কৈশোরে পুষ্টি

কৈশোরে পুষ্টি

স্বাস্থ্যকথা ডা. এহসানুল কবীর আগস্ট ২০২৩

সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত সময়সীমাকে কৈশোরকাল বলা হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০% কিশোর-কিশোরী। এই বাড়ন্ত সময়ে তাদের পুষ্টির চাহিদা থাকে প্রচুর। আর সেটা যদি তারা যথাসময়ে যথাযথভাবে না পায় তাহলেই তাদের পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয় এবং শুরু হয় নানান শারীরিক বিপত্তি। এই বয়সে তারা যদি সারাক্ষণ ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত, পড়াশুনায় অমনোযোগী থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে, তারা অপুষ্টিতে ভুগছে। আমাদের দেশে ৩৩% কিশোরী অপুষ্টি ও রক্তশূণ্যতায় ভুগছে। আবার বর্তমানে কিছু কিশোর-কিশোরী নিজেদের শরীরকে ফিট রাখার প্রবণতায় (জিরো ফিগার) ডায়েট কন্ট্রোল করতে গিয়ে পর্যাপ্ত খাবার খাচ্ছে না অথবা দীর্ঘ সময় পরে খাচ্ছে। এটাকে ‘ইটিং ডিজঅর্ডার’ বলা হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

বলাবাহুল্য, খাদ্যের ওপর দেহ গঠন কতখানি যে নির্ভর করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশ্চাত্যের কিশোর-তরুণরা প্রাচ্যের চেয়ে লম্বা হয়। তার কারণ শুধু বংশগত নয়, পুষ্টিগতও বটে। ইদানিং জাপানের কিশোর-তরুণরা উন্নততর খাদ্যব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে এখন অধিক লম্বা হচ্ছে। কৈশোরে সুস্বাস্থ্য মজবুত না হলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে পরবর্তী জীবনে।


✪ পুষ্টি বলতে কী বুঝায়?

দেহ সুস্থ ও সবল রাখার প্রক্রিয়াকে পুষ্টি বলে। দেহের শক্তির চাহিদা পূরণ, বৃদ্ধি, ক্ষয়পুরণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করাই হচ্ছে পুষ্টির লক্ষ্য। আর খাদ্যই হচ্ছে পুষ্টির প্রধান উপাদান। 


✪ কৈশোরে অপুষ্টির কারণ কী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ইদানিং স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের রক্তে হিমোগ্লোবিন ও ভিটামিনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। 

নিচে দৈনন্দিন কিছু রুটিন অভ্যাসের কারণে তারা ঠিকমত খেতে পারে না বিধায় অপুষ্টিতে ভোগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন-

- অনিয়মিত খাদ্যাভাস অর্থাৎ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে না খাওয়া। সকালে উঠেই না খেয়ে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে বাসায় এসেই খেলতে যাওয়া। দুপুর ও বিকেলে কোচিং সেন্টারে দৌড়ানো। সন্ধ্যার পরে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ার তাগাদা। সান্ধ্যকালিন নাস্তা করারই সময় পাচ্ছে না। 

- দোকানের অস্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিমানহীন খাবারের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকা। 

- প্রতিদিন একই ধরনের খাবার খেতে অনীহা। ফলে পুষ্টির ওপর সেটার বিরূপ প্রভাব পড়ে। 

- খাবারের পুষ্টিমান সম্বন্ধে অভিভাবকদের অজ্ঞতা ও দারিদ্রতা


✪ কৈশোরে অপুষ্টি হলে কী হয়?

- শারীরিক দূর্বলতা, স্নায়বিক দূর্বলতা

- ক্ষুধা লাগা অথবা বমি বমি ভাব 

- রক্তস্বল্পতা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন

- হাড়ের ক্ষয় (স্কার্ভি, রিকেটস)

- দাঁতের ক্ষয়রোগ

- ত্বকের শুষ্কতা ও রুক্ষতা

- চোখ জ্বালা, অন্ধত্ব   

- প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা (মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত হওয়া)

- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা (যার ফলে মুটিয়ে যাওয়া)

- অন্যান্য ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবজনিত রোগসমুহ


✪ কৈশোরে পুষ্টির জন্য করণীয়

খাদ্য, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খাদ্যের সহজলভ্যতা ও পুষ্টিমান বজায় রাখলেই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব। সরকারের ‘স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম’ সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যৌথভাবে ‘কৈশোরকালীন পুষ্টি’ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মূলত এ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো কিশোরবেলায় পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। ২০২২ সালের এপ্রিলে উদযাপিত পুষ্টি সপ্তাহের মূল প্রতিপাদ্য স্লোগান ছিল ‘সঠিক পুষ্টিতে সুষ্ঠু জীবন’। 

পুষ্টি সুরক্ষায় নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা উচিত। একজন কিশোরের প্রতিদিন তার শক্তি সরবরাহ, দেহের উচ্চতা এবং ওজন ঠিক রাখতে ১৮০০ থেকে ২৬০০ ক্যালরির প্রয়োজন হয়। অপরদিকে একজন কিশোরীর প্রয়োজন হয় ১৬০০ থেকে ২২০০ ক্যালরি। মনে রাখতে হবে যে, পেট ভরে খাওয়া মানে পুষ্টি না। বরং কিশোরবেলার খাদ্যতালিকা এমন হতে হবে যেন তাতে তাদের দেহের গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ, কর্ম ও মননশক্তি বৃদ্ধির সহায়ক হয়। তাই কিশোর-কিশোরীদের খাদ্যকে আকর্ষণীয় করতে তাদের পছন্দনীয়, তৃপ্তিকর ও রুচিশীল খাবার দিতে হবে যেটা হবে সহজপাচ্য ও সুষম খাবার। মনে রাখতে হবে, সুষম খাবার মানেই দামি খাবার নয়। সকালের নাস্তাটা ঠিকমত খেতে হবে। কারণ এটা তাদেরকে সারাদিনের পুষ্টির যোগান দেবে। তাদের হাড়ের বৃদ্ধি বা লম্বা হবার জন্য নিয়মিত ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার অর্থাৎ ডিম, দুধ, দই, পনির, কাটাযুক্ত ছোটো মাছ, পাতাওয়ালা সবুজ শাক ইত্যাদি খাওয়া উচিত। পেশীর বৃদ্ধির জন্য আমিষসমৃদ্ধ খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বাদাম ইত্যাদি খাবার খাওয়া উচিত। ভিটামিন-ডি প্রাপ্তির জন্য দৈনিক পাঁচ মিনিট রোদ পোহানো উচিত। অপরদিকে মুটিয়ে যাওয়া রোধের জন্য তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। এ সময় তাদের শরীরে পানিশূন্যতা থাকে বেশি, তাই বার বার পানি বা অন্যান্য পানীয় পান করা উচিত। বাইরের খাবারের প্রতি আসক্তি কমাতে হবে। কারণ এসব খাবারে মেওনিজ, সয়াসস, কেচাপ, মার্জারিন, টেস্টং সল্ট ইত্যাদি দেওয়ার ফলে মুখের স্বাদগ্রন্থির স্বভাবটাকেই চেঞ্জ করে দেয়। তখন ঘরের তৈরি খাবার আর ভালো লাগে না। অথচ এগুলো স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও ভালো নয়। সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাবার গ্রহণ করা উচিত। 

শারীরিক পরিশ্রম বাড়ানোর জন্য ঘরের কাজ বা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে। অপুষ্টি সম্পর্কে তাদেরকে ধারণা দিতে হবে। পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা দরকার। শরীরচর্চামূলক ক্রিয়াকলাপে নিয়মিত যুক্ত রাখতে হবে। যেহেতু খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে বাল্যকাল থেকে, তাই জীববিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে ‘পুষ্টিবিজ্ঞান’ নামক একটা অধ্যায় আবশ্যিক হিসেবে রাখা উচিত।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ