কৃতজ্ঞতা    -হাসবিতুল হাসান নিঝুম

কৃতজ্ঞতা -হাসবিতুল হাসান নিঝুম

তোমাদের গল্প নভেম্বর ২০১৫

‘ভাই, ভাড়াটা দেন।’
রবিন তাকিয়ে দেখল কথাটা বলেছে বাসের হেলপার। সে তার মানিব্যাগ বের করে ভাড়াটা দিয়ে দিল।
আজ সে ঢাকা থেকে গ্রামে নানাবাড়ি যাচ্ছে। নানাবাড়ি রানীগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত। ছবির মত সুন্দর গ্রামটা। রূপ দেখে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। গ্রাম তো নয়, যেন স্বর্গ!
এতদিন ঢাকা শহরে একা একা ঘুরতে বের হলেও ঢাকার বাইরে এখনও একা একা যায়নি। সাথে সবসময় আব্বু, আম্মু অথবা ছোট চাচা গিয়েছেন। তার মনে একা গ্রামের বাড়ি যাওয়ার শখ অনেক দিনের। এতদিন বাবা-মাকে বললেও তার কথার গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু গতকাল রাতে বলতেই কেন জানি রাজি হয়ে গেলেন।
রাজি হবেই বা না কেন? ওর বয়স এখন আঠারো। সবকিছুর দায়িত্ব এখন নিজে থেকেই নিতে হবে। এখন আর ওর দায়িত্ব কেউ নেবে না।
কেউ নেবে না।
বাসটা ঢাকা শহর ছেড়েছে। সে টিকেট না কেটেই বাসে উঠেছে। এ জন্য ভাড়াটাও বেশি দিতে হয়েছে। বাসে ওঠার কিছুক্ষণ পর যখন বাসের টিকেট দেখতে চাইল তখন সে দেখাতে পারল না। অবশেষে সে বলে দিয়েছিল, ‘ওকে। আরেকটু পরে আসেন, আমি ভাড়াটা একটু বেশিই দেবো।’
রবিন এখন বাসের জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছে। জায়গাটা দারুণ। সবেমাত্র বাসটা শহর ছেড়েছে। তাই জায়গাটায় শহরের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। কিন্তু সাথে সাথে গ্রামের ছাপ রয়েছে। গ্রাম আর শহরের কী অপূর্ব সংমিশ্রণ!
রবিন দৃশ্যটা উপভোগ করছে। এরকম দৃশ্য সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। তার পরম সৌভাগ্য যে, সে এটা অবলোকন করতে পারছে।
হঠাৎ তার সুন্দর মুহূর্তটা অসুন্দর হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল যে, তাদের বাসটা হঠাৎ বিকট রাগে যেন কেঁপে উঠল। বাসের সমনের দিকের কাচগুলো দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেল। ড্রাইভারের শরীরে কাচ বিঁধে রক্ত ছলকে উঠল। যাত্রী সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। সে সামনের সিটের সাথে মাথায় বাড়ি খেল। তারপর আবার ঝাঁকি দিয়ে তার মাথাটা জানালার কাচের সাথে বাড়ি খেল। রবিন আর কিছু দেখতে পেল না। তার চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো।
তাদের বাসটা আরেকটা বাসের সাথে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। কিছুক্ষণ পর রবিনের একটু জ্ঞান ফিরল। সে তার সামনে আবছা আবছা লাল রক্ত দেখতে পেল। ঘাড়টা কাত করে দেখল যে, বাসটা উল্টে পড়ে আছে। আর একজন গামছা বাঁধা কোমরে খাটো করে পরা লুঙ্গি এবং গেঞ্জি গায়ে গেঁয়ো লোক, তাকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে।
এরপর রবিনের আর কোন কিছুই মনে নেই।
রবিন চোখ মেলে তাকাল। সে নিজেকে একটা উন্নত হাসপাতালে আবিষ্কার করল। সে কিছুই বুঝতে পারল না। হঠাৎ তার সবকিছু মনে পড়ল। একজন ডাক্তার রবিনকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘রোগীর জ্ঞান ফিরে এসেছে।’ ডাক্তারের কথা শুনে বাইরে থেকে সবাই কান্নাভেজা চোখে হুড়মুড় করে চলে এলো। রবিন সবাইকে চিনতে পারল। বাবা, মা, নানা, ছোট চাচা, বড় মামা, বড় মামী, ছোট মামা, মামাতো বোন শানু, মামাতো ভাই শ্রাবণ-সবাই এসেছে।
রবিন ছোট চাচার কাছ থেকে জানতে পারে যে- সাতদিন পর আল্লাহর রহমতে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। সবাই ভেবে ছিল ও মারাই যাবে। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে?
সে আরও জানতে পারল শরীয়ত উল্লাহ নামে একজন রিকশাওয়ালা তাকে বাঁচিয়েছেন। অ্যাকসিডেন্টে যখন সে প্রায় মারা যাচ্ছিল, তখন শরীয়ত উল্লাহই তাকে হাসপাতালে এনেছেন। শুধু তাকে নয়, তার মতো অনেককেই এনেছেন কাছাকাছি হাসপাতালে। সেখানে ঐ রিকশাওয়ালা রবিনকে নিজের শরীর থেকে রক্ত দিয়েছেন। বাস উল্টে যখন একেবারে নাজেহাল অবস্থা, সব যাত্রীই চিপায় পড়ে আছেন, তখন শরীয়ত উল্লাহ তাদেরকে টেনে টেনে বের করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।
ঐ অ্যাকসিডেন্টে ঘটনাস্থলেই প্রায় দেড় শ’ এবং হাসপাতালে প্রায় এক শ’ লোক মারা গেছে। দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই বাস মিলিয়ে প্রায় আড়াই শ’ লোক মারা গেছে। বেঁচে ছিল সত্তর জনের মতো। রবিন ভাগ্যবান সত্তর জনের একজন।
রবিনের শরীরে এখন একজন রিকশাওয়ালার রক্ত বইছে, যাদের সে আগে ঘৃণা করত। এখন রিকশাওয়ালাদের জন্য ঘৃণা নয়, বরং কৃতজ্ঞতা জেগে ওঠে। কারণ ঐ জরুরি সময়ে তাকে না উদ্ধার করলে হয়তো সে মারাও যেতে পারত। তা ছাড়া, তাৎক্ষণিক রক্ত না পেলে তার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যেতো। রবিন তার ছোট চাচার কাছ থেকে অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটার নাম জেনে রেখেছে আলিমপুর।
কয়েক মাস পর।
রবিন এখন প্রতিদিন আলিমপুর আসে। সে পুরো গ্রামে (গ্রাম না বলে উপশহর বলাই ভালো) শরীয়ত উল্লাহ নামে রিকশাওয়ালাকে খোঁজে। সে তার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করে না। সে পত্রিকা থেকে ঐ রিকশাওয়ালার একটা ছবি কেটে রেখেছে। সে নিজেই এখন তাকে খোঁজে।
রবিনের বিশ্বাস একদিন না একদিন তার দেখা পাবেই। সে তাকে পেলে খুব বেশি কিছু চাইবে না, শুধু তার হাতে ধরে একটু ‘কৃতজ্ঞতা’ জানাবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ