কাগজের ফুল

কাগজের ফুল

গল্প এপ্রিল ২০১৫

তমসুর হোসেন#

নিলয় ভেবেছে এবার স্বাধীনতা দিবসে শহীদ মিনারে নিজের বাগানের ফুল দেবে। সে বন্ধুদের বলেছে ‘বন্ধু সংঘের’ পক্ষ থেকে বড়দের সাথে ফুলের ডালা দেবে তারা। তার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছে বন্ধুরা। সোহেল তো মুখের ওপর বলেই ফেলেছে, ‘ডালা দিতে চাও। ফুল পাবে কোথায়?’ ‘সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। ফুল আমি দেবো।’ জোর দিয়ে কথাটা বলেছে নিলয়। ‘ফুল দেবে মানে? তুমি কি ফুলের ব্যবসা করো?’ খোঁচা দিয়ে বলে সুশান্ত। ‘যারা ফুল দেবে তারা বুঝি ব্যবসা করে?’ সুশান্তের প্রশ্নের জবাবে বলে নিলয়। নিলয়কে ধরে বসলো বন্ধুরা। কোথায় পাবে সে ফুল। গতবার তারা সারা শহরে তন্নতন্ন করে ফুল খুঁজেছে। কোথাও ফুল পায়নি। যেখানে ফুল সেখানেই কড়া পাহারা। এক ডাক্তারের বাগানে কোন পাহারাদার দেখতে না পেয়ে তারা গেট খুলে প্রবেশ করে। একটা বুড়ো যে পাশের খুপরিতে লুকিয়ে ছিলো তা তারা টেরই পায়নি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে যেই তারা চন্দ্রমল্লিকার ঝোপে ঢুকে পড়েছে অমনি বুড়োটা হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে- ‘কে রে ওখানে? একটুও নড়বিনে। নড়লে ভালো হবে না।’ বুড়োর গলা শুনে যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। কিন্তু নিলয় পালানোর সুযোগ পেলো না। কানটুপি আর মোটা মাফলারে মাথা ঢেকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেঁটে এসে বুড়োটা ওর হাত চেপে ধরলো। ‘এই পুচকে পালাবে কোথায়। ফুল চুরি করে শহীদ মিনারে দেবে?’ ‘আমি আসতে চাইনি। ওরা ডেকে এনেছে।’ ‘চলো সাহেবের কাছে। তাইতো বলি বাগানের ফুল যায় কোথায়।’ ‘আর কোনদিন আসবো না। যদি দেখেন তখন বলবেন।’ ‘ওসব বলে লাভ নেই। আগে সাহেবের কাছে যাই। পরে কথা হবে।’ ভয়ে কুঁকড়ে গেল নিলয়। এমন বিপদে সে কোনদিন পড়েনি। যদি থানায় দেয় তখন কী হবে। মা তো সে কথা জানবেই না। সে অনুনয় করে বলতে লাগলো, ‘এই যে কাকু। আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন।’ ‘আমার নকরি খাবে আর আমি ছাড়বো। আমি তা পারবো না।’ ওকে একা ফেলে যেয়ে বন্ধুরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লো। ওকে ফেলে যাওয়া কি ঠিক হয়েছে। পরামর্শ করলো কী করে নিলয়কে মুক্ত করা যায়। পকেটে  ছাই ভর্তি করে নিলো সবাই। তারপর সাহস করে বাগানের কাছে ফিরে এলো তারা। ওরা দেখতে পেলো বুড়োটা নিলয়কে নিয়ে যাচ্ছে তার মালিকের কাছে। ওরা মিনতি করে একযোগে বলতে লাগলো, ‘কাকু, ফুল নষ্ট করি না আমরা। শহীদ মিনারে দেই।’ ‘বলে কোনো কাজ হবে না। সকলকে আমি জেলে দেবো।’ ‘আমরা ছোটো মানুষ। জেলে দিয়ে কী করবেন।’ ‘বড় কাজ করে বসে আছো। আর বলছো ছোটো মানুষ। চাবুক খেলে সব ঠিক হবে।’ বুড়োটার চোখে ওরা ছাই ছিটিয়ে দিলো। ছাইয়ের যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে লাগলো। এই সুযোগে পালিয়ে এলো তারা। ওদের উদ্দেশ্য বুড়োটা চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ভিটেয় বাগান নেই মিনারে ফুল দেবে। চোরের বাচ্চা। আর একদিন এলে মুখে জুতা ঢুকাবো।’ বুড়োটার কথায় নিলয়ের মন বিষিয়ে গেলো। কী দরকার ছিলো এসব করার। চুরি করা ফুলে কি শহীদের আত্মার কল্যাণ হবে? সেদিন সে প্রতিজ্ঞা করেছে যেমন করে হোক ফুলের বাগান করবে। মাকে বলে কিচেনের পাশে ফুলের চারা লাগিয়েছে সে। জবা, টগর, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, গাঁদা এবং গোলাপ ফুলে তার বাগান ভরে গেছে। বন্ধুদের ডেকে বাগানটা দেখালো নিলয়। তার প্রতিজ্ঞার কথাও তাদের জানালো সে। সবাই অবাক হলো ওর কান্ড দেখে। সুশান্ত বললো, ‘আমাদের বলিস ্নি কেন? আমরা কি তোর শত্রু?’ ‘ইচ্ছে ছিলো তোদের অবাক করবো।’ বিনয়ের সাথে বললো নিলয়। ‘বাড়ির ফুলে মিনারে শ্রদ্ধা জানাবো। ভাবতে বেশ লাগছে।’ খুশিতে গদগদ হয়ে বললো সোহেল। ডালা সাজাতে কি করা দরকার ওরা জানে না। ডালার ভেতরে ‘বন্ধু সংঘের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি’ কথাটা লিখে দিতে হবে। সীমান্ত আর্টের সজলদাকে এ সম্পর্কে  কিছুই বলা হয়নি। ডালায় কেমন করে ফুলের বিন্যাস করতে হয় তাও তারা জানে না। এসব বিষয়ে পারদর্শী তাদের সংঘে কেউ নেই। বেশ ঝামেলায় পড়ে গেল তারা। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে কাজ ভাগ করে নিয়ে দু’জন দু’জন করে তারা বেরিয়ে পড়লো। রাত দশটার মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ না হলে শহীদ মিনারে উপস্থিত হওয়া যাবে না। মাকে বাগানের দিকে নজর রাখতে বলে বন্ধুদের সাথে বাইরে গেলো নিলয়। ফিরে এসে বাগান দেখে সে হতবাক হয়ে গেলো। একটি ফুলও নেই বাগানে। কারা যেন সব গাছ উপড়ে নিয়ে গেছে। এখন কী হবে! কি দিয়ে তারা ডালা সাজাবে। হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো নিলয়। কত কষ্ট করে ফুলের চাষ করেছে সে। কে তার সব স্বপ্ন বিফল করে দিলো? নিলয়ের কান্না থামাতে ব্যর্থ হয়ে বাবাকে মোবাইল করলেন মা। ‘ওগো শুনছো। সব ফুল চুরি হয়ে গেছে।’ ‘কী বলো। কে এমন কাজ করলো? তোমরা কি ঘুমিয়ে ছিলে?’ ‘আমি তো জেগেই আছি। মন্টু তো বারান্দায় বসে কাজ করছিলো।’ ‘এখন কী হবে? ওকে কি থামানো যাবে?’ ‘তুমি জলদি এসে ওকে থামাও।’ বাবা এসে নিলয়কে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ওকে অনেক করে বুঝালেন। ওর কাজে শহীদের আত্মা শান্তি পেয়েছে। শহীদরা তো জীবিত। তারা কোনদিন মরে না। তারা বেহেশতের মধ্যে পরম আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। ফুল দিয়ে ওদের শ্রদ্ধা জানানো বাহ্যিকতা ছাড়া কিছু নয়। আসল কাজ হলো আল্লাহর কাছে তাদের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করা। সে কাজ ক’জন করে। সবাই তো মেতে থাকে লোকদেখানো কাজে। মফস্বল শহরে বাজারে ফুল কিনতে পাওয়া যায় না। বাবা মন্টুকে পাঠিয়ে রঙিন কাগজ এবং ফুলের কারিগরকে ডেকে আনলেন। লোকটার নাম শেখ ফজল। আঙিনায় পাটি বিছিয়ে তিনি লাল নীল হলুদ এবং গোলাপি রঙের কাগজ কেটে ফুল বানাতে লাগলেন। সেই ফুল একত্র করে তিনি মনের মতো একখানা ডালা সাজালেন। খুব সুন্দর ফুল বানাতে পারেন শেখ ফজল। তার কাজ দেখে সবাই খুব খুশি হলো। নকল ফুলের কারুকার্য দেখে নিলয় এবং তার বন্ধুরা আনন্দে নাচতে লাগলো। গভীর রাতে তোপধ্বনি হওয়ার সাথে সাথে বাবা শহীদ মিনারে চললেন নিলয় এবং তার বন্ধুদের  নিয়ে। সেখানে সবাই ফুল দিয়ে হৃদয়ের নির্মল শ্রদ্ধা তুলে ধরছে শহীদদের উদ্দেশে। বাবার সাথে হাত মিলিয়ে তারা শহীদ মিনারে ফুলের ডালা বিছিয়ে দিলো। সব ফুলের মাঝে অনন্য হয়ে থাকলো নিলয়ের দেয়া বিচিত্র কাগজের ফুল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ