গর্ব

গর্ব

গল্প আগস্ট ২০১০

আবদুল ওহাব আজাদ

গর্বপ্রতিদিনের মতো পাখির গানে ঘুম ভাঙলো সুমনের। তারপর সোজা চলে গেল ওরই লাগানো ফুলের বাগানে, কিন্তু আজ আর একটুও মন টিকছে না ওর। কেন জানি তবু সে রাস্তার পাশে বসে থাকা কঙ্কাল আর বৃদ্ধ কফিলের কথা মনে পড়ছে, বড় খায়েশ করে যেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দশ টাকা চেয়েছিল কফিল, কিন্তু সুমন দিতে পারেনি। সুমনের আব্বা ফরিদ সাহেব অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, হাব-ভাবে তাকে বেশ ব্যস্ত মনে হচ্ছিল, হঠাৎ ধীর পায়ে সুমন আব্বার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। ফরিদ সাহেব ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন। নিশ্চয়ই সুমন কিছু বলতে এসেছে, ছেলেকে অভয় দিয়ে ফরিদ সাহেব বললেন, : তুমি যেন কিছু বলতে এসেছো সুমন? : ‘হ্যাঁ বাপী, আমায় দশটা টাকা দেবে?’ : ‘টাকা নিয়ে তুমি কী করবে?’ : ‘আমার এক বন্ধুকে দেব।’ : ‘বন্ধুকে?’ : ‘হ্যাঁ বাপী, ওরা খুব গরিব।’ হাতে সময় কম ভেবে আর কথা বাড়ান না ফরিদ সাহেব। চকচকে একখানা দশ টাকার নোট ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে অফিসের দিকে পা বাড়ান তিনি। বড় হাসি হাসি ভাব সুমনের। নাজানি বৃদ্ধ কফিল আজ সুমনকে দেখে কত খুশি হবে। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে যথারীতি নির্দিষ্ট স্থানে এসে থমকে দাঁড়ায় সুমন। রাস্তাটা ক্রমশ শহরমুখো হয়েছে। একটা প্রকাণ্ড কৃষ্ণচূড়া গাছ, তার ছায়ায় বসে কফিল কাতরিয়ে বলছে, : ‘একটা টাকা দেবে বাবা।’ কেউবা দু-এক টাকা দিচ্ছে তার হাতে, আবার কেউবা নানান কটূক্তি করে চলে যাচ্ছে যে যার মত। একটু দাঁড়ানোর সময় নেই যেন কারো। ব্যস্ত মানুষ, ব্যস্ত সব যানবাহন, সুমন সেই বুড়োর আরো কাছাকাছি গেল, ঠিক মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, : ‘তুমি ভিক্ষে কর কেন?’ : ‘খেতে দেবে কে?’ : ‘কেন তোমার আর কেউ নেই।’ : ‘দুটো ছেলে আছে তারা খেতে দেয় না।’ : ‘তোমার আর কেউ নেই?’ : ‘না।’ : ‘তা হলে তুমি মরে গেলে তোমাকে মাটি দেবে কে?’ : ‘কেন আপনারা।’ অবুঝ মনে এই কথাটার অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করে সুমন, কেমন যেন ঘোলাটে মনে হয় তার কাছে সব কিছু। তারপর একটু ম্লান হেসে সুমন বলল, তুমি দশটা টাকা চেয়েছিলে না, এই নাও তোমার সেই দশটা টাকা। হাত বাড়িয়ে নোটখানা নেয় কফিল, তারপর বিড় বিড় করে কী যেন বলতে থাকে। আনন্দে কফিলের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। সুমনের কৌতূহল ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে কফিলকে অতিষ্ঠ করে তোলে। : ‘এই দশটা টাকা নিয়ে তুমি কী করবে?’ : ‘দু’খানা রুটি আর ডাল ভাজি খাবো, তাতেই পেট ভরে যাবে।’ : ‘তোমরা বুঝি পেট ভরে খাও না।’ : ‘না প্রায় সময় পেট ভরে খাওয়া হয় না।’ সুমনের চিন্তা হলো, ওরা সপ্তাহের প্রায় দিন মাছ গোশত খায় , আর বাপী অফিস থেকে ফেরার পথে কত খাবার নিয়ে আসেন। আর এরা কখনো পেট ভরে খেতে পারে না। সুমনের মনে হলো, বাসা থেকে যেদিন কোরমা-পোলাও হয় টিফিন বাটি ভরে কফিলের জন্য নিয়ে আসবে। প্রতিদিন টিফিন খরচ বাঁচিয়ে দু-একটি করে টাকা দেয় কফিলের হাতে। একদিন কফিল সুমনকে জিজ্ঞাসা করলো, : ‘আপনি আমায় রোজ রোজ দু-একটি করে টাকা দেন কেন? আমি আপনার কে?’ : ‘তুমি আমার বন্ধু।’ : ‘বন্ধু, আমার তো কোন বন্ধু নেই।’ : ‘কেন তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো না?’ : ‘আপনারা বড়লোক মানুষ, আপনি আমাকে বন্ধু ডেকেছেনÑ এ কথা জানতে পারলে আপনার বাবা-মা আমাকে মেরে ফেলবেন।’ : ‘এ জন্য তুমি ভেবো না বন্ধ,ু আমার বাপী খুব ভালো মানুষ। এভাবে কেটে যায় অনেক দিন। একদিন কফিলকে রাস্তার পাশে দেখতে না পেয়ে থমকে দাঁড়ায় সুমন। আশপাশের লোকের কাছে জেনে নেয়, কে বা কারা কফিলকে গাড়ি চাপা দিয়ে রেখে গেছে। সে এখন সদর হাসপাতলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয় সুমনের। পুত্রের ম্লান মুখ দেখে ফরিদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, : ‘কী ব্যাপার সুমন, তোমাকে আজ এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?’ সুমন ছলছল চোখে বলল, : ‘বাপী আমার বন্ধুর খুব অসুখ, সে এখন হাসপাতালে, চলো না বাপী, তাকে একবার দেখে আসি সুমন ঝর ঝর করে কয়েক মিনিট কাঁদলো। অগত্যা সুমনকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন ফরিদ সাহেব। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে খুঁজে ফিরছে সুমন তার বন্ধুকে। অবশেষ ১৩ নম্বর বেডের কাছে যেয়ে থমকে দাঁড়ালো ও, ভূত দেখাব মতো চমকে উঠলো সুমন, হ্যাঁ ঐতো এক মুখভর্তি দাড়িওয়ালা কফিল। মাথায় ব্যান্ডেজ, তুলো ব্যান্ডেজ চুয়ে চুয়ে এখনো রক্ত ঝরছে। চোখ দুটো বুজে আসে কফিলের, ইশারায় কাছে ডেকে নেয় সুমনকে। বৃদ্ধ কফিলের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। ক্ষতযুক্ত হাতখানা আবছা করে একবার সুমনের বুকে বুলিয়ে কফিল বলল, ‘বন্ধু এসেছো তা হলে?’ কথাগুলো বলতে খুব কষ্ট হলো কফিলের। সুমন নির্বাক, কোন কথা বলতে পারছে না ও। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ফরিদ সাহেব। তিনি ভাবছেন, রাস্তার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ কফিল তারও চিরচেনা। অফিসে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিন তো দু’বার তার সঙ্গে দেখা হয়। ফরিদ সাহেবের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সুমনের বন্ধু রুগ্ণ জীর্ণশীর্ণ কঙ্কালসার বৃদ্ধ ভিক্ষুক কফিল। হঠাৎ নিজের অজান্তে পুত্রের কৃতকর্মের জন্য ফরিদ সাহেবের বুকটা গর্বে ভরে ওঠে যেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ