কাঁচা রোদের ছিটেফোঁটা

কাঁচা রোদের ছিটেফোঁটা

স্মৃতিকথা জাফর তালুকদার মে ২০২৪

নলখাগড়ার পাঁচালি

ছেলেবেলার আমাদের গাঁয়ের বাড়ির কাচারিখানা ছিল দেখার মতো। যেমন গায়েগতরে রাজস্থানি ষাঁড়ের মতো উঁচু লম্বা, তেমনি গম্বুজ-চুটোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মস্ত দুই শিংয়ের বাহার। বাড়িখানার আভিজাত্য প্রথম দেখাতেই সমীহ আদায় করে নেয়। আশপাশের ছয়ছোট্ট মাঠ, রাস্তা, খাল, পুকুর, কবরস্থান, মসজিদ আর এন্তার গাছগাছালির ফাঁকে চমৎকার গ্রীবা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঝকঝকে টিনের উজ্জ্বল বাংলাঘরটা।

পাকা ভিতের ওপর মূল্যবান বার্মা টিকের কাঠ-কাঠামোয় এর চেহারাখানা খুলে গেছিল অদ্ভুত বিন্যাসে। ঢোকার মুখে মস্ত ধাপের সিঁড়ি। দশাসই দুখানা পাকা খাম্বার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুরোনো আমলের লতানো মূল্যবান গ্রিল। প্রকাণ্ড চৌচালা এই টিনের ঘরটির বারান্দার উত্তর-দক্ষিণে ছিল দুইখানা কোঠা। একটিতে পোস্টাপিস। অন্যটি লজিং-মৌলভির হুজরাখানা। ঘরের মাঝখানটা একহারা ফাঁকা। ওখানে সাত সকালে শুরু হতো পাড়ার ছানাপোনাদের নিয়ে বকর মাস্টারের আজব পাঠশালা। আমরা মাস্টারকে বলতাম ‘মাসসাব’।

পাঠশালার প্রথম দিনের স্মৃতি বড়োই অভিনব। এলিপাতার ছোট্ট হোগলায়-মোড়া তালপাতা, নারকেলের ছোবড়া পুড়ে বানানো কালির মাটির দোয়াত আর কঞ্চির চোখা কলম নিয়ে আব্বা একদিন হাজির হলেন মাস্টারের দরবারে। ঘরের খোলা জায়গায় মন চাইলে হাডুডু খেলা যায়। এখানেই মেঝের চারদিক ঘুরে হোগলা পেতে বসেছে দশবাড়ির লেতুপেতুর দল। তারা গম্ভীরভাবে তালপাতায় দাগানো অক্ষরের ওপর কলম ঘোরাচ্ছে আর কানে তালালাগা হাঁক দিয়ে সুর তুলছে- কো-খো-গো..। এমন মধুর আওয়াজে যারপরনাই বিমোহিত হলাম।

নতুন ছাত্রটি ইতোমধ্যে তাদের নেক নজরে আসায় এ-ওকে গুঁতিয়ে ফিচিক ফিচিক হাসছে। নাকে-শিওন পুলাপানদের পাত্তা দিলাম না। গম্ভীর মুখে টিন টিনে কোমরের সঙ্গে অতিশয় বেমানান ঢিলা প্লাস্টিকের থলবলে হাফ প্যান্টটা টেনে তুললাম বুক অবধি। এবার সবার সমীহ দৃষ্টি আদায় করে প্রজাপতির শুঁড়ের মতো দু’খানা কাঠি কাঠি পা আসনপিঁড়ি করে বসলাম দুষ্টুমতি জুলেখার পাশে। চাচাতো বোন জুলেখা পিঠাপিঠি হলেও চালাকির দৌড়ে সবসময় এককাঠি সরেস। সে কো খো বন্ধ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছিল নতুন সহপাঠীর দিকে। আব্বা মাস্টারের হাতে নবীন ছাত্রকে গছিয়ে দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে চলে গেলেন পোস্টাপিসের দিকে। ডাক খোলার সময় হয়ে গেছে। 

নতুন ছাত্রটিকে ঘষামাজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মোবারক মাস্টার। সুন্দরবনের চঞ্চল হরিণকে বাগে পেয়ে তাঁর চোখের তারা লাফাচ্ছিল অস্বাভাবিকভাবে। নবীন শিষ্যর পেছনে ঝুঁকে বসে কঠিন প্রত্যয় নিয়ে কাঠির মতো আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরলেন কলমটা। তারপর সেটা দোয়াতের কালিতে চুবিয়ে এমন কারিশমায় পাতায় দাগানো অক্ষরগুলো ঘুরিয়ে আনলেন যা দেখে তাক না লেগে উপায় নেই। এখন শিষ্যের কাজ হলো কলমটা দোয়াতে ঢোকানো আর তালপাতায় সেটা ঘুরিয়ে অ-আ সুর করে পড়া। কিন্তু যত জোরে চেঁচাই না কেন ইঁদুরের মতো কিচকিচে আওয়াজ ছাড়া কিছুই বেরোয় না। এমত পাঠে নিমগ্ন ছাত্রের বেধড়ক কলমের গুঁতোয় হঠাৎ দোয়াত উলটে প্যান্ট সয়লাব হয়ে যায় উপচানো কালিতে। এই চটকদার মজার দৃশ্য দেখে জুলেখা বিপুল অট্টহাস্যে কী একটা কানগরম ফুচুটে কথা বলতেই বিপুল ক্রোধে বাঘের মতো তিড়িং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাতে খিমচে ধরলাম লম্বা চুলের বিনুনি। মহা শোরগোলে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। মাসসাব দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বেত নিয়ে তেড়ে আসতেই রণে ভঙ্গ দিয়ে ভালো মানুষের মতো ফিরে এলাম তালপাতার কঠিন বিদ্যায়।

কাচারি সংলগ্ন ঘাট বাঁধানো ছায়াঘেরা মস্ত পুকুর। দাদু ছিলেন জেলা আদালতের সম্মানিত জুরি। শরীর নাচার হয়ে গেলে টেকো মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য তালের কষের প্রলেপ দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘাটে। পুকুর ছুঁয়ে মাথা নুইয়ে প্রার্থনায় হেলে ছিল ভরা-যৌবনের লাজুক শেফালি এক। ডালে ডালে তার ফুলটুসি পাখির নাচানাচি আর অগণিত ফুলের উন্মাদনা। সারারাত টুপটুপ ঝরে ঘাট আর পুকুর সয়লাব হয়ে যেত শাদা-হলুদের বন্যায়। সাত সকালে ফুল কুড়ানো নিয়ে রেষারেষির অন্ত ছিল না। মন্টু, টুলু, বিলু, রত্নার সঙ্গে কিছুতেই কুলিয়ে ওঠা যেত না। ওরা আগেভাগে এসে হুড়মুড়িয়ে কুড়িয়ে নিত অনেকখানি। তবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যতটুকু অবশিষ্ট থাকতো সেটাই বা কম কিসে! হলুদ ঠ্যাং উঁচিয়ে রাজ্যের ফুল উবু হয়ে ভেসে বেড়াতো পুকুরে। সে এক মনোরম দৃশ্য। সহজে চোখ ফেরানো যেত না। মনটা কেমন যেন খচখচিয়ে উঠতো কেবল। দুঃখ করে লাভ নেই। ঘাটের কুড়ানো ফুলগুলো জোড়ায় জোড়ায় গেঁথে অনায়াসে তৈরি হয়ে যায় একটা মালার শিকলি। মালা না হয় হলো, কিন্তু কাকে দেওয়া যায় এখন? ভাবনার তর সয় না। দৌড়ে হাশেম কাকুর ঘরের জানালার কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে ডেকে উঠি, ‘জুলেখা, এই জুলেখা...।’

পুকুরের চারদিকটা ছিল ছায়া ছায়া গাছপালা ঘেরা। পানিতে তার ছবিটা ভেসে থাকতো নানা কৌণিক মাত্রায়। ঝুমকো জবা, রঙ্গন, সোনালু, বিলাতি গাব, আতা, আম, সুপারি, তাল, সফেদা মিলে আগলে রেখেছিল টলটলে পানির পুকুরটা। কোণের দিকে অদ্ভুত হেসে হেসে মাথা কুটতো লাল শাপলার দল। সেখানে ছুঁই ছুঁই খেলায় অপরূপ নেচে বেড়াতো গোটা দুই ফড়িং। মায়ের হাঁসের দল সকালের আধার খেয়েই যুগল আনন্দে ডিগবাজি খেতো পুকুরে। শাপলার গোলপনা পাতার ফাঁকে তুর তুরিয়ে নেচে বেড়াতো শোল মাছের লালচে পোনার ঝাঁক। পানির নিচে ছায়ার মতো আগলে বেড়াতো মা শোলটি। একবার কোণের গাব গাছের নিচের গর্তে চাঁই পেতে সকালে দু’জন কিষাণের তুলতে হিমশিম খেতে হয়েছিল মাছের ভারে। কী ছিল না সেখানে! নীল দাঁড়ের স্যাতলা পড়া একসেরি বিশাল গলদা, তেলতেলে রাম টেংরা, পাতারি, শিং, মাগুর, শোল, রয়না, শরপুঁটি, ফলই, চিতল, আহা চোখ জুড়িয়ে যায় আর কী! 

আব্বার হাতে লাগানো সফেদা গাছটি পুকুরের পার ভেঙে আধেকখানি ছাতার মতো নেমে গিয়েছিল পুকুরের মাঝ বরাবর। ডালপালায় চমৎকার বাড়-বাড়ন্ত এমন পয়মন্ত গাছ বিরল ছিল এই তল্লাটে। যেমন চোখ জুড়ানো ফল। তেমনি সুস্বাদু। বাদুড় আর পাখপাখালির চোখ এড়িয়ে থোকায় থোকায় ঝুলতো চোখের সামনে। যার যেমন ইচ্ছে ছিঁড়ে নিতে কসুর ছিল না। এতদিনের মাটি কামড়ে থাকা সেই প্রবীণ গাছটি সবাইকে কাঁদিয়ে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পুকুরে আছড়ে পড়লো সিডরের তাণ্ডবে। 

পুকুরের পুব পারে ছালচামড়া খসা শতবর্ষের প্রাচীন জামে মসজিদ। অদূরে খাল ছুঁয়ে এজমালি কবরস্থান। ছোটোভাই বাবুলের কবরের ওপরের বাঁশঝাড়টি সবার উপকারে আসত দাফনের কাজে। পাশেই নৌকা রাখার চিকন নালা। খালের সাঁকো পেরিয়ে সরু রাস্তাটা মসজিদের সীমানা ছুঁয়ে বেঁকিয়ে চলে গেছে বাগানের দিকে। বাগানটা বিশাল আর মনোরম গাছপালায় পূর্ণ। দিনদুপুরেও কুঁতে কুঁতে সমস্বরে শিয়াল ঢাকত সেখানে। ওদের মধুর কোরাসে তাল দিয়ে ভয়ংকর দাপিয়ে বেড়াতো আমাদের বাঘা কুকুরটা। 

দুধাপ সিঁড়ি ভেঙেই মসজিদের লেপামোছা বিবর্ণ দরজা। ভেতরে টালির ছাদের নিচে আড়াআড়ি বসানো বিলাতের তৈরি মস্ত লোহার খাম্বা। নামাজে বসে কেবলই মনে হতো ওই মস্ত খাম্বা যদি ভেঙে পড়ে মাথার ওপর! এইসব ধানাইপানাই ভেবে লিকলিকে শরীরখানা ম্যাদা মেরে যেত বাইলা মাছের নাহান। অথচ এই পুরোনো মসজিদ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ ছিল না। এটাই এলাকার একমাত্র জামে মসজিদ। শুক্রবার জুমার নামাজে এপাড়া-ওপাড়া থেকে মুসল্লিরা দলবেঁধে হাজির হতেন মসজিদে। আমাদের অতো হিসাব থাকতো না। বাড়ির দস্যি পুঁচকে-পাঁচকা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে গোলা করে ফেলতো পুকুরের টলটলে পানি। মুসল্লিরা অজু করতে এসে মধুর ভর্ৎসনায় চোখ পাকাতেন । কফিল উদ্দিন হাওলাদার বৃদ্ধ হলেও টনটনে খাড়া ছিলেন কঞ্চির মতো। এই রাগি মানুষটা একবার মুখ বেঁকিয়ে এমন এক আলটপকা মন্তব্য করেন যা শুনে কান গরম হয়ে যায় সবার।

সন্ধ্যায় কাচারিটা চলে যেত কিষাণদের দখলে। খালেক পাঠান ছিল সর্দার গোছের। হাকিম পাহলোয়ান, ছুরাত জোমাদ্দার, হরমুজ মৃধা, হামেজ খাঁ, ধলু বেগ, ছোমেদ ফরাজি মিলে গুচ্ছের লোকজনে গিজ গিজ করতো কাচারিটা। খালেক পাঠান গাজীকালু পালার সুর তুলত বিরহী গলায়। অন্যেরা তাওয়ার ছাইচাপা আগুন থেকে হুকো সাজাতে বসতো গোল হয়ে। পুকুস পুকুস কয়েক টান দিয়ে হাতে হাতে ঘুরত হুকোটা। এক হাত থেকে অন্য হাতে গেলে হুকোর ফুটোটা মৃদু গালে ঘষে পবিত্র করে নিত। রাতে মহাজনের ঘরে পেল্লায় গামলার আমন চালের মোটা ভাতের সঙ্গে মিষ্টি আলুর গণ্ড, কুমড়াচিংড়ির ঝোল, পোড়া মরিচ আর পানি-ডালের বিপুল কসরতের পর কাচারির খাটালে মোটা হোগলা বিছিয়ে কাত পড়তো সবার।

কাচারিটা এখন আর নেই। বহু আগে ভেঙে ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেছে শরিকদের মধ্যে ।

এই বিশাল বাগানবাড়ির সব কোলাহল থেমে গিয়ে আজ ভর করেছে মৃত্যুর হিম শীতল নিস্তব্ধতা। 


বনমর্মরের হাহাকার

সুন্দরবনের অদূরে বলেই কিছু জায়জঙ্গলের উত্তরাধিকার পূর্ব থেকে বরাদ্দ ছিল আমাদের ললাটে। বিঘাকয়েকের বাড়ির চৌহদ্দির অর্ধেকেই বলতে গেলে বাগান। এলাকায় পরিচিত হেন গাছ নেই যা ছিল না সেখানে। আব্বা ছিলেন গাছপাগল মানুষ। যখন যেটা মনে ধরেছে দু’হাতে পুঁতেছেন পুলকানন্দে। এ নিয়ে তাঁর কোনো বাছ-বিচার ছিল না। দক্ষিণবাংলার দোআঁশ মাটি এমনিতে কিছুটা লবণাক্ত। নারকেল-শুপুরির ফলন ছিল দেদার। তিনখানা বাগানে মার্চ করে সুপারি গাছগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল মসৃণ ঊরুর মতো। এর বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নারকেল, তাল, আম, অর্জুন, তেঁতুল, চালতা, কাঁটাবহর, গাব, বেল, বরই, জাম, কাঁঠাল, ডুমুর, বাতাবি, ডেউয়া, সফেদা, জামরুল, বাদাম, লোহাকড়া, নিম, বাঁশ, কলা, সজনে, মেহগিনি, চম্বল, শিরীষ, খৈ, কড়াই, তেলিকদম ইত্যাদি কত কী গাছের বাহার! খালপাড়ের দিকে স্বমহিমায় শোভা পেত বেধড়ক আলকুসি, জিয়ল, মাদার, ধুতরা, আকন্দ, বাবলা, ছৈলা, কেওড়া, পিঠেশরা, বট, উরমই, বুনো ঘাস আর চোর কাঁটার মতো নানা পদের ঝোপঝাড়ের মিশেল। 

ওয়াপদার বেড়ি ধরে বাগান চিরে রাস্তাটা চলে গিয়েছিল বাড়ি অবধি। রাস্তার দু’পাশে লতাপাতায় ফুটে থাকতো ছোটো ছোটো ফুল।

বন তুলসী, কচু, আগ্রা, ঢেঁকিশাক, থানকুনি, লজ্জাবতী লতা, ভাঁট, এঁটুল, ফার্ন, বন-আলু, গলখেসিয়া, তেলকুচি, জার্মান লতার বুনো ঘ্রাণে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো। জার্মান লতাকে আমরা বলতাম যশোর লতা। হাত-পা ছড়ে বা মচকে গেলে এই পাতার রস দিলে উপশম হতো হাড়গোড়ের ব্যথা। বাগানের নিচু ডোবার স্বল্প পানিতে লতাপাতায় লকলকিয়ে বেড়েছিল ঢোল কলমি, পানি কচুর লতি, হোগল, এলিপাতা, হেলেঞ্চা আর কাঁটাশ্যাওলার বিপুল বিস্তার। গোলপাতার বিশাল ঝাড়টা মনে করিয়ে দিতো এক সময় এই এলাকায় সুন্দরবনের গভীর অস্তিত্বের স্মৃতি। সুপারি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল লম্বাটে নালার বেড়। নালার গিরা-পানির মৃদু স্রােতে তিড়িং তিড়িং লাফিয়ে বেড়াতো মেউন্না আর খেলুড়ে ব্যাঙের দল। মুতকুড়া, থুরিনা, বাইলা, চ্যালা, কাঁকড়া, কাটালি, গোদা, টাকি, উটকাল, পুঁটির সঙ্গে দু-একটা মাইটা আর গুঁইসাপ নিভৃতে হেঁটে বেড়াতো অলস ভঙ্গিতে। এই দেখে দুষ্টু বুদ্ধিতে লাফিয়ে উঠত আমাদের চোখ। ছোটোাছুটি করে খেজুর ডগার পাতা ছেঁটে একটা গোল ফাঁদ বানাতাম ডগাটার মাথায়। বেকুব মাইটা সাপের মুখের কাছে ওটা একটু নাড়াচাড়া করতেই গেঁরো লেগে যেত পেটে। তখন আনন্দ আর দেখে কে! ওটাকে টেনে তুলে সাপুড়ের মতো উল্লাসে ফেটে পড়তাম নিদারুণ হৈচৈ করে। 

সারাবেলা বাতাস হামা দিয়ে অদ্ভুত এক ঝংকার উঠতো গাছপালার ডালে। নির্জন আলোছায়ার কুহকে আশ্চর্য রকম ভুতুড়ে করে রেখেছিল বাগানটা। প্রজাপতি, ফড়িং আর মৌমাছিদের অভয়ারণ্যে হানা দিয়ে পাতা কুড়নিরা ভয় ভয় চোখে দিনমান ঘুর ঘুর করতো সেখানে। এই নীরব নির্জনতার সুযোগে রাজ্যের পাখপাখালি ঠাঁই নিয়েছিল গাছে গাছে। বক পাখির দল চুন হেগে ছয়লাব করে দিয়েছিল বাগানটা। দুষ্টু লোকজন লম্বা নলের ডগায় লোহার চিকন ফলা দিয়ে পাখি খুনে মেতে উঠলে হঠাৎ বাগান ছেড়ে উধাও হয়ে যায় তাবৎ পাখির দল। ঘুঘু, দোয়েল, ফিঙে, কোকিল, প্যাঁচা, কাক, শালিক, ফেতরা, বুলবুলি, টুনটুনি, বাদুড়, চড়–ই, হরিয়াল, সুইচোর, মাছরাঙা, ডাহুক, টিয়া, ফুলটুসি, বাবুই, হলদে আর কুপাখি তখনও বাগান ছেড়ে যায়নি মায়ার টানে। তারা দিনভর গলা ছেড়ে ডেকে যেত বিচিত্র সুরের মূর্ছনায়। কবরস্থানের কাছে একটা মেটে রঙা লাল চোখের পাখি ভয়ার্ত গলায় রাত-বিরেতে ডেকে উঠতো কুপ কুপ করে। বহু রাত অনিদ্রায় কেটেছে এই রহস্যময় ডাক শুনে। 

কয়েকটা টরেটক্কা দুপুর নাগাদ ডাকতো খনখনে গলায়। ওরা রক্ত শুষে খায় বলে ভুলেও পা বাড়াতাম না ওদিকে। বাগানটা ছায়া ছায়া বলে খাটাশ আর শিয়ালের দল হাঁস-মুরগির লোভে ওঁৎ পেতে থাকতো ঝোপের আড়ালে। দল ভারী হলে খুশু খুশু গলায় আনন্দের ছড় টানত সমবেত কোরাসে। এই মধুর সঙ্গীতে বেসামাল হয়ে আমাদের বেরসিক কুকুর বাহিনী ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যেত মহা আক্রোশে।

ছেলেবেলায় আমাদের নদীর ঘাটে নৌকায় গোলপাতা, সুন্দরী আর গেওয়া কাঠের চালান নিয়ে আসত বাওয়ালিরা। ওদের দেখাদেখি বাড়ির পুঁচকেরা ভাঁট ফুলের গাছ কেটে বিক্রি করতাম সুপারি খোলের নৌকায়। লেনদেন হতো হাড়ি-ভাঙা টুকরোয়, নয়তো ফেলে দেওয়া শক্ত কাগজে। এটাই ছিল কয়েন আর টাকার বিনিময় মাধ্যম। বাগানটাকে ঘিরে এভাবে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সেদিনের ব্যবসাটা।

সময় বদলেছে। নিতান্ত খাপছাড়াভাবে এখনো অসহায় দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের ঘুম ঘুম বাগানটা। গভীর তামিস্রা বাসা বেঁধেছে সেখানে। কেউ জেগে নেই। 


ধানপোকাদের উল্লাস

ছেলেবেলায় আমাদের কোনো ‘পকেট মানির’ ব্যবস্থা ছিল না। বাবা পকেটের ধার ধারতেন না। মা চঞ্চল টাকা অঞ্চলে না বাঁধলেও চাবির গোছাটা ঠিকই বাঁধতেন পোক্ত করে। অতএব টুকুদের মতো দুটো খুচোখাচা হাত সাফাই করবো সেটা ছিল দিল্লি দূরঅস্তের শামিল।

ঘরের খেয়ে এক পলক দূরত্বে স্কুলে যাই চুলে টেরি কেটে। ছুটির পর দলবেঁধে ফিরে আসি নাচতে নাচতে। নো টিফিন। নো কনভেন্স। এরপরও গড়িয়ে মড়িয়ে দু-একটা ফুটো পয়সা হাতে এসে যেত কালেভদ্রে। চিকন আঙুল পয়সার ফুটোয় ঢুকিয়ে এমন চরকির ঘুর লাগাতাম যা দেখে চোখে পলক পড়তো না বিলুদের। সবাইকে হিংসায় পুড়িয়ে শেষতক মেহেরালির টঙ দোকান থেকে সেই ফুটো অর্থ বিনিয়োগ করে একখানা কাঠি চকোলেট কিনে খেতাম তারিয়ে তারিয়ে। লিপস্টিকের মতো লাল ঠোঁট-জিভ দেখে মায়ের সিসি ক্যামেরায় ধরা খেয়েছি বেশুমার। তিনি মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জেরার পর জেরা করেও মুখ খুলতে পারতেন না ত্যাড়াটে আসামির। শেষে গুণধর পুত্রের হাঁ করা টাগরায় নিঃশ্বাস টেনে কনফার্ম হতেন ফুটো পয়সার বাহাদুরি। 

পৌষ-মাঘের দিকে শুরু হতো ধান কাটার এন্তেজাম। বাড়ির কিষাণ আর ফরিদপুর থেকে আসা পরবাসী মিলে ছোটাছুটি শুরু হতো খাল-বিল-মাঠে। ওদের পিছু ধরে আমরাও ঝুড়ি কোদাল নিয়ে মাঠে হাজির হতাম আয় উপার্জনের ধান্ধায় মশগুল একদল পুঁচকেপাঁচকা। আধা কাটা নাড়ার ভেতর ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে বের করে আনতাম গোছা গোছা ধানের শিষ। গর্তে যে বিষধর গোখুর বাসা বাঁধতে পারে সেকথা লোভের বশে ভুলে যেতাম বেমালুম। 

ধান টোকানোর পাশাপাশি ক্ষেতের শেষ মাথায় পেতে রাখতাম ঝাঁকি জালের ফাঁদ। কিষেণরা ধান কাটতে কাটতে যত সামনে এগোতো উল্লাসে চোখমুখ ফেটে পড়তো আমাদের। ততক্ষণে জালের ফাঁদে পড়ে খচ খচ করে পাখা ঝাপটাচ্ছে কোরা, ডাহুক, চ্যাগা, বক আর মানিকজোড়ের মতো হরেক পদের পাখি। ওদের নিরীহ ভয়ার্ত চাহনি দেখে বুকটা কেমন যেন ধড়ফড়িয়ে উঠতো।

খালের ঘাটে-বাঁধা নৌকা থেকে কিষাণরা ধানের আঁটি বয়ে এনে উঁচু করে পিরামিড সাজাতো উঠোনে। তাদের দুলে দুলে হাঁটার ঝাঁকুনিতে অনেক ধান শিষ খসে পড়ে যেত মাটিতে। বাড়ির কাজের মেয়েরা পথ কুড়ানো কাদামাখা ধান ধুয়েথুয়ে শুকাতে দিতো তাফালের কাছে। 

নানারকম কায়ক্লেশে জোগাড় করা এই ধান বেচে যে অর্থযোগ হতো তা দিয়ে আদপে মোয়ামুড়ির চেয়ে বেশি কিছু জুটতো না। সেই যুগটা ছিল মোটামুটি শায়েস্তা খাঁর আমল। ধানের মণ বিকাতো বড়োজোর সাত আট টাকা দরে। সেই সস্তার যুগে বড়োমামা ১১ টাকা দিয়ে একখানা গোমতী লুঙ্গি কিনে রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। এই খবর শুনে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া করে মূর্ছা খেতে খেতে হাজির হয়েছিলাম কড়কড়ে শক্ত অতিশয় মূল্যবান লুঙ্গিখানা দেখতে। 

সময় পালটেছে। এখন একখানা হাতে আঁকা ছবির দাম কোটি ডলার শুনেও বিস্মিত হই না।


বন কেটে বসত

ছেলেবেলায় দক্ষিণ বাংলার গাঁও-গ্রামে একদল লোককে দেখতাম শিক দিয়ে মাঠবিল খুঁচে বেড়াতে। কী তারা খুঁজতো এ নিয়ে শিশু মনে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। কেউ কেউ রগুড়ে গলায় বলতো ওরা গুপ্তধন খুঁজছে। একটু রহস্যপূর্ণ হলেও কেন জানি বিশ্বাস হতো কথাটা। আমাদের বাগান-ঘেরা পুরোনো আমলের বাড়ির আনাচে কানাচে বহুদিন তক্কে তক্কে থেকেছি যদি হঠাৎ কোথাও মিলে যায় গুপ্তধনের মোহর। গোপনে গোপনে বহু রকম তৎপরতা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ঘটে ওঠেনি কিছুই। 

যে কারণে অচেনা মানুষগুলোর এত খোঁচাখুঁচি দেখে একটা আন্দাজ-রহস্যের কল্পছবি গেঁথে নিয়েছিলাম মনের কোণে। 

বাগেরহাটের দখিনের পুরো অঞ্চলটাই ছিল সুন্দরবন পরগনার অধীন। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে একসময় মোরেলগঞ্জ খ্যাত মি. মোরেলের হাতে আসে সুন্দরবন পত্তনির বিশাল অংশ। বেনিয়া মোরেল সুযোগ পেয়েই উঠে পড়ে লেগে যান জঙ্গল সাফ করতে। মাগনা জমির লোভ দেখিয়ে বাখরগঞ্জ থেকে দলে দলে নিয়ে আসেন বহু লোক। তারা বন কেটে বসতি নেন দখিন জনপদের বিশাল এলাকাজুড়ে। বাগেরহাটের একই জনপদের ভেতর মানুষের কথাবার্তার ভেতর অন্য অঞ্চলের যে প্রভাব তা মূলত এ কারণেই। 

আমাদের পূর্বপুরুষ ভান্ডারিয়ার রাজাপুর থেকে এসে পত্তনি নেন এখানে। একসময় এখানে যে বন ছিল তার আলামত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বজায় ছিল তখনও। সুন্দরবনের সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতার মতো বহুল পরিচিত গাছের অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান রয়েছে সর্বত্র। আমাদের বাড়ির গোলপাতার ডাগর চেহারা দেখে কেমন এক উন্মাদনায় ভাসিয়ে দেয় আমাকে। রামপালের আশপাশের গ্রামগুলোতে এখনও চোখে পড়ে কেওড়া গাছের বিপুল ছড়াছড়ি। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কেওড়ার ‘টক’ পাতে না উঠলে খাবার জুতমতো মুখে রোচে না।

মাঠবিল খুঁচে বেড়ানোর লোকজন এমত তল্লাশি চালিয়ে মাটির তলা থেকে বের করে আনতো বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি। জ্বালানি হিসেবে এর বিশেষ কদর ছিল বাজারে। আমাদের অবশ্য ওদিকে হাত বাড়াতে হয়নি। নিজেদের বাগানের অঢেল ডাল-পাতায় চাহিদা মেটানোর পরও প্রতিবেশীদের উনুনের জন্য থেকে যেত যথেষ্ট। 


তারাবাতির দিন

শহুরে মানুষের পাখা গজালে একখানা গাড়ি কেনে। আমাদের মতো গাঁও-গ্রামের জনমনিষ্যিদের কাজে-অকাজে দরকার হতো একখানা নৌকা। ছেলেবেলায় এই নৌকার ব্যবহার ছিল বহুবিধ। হাটবাজার, চাষাবাদ, মাছধরা, শিকার, ভানাকোটা, বেড়ানো ইত্যাদি দশ রকম কাজে এর প্রয়োজন হতো সবসময়। এই জরুরি চাহিদা মাথায় রেখে আব্বা একদিন তাঁর স্বপ্নের তরণী নিয়ে ঘাটে এসে ভিড়লেন। আহা, দেখে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। যেমন ছিপছিপে কালো, তেমনি আফ্রিকান সুন্দরীর মতো মায়াবী দেহবল্লরীর চেকনাই গড়ন।

আমাদের পায়লাহারা নদীতে তখন ধুন্ধুমার নৌকা বাইচের এন্তেজাম হতো। সে এক আজব ব্যাপার। রীতিমতো হুলস্থুল পড়ে যেত দশগ্রামে। দলবেঁধে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়তো নদীর পাড়ে। দিকবিদিক লাফাতে লাফাতে তাদের লুঙ্গি খুলে যাবার জোগাড় হতো। তখন নদীতে রীতিমতো ঝড় শুরু হয়েছে। অর্জুনবাহারের ঝাউ গাছের নিশানা থেকে হেড়মা বাজারের দিকে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে আসছে পাঁচখানা বাইচ-নৌকা। নৌকা তো নয় ছুরি মাছ। তালে তালে বৈঠা উঠছে, নামছে। মাঝখানে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে ঘণ্টা বাজাচ্ছে একজন রংদার মানুষ। আব্বা কী বাইচ খেলতে যাবেন নাকি এই তেলতেলে ছুরি-নৌকা নিয়ে! মন্দ হয় না ব্যাপারটা। নৌকাটার গলুইয়ের দু’পাশে রংটঙ মেখে সাজাতে হবে একটু। ছুরাত, হাকিম, কেরামত, হাতেম, রুস্তম, মধুদের হাতে বৈঠাটা খেলবে ভালো। নেচে নেচে ঘণ্টির হেঁইয়োটা না হয় আমিই দেবো। খোদেজাকে বুক ফুলিয়ে কথাটা বলা দরকার। অবশ্য ওই পেট-আলগা মেয়েটাকে বিশ্বাস নেই একটুও। এই নিয়ে হয়তো রগুড়ে গলায় একটা গল্প ছড়িয়ে দেবে হাসু, বিলু, মিঠু আর টুকুদের কাছে। তা দিক। কে পাত্তা দিচ্ছে! 

এ ধরনের লম্বুটে তিরতিরে নৌকাকে আমরা বলতাম ‘টালাই’। আব্বার বাজার সদাই নিয়মিত ঘটতো এই টালাই নৌকা নিয়ে। সন্ন্যাসী, হেড়মা, ঘষিয়াখালি, প্ল্যানেরহাট, ফুলহাতা... ঘুরেফিরে কোনো হাটই বাদ যেত না। মাঝে মাঝে চোখে চালাকি-পানি এনে বায়না ধরতাম হাটে যাবার। না, না, করে শেষতক অনুমতি মিলতো। টুলটুলে নৌকার মাঝখানে তক্তায় হোগলা বিছিয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতাম আব্বার কাছে। হাঁটুর কাছে শোয়ানো থাকত ফ্রান্সের বিখ্যাত সিমপ্লেক্স কোম্পানির সিঙ্গেল-বোর বন্দুক। এ সময় কী এক তেজের চোটে বুক ফুলে দ্বিগুণ হয়ে যেত। হাত নিশপিশ করতো অকারণ। আলকুশি ঝোপে মাছরাঙা বসে থাকতে দেখলেও মাথা চড়াক দিয়ে উঠতো। দেবো নাকি গুলি করে? 

নিরুত্তাপ এভাবে বসে থাকাটা কোনো কাজের কথা নয়। ছুরাতের এ নিয়ে হেলদোল নেই। সে হাল ধরে বসে আছে গাছের গুঁড়ির মতো। ইচ্ছে হলে দুটো একটা টান দিচ্ছে বৈঠায়। স্রােতের টানে পিরপিরিয়ে চলছে আমাদের টালাই। ছোটো বৈঠাখানা নিয়ে একটু তৎপর হলাম পাকা মাঝির মতো। আব্বা এসব পাকামো দেখেও আমল দিতেন না। পান চিবাতে চিবাতে তিনি কিষেণের সঙ্গে মেতে থাকতেন পুরোনো দিনের গালগল্পে।

বাজারের ঘাটে নৌকার গেঁরোতে নৌকা বেঁধে কেনাকাটায় মশগুল হতেন আব্বা। আমের সময় আম। কাঁঠালের সময় কাঁঠাল। তবে কচা নদীর তেলপেটের ইলিশ না হলে সদাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। পূজোর সময় লাঠি-পটকা, তারাবাতি আর দানাদারের স্পেশাল চাহিদা ছিল আমাদের তরফে। সূর্য হেলে গেলে নদী খাল বেয়ে নৌকা ফের রওনা দিতো বাড়ির উদ্দেশে। আখ খেতে খেতে উত্তেজনায় কাঁই হয়ে পড়তাম কখন পটকাটা ফাটাব খোদেজার কানের কাছে। যা বজ্জাত মেয়ে পাত্তা না দিয়ে হয়তো ঠোঁট উলটে বলবে, ‘ইসরে কী এমুন পুটুস শব্দ, তোর পটকায় তো বারুদই নেইরে বোকুস কোথাকার!’


তেল নিয়ে তেলেসমাতি

আমাদের গ্রামটি তখনও ডুবে আছে অন্ধকার যুগে। ল্যাম্প-কুপি ছিল আঁধার তাড়ানোর বড়ো ভরসা। তবে ধনেমানে যারা একটু কোমর ভারি, তাদের ঘরে শোভা পেত মহামূল্যবান হারিকেন। আমরা যথেষ্ট খানদানি না হলেও পিকদানির চল ছিল। এমত ফুটানির তোপে মাটির কুপির সঙ্গে গলাগলি দিয়ে পেতলের ল্যাম্পেরও উঁকিঝুঁকি ছিল সমানতালে। কিন্তু এই মুখটেপা আলোয় মন ভরে না সকলের! যে কারণে নানা কিসিমের বায়েজিদ হারিকেন ফকফকা আলো ছড়াতো চৌচালা ঘরের কোঠায় কোঠায়। 

ফিবছর রমজানে বিশেষ খানাপিনার আয়োজন হতো খোলা উঠানে। আমরা গোল হয়ে বসে আব্বার হ্যাজাক জ্বালানো দেখতাম চোখ বড়ো বড়ো করে। গুঁতিয়ে পাম্প দিতে দিতে হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে উঠতো গোল আলোর উজ্জ্বল ম্যান্টল। বাহারি আলোর বন্যায় মুহূর্তে ভেসে যেত চারদিক। জালিকাটা আলোছায়ায় বেশ একটু রহস্যময় হয়ে উঠতো ছবেদা গাছের ডালপালা। আলোর সাড়া পেয়ে সহসা ডানা ঝাপ্টে ছড়বড়িয়ে উড়ে যেত কলা বাদুড়ের দল।

হারিকেনের মতো তখন ছিল টর্চ লাইটেরও জয়জয়কার। আব্বা ঘরের জানালা থেকে পাঁচ ব্যাটারির লাইট মেরে সুপারি বাগানের চোর তাড়াতেন। এই পাঁচ ব্যাটারির লাইটওবা ক’জনের ভাগ্যে জুটতো সেই আমলে!

আসরের আজানের পর তাবৎ হারিকেন, ল্যাম্প, কুপি জোগাড় করে ঘষামাজা করতে বসতো ফুলি। হেরিকেনের কালো চিমনি মুছতে হতো সাবধানে। একটু উলটো-পালটা চাপ লাগলেই ঠুন করে ভেঙে যেত হরদেও কোম্পানির গোল পাতলা কাচ। কয়েক পদের হারিকেন ছিল আমাদের। বড়ো, মেঝে, ছোটো। ফুলি সব ঘষামাজা করে তেল ভরে সাজিয়ে রাখতো এককোণে। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানো আর কী!

মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে সবগুলোতে আলো জ্বালিয়ে দিতো ফুলি আর হাজেরা। বড়োটা যেত মায়ের কোঠার টেবিলে। মেঝেটা কাচারিতে মৌলভির জিম্মায়। ছোটোটা বরাদ্দ ছিল আমাদের জন্য। কাচারির বারান্দায় ল্যাম্পের আলোয় বসে কিষাণরা হুকো টানতো পুকুস পুকুস করে। আব্বা বড়ো চেয়ারটায় বসে চাষের খোঁজখবর নিতেন গম্ভীর গলায়, ‘কী রে হাকিম, বারোকুড়ার পাতোর খবর কী? একটু হাত চালাইয়া কর। বর্ষা আইলে তোগো খবর আছে কলাম।’

আমরা ছোটোরা হারিকেনের চিমনির খাঁচায় কাগজের বেড়ি দিয়ে স্কুলের পড়া মুখস্থ করতাম মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে। তৈয়ব মাস্টার কিছুক্ষণ পর পর ঘোঁৎ করে উঠতেন। মাস্টারের বাড়ি দৈবজ্ঞহাটি। নোয়া মামার সঙ্গে ভালো খাতির। দু’জনে গুজগুজ করে গল্প করতেন আর ফিচফিচ হাসতেন। আমরা বইয়ে চোখ রেখে কান খাড়া করে রাখতাম মধুর গল্পে। 

কথাটা তেল দিয়ে শুরু করলেও কেমন করে জানি গল্পে এসে ঠেকলো। মাফ করবেন, পুনরায় একটু তেলচর্চায় নিমজ্জিত হই। আমার কিন্তু বরাবর একটু তেলে আসক্তি। তবে এই তেল সেই তেল নয়। আমি আলবত বিমোহিত ছিলাম কেরোসিনের মধুর ঘ্রাণে। সেই পুটুস-বয়সে তক্কে তক্কে থাকতাম কখন ল্যাম্পটা মুঠোয় বাগিয়ে চুমুক দেবো কেরোসিনে। মা তেলের গন্ধ শুঁকে খলবলিয়ে দ্রুত ছুটে আসতেন তেড়ে, ‘বজ্জাত পোলা, আবার ওই গুমুত খাইছস? ওই বিষ খাইয়া তোর মরণ আছে কপালে!’

মা এখন আর বেঁচে নেই। থাকলে নিশ্চয় বিস্মিত হতেন এই দেখে যে, তার তেলখেকো গুণধর সুপুত্তুর সত্তর পার করেও কেমন দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে! তারতো এতদিনে পেটে আগুন লেগে মরার কথা।


ষাঁড়ের যুঝু

ছেলেবেলায় আমোদ-ফুর্তিতে শরিক হতে কোথাও একা যাবার রেওয়াজ ছিল না আমাদের। বিশেষ করে ট্রাকের পেছনে যেমন দশ হাত দূরে থাকুন কথা লেখা থাকে, আমার বেলায়ও তদ্রƒপ খেটে যেত কথাটা। কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রথাটা ভাঙলো মোতালেব স্যারের প্ররোচনায়। একটু খোলাসা করে বললে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

একসময় আমাদের বাড়িতে মৌলভি, তালবেয়ালিনের সঙ্গে একজন প্রাইমারি মাস্টার লজিং রাখার চল ছিল।  বেঁটেখাটো মোতালেব স্যার আর যাহোক মানুষটা ভালো। বাড়ি দৈবজ্ঞহাটি। উনি আমাকে লোভ দেখালেন ষাঁড়ের যুঝু দেখার। গরু নিয়ে বরাবর হালচাল করতে দেখেছি কিষেণদের। দু’একটা পাগলা গরু অবশ্য থাকলেও থাকতে পারে। তাই বলে সেই নিরীহ গরু বাঘ-সিংহের মতো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে যুদ্ধ করবে এটা কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু স্যার যখন বলেছে তখন আর অবিশ্বাস করার জো নেই। আব্বার কাছে বায়না ধরতেই অনুমতি মিললো।

মা পরাণ মানিকের মাথায় ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দিলেন মাস্টারের হাতে। তখন পথঘাট অতো সুবিধার ছিল না। আমরা হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। লাফিয়ে লাফিয়ে যতো চলি না কেন পথ আর ফুরোয় না। সরু কাঠির মতো দু’খানা পা নাচার হয়ে যায় অবসাদে। কিন্তু মনের সাধে কোথাও ঘুরতে পারছি এমন একটা উত্তেজনায় ভুলে যাই সব কষ্টের 

বিষ-পিঁপড়া। 

মোতালেব স্যারের বাড়িতে ভালোই অভ্যর্থনা জুটলো। বাবা-মা-ভাই-বোন মিলে আদর যতেœ মাথায় করে রাখলো ভিন গাঁয়ের রোগাপটকা টিনটিনে মুখচোরাকে। মাছধরা আর ঘোরাঘুরির ফুর্তিতে কটা দিন ভালোই কাটলো। অবশেষে হাটবারে সেই বিখ্যাত ষাঁড়ের যুঝু দেখার জন্য রওয়ানা দিলাম উত্তেজনায় কাঁই হয়ে। 

লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে বিশাল মাঠ। মাইকে ফাটাফাটি গান বাজছে। জিলাপি ভাজা ঘ্রাণে ভুর ভুর করছে বাতাস। সবাই চিৎকার করে ছাতা আর লাঠি নিয়ে নাচানাচি করছে। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধের দামামা। মাঠের মাঝখানে গলায় রঙিন মালা পরা দুটো ষাঁড় মহাক্রোধে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বেধড়ক ফুঁসছে। হৈ-চৈয়ের উত্তেজনায় শিং বাগিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো একে অন্যের ওপর। সময় বয়ে যায়। কেহ নাহি হারে। সমানে সমান। হঠাৎ চোখের পলকে কী ঘটলো। শাদা রঙের চুটো ষাঁড়টা মওকা পেয়ে লাল প্রতিপক্ষকে গুঁতিয়ে দাবড়ে চললো মাঠের বাইরে। বিশাল গর্জনে জনতা ফেটে পড়লো। জয় হলো শাদার।

আমাদের গ্রামে সেসময় জালাল মাস্টারের খুব নামডাক। বড়োবাড়ির লজিং মাস্টার বলে তার হাঁকের জোর ছিল উঁচু তারে বাঁধা। বিদ্যা জহিরের সঙ্গে নেচে বেড়াতো তার বেতের লাঠির বিপুল কারিশমা। জালাল মাস্টারের প্রিয় ছাত্র মন্টু। তাকে যুঝুর জন্য তৈরি করেছেন ঝেড়েমুছে। মন্টু আমার সমবয়সী হলেও রীতিমতো বুদ্ধির জাহাজ। মোতালেব স্যার তার ভোঁতা ছাত্রটিকে ঘষেমেজে হাতালের সবচেয়ে অকেজো গরুটার সমকক্ষ করতে পারলেন না!

জালাল মাস্টার সুযোগটা কাজে লাগালেন। মন্টুকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঘোষণা দিলেন ষাঁড়ের যুঝুর। প্রতিপক্ষ সেই বিখ্যাত মুখটেপা অকেজো গরু। মোতালেব স্যারের মনে কী ছিল কে জানে! বুক চেতিয়ে চ্যালেঞ্জটা নিলেন। বড়ো বাড়ির কাচারি ঘরে অনেক উৎসুক চোখের সামনে শুরু হলো পরীক্ষার লড়াই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। চাপা গর্জন আর ধমকে রীতিমতো জমে উঠলো সেই বিখ্যাত শাদা আর লালের মরণপণ যুঝু। কে হারে কে জেতে! অনেক গুঁতোগুঁতির পর অকস্মাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে লাল দৌড়ে পালালো যুদ্ধের আসর ছেড়ে। 

জালাল মাস্টারের আগুন চোখ ক্ষোভে-দুঃখে ছাই বর্ণ হয়ে গেল।


শুশুক-নৃত্যের পদাবলী

ছেলেবেলায় মামা বাড়ি ছাড়া আমাদের তেমন একটা বেড়ানোর জায়গা ছিল না। তাও কেটেছেঁড়ে অপেক্ষা করতে হতো সেই বৈশাখ-জষ্টির মধুমাস পর্যন্ত। আদম আলী ছিল মামাদের বাঁধা মাঝি। মা-খালাদের নাইয়র যাবার সময় হলেই যথারীতি হাজির হতো আদম আলীর টাবুরে নৌকা। শুধু নৌকা হলে চলবে কেন? খানদানি নিয়ম-কানুনের একটা ব্যাপার আছে না! বোনের তকলিফ লাঘবের জন্য মনু মামার উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক। মামা তখন পিসি কলেজে আই.এ করছেন। সেই আমলে কলেজ-ছাত্রের ভাবই ছিল আলাদা। কথায় কথায় গোঁফ মুচড়ে হাতের নাচন আর মুখ বেঁকিয়ে কেবলই পুটুস পুটুস ইংরেজির বোলচাল। চলনে-বলনে মামাকে মনে হতো ভিনগ্রহের মানুষ। তাঁর কারিশমার সামনে আমার বিস্মিত হায়ের গহ্বরে ডুমো মাছির আনাগোনা সহজে টের পেতাম না!

কালো বোরকা পরা মা মামার হাত ধরে নৌকায় উঠেই হুড়মুড়িয়ে চলে যেতেন ছইয়ের লাল-সাদা পর্দার আড়ালে। মামা আসনপিঁড়ি হয়ে বসতেন মাঝির সামনে খোলা পাটাতনে। পুরুষ মানুষকে অন্দর মহলে ঘাপটি মেরে থাকা কাজের কথা নয়। অগত্যা ন্যাতাপাতা শরীরখানা মুক্ত হাওয়ায় খুলেমেলে চোখ উলটে চারদিকের দৃশ্য দেখতাম তারিয়ে তারিয়ে। কেওড়া নদীর ফুচুক ফচুক শুশুক-নৃত্য ছিল দেখার মতো। চোখ কটক করে যতবার ওই-ওই করে লাফিয়ে উঠেছি, সঙ্গে সঙ্গে পিঠের ওপর একখানা হাত উঠে এসে জল ঢেলে দিতো তামাম উত্তেজনায়। মামা যে কত রকম রসুটে কথা জানতেন তার ইয়ত্তা নেই। পুটুস-ভাগ্নেকে নানা কথায় ক্ষেপিয়ে তার সুখ। আমি ছিলাম লজ্জাবতী লতা। মেয়েমানুষ দেখলেও শরমে লাল হয়ে যেতাম পাকা তেলকুচার মতো। নসু খালা এই দেখে নাকে ঠোনা মেরে বলতেন, ‘আয়, তোর নাকটা টিপে দেখি কোথায় এত লজ্জা!’ মামা ভবিষ্যতে এই হাঁদুটে লবেজানকে জামাই বানাবেন শুনে কান দিয়ে বাগেরহাটের কয়লা ইঞ্জিনের ট্রেনের মতো ধোঁয়া বেরোতো ভুস ভুস করে। 

আদম আলী মানুষটা ছিল ছয়ছোট্ট ক্লিশে টাইপের। যেন হাড়গোড়ের ওপর কোঁচকানো চামড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর কাকতাড়–য়া একটা। ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর। পুকুস পুকুস শালপাতার বিড়ি টেনে সে চালিয়ে যেত নৌকাখানা। নরম চিকচিকে রোদে মামাকে তখন দেখার মতো। নদীর আউলা বাতাসে ফুরফুরে চুল উড়ে বাড়ি খাচ্ছে নাক-চোখ-মুখে। কলেজে আই.এ পড়লে সবাইকে একটু উত্তম কুমার হতে হয়। মামা এখন সেই পোঁজে মগ্ন হয়ে ‘ওগো তুমি যে আমার...’ ধরলেন বিরহী গলায়। সুরের মহিমায় লজ্জা পেলাম। কোনো কাজ না পেয়ে আঙুল পানিতে ডুবিয়ে মেতে উঠি ছুঁই ছুঁই খেলায়। মামা হঠাৎ সুর ভঙ্গ দিয়ে ধমকে ওঠেন বেসুরো গলায়, ‘ওরে, মোর জামাইরে, খাইলো তোরে কামটে...!’

রোদে পুড়ে বাঁদরামি বেড়েছে দেখে মা লতপতে হাফ প্যান্টের কোমরদড়ি খিমচে টেনে নিলেন ভেতরে। একটু অপমানিত হলেও হামা দিয়ে ঠাঁই নিলাম গলুইতে। মামা বাড়ি যাবার পথে কিছু দিকচিহ্ন বসিয়ে রেখেছি মনে মনে। ঘষিয়াখালির মোহনা ঘুরে একটা নিঃসঙ্গ তালগাছ। তারপর কিছু দূর না যেতেই চকচকে কবিরাজ বাড়ির টিনের চালা। এবার আর ডানে বাঁয়ে নয়। সোজা যেতে যেতে সহসা গাছপালার ফাঁকে ভেসে ওঠে হাওলাদারদের জামে মসজিদের শাদা মিনার। তারপর হাঁটু ভাঙা বাঁকখানা পেরোলেই সহসা তুমুল চমকে হেসে ওঠে বিখ্যাত ফুলহাতা বাজার। হাইস্কুল। এভাবে দিকনিশানার শেষ চিহ্নটি শেষ হয় একটি খাল দিয়ে। এই খাল বেয়ে যেতে যেতে যেখানে লাল কৃষ্ণচূড়া বিকট আগুন ধরে আছে.. ওটাই মামাদের স্বপ্নবাড়ি।

সব স্বপ্নের সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্নের ছবি নির্মম ভাবে আঁকা থাকে। না হলে স্বপ্নবাজ মনু মামাকে কেন হঠাৎ অকালে চলে যেতে হবে মহামারী কলেরায়!


বেলা গেল লুকোচুরিতে

মামা বাড়ির দুষ্টু ছেলেরা খুব একটা পাত্তা দিতো না আমাকে। একটু ছিচকাঁদুনে ছিলাম বলে সহজে ঘেঁষতে পারতাম না ওদের দলে। বিল্টু ছিল নাটের গুরু। সে আকার ইঙ্গিতে কথা বলতো দলের সঙ্গে। প্রায়ই কিউকাম্বার কথাটা বলেই চোখ নাচিয়ে উধাও হয়ে যেত। পরে শুনেছি মজুমদারদের বাগান থেকে তারা লুকিয়ে শসা চুরি করে খেতো কল্পনা মাসির চোখ ফাঁকি দিয়ে।

আমার যা একটু ভাবসাব ছিল কুচোকাচা বালিকা বাহিনীর সঙ্গে। এদের মধ্যে তুষির ছিল মুখভর্তি ফোঁড়া। ভারি টনটনে মেয়ে। কথায় কথায় খিমচে দিতো বলেই ওকে আড়ালে আবডালে শিরা বলে ডাকতাম। হুতোম প্যাঁচাকে আমরা বলতাম শিরা। ফোঁড়ার কারণে ওর মুখখানা কী আসলেই প্যাঁচার মতো লাগতো? কী জানি কেন এই অদ্ভুত নামকরণ! 

সেইসময় ‘পলাপলি’ খেলার ধুম ছিল খুব। বেশ পরিচিত সোজা ধরনের একটা খেলা। কেউ হয়তো দরদালানের কোথাও পালিয়ে ‘কু’ দিতো। তখন অন্যেরা ছুটে গিয়ে তাকে খুঁজে পেতে বের করতো হৈ হৈ করে। অনেকটা চোর-পুলিশ ধরনের লুকোচুরি খেলা। আমি ছিলাম সোজা তালগাছ। নাকি গাব গাছ! ঠিকঠাক পালাতেও জানতাম না। টেবিলের তলায় চোখ বন্ধ করে আড় দিয়ে পড়ে থাকতাম ভোঁত বাইলার মতো। ওরা সহজে লেতুপেতু ঠ্যাংখানা টেনে বের করতো হিড় হিড় করে। ওদের হাততালির মুখে বাগদা চিংড়ির মতো ছটাং করে একটু ভাব দেখালেও শিরার খামচির ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে সারেন্ডার করতাম হাত উঁচিয়ে। 

মমতাজ ছিল একটু অন্য ধাঁচের। তার ভেতর একটু মোড়লিপনা ভাব ছিল সবসময়। কথা বলতো আঙুল নাচিয়ে। ভাবখানা যেন ফুলতলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা কুহেলি রানী সমাদ্দার। সে ভাষণ দিলে অন্যরা অনিবার্য শ্রোতা হয়ে যেত। আমি শিরাদের পীড়নে নাজেহাল হলে সে প্রশ্রয়ের ছাতাটা তুলে ধরতো মাথার ওপর। বোকাদের শত্রু নেই। তবে বোকা বলেই তাকে আখেরে অনেক শোক সইতে হয়।

আমরা দলবেঁধে স্কুলে যেতাম। খালি পায়ে ধুলোটে রাস্তায় মাইলটাক হাঁটা কম কথা নয়। রাস্তায় কত যে কী দেখার ছিল বলে শেষ করা যাবে না। খাল পাড়ে ছোটো নানার বৈঠকখানায় আগুন আগুন কৃষ্ণচূড়া, বেমক্কা উঁচু লম্বা পুলসিরাত, গাছপালার ফোকরে মতিন খালুর দোকান, রতন মামা মারা যাবার দিন খালু ডেকে ভাত খাইয়েছিল লালশাক আর টাকি মাছ দিয়ে, সেই ভয়ংকর লাল সালুনের স্বাদ এখনো লেগে আছে জিভে, নয়া বাড়ির দুই নানার সঙ্গে একটু খুনসুটি, কুকুরের ভয়ে কাঁচুমাচু, জোয়ারে ভেসে যাওয়া টাবুরে নৌকা, জালে মাছ ধরা, খালের দুপাশে বেশুমার গাছপালায় ঠাসা সবুজ ক্ষেতখামার, গাছে-গাছে পাখপাখালির ওড়াউড়ি, কিচিরমিচির, ভাঁটফুলে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িংয়ের মগ্ন নাচানাচি- সব পাশ কেটে যেতে না যেতেই সহসা ভেসে উঠতো কেওড়া নদী ছুঁয়ে দাঁড়ানো আমাদের স্কুলের ঝকমকে টিনের চালা।

আনন্দে-নিরানন্দে এই স্কুলে কেটেছে শিশুবেলার উজ্জ্বল তিনটি বছর। শ্যামল, কল্যাণ, অনঙ্গ আর মন্টুদের সঙ্গে কত স্মৃতি! স্যারদের ভালোবাসার সঙ্গে ওঁৎ পেতে থাকতো মুহুর্মুহু কান ডলার বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দেলোয়ার স্যার আমাদের কূপমণ্ডূকতায় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘কালি পূজোর পাঁঠা।’ এই মধুর বাক্যে কান গরম হলেও নির্বোধের মতো লুকিয়ে ফিচিক ফিচিক হাসতাম।

গুরু বাক্য বৃথা যায় না। বিধাতা এই অধমদের আজো পাঁঠা বানিয়ে রেখেছেন। মানুষ করেননি!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ