কাজলের শরবত

কাজলের শরবত

গল্প জুলাই ২০১৫

আহমদ বাসির#

চৌরাস্তার এক কোনায় লেবু মিয়ার অস্থায়ী শরবতের দোকানটিতে প্রচন্ড ভিড়। এক গ্লাস শরবত খাওয়ার জন্য লোকজন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের এই খরতপ্ত ভর দুপুর বেলায় প্রচন্ড গরমে গোটা নগরী জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে।  মানুষ কোথাও তিষ্ঠাতে পারছে না। তবুও জীবনের তাগিদে ছুটছে সবাই। ছুটতে ছুটতে চৌরাস্তার এই কোনায় এসে যারা হাঁপিয়ে উঠছে, লেবু মিয়ার চটকদার বিজ্ঞাপন শুনে তারাই ভিড় জমাচ্ছে, এক গ্লাস শরবত খেয়ে প্রাণটা ঠান্ডা করার লোভে। লেবু মিয়ার হাত মেশিনের চাইতেও নিখুঁত তালে, দ্রুত গতিতে কাজ করছে। বড় বড় দু’টি মগ দুই হাতে নিয়ে একটা থেকে আরেকটায় ঢেলে সে শরবত তৈরি করছে। প্রতিবারে দশ গ্লাস শরবত তৈরি হচ্ছে। বরফ পানির ঠান্ডা শরবতে গ্লাসগুলো পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে অপেক্ষমাণ একেক জনের হাতে তুলে দিচ্ছে বারো তেরো বছর বয়সী একটি ছেলে। আরেক পাশে সমবয়সী আরেকটি ছেলে খালি হয়ে যাওয়া গ্লাসগুলো ধুয়ে লেবু মিয়ার সামনে রাখছে। লেবু মিয়া ক্রমাগত সেগুলো পূর্ণ করেই চলেছে।
এভাবেই চলছে দিনের পরদিন। ফাল্গুন মাসে এই শরবত বিক্রি শুরু হয়েছে। আবার শীত আসার আগ পর্যন্ত লেবু মিয়া শরবত বিক্রি করবে। তারপর দোকানের চেহারা বদলে যাবে। বিক্রি হবে সিদ্ধ ডিম আর গরম দুধ। সারা বছর লেবু মিয়ার সহযোগী মূলত একজন। যে ছেলেটা শরবতের ভরা গ্লাসগুলো অপেক্ষমাণ লোকদের হাতে তুলে দেয় এবং তাদের কাছ থেকে শরবতের দাম বুঝে নেয় সেই ছেলেটা ইদানীং এসে ঝুটেছে। নাম কাজল। অবশ্য কাজলের কাছে কেউ ওর নাম জানতে চাইলে ও কখনোই শুধু ‘কাজল’ বলে পরিচয় দেয় না। নিজের পুরা নামটাই সে সবাইকে জানিয়ে দেয়। আরিফুর রহমান কাজল। লেবু মিয়া এ কারণেই  মাঝে মাঝে কিছুটা ব্যঙ্গচ্ছলে কাজলকে পুরো নাম ধরে ডাকে। কাজল লেবু মিয়ার কাজ করে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত। গত পনের দিন ধরে কাজ করছে কাজল। এখনও কোন টাকা-পয়সা দেয়নি লেবু মিয়া। প্রতিদিন দুপুরে নিজের ঘর থেকে রান্না করে আনা খাবার খাওয়ায় কাজলকে। এর সঙ্গে প্রতিদিন কুড়ি টাকা করে দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেয় লেবু মিয়া। কাজল মাঝে মাঝে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়লেও কাজে ফাঁকি দেয় না। এ জন্য লেবু মিয়া খুবই খুশি। অল্প ক’দিন হলো কাজলের বাপ মারা গেছে। দুই মাসও পার হয়নি, তিন ভাইবোনের মধ্যে কাজল বড়। ওর ছোট একটি ভাই, আরেকটি বোন। কাজলের বাপ আব্দুল করিম তিন ভাইবোনকেই পড়তে দিয়েছে একটি এনজিওর স্কুলে। ওখানে খরচপাতি কিছু নেই। এ সুযোগটা না থাকলে বাচ্চাদের স্কুলের পড়ানোর অবস্থা তার ছিল না। একটি ভাড়া রিকশা চালিয়ে পাঁচজন মানুষের সংসার চালাতো সে। খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেতে হতো তাকে।  বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো কাজলরা।  আবদুল করিম তার সামান্য জমানো টাকা আর কিছু ধার-দেনা করে মাস ছয়েক হলো একটি ঘরও কিনেছে। ঘরটির কিছুটা সংস্কার করে সেখানেই বসবাস করছে কাজলরা। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই  মিলেছে। কিন্তু এরই মধ্যে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুতে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে কাজলের মা আফিয়া বানু। ঘরে বসে থাকার উপায় নেই তার। স্বামীর এক রিকশাওয়ালা বন্ধুর সাহায্যে কিকশাওয়ালাদের কয়েকটি মেসে রান্না করার কাজ জুটেছে কাজলের মার। তার ইচ্ছা কষ্টে-সৃষ্টে ছেলেমেয়েগুলোকে দু’কলম লেখাপড়া শেখানো। সকালে ডাল ভাত একটা কিছু রান্না করে ওদেরকে স্কুলে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে সে কাজে বেরিয়ে যায়।  সারা দিন ওদের খোঁজ-খবর নেয়ার সুযোগ তার থাকে না। এই সুযোগে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে কাজল। মাকে সে কোন কাজ করতে দিতে চায় না। কিন্তু এখনই সে কথা মাকে জানানোর কোন উপায় নেই। মা শুনলে চটে যাবে। এদিকে ভাইবোনদেরও কাজল নিষেধ করে দিয়েছে, সে যে স্কুলে যায় না এ কথাটি ওরা যেন মাকে বলে না দেয়।
অনেক ঘোরাঘুরি করে লেবু মিয়ার শরবতের দোকানে কাজ পেয়েছে কাজল। লেবু মিয়ার সাথে কথা বলা আছে, অর্ধেক মাসের টাকা যেন তাকে এক সঙ্গে দেয়া হয়। সে হিসেবে কাজলের আজ পনের দিন পূর্ণ হবে। এক সঙ্গে তিনশ টাকা হাতে পাবে কাজল। কিছুটা উত্তেজনার মধ্যে আছে সে। গত পনের দিন ধরে কোমল হৃদয়ে তিল তিল করে সে একটি স্বপ্ন বুনেছে। মায়ের হাতে তিনশ টাকা তুলে দিয়ে সেই স্বপ্নের কথাটি সে তার মাকে জানাতে চায়। চারটা বেজে গেছে। লেবু মিয়া তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছে। অপেক্ষা করতে কাজলের কোন সমস্যা নেই। সন্ধ্যার আগে আগে মা ঘরে ফিরবে। সন্ধ্যার পরে গেলেই চলবে কাজলের। লেবু মিয়ার দোকানে কাস্টমারের ভিড় এখন অতটা না থাকলেও উপস্থিত কাস্টমারদের বিদায় দিয়েই কাজলকে টাকা দিবে লেবু মিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যে শরবত বিক্রিতে সাময়িক ছেদ পড়ে। কারণ শেষ কাস্টমারটি শরবত খেয়ে টাকা দিয়ে বিদায় হয়েছে।  লেবু মিয়ার হাত খালি হয়েছে। সে তাকায় কাজলের দিকে,
- ও, কাজল, আরিফুর রহমান কাজল, টাকাটা নিয়ে আবার কোন আকাম-কুকাম করবা নাতো?
আকাম-কুকামের কথা শুনে কাজলের মুখ কালো হয়ে যায়। তাই দেখে হি-হি করে হেসে ওঠে  লেবু মিয়া। হাসতে হাসতেই বলে,
- ও হো, বুঝছি, বুঝছি, তুমি খুব ভালো পোলা। তা টাকাটা পাইয়া আমার কাজটা ছাইড়া দিবা না’ত।
লেবু মিয়ার কথা শুনে চমকে ওঠে কাজল। কাজলের মনের কথা লেবু মিয়া কিছু বুঝে ফেলল নাকি। কাজলকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লেবু মিয়া আবারও বলে ওঠে,
- থাক, থাক, আসো না আসো সেইটা তোমার ব্যাপার। তবে তোমার কাজ আমার খুব পছন্দ হইছে।  ধরো, ধরো, টাকাটা নিয়া মায়ের হাতে দিবা, নষ্ট করবা না।
কাজল লেবু মিয়ার বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে হাত বাড়িয়ে একশ টাকার নোট তিনটি হাতে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার গোটা শরীরে অন্যরকম এক পুলক ছড়িয়ে পড়ে। ঠোঁটের কোণে তার অজান্তেই এক টুকরা হাসির ঝিলিক ওঠে। লেবু মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় কাজল।
মায়ের মুখোমুখি হতে ভয় করে কাজলের। দুরু দুরু বুকে মাকে ডাকে সে মা ও মা, শুনছো? সারা দিনের ক্লান্তি ঝাড়া গোসল সেরে দিয়ে আড়াআড়ি হয়ে বিছানার ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল আফিয়া বানু। এ বিছানাতেই  সে তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমায়। ছেলের ডাকে পাশ ফিরে শোয় আফিয়া বানু। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- কী বলবি, বল
- মা, আগে এই টাকাটা রাখো, তারপর সব বলছি।
- টাকা পাইলি কই?
- আমি কাজ করে রুজি করছি মা।
ছেলের অবাক করা কথা শুনে উঠে বসে আফিয়া বানু। একসঙ্গে তিনশ টাকা এই ছেলে কেমন করে রুজি করবে, গম্ভীর হয়ে আফিয়া বানু জানতে চায়- কী কাজ কইরা রুজি করলি তুই? মা যতটা উত্তেজিত হবে ভেবেছিল ততটা হয়নি দেখে কাজল সাহসী হয়ে ওঠে। সব কথা খুলে বলে মাকে।  শুনে অবাক হয়ে যায় আফিয়া বানু। বেশি অবাক হয় ছেলের পরিকল্পনার কথা শুনে। খুশি হয় আফিয়া বানু। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আদর করে জানতে চায়- তাহলে তোর লেখাপড়ার কী অইব বাপজান।
- আমি লেখাপড়া করমু মা। ভোর সকালে আর বিকালে শরবত বেচুম আর দিনে স্কুলে যামু, রাইতে লেখাপড়া করমু।
ছেলের কথা শুনে বিস্মত ও আশ্বস্ত হয় আফিয়া বানু।
কাজল লেবু মিয়ার কাছে আর যায়নি। শরবত বানানোর সব নিয়মকানুন সে শিখেছে। লেবু মিয়ার কাছ থেকে নয়, রাস্তায় পাওয়া একটি পত্রিকার পাতা থেকে। সেখানে সকাল বিকাল পান করার উপযোগী দু’টি উপকারী শরবতের রেসিপি দেয়া হয়েছে। এনজিও স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র কাজল বাংলা ভালোই পড়তে পারে। পত্রিকার লেখা পড়তে তার অসুবিধা হয়নি। খুবই সহজ উপায়ে এ শরবত তৈরি করা যায় কিন্তু পত্রিকায় এ শরবতের অসাধারণ গুণাগুণ লেখা আছে। পত্রিকার পাতাটি যতœ করে রেখে দিয়েছে কাজল। তবে এ কথা মানতেই হবে, লেবু মিয়ার শরবতের দোকানে কাজ করার কারণেই পত্রিকার পাতায় ছাপা শরবতের গ্লাসের দিকে চোখ পড়েছে কাজলের।  কাজলও মনে মনে এ কথা স্বীকার করে।
কাজল নিজেই শরবত বানিয়ে সকাল-বিকেল বিক্রি করবে। আশপাশের রাস্তার যে মোড়টিতে মানুষের চলাচল বেশি সেখানে গিয়ে বসলেই হবে। একটি ড্রাম ও দু’টি কলসিতে তৈরি  থাকবে শরবত। একবার তৈরি করা শরবত স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চব্বিশ ঘণ্টা খাওয়ার উপযোগী থাকবে। কোন সমস্যা নেই। রোজ দুই শ’ গ্লাস শরবত বিক্রি হলে চার শ’ টাকার মতো লাভ হবে। প্রতি গ্লাস শরবতের দাম পড়বে পাঁচ টাকা। সব পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে কাজল। আফিয়া বানু সব রকম সাহায্য করে। কয়েকদিনের মধ্যেই একটি ছোটখাটো পানির ড্রাম, দু’টি কলসি, দু’টি বড় মগ আর ডজনখানেক কাচের গ্লাসের ব্যবস্থা হয়। বিজ্ঞাপনের জন্য পত্রিকার বড় পাতাটিও লেমিনেট করে রাখে কাজল। ড্রামের ওপর রাখা থাকবে। যার ইচ্ছা হয় সে পড়বে।
ভোর রাতে জেগে মায়ে-পুতে মিলে শরবত তৈরি করে। সকালে অতি কষ্টে ঘাড়ে করে মায়ে-পুতে ড্রাম কলসি নিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। একটি পরিষ্কার প্লাস্টিক বিছিয়ে তার ওপর গ্লাসগুলো রাখা হয়। পাশেই রাখা হয় ড্রাম আর কলসি দু’টি। লোকজন তেমন নেই। দু-একটি গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে। ভ্যানগাড়ি আর রিকশা দেখা যাচ্ছে দু-চারটি। হঠাৎই একটি গাড়ি এসে ব্রেক কষে মোড়টিতে। লাফিয়ে নেমে আসে গাড়ির হেলপার। যাত্রী নেই।
- এই পিচ্চি, দুই গ্লাস শরবত দে, তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর, তেল ভরাইতে যাইতে অইব। দুই গ্লাস কয় টাকারে।
হেলপার কাজলের সামনে দাঁড়িয়ে একটানা বলে গেল। কাজল তার কাস্টমার পেয়ে অভিভূত।  তাড়াতাড়ি কলসি থেকে মগে শরবত নিয়ে গ্লাস ভরতে ভরতে সে জবা দেয়,
- দশ টাকা, মামা,
হেলপারটি দশ টাকা নোট ছুড়ে দিয়ে গ্লাস দু’টি নিয়ে গাড়ির দিকে উঠতে উঠতে বিদ্রƒপ করল কাজলকে।
- আরে হালায়, আমি তোর মামা অইলাম কবেরে? কাজল কোন জবাব দেয় না। এক তরাসে ড্রাইভার আর হেলপার গ্লাস দু’টি সাবাড় করে দ্রুত ফেরত দিয়ে হেলপারটি উঠে পড়ে গাড়িতে। সাঁই সাঁই করে ছুটে যায় গাড়িটি। দশ টাকা নোটটি মায়ের হাতে তুলে দিতে গিয়ে গাড়ির পিছু পিছু চোখ দু’টি ছুটে যায় কাজলের। মনে মনে ভাবে, যাত্রা কাস্টমারের কাছে শরবতের স্বাদটা জানা গেল না। একটি আফসোস জেগে ওঠে মনে। এরই মধ্যে আরও দু’জন এগিয়ে আসে কাজলের শরবত খেতে। ঘণ্টা পার হতে না হতেই কাজলের চার ভাগের তিন ভাগ শরবত বিক্রি হয়ে গেছে। কাজল  কয়েকবার বিড়বিড় আলহামদুলিল্লাহ উচ্চরণ করে। মনে মনে বলে, আল্লাহ তুমিই দিতাছ আমারে, আল্লাহ তুমিই দিতাছ আমারে। তোমার অনেক শোকর আল্লাহ। আফিয়া বানুও খুশি। ছেলেকে সাহায্য করে। মুখে কিছু বলে না। মনে মনে আল্লাহর শোকর আদায় করে।
শরবত বিক্রি হতে থাকে। বিক্রি হতে থাকলে তো শেষ হবেই। কাজলের শরবতও প্রায় শেষ। কলসির তলায় আর মাত্র দু’তিন গ্লাস শরবত পড়ে আছে। কাজল একটি গর্বিত গর্বিত ভাব নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের খুশিটাও সে টের পায়। বাপটা বেঁচে থাকতে মাকে কোনদিন কারো কাজ করতে হয়নি। এখন কিনা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাকে পরের জন্য খাটতে হয়। আল্লাহর রহমতে এখন থেকে আর পরের জন্য খাটতে  হবে না। মায়ে পুতে  ব্যবসা করে খাব, আনন্দ-বেদনা একসঙ্গে কাজলের চোখের কোণে পানি নিয়ে আসে। মা সে পানি দেখে ফেললে ভয়ে সরাসরি রাস্তার দিকে চোখ ফেরায় কাজল। চার-পাঁচটা ছেলে রাস্তা পার হয়ে এ পাড়ে আসছে। কাজলের মনোযোগ ওদের দিকে চলে যায়। ওরা যদি শরবত খেতে চায় তাহলে তো সবাড় হবে না। ছেলেগুলো এসে কাজলের সামনে দাঁড়ায়। পাশে  দাঁড়ানো আফিয়া বানুর দিকে তাকায়। একটি ছেলে বলে ওঠে- কিরে, রাস্তাটা কী তোর বাপের? যেমন খুশি তেমন আইসা বইসা পড়বি আর বেইচ্যা-টেইচ্যা টেকা নিয়া ঘরে চইলা যাবি। আফিয়া বানুর দিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলে, ওই মহিলা, তুমিও কি পোলাপাইন নাকি! তুমি জানো না রাস্তায় বইতে অইলে টেকা দিয়া অনুমতি লইয়া বইতে অয়।
কাজল হতভম্ব হয়ে পড়ে। বাপ তুলে কথা বলায় ছেলেটার ওপর ওর মেজাজ চড়ে যায়। আফিয়া বানুর সাথেও খারাপ আচরণ করতে দেখে কাজল আর স্থির থাকতে পারে না। সে পাল্টা জবাব ছুড়ে দেয়- রাস্তা কারো বাপের না। আপনার বাপেরও না, আমার বাপেরও না। রাস্তা সরকারের। সরকার চাইতে আইলে আমি টাকা দিমু। আপনাগোরে দিমু কেন? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে কাজল। তড়াক করে ওঠে আরেকটি ছেলে, ওস্তাদ পোলাটার বাড় দেখছ। সাহসটা ওর কই উঠছে একবার চিন্তা করতে পারো। হালার কথা শুইনা এখনও চুপ কইরা রইছ কেন, দাও না একটা লাথি। কথা মুখ থেকে পড়তে দেরি হয়েছে কিন্তু লাথিটি পড়তে দেরি হয়নি। যেই ছেলেটি শুরুতে কথা বলেছে ওই লাথি মেরেছে। ওর লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে অন্য ছেলেগুলো কাজলের গ্লাস, শরবতের ড্রাম ও কলসিগুলোতে লাথি মারতে থাকে। আফিয়া বানু লাথি খেয়ে দূরে ছিটকে পড়া তার প্রাণের ধন কাজলকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়। কাজলের মাথার চামড়া রাস্তার পিচের সঙ্গে ঘষে চুলসহ চামড়া উঠে গিয়ে দরদর করে রক্ত ছুটেছে।  ছেলেগুলো  কেউ ড্রাম, কেউ কলসি হাতে আফিয়া বানু ও কাজলের ওপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপর্যুপরি আঘাতে আঘাতে দু’জনই যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে ছেলেগুলো তখন থামে। হাতের একেকটি জিনিস একেক দিকে ছুড়ে মারে। ছোড়ার সময় কলসি থেকে কাজলের শরবতের শেষ বিন্দুগুলোর ক’টি ছিটকে  এসে পড়ে কাজল ও আফিয়া বানুর চোখে মুখে, প্রায় চেতনাহীন কাজলের চোখ দু’টি খুলে যায়। বড় বড় চোখে সে উপরের দিতে তাকায়। আফিয়া বানু নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। মনে হয় পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে গেছে। কাজলের ঠোঁটের ওপর একফোঁটা শরবত এসে পড়েছে। জীব দিয়ে সে ঠোঁট  চাটে। বিড়বিড় করে উচ্চরণ করে-মা, আমার শরবত, মা গো আমার শরবত। মাত্র দু-এক মিনিটের মধ্যেই ঘটে ঘটনা। ছেলেগুলো আফিয়া বানুর হাতে থাকা ছোট ব্যাগটি থেকে শরবত বিক্রির টাকাগুলো বের করে নিয়ে সেটি ছুড়ে ফেলে দেয়। পথের ওপর পড়ে থাকা কাজল ও আফিয়া বানুর দিকে তাকিয়ে একটা ছেলে বলে ওঠে, দু’ই দিনের পোলা আমাগোরে সরকার শিখায়। সরকার  আমরা বানাই, আমরা চালাই। আমাগো কথা হুনবি নাতো এরমই খাবি। আর যেন এই রাস্তায় না দেখি তোগোরে। বইতে অইলে কথা কইয়া বইবি। চাঁদা দিবি, ব্যবসা করবি। ব্যাস, একজন আরেকজনকে টেনে নিয়ে ছেলেগুলো তড়িঘড়ি করে চলে যায়।
এরই মধ্যে জড়ো হয়ে যায় লোকজন, রাস্তার মোড়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আফিয়া বানু, পড়ে আছে আরিফুর রহমান কাজল। দু’জনকে ঘিরে লোকজন একটি বৃত্ত বানিয়ে ফেলেছে। একটি কাক সেই বৃত্তের মাথার ওপর ক্রমাগত কা কা করতে করতে কয়েকটি চক্কর মেরে কোথায় যেন চলে গেছে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ