কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙে ফুল’  -ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙে ফুল’ -ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

স্মরণ আগস্ট ২০১৮

ইংরেজি সাহিত্য ও বাংলাসাহিত্যের যুগ বা কালের মধ্যে বেশ পার্থক্য যা রীতিমত বিস্ময় লাগে। সে বিস্ময়ের প্রধান কারণ ইংরেজি সাহিত্যের যুগ বা কালকে ছোট ছোট যুগে চিহ্নিত করেছে যা সাহিত্য বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এ পরিবর্তন বাংলাসাহিত্যেও রয়েছে, তথাপি বাংলাসাহিত্যকে তিনটি মোটা দাগে বিভক্ত করে বাংলাসাহিত্যের অনেক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বৈশিষ্ট্যকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা খেয়াল করা যায়। ফলে অনেক যুগের মত বাংলাসাহিত্যে আলাদা করে কোন রোমান্টিক যুগ নেই। যদি পশ্চিমা সাহিত্যবিচারেও বাংলাসাহিত্যকে বিচার করি সেখানেও কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের কবিতা ও অন্যান্য সাহিত্যে রোমান্টিসিজমের অস্তিত্ব বেশ সুস্পষ্ট। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায় যে রোমান্টিসিজম্ রয়েছে তা আলোচনা করা হবে।
কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বিদ্রোহী’ বলে একপেশে যেমন করা হয় তেমনি শিশুদের মনে শৈশবকাল থেকে ভয় ধরিয়ে দেয়ার কালো তথা হীন চক্রান্তও খেয়াল করা যায়। ফলে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের যে বিচিত্রতা রয়েছে তা শিশুরা বুঝার চেষ্টা করে না। কাজী নজরুল ইসলামের বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি মানবতাকে ধারণ করেছেন এবং মানব স্বাধীনতাকে তিনি এগিয়ে নিতে ছোট-বড় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার সব চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যকে সমভাবে ধারণ করে বাংলাসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁর শিশুসাহিত্যে রোমান্টিসিজমকে বেশ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন, ফলে বাংলা শিশুসাহিত্য রোমান্টিসিজমকে নতুন করে জানান দিলো আমাদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যকে।
শুরুতে রোমান্টিসিজমের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো শিশুদের জানা দরকার, তবেই তারা বুঝতে পারবে কিভাবে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর শিশুসাহিত্যে রোমান্টিসিজম্রে নান্দনিক ব্যবহার করেছেন।
ইউরোপে ১৮ শতকের শুরুর সময়টি নিউ-ক্লাসিক্যাল যুগ বলা হয়। কিন্তু ১৮ শতকের মধ্যভাগ থেকে ক্রমান্বয়ে সাহিত্যের নতুন সুর প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয় বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কনসেপ্ট তথা ধারণা দিয়ে। নতুন ধারণার মধ্যে মানুষের বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য। এরপর ১৭৮৯ সালে রুশো, গডউইন প্রমুখ দার্শনিকগণের প্রচারিত নতুন আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ফরাসি বিপ্লব সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিপ্লবের মধ্যে মূলত সাধারণ জনগণ আলোচিত বিষয়ের মূলস্থানে স্থান পেয়েছে। ফলে বিশ্বসাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ ঐক্যবদ্ধভাবে সাহিত্যে নতুন রূপ সৃষ্টি করেছেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ১৭৯৮ সালে লিরিক্যাল ব্যালাড নামক একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা করেন। সে যুগের নাম হলো রোমান্টিসিজম্। রোমান্টিসিজম্ যুগ ১৭৯৮ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত। তাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- সাধারণ মানুষের ভাষা ও বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে কবিতা লেখা। কেননা, একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো সাধারণ জনগণ, যেখানে শহরের মানুষের সংখ্যা বড়জোর পাঁচ শতাংশ। তাই শহরের মানুষ পুরো জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। এ ছাড়া সব তুচ্ছ জিনিসকে অসাধারণভাবে তুলে ধরা যাতে সেগুলো মানুষের মনে রেখাপাত করে এবং নতুন করে গুরুত্ব পায়। এ যুগের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া। ওয়ার্ডওসায়ার্থ বিশ্বাস করেন প্রকৃতির প্রতিটি কণায় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব রয়েছে। এভাবে আরো বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
এ যুগের আরো দু’জন অন্যতম কবি হলেন পার্সি বিসি শেলি ও জন কিট্স। কিট্সের বিখ্যাত কবিতা হলো ‘টু অটাম’। এ কবিতায় তিনি অটামকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে পুরো পশ্চিমা বিশ্বের অটামকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা একেবারে শেষ হয়ে গেল। আবার ‘ওড অন আ গ্রিসিআর্ন’ কবিতা এক টুকরো ভাঙ্গা মাটির পাত্রকে নন্দনতত্ত্বের নান্দনিকতা দিয়ে পাঠকহৃদয়ে ঢুকিয়ে দিলেন যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। এসবের মূল কারণ প্রকৃতিতে তথা সৃষ্টিজগতে কোন কিছুই অবহেলার নয়।
কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতায় এর সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখা যায়। এর মধ্যে শিশুদের জন্য লেখা ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায় রোমান্টিসিজম্রে সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঝিঙে ফুলের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না। এ কবিতা প্রথমত, প্রকৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। দ্বিতীয়ত, তিনি অবহেলিত প্রকৃতির এক উপাদানকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে এ অবহেলিত জিনিসটি নতুনভাবে গুরুত্ব বহন করেছে। এ ছাড়া, ছন্দকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যেন প্রকৃতির এ উপাদানটির মাধ্যমে একটি বার্তা সুস্পষ্টভাবে পাঠককুলকে দেয়া হয়েছে, যা সৃষ্টিকর্তার গুণ প্রকাশ পেয়েছে। এবার কবিতাটির প্রতিটি শব্দের ব্যবহার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তবেই বুঝা যাবে শিশুদের কাজী নজরুল ইসলামের উদ্দেশ্য।
সাতাশ লাইনের চুরানব্বইটি শব্দ রয়েছে। এ কবিতায় বক্তা সরাসরি ‘ঝিঙে ফুল’-কে সম্বোধন করে কথা বলেছেন। শুরুতে ‘ঝিঙে ফুল’-কে দু’বার ডেকেছেন। ঝিঙে ফুলকে এদেশের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে বলেন ‘সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-ফুল’। অর্থাৎ এখানে তিনি তিনটি রঙ ‘সবুজ’, ‘ফিরোজিয়া’ ও ‘ফিঙে’-এর কথা বলে মূলত দু’টি কাজ করেছেন। এক, বাংলাদেশের প্রকৃতির বিভিন্ন রঙের বর্ণনা দিয়ে শিশুদের মনকে রঙিন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। দুই, প্রকৃতির এ বিচিত্র রঙের উপস্থিতি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। এ কবিতায় তিনি আরো কিছু রঙের উল্লেখ করেছেন। যেমন- ‘জাফরান’, ‘শ্যামলী’ ইত্যাদি।
রঙের বর্ণনার পাশাপাশি ঋতুর বর্ণনা দিয়েছেন, যেমন- ‘পউষ’। এ কবিতায় দেশকে নানাভাবে ও নানারূপে উপস্থাপন করেছেন। যেমন দেশকে কখনো ‘সবুজ পাতার দেশ’, আবার কখনো ‘পাতার দেশ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। স্বভাবসুলভভাবে তিনি এখানেও দেশকে ভালোবাসার আহ্বান করেছেন। তিনি শেষ স্তবকে বলেন, ‘তুমি বলো- ‘আমি হায়/ ভালোবাসি মাটি-মায়,/ চাই না ও অকায়-/ ভালো এই পথ-ভুল!’
যেহেতু শুরুতেই উল্লেখ করেছি রোমান্টিসিজম্রে মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রকৃতিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। এখানেও কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতিকে নান্দনিকভাবে তুলে ধরেছেন। কিট্সের ‘টু অটাম’ কবিতায় অটামের গানের বর্ণনা দিয়েছেন এবং সবাইকে জানান দিলেন এ ঋতু অন্য ঋতুর চেয়ে কোনোভাবেই সুরের দিক থেকে কম নয়। তেমনিভাবে কাজী নজরুল ইসলাম ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায় পউষের গানের কথা বলেন। আর গানের মূল হলো ফুল। আর ফুল ‘করে তোলে মশগুল’।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় কাজী নজরুল ইসলাম এমন এক প্রতিভাধর সাহিত্যিক তিনি যেমন নিজের দেশকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করেছেন তেমনি বিশ্বসাহিত্যের নানা রূপকে নিজের লেখায় ধারণ করে বাংলাসাহিত্যের বহুমাত্রিক রূপকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম এ কবিতার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যকে জানান দিলেন বাংলাসাহিত্যে বহুমাত্রিকতা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ