ‘আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না’ শিরোনামে এমনি একটি খবর পত্রিকার পাতায় যা মাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। সত্যিই খবরটা দুঃখজনক। এভাবেতো মানুষ মরার আগেই মরে যাবে। কিভাবে সাহস জোগানো যায়, কিভাবে নিরাময় দিয়ে দুর্ভাবনা দূর করা যায়- এ ভাবনা থেকেই যেনো মা স্বগোক্তি করে ওঠেন: ‘হে মহান প্রভু, করোনাকে গজব নয় বরং অছিলা করে দাও ঘরে ঘরে এমনি সহমর্মিতা, মানবে মানবে এমনি সম্প্রীতি, জাতিতে জাতিতে ভালোবাসা, দেশে দেশে সৌহার্দ্যতার অমিয় সুধায়। আমিন পড়তে পড়তে মা চলে গেলেন শোবার ঘরের দিকে। আর মাহমুদ পুনঃ ডুব দিলো আত্মপর্যালোচনায়- করোনায় ধুয়ে যাক হৃদয়ের সঙ্কীর্ণতা। সম্প্রীতিতে খুলে যাক হৃদয়চক্ষু।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ