খলিল স্যারের স্মৃতি -মাহাথির আরাফাত

খলিল স্যারের স্মৃতি -মাহাথির আরাফাত

গল্প জুলাই ২০২০

খলিল স্যার আমাদের ক্লাস টিচার। বাংলা পড়ান। লম্বা চওড়া মানুষ। খুবই নিরীহ গোছের। অন্য স্যারদের মতো উনি ধমক দেন না, চোখ গরম করে তাকান না, বেয়াদবি করলে বেতান না। এমনকি হোমওয়ার্কও না করলে তিনি কিছু বলেন না। এমন স্যার পাওয়া আসলে ভাগ্যের ব্যাপার।
গত বছর পরীক্ষায় ‘তোমার প্রিয় শিক্ষক’ রচনা এলে সবাই লিখেছিল খলিল স্যারকে নিয়ে। তিনি আমাদের খুবই প্রিয় একজন ব্যক্তি।
আজকে উনি আমাদের ক্লাসে এলেন। উনার পারফিউমের গন্ধ আমাদের নাকে লাগল। এই গন্ধটা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। স্যার রোল কল শেষ করে বললেন, আজ ক্লাস করাবো না। গল্প করবো। কারণ আজকে আমার একটা ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়েছে। তোমরা কি সবাই শুনবে?
স্যারের শৈশব কেটেছে গ্রামে। তিনি প্রায়ই আমাদের গল্প শোনান। কাল্পনিক গল্প না। একেবারে বাস্তব গল্প, যা শুনতে খুবই ভালো লাগে। তাই সবাই চেঁচিয়ে জবাব দিল, জি স্যার।
স্যার চেয়ারে বসলেন। তারপর গল্প শুরু করলেন, আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। হাড় কাঁপানো শীত ছিল তখন। আমাদের বাজারে সেদিন জসিম কাকার দোকানে হালখাতা ছিল। ওই হালখাতায় আমাদের সাত শ’ টাকা দেওয়ার কথা। আমার আব্বার ছিল জ্বর। বড় দুই ভাই বাড়িতে ছিল না। যে কারণে আমাকে যেতে হয়েছিল হালখাতা করতে। দুইটি রসগোল্লা খেয়ে যে-ই না বাড়ি ফিরছি তখন লতিফ নানার সাথে দেখা। আপন নানা না। নানার আপন ভাই। উনাকে দেখে ভালো লাগল। নানা আমাকে বললেন যে আজকে রাতে মঞ্চ নাটক হবে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা। যে কারণে আমাকে থাকতে বললেন। আমিও উনার কথামতো নাটক দেখতে বসে গেলাম। রাত দুইটার সময় নাটক শেষ হলো। নানা অনেক জোরাজুরি করলেন উনার সঙ্গে যেতে। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। তারপর বাজার পার হয়ে অনেকটা চলে এলাম। জঙ্গলটা পার হলাম ভয়ে ভয়ে। আমার সাথে কোনো টর্চলাইট ছিল না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এত রাত হয়ে গেছে এখনো আমি বাড়িতে যাইনি। মনে হচ্ছে বাড়িতে গেলেই উত্তম মধ্যম কিছু খেতে হবে। তারপর নদীর ঘাটে এলাম। এপারে শুধু একটা নৌকা। নদীতে আড়াআড়িভাবে দড়ি টানানো থাকত। দড়ি ধরে টেনে টেনে নৌকা চালানো হতো। আমি নৌকায় উঠে দড়িতে হাত রাখলাম। নৌকায় ছিল অনেক পানি। আমি তা খেয়াল করিনি। মাঝ নদীতে আসতেই নৌকা ডুবে গেল। আমি পাতলা একটা ছেলে, আমাকে নিয়ে নৌকা কিভাবে ডুবে যায়? এ হতেই পারে না। আমার গায়ে ছিল শীতের ভারি ভারি কাপড়। যে কারণে সাঁতরাতে কষ্ট হচ্ছিল। মাঝ নদী থেকে সাঁতরিয়ে ওপারে যাওয়া অনেক দমের ব্যাপার। তাছাড়া আমি তখন ভয় পাচ্ছিলাম। নৌকাটা কি ভূতে ডুবালো নাকি? এখন কি তাহলে আমাকে নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারবে নাকি? আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। এত রাতে তো কোনো মানুষই জেগে নেই যে ডাকলে আসবে। আমি ভাবতে লাগলাম নানার সাথে চলে গেলেই বরং ভালো হতো।
অনেকক্ষণ ধরে সাঁতরাচ্ছি, এখনো মাটি পাচ্ছি না কেন? এদিকে আমার ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ রক্ষা করো। হঠাৎ কি মনে করে যেন পা ফেললাম মাটিতে। দেখি হাঁটু পানি। ধূর! কিছুক্ষণ ধরে তাহলে হাঁটু পানিতে সাঁতার কাটছি। আর একটু হলে তো ভয়ে মরেই যেতাম। তারপর পাড়ে এসে উঠলাম । শীতে শরীর কাঁপছে। আরও অনেকটা পথ এখন হেঁটে যেতে হবে। আমি হাঁটছিলাম আর রাতকানা রোগীর মতো সব অন্ধকার দেখছিলাম।

দুই.
স্যার থামলেন এবং হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা রাফিন বলল, তারপর কী হলো স্যার?
তারপর আমি যখন বাড়ি গেলাম, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমি কোনো বড় অপরাধ করেছি। মজার ব্যাপারটা হলো আমি কারও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম না। একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কেউ আমাকে বেশি ঘাঁটাইনি। সকালে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। দাদা ফকির ডেকে আনলেন এবং আমার সারা শরীরে ফুঁ দিল সেই ফকির। ফকির বলল যে আমার গায়ে কালা বাতাস লেগেছে।
রাতুল বলল, স্যার, কালা বাতাস কী?
কালা বাতাস মানে ভূত প্রেতের নজর পড়া। আগেকার দিনে এসব কুসংস্কার চালু ছিল। আমার গ্রামের নদীটার কথা এখন কিছু বলি তোমাদের। ওই নদী আমার অস্তিত্বে মিশে আছে। কত সাঁতার কেটেছি। কত মাছ ধরেছি। আহা! আমার নদী। দুঃখের বিষয় নদীটা এখন মৃত।
জুনায়েদ বলল, নদী মৃত মানে কী স্যার?
নদী মৃত মানে এখন নদীতে বেশি পানি হয় না, বড় বড় নৌকা চলে না। যে নদী আগে আমরা নৌকা করে পার হতাম, সেই নদী এখন গরু-ছাগল অনায়াসে পার হয়ে যায়।
সাথি বলল, স্যার, আমরা তো ভালো করে নদীই দেখিনি।
সমস্যা নেই, এবারের পিকনিকটা আমরা কোনো নদীর পাড়ে করব। তখন বুঝতে পারবে নদী কী জিনিস। নদীর পাড়ে গেলে যে কারও মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় যেন নদীর কোনো পাওয়ার আছে।
ক্লাসের সবাই এভারেস্ট বিজয়ীর হাসি দিল। তারপর খলিল স্যার বললেন, এখন এক কাজ করো ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ রচনাটা আগামীকাল শিখে এসো। ঠিক আছে? কেউ মুখস্থ করো না যেন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ