কাঁদছে মানবতা । আহমদ মতিউর রহমান

কাঁদছে মানবতা । আহমদ মতিউর রহমান

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাত দুপুর। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাংলাদেশ মিয়ানমার যুদ্ধ লাগবে লাগবে করেও লাগেনি। মিয়ানমারের হানাদারি ও আগ্রাসী তৎপরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেমন যেন চুপসে গেছে। যুদ্ধ লাগলে কেমন হতো? নো ম্যান্স ল্যান্ডে কল্পনা করার চেষ্টা করে তহমিনা। বয়স ১৩। অতি সাধারণ একটি রোহিঙ্গা পরিবারের কন্যা। আরাকান, যা ছিল শত শত বছর ধরে তাদের বসটভিটা সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। দেখতে সে ভালোই ছিল। চোখ দুটো টানা টানা, লম্বাটে চেহারা, গায়ের রং দুধে আলতা না হলেও ফর্সা যাকে বলে তাই। মা খুব গৌরব করতেন তার মেয়েকে নিয়ে। এখন আর তাকে রূপসী বলা যাবে না। ক্রমাগত না খেয়ে থাকতে থাকতে আর ভয়ঙ্কর সব পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। সৌন্দর্য দিয়ে কী হবে এখন তো জানই বাঁচে না। আগে আম্মা বলতেন- : বুঝলেন তহমিনার আব্বা, আল্লাহ আমাদের একটি সম্পদ দিয়েছেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। রূপে গুণে সবদিক থেকে সুন্দর আমাদের মাইয়া। নিজের মেয়ের প্রশংসা নিজেই করতেন তাহমিনার মা। শুনে বাবা জাফর আলম হাসতেন। : তাতো তো হাচাই কইছো, সুখ কি আমাগো কপালে সইব? আল্লা আল্লা কইরা মাইয়াডার একটা ভালা বিয়া দিতে অইব। এটা বলতেন ঠিকই তারপর চুপসে যেতেন তহমিনার বাবা। তার মনে হাজার চিন্তা। আরাকানের ছোট্ট একটি গ্রামে তাদের বাড়ি, নারিকেল সুপারি গাছ আছে, আছে পুঁইয়ের মাচা। তাতে বাতাসে পুঁইয়ের লতা দোল খায়। আরো কত গাছ। কত পাখি। কি থেকে কি হয়ে গেল! রোশনারা ওরফে হ্লা মিয়ং। এটা রোশনারার বর্মী নাম। মুসলমানি নাম আরাকানে সবখানে চলে না। তহমিনার, তহমিনার বাবা আর ভাইদেরও বর্মী নাম আছে। কিন্তু বাড়িতে তারা মুসলিম নামই বলেন। বর্মীদের সঙ্গে মিশতে গেলে আর বর্মী স্কুলে বর্মী নাম। স্বামীর উত্তর রোশনারার ভালো লাগতো না। তিনি বলতেন, : আপনি বিয়া বিয়া কইরেন না তো! এতটুকুন মাইয়া কি বিয়া দিমু? আপনি ওরে নিয়া ভাইবেন না। আমরা অনেক ভালা বর পামু। বলেন রোশনারা। : হ্যাঁ রোশনারা, আমিও তো সেই আশাই করি। বাকি আল্লার ইচ্ছা। যাই অহন কামে যাই।

২. এখন এগুলো সব ইতিহাস। বাবা-মায়ের সেই কথামালার পর আরো দেড় বছর পার হয়ে গেছে। এখন কঠিন বাস্তব তার সামনে দাঁড়িয়ে। মা রোশনারা, প্রতিবেশী হালিমা খালা, সুফিয়া ফুপু, উত্তর পাড়ার ফুল বানু, শামসি আরা বিলকিস বানুসহ দশ-বারোজন মহিলাকে চোখের সামনে বেয়নেটের মুখে ধরে নিয়ে গেল বর্মী বাহিনী। সবাই তখন থরথর করে কাঁপছে আর আল্লার নাম জপছে। বর্মী বাহিনীর লোকেরা সবাইকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে প্রধান সড়কের দিকে। তাদের সাথে ছিল সীমান্ত রক্ষী লুন্টেন বাহিনী ও রাখাইন নেতারাও। অসহায় মহিলারা ধান খেতের আল বেয়ে ওদের কথা অনুযায়ী দূরে রাখা সেনা জিপের উদ্দেশে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের মনে মনে জাগছিল দুঃখের বোধ, অনুশোচনা। বাতাসে দোল খাচ্ছিল ধান খেতের চিরল চিরল পাতা, অপুষ্ট ধানের ছড়া। ওরা কি টের পেয়েছে এই অসহায় মহিলাদের আসন্ন দুর্যোগের কথা? হয়তোবা পেয়েছিল, নয় তো নয়। ছি ছি এত কিছু দেখেও ধানের অপুষ্ট ছড়া আর পাতা বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে গেল?

৩. তহমিনার কাছে সব দুঃস্বপ্ন। ওর বেঁচে যাওয়া, এইখানে আশ্রয় পাওয়া। দুঃস্বপ্ন দুই ভাই ইব্রাহিম আর বশিরের কাছেও। বাবা ও দাদাকে ওরা তাদের চোখের সামনে মেরে ফেলতে দেখেছে। ঝোপের পাশে লুকিয়ে তিন ভাই বোন দেখেছে এই পৈশাচিক দৃশ্য। মিয়ানমার বাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে ওদের বাবা জাফরের রাখাইন বন্ধু উ খিউ চাচা। ছি ছি ছি। খিউ চাচা কতনা দাওয়াত খেয়েছে তাদের বাড়িতে। ওর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক এত ভালো ছিল- সবাই বলবে দু’ ভাই। সেই খিউ চাচা কিনা ....। না আর ভাবতে পারে না। পেছনের চিন্তা করে আর কী লাভ? ওদের বড় দু ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে লুন্টেন বাহিনী। শুনেছে ওদের মেরে ফেলেছে। আর মাকে? আর তার সাথে থাকা নারীদের ! সড়ক পর্যন্ত নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে লাশ বাস্তার পাশে খালে ফেলে দিয়েছে। এসব বর্ণনা দিয়েছেন বেঁচে আসা এক নারী। তহমিনা তাকে চেনে- আকিয়াবের উত্তর পাড়ারই কোন একজন মহিলা হবেন। যুদ্ধ লাগলে দু’ দেশের বিমান ও কামানের গোলার আঘাতে আর নিচে জ্বলতে থাকা আগুনে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার হয়তো কমতো। ওরাও যদি গোলার আঘাতে উড়ে যেত সেটাই ভালো হতো! তাতো আর হলো না। এই জিল্লতির জীবন কাটাতে হচ্ছে এখন। বস্তা বিছিয়ে শোয়ার জায়গা করা হয়েছে- ওর দু’ভাই ইব্রাহিম আর বশির ঘুমিয়ে পড়েছে। তহমিনার চোখে ঘুম নেই। পনের দিন হলো জনা পঞ্চাশেক রোহিঙ্গা উত্তর প্রান্তের বাংলাদেশ সংলগ্ন এই ঢিবিরি মধ্যে বসে আছে। বাবা ও দাদাকে গুলি করে মারার পর মশাল দিয়ে ওদের ঘর বাড়িতে আগুন দেয় খিউ চাচা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। মাকে তো ধরেই নিয়ে গেল। ওরা ঝোপের পাশে লুকিয়ে সব দেখতে পেয়েছে আর থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠেছে। করার কিছুই ছিল না। ওরা বাড়িতে ফিরে গেলে নির্ঘাৎ মারা পড়বে? তিন ভাইবোন অন্য আরো শত শত রোহিঙ্গার সাথে ধান খেতের আল বেয়ে বেয়ে রাতের আঁধারে নৌকাঘাটে এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে নৌকায় চড়ে বাংলাদেশ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সবাই ছিল দু’টি নৌকায়। একটি নৌকা পার হয়ে গেল। বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড আটকে দেয় ওদের নৌকাটা। দুর্ভাগ্য যাকে বলে। কি আর করা। ওরা ভিটিমতো একটি জায়গায় নেমে সেখানেই বসে থাকে। না সেখান থেকে আর কোন দিকে নড়া হয়নি। ওরা জেনেছে এই জায়গাটাকে বলে নো ম্যান্স ল্যান্ড। দুদেশের মাঝখানে মনুষ্যবিহীন এলাকা। ওরা এখানে আছে ১৫ দিন ধরে। জনা পঞ্চাশেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশু। অধিকাংশই মুসলমান, তবে কয়েকটি হিন্দু পরিবারও রয়েছে। যুদ্ধে সংঘাতে হিন্দু মুসলমান আলাদা করার কিছু নেই। যুদ্ধের আর আগ্রাসনের কাজই হলো সবাইকে ধ্বংস করা। ওরা সবাই চলে এসেছে আতঙ্কে। মিয়ানমার বাহিনী আরাকানে গণহত্যা চালাচ্ছে। আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে সবাইকে ঠেলে দিয়েছে সীমান্তের ওপারে। মিয়ানমার সেনা, বর্ডার পুলিশ কিংবা বৌদ্ধ খিউদের দল- কেউই নির্যাতনের ক্ষেত্রে হিন্দু কি মুসলিম ফারাক করে না।

৪. ভাই দুটোর দিকে তাকায় তহমিনা। ফ্যাকাসে- কয়েক দিনের না খাওয়া চেহারা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশী সেনারা এসে দু’ বেলা কিছু খাবার দিয়ে যায়। তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। ওরা কোন দিন পায় কোন দিন পায় না। না পেলে অভুক্তই থাকতে হয়। আজলা ভরে নাফ নদী থেকে তুলে পানি খায় তহমিনা। তবে এখন আর এই পানি খাওয়া যায় না। পানিতে রক্তের গন্ধ। কি জানি তার ভাই, বাবা মা দাদার রক্ত এতে মিশেছে কি না! কোন কোন দিন আজলা ভরে তুলেও পানি ফেলে দেয়। খায় না। বাংলাদেশীরা তবু ভালো। খাবার আর পানি দিয়ে যায়। কিন্তু পেছনে তাদের নিজ দেশে যমদূতেরা খাড়া হয়ে আছে। পেছনে ফিরে গেলেই নির্ঘাৎ গুলি আর মৃত্যু। কী দোষ তাদের? তারা শত শত বছর ধরে আছে আরাকানে। এখন নাম দিয়েছে রাখাইন। আগের অনেক কিছুই আর নেই। তাদের পরিচয় ছিল মুসলিম। এটা কি অপরাধ? যদিও প্রত্যেক আরাকানির মুসলিম নামের পাশাপাশি একটি করে বর্মী নাম থাকা চাই। রাখাইন বা বার্মিজদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এই ভাষা। নিজেদের ঘরে মক্তবে চলতো বাঙলা ভাষা। তাদের নিজেদের ভাষা। চট্টগ্রাম এলাকার মতো শোনালেও রোহিঙ্গাদের ভাষা একটু আলাদা, হুবহু চট্টগ্রামের ভাষা নয়। সেই ভাষায় আছে গান ও কবিতা। সেগুলো গোপনে সেখানো পড়ানো হতো ছেলে মেয়েদের। কী যেন কোথায় আরাকান আর্মি না কি যেন কি বাহিনী ১১ জন বর্মী সেনাকে হত্যা করেছে। সেই বাহানায় রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা শুরু। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল মিয়ানমার সেনারা। দেশের নতুন নেত্রী অং সান সু চিকে সবাই ভাল বলে মনে করেছিল। কিন্তু না, সেও বিষদাঁত বের করে কামড় বসালো। মা বলতেন, : সুচি জেনারেল অং সানের কন্যা না ছাই, ডাইনি একটা। : তোমরা তো জানো না, জেনারেল অং সান আমাদের মুসলমানদের কতটা ভালোবাসতেন। ওনার মেয়েটা সেই গুণ পায়নি। শুধু শুধুই এতদিন আমরা আশায় ছিলাম। আমাদের আশার গুড়ে বালি পড়েছে বৌ মা। দাদা বলতেন। তারপর যা হলো। প্রাণের ভয়ে ছুটে পালালো লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পাশের দেশ বাংলাদেশে। কিছু গেল থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া। ওরা বর্মী ভাষা শিখে বর্মী নাম ধারণ করে মিশে যেতে চেয়েছিল সেখানকার জনগোষ্ঠীর সাথে। কিন্তু তা আর হলো কই? তহমিনা শুনেছে যারা বাংলাদেশে ঢুকেছে তারা মোটামুটি ভালোই আছে। থাকার জায়গা পেয়েছে, খাবার পাচ্ছে। তাহলে ঘুমিয়ে থাকা জাতিসংঘ আর বিশ্বের দৃষ্টি পড়েছে! কিন্তু দু’ দেশের মাঝখানে আটকা পড়াদের কী হবে? : আপু রে। একটু পানি দে। ধড়মড় করে জেগে ওঠে ছোট ভাই বশির। একটা বোতলে সামান্য পানি ছিল। : এই নে। খেয়ে ঘুমা। : তুই ঘুমাবি না? : আমার ঘুম আসছে না। : সারা রাত জাইগা থাকবি? : আপুরে, হঠাৎ করে মা’র কথা মনে পড়তাছে। মার অসহায় মুখটা ভুলতে পারছি না। মা তুমি কোথায়? এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে বশির। ওর কান্না দেখে তহমিনাও তলে তলে ভেঙে পড়ে। ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছে সে দুঃখ লুকানোর চেষ্টা করে। ও বড়। ওকে কাঁদতে দেখলে ছোট ভাই দুটো কেঁদে বুক ভাসাবে। বশির সবার ছোট বলে মা তাকে খুব আদর করতেন। ছাগল চরানোর সময় ওকে সঙ্গে নিতেন। মাচানের পুঁই লতা কাটার সময় বা খেতের ঢেঁড়স ইত্যাদি সবজি তোলার সময় মাকে সাহায্য করতো বশির। : ও সব ভেবে আর কাজ নেই। নে পানি খাইয়া অহন ঘুমা। তহমিনা আবার তাড়া লাগায়। কতক্ষণ কাঁদে। তার পর বস্তার ওপর ঘুমিয়ে পড়ে বশির। ওর আরেক পাশে আরেকটি বস্তার ওপর ঘুমিয়ে ইব্রাহিম। রাত তখন কত হবে? দুটোও হতে পারে তিনটেও হতে পারে। শুধু তহমিনা একা জেগে আছে। ও দিকটায় অন্য মেয়েরাও রাতভর জেগে থাকে। আকাশ ফর্সা হয়ে এলে ঘুমায়। নো ম্যান্স ল্যান্ডে ইজ্জত হারানোর ভয় নেই। তবু কেন যেন প্রথমরাতে ঘুম আসে না তহমিনার। কয়েক দিনে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন ওদের একটাই স্বপ্ন বাংলাদেশে ঢোকা। সেটা কি সম্ভব হবে? নাকি ওরা সামনে নাফ নদী আর পেছনে উদ্যত সঙ্গীনের মাঝখানে পড়ে থেকেই মারা পড়বে। হায় আল্লাহ! গতকাল বাংলাদেশী সেনা সাহায্য দেয়ার সময় শাসিয়ে গেছে। আর কোন রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেয়া হবে না। যারা ঢুকেছে তাদেরই নাকি স্থান সংকুলান হয় না। না বাপু এত শক্ত শক্ত কথা তহমিনা বুঝতে পারে না। ওদের চাওয়া ওপার যাওয়া, সেটা বোধ হয় আর হবে না এটুকু বুঝতে পারে। এর মানে নির্ঘাত মৃত্যু। মৃত্যুদূত যমদূত দু পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

৫. ক্রমশ আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। দেখা দেয় দূরের পাহাড়। নলখাগড়ার বন। লাল মাটির ঢিবি। আহা এগুলো কোথায় ছিল সারা রাত। ভাবে তহমিনা। ক্ষিদেয় পেটে মোচড় দিয়ে উঠছে। গতকাল যা যা শুকনো খাবার দিয়েছিল বাংলাদেশী সেনা আর সাহায্যকর্মীরা তা দু’ ভাই ইব্রাহিম আর বশিরকে খাইয়েছে। গতকাল সেও সামান্য খেয়েছিল, আজ আর খেতে ইচ্ছে করেনি। আমিনা ফুপু বলছিল- : তহমিনা, লাজ করিস না। খাওন লাগলে কইবি। : না ফুপু, লাগবো না আমরা খাইছি তো। জবাব দেয় তহমিনা। মহিলাকে ভালো লাগে তার। সব সময় খোঁজ খবর রাখেন। কে বলবে তার আপন ফুপু নয়। যুদ্ধ আর অশান্তির এই এক কাজ। সবাইকে একসাথ আর আপন করে দেয়। এখানে এভাবে না এলে হয় তো কোন দিন আমিনা ফুপুর সাথে ওদের দেখাই হতো না। আমিনা ফুপু বুচিডং এর সরদার পাড়ার এক মহিলা। ওদের সঙ্গে এখানে পড়ে আছে ১৫ দিন। পেছনে রেখে এসেছে স্বামী, দেবর, এক ছেলে ও মেয়ে পরিবানুকে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল, বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। মেয়ের জামাই সমুদ্রে কাজ করতো। আমিনার স্বামী করতো কৃষি কাজ আর মানুষের ফাই ফরমাস, খেত নিড়ানো, ঘাস কাটা ইত্যাদি। ওতে যা আসতো কোন রকমে চলে যেত। এখন আমিনার কেউ নেই। স্বামী আর ছেলে বৌদ্ধদের হাতে মারা পড়েছে। পোয়াতি হওয়ার পরও বর্মী সেনারা মেরে ফেলেছে পরিবানুকে। ওরা পিশাচ, ওদের কোন দয়া মায়া নেই। একটা সন্তান সম্ভবা কিশোরীর সঙ্গে ওরা এই আচরণ করে কিভাবে? আরাকানে শয়তানদের বদনজর থেকে রক্ষা পেতে প্রত্যেক মেয়েকেই বাবা মা কম বয়সে বিয়ে দেন। যাতে অন্তত হার্মাদগুলোর হাত থেকে বাঁচা যায়। বুচিডং আকিয়াব মংডু সবখানেই এই রীতি। পরিবানুর এই হাল দেখে পাগল হয়ে গেলো ওর স্বামী জুলহাস। জানা যায় কাদের সাথে নাকি পাড়ি জমিয়েছে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে। সেটা আরেক ভয়ঙ্কর যাত্রা। অনেকেই নাকি পৌঁছতে পারে না, মাঝ সমুদ্রে মারা পড়ে। জামাই বাবাজির কি হাল জানা নেই আমিনার। তহমিনার কাছে এসব দুঃখের কথা বলে মাঝে মাঝে মন হালকা করেন আমিনা। এক মুঠি চাল চিবিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে জামা কাপড়ের পোঁটলায় মাথা রেখে শুয়ে পড়ে তহমিনা। আকাশ আরেকটু ফর্সা হতে উঠে পড়ে ইব্রাহিম। বশির তখনো ঘুমে। দূরে দেখা যায় বাংলাদেশী টহল বোট। আর পেছনে আরো দূরে বর্মী পাহাড় আর ঝোপঝাড়। বাঁ পাশে কাঁটাতারের বেড়া। : বশির, উইঠা পড় ভাই। একটা ঝোপের আড়ালো যাইতে হইব। এই হানে থাকন যাইব না, রইদ যেভাবে চড়তাছে। ইব্রাহিম বশিরকে লক্ষ্য করে বলে। অন্যান্য নারী পুরুষ শিশুরাও উঠতে শুরু করেছে। বশির উঠি উঠি করেও আবার পাশ ফিরে শোয়। যেন তাদের আকিয়াবের বাড়িতে শুয়ে আছে। তার পাশে তহমিনা এইমাত্র শুয়েছে। নিজেদের জীবনের ওপর ঘেন্না ধরে যায় ইব্রাহিমের। এর নাম জীবন? এর নাম বেঁচে থাকা? থুক। কোথায় বাবা, দাদা, কোথায় মা, বড় দু’ ভাই লোকমান আর ফরমান? আর কোথায় তারা অনাথ তিন ভাইবোন? গাটা রিরি করে ওঠে। সব ঠিকঠাক থাকলে ও এ বছর ক্লাস সিক্সে উঠতো। হাইস্কুলে। কি থেকে কি হয়ে গেল। কেউ একটা লাঠি ধরলো না প্রতিবাদ করলো না? হায় আল্লাহ। জাতিসংঘ কি দেখে না। বিশ্বের কেউ কি নেই এই অসহায়দের জন্য। স্বগতোক্তি করে ইব্রাহিম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে ভেতর থেকে। চোখ থেকে দরদরিয়ে পানি পড়ছে। ইব্রাহিম কতটুকুন মানুষ? তার এখন খেলাধুলার বয়স, স্কুলে লেখাপড়ার বয়স। তা না- এখন জীবন বাঁচানোর জন্য লড়ে চলেছে প্রাণপণ। কি পাপ করেছে রোহিঙ্গারা? কার পাপে দশ বারো লাখ আদম সন্তানের এই হাল।

৬. দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে। সকালে বাংলাদেশের সেনারা এসে কিছু খাবার দিয়ে গেছে। সেগুলো খেয়ে সবাই হালকা ফিকে হয়ে আসা রোদের মধ্যে বসে আছে। এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, নাফ নদীর কাছে মনে হচ্ছে কোন খবর নেই। খরতর বেগে সে আপন মনে বয়েই চলেছে। মানুষের জীবন মরণ কান্না তাতে তার কি আসে যায়? পৃথিবীতে সত্যি অর্থে কে কার? নদীর কান্নাই বা কয়জন শোনে। নাফের কোথাও স্বাভাবিক পানি, দক্ষিণে সমুদ্রের ধারে নীল পানি আর কোথাও কোথাও মানুষের রক্তের আভায় লালচে রং ধরেছে। দূরে দেখা যায় জাহাজ যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের না মিয়ানমারের বোঝার উপায় নেই। অন্য সবার সঙ্গে তহমিনাও বসে আছে। মনটা একটু উৎফুল্ল। শোনা যাচ্ছে তাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হতে পারে আজ। গভীর রাতে পাড়ি দিতে হবে পথ, নাফ নদী। : বশির ছালার বস্তা জামা কাপড় আর পোঁটলা পুঁটলি গুছিয়ে রাখ। বশিরকে বলে তহমিনা। : কেন আপু? জানতে চায় বশির। : সেইডা তক্ষণই বুঝবার পারবি। : বল না তবু একটু। : যা শুনছি তা কি সত্যি রে বুজি? ইব্রাহিমও প্রশ্ন করে। : হ্যাঁ, চুপচাপ বইসা থাক। যখন হইব দেখতেই পাবি। কথা আর আগায় না। একটা রহস্য থেকেই যায় দুই ভাইয়ের মনে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। চরের মাঝখানটায়- যাকে বলে নো ম্যানস ল্যান্ড, সেখানকার বাসিন্দারা এখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আজ কারো চোখে ঘুম নেই। কি জানি কি হয়। ওদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার খবর গেছে দূরে মিয়ানমার সেনা ও বর্ডার পুলিশ ক্যাম্পেও। একজন সাধারণ সেপাই বললো- : যাক ভালোই হয়েছে, আপদ বিদায় হচ্ছে। : বিদায় হচ্ছে না ছাই। এগুলো ঠিকই এক সময় ফিরে আসবে। বললেন ওদের ওয়ারেন্ট অফিসার মিন ইউ খিন। : জি স্যার। তো কি করতে হবে স্যার। স্যালুট মেরে প্রশ্ন করে সেপাই অং কিন মিন্ট। : ওপর থেকে অর্ডার হয়েছে, কিল দেম। গোলার আঘাতে যে কটাকে পারো শেষ করে দাও। সাপের বাচ্চাও রাখতে নেই। ওরা আমাদের বহু দিনের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। : ইয়েস স্যার। বলে আবার স্যালুট দেয় মিন্ট। ভোর চারটা। একটা বড় নৌকা ভিড়ে আছে চরের পশ্চিম তীরে। একে একে সবাই উঠে বসছে নৌকায়। গন্তব্য নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির। এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায়। হোক না খাঁচা! জীবন তো বাঁচবে। ভাবে ওরা। আচমকা পূবের পাহাড়ের দিক থেকে গোলার আঘাত শুরু হলো। গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে মিয়ানমার বাহিনী। যে যার মতো নিরাপদ হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে নো ম্যান্স ল্যান্ডের রোহিঙ্গারা। একটা গোলার আঘাত তহমিনার দেহ ভেদ করে চলে যায়। লুটিয়ে পড়ে তহমিনা। রক্তে লাল নো ম্যান্স ল্যান্ড। আরো কয়েক জনের একই করুণ দশা। একি হলো? তীরে এসে তরী ডুবলো? দৌড়ে কোন রকমে নৌকায় উঠলো ইব্রাহিম ও বশির, সাথে আমিনা ফুপু। গুলির পর গুলি চলছে, গোলার আঘাত এসে পড়ছে পানিতে। এক সময় নৌকা ছেড়ে দিল। নিকষ কালো অন্ধকারে নৌকা এগিয়ে চলেছে নাফের বুক চিরে। পেছনে পড়ে রইল কয়েকটি লাশ। বুবু বুবু আপু আপু বলে ইব্রাহিম ও বশির কাঁদছে। কাঁদছে সবাই। কাঁদছে মানবতা। ওপার থেকে তখনো মর্টার আর মেশিনগানের গোলাগুলি নিক্ষেপ করে চলেছে মিয়ানমার বাহিনী।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ