গাজী ব্রিগেড

গাজী ব্রিগেড

উপন্যাস হারুন ইবনে শাহাদাত এপ্রিল ২০২৪

শুরু কথা

ইসরাইলের বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত আল-জাহার একটি স্কুলে আটকা পড়ে ১০ জন ছাত্র। চারদিকে ঘিরে রেখেছে জায়নবাদী আগ্রাসী বর্বর সৈন্যরা। আটকা পড়া ছাত্রদের মাঝে আছে তীক্ষè বুদ্ধির আমর, যোগ্য নেতা জায়াদ, ক্ষুদে বিজ্ঞানী আম্মার জায়েদি, আত্মবিশ্বাসী হাম্মাদ, জায়নবাদবিরোধী নেটিভ ইহুদি ডেভিড। ওদের স্বপ্ন এই ধ্বংসস্তূপ থেকে গাজীর বেশে ফিরে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেবে। মুক্ত-স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন গড়বে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সেই ধ্বংসস্তূপে বসেই ওরা গঠন করে গাজী ব্রিগেড।


আগুন লাগার আগে

কত সুন্দর এ পৃথিবী। ওপরে নীল আকাশ। ধসূর মাটির বুক জুড়ে সবুজ ঘাস। জলপাই বন। বনের পথে ধরে কয়েক মিনিট হাঁটলেই যব, গম আর বাহারি ফসলে ভরা মাঠ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্বচ্ছ পানির নহর। গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে রং-বেরঙের পাখি। কত সুন্দর ঐ হলদে পাখার পাখিটা কী মিষ্টি সুরে গান গাইছে। জায়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ...গান বন্ধ করে, হঠাৎ উড়াল দেয় পাখিটি।

: ‘না না সুন্দর পাখি তুমি যেও না, চিৎকার করে ওঠে জায়াদ।’

কোথায় হারিয়ে গেল সেই সুন্দর পৃথিবী...। সে বুঝতে পারে এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। জায়াদ ভাবে যুদ্ধের আগে তাদের প্রিয় জন্মভূমি কতই না সুন্দর ছিল। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার সবচেয়ে সুন্দর জনপদ ছিল এই আল জাহারা। ইট পাথরের অট্টালিকা দেখে মনে হয় আধুনিক শহর। আর সবুজের সমারোহ দেখলে মনে হয় একটি সাজানো গ্রাম। নগর আর গ্রামের অপরূপ মিতালি।

এই মাত্র জায়াদের দেখা স্বপ্নের মতোই সুন্দর ছিল ওর জন্মভূমি ফিলিস্তিন। 

ঘুম ভাঙার পর জায়াদ নিজেকে আবিষ্কার করলো একটি অন্ধকার বন্ধ ঘরে। কখন কীভাবে সে এখানে এসেছে কিছুই তার মনে পড়ছে না। কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? এখন তার কী করা উচিত? চিৎকার করে কাঁদবে? না কি পরিস্থিতি বোঝার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করবে? 

জায়াদ মনে করার চেষ্টা করছে ঘুম ভাঙার আগে সে কোথায় ছিল? তার আবছা আবছা মনে পড়ছে... জলপাই বনে আগুন...। না জায়াদ আর ভাবতে পারছে না, মাথাটা খুব ব্যথা করছে। এমন সময়

‘আহ.. ওহ..’ কান্নার আওয়াজ ওর কানে আসে। সে আস্তে আস্তে সে দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। জায়াদ মনে মনে আল্লাহকে ডাকে, ‘হে রাব্বুল আলামিন আমার সহায় হোন। আমায় শক্তি দিন। ধৈর্যের সাথে এই বিপদ মোকাবেলা করার তৌফিক দিন।’

জায়াদ মনে শক্তি পায়। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। আবছা আলোয় আমরকে দেখে চমকে উঠে

: আমর তুমি...

: জায়াদ তুমি...

: হ্যাঁ আমি... কিন্তু আমরা কোথায়?

: কেন তোমার মনে পড়ছে না, অবৈধ দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বিমান থেকে ফেলা বোমার বিস্ফোরণে যখন জলপাই বন জ্বলছিল...

: হ্যাঁ। মনে পড়ছে, আমরা তো তখন স্কুলে ছিলাম

: এখনো সেখানেই আছি।

: বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত স্কুলে আমরা আটকা পড়েছি...

: উদ্ধারকারী মুজাহিদরা নয় তো রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা না আসা পর্যন্ত ..

: না। আল্লাহকে ডাকো তিনি আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন।

: অবশ্যই দুনিয়ার দায়িত্ব শেষ হলে উদ্ধার করে জান্নাতে স্বাগত জানাবেন

: ফেরেস্তারা তো তার নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত।

: শাহাদাতের মৃত্যু অবশ্যই আমাদের কাম্য, কিন্তু আমরা চাই মুক্ত ফিলিস্তিন।

: আমরা তার কাছে শক্তি চাই, শাহাদাতের মৃত্যু নয় তো বিজয়ী গাজীর জীবন।

: ‘আমরা চাই স্বাধীন ফিলিস্তিন, বিজয়ী গাজীর জীবন’ এক সাথে অনেকগুলো কণ্ঠ গর্জে ওঠে।


  • স্বাধীনতা সংগ্রামী গাজী ব্রিগেড 

কিছুক্ষণের জন্য ওরা ভুলে যায়। ওরা ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছে। ওরা এই ধ্বংসস্তূপটাকে ভাবতে শুরু করে একটি বাংকার। যেই ভাবনা সেই কাজ। জায়াদ শান্ত ও দৃঢ়ভাবে প্রথমে কথা শুরু করে।

: বন্ধুরা। এ ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হওয়া মানেই আমরা মুক্ত নই। আমরা ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হই বন্দি অবস্থায়, মুক্তির প্রত্যয় নিয়ে। কারণ এক সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ এ ভূমি, আমাদের জন্মভূমি ফিলিস্তিন আজ জায়নবাদীদের আগ্রাসনের শিকার। আমরা নিজদেশে পরবাসী। আমাদের দেশ আজ ধ্বংসস্তূপ। স্বাধীন ফিলিস্তিন নয় তো শাহাদাত। এই হোক আমাদের শপথ। আমরা কলম-খাতা হাতে নিয়ে এই ভবনে প্রবেশ করেছিলাম। এটা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু জায়নবাদীদের বোমার আঘাতে তা আজ বিধ্বস্ত। তাই এ খাতা কলমের সাথে অস্ত্রও আমাদের হাতে তুলে নিতে হবে। ওরা আমাদের বাধ্য করছে। 

: ‘হ্যাঁ। ওরা আমাদের বাধ্য করছে।’ সবাই এক সাথে বলে ওঠে।

আমরের কান্না থেমে গেছে অনেক আগেই। জায়াদের কথায় তার বুকে প্রতিবাদ আর প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে।

সে চিৎকার করে বলে : ‘হ্যাঁ। খাতা, কলম, বইয়ের সাথে অস্ত্র হবে এখন থেকে আমাদের নিত্যসঙ্গী। আর নয়। আমরা বসে বসে বোকার মতো মরতে চাই না। প্রতিরোধ সংগ্রামে শাহাদাতের পথে জান্নাতের যাত্রী হবো। নয় তো মুক্ত ফিলিস্তিনের গাজী মুক্তিযোদ্ধা। জায়াদ বন্ধু, তুমি বলো আমাদের কী করতে হবে?’

: আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সংগঠিত শক্তি ছাড়া যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে পিপীলিকার মতো আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বোকার মতো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। এভাবে মরণ বরণ নয়। আমরা যারা জীবিত আছি। সবাই একটা সংগঠনের ছাতায় ঐক্যবব্ধ থাকবো। আমি এই সংগঠনের নাম-‘গাজী ব্রিগেড’ প্রস্তাব করছি। আমাদের নেতা হবে আমর..

আমর প্রতিবাদ করে বলে; ‘না, না, নেতা হবে জায়াদ।’

: না। আমরই হবে এ ব্রিগেডের নেতা। আল্লাহর রাসূলের দুঃসাহসী এক সাহাবির নাম ছিল আমর ইবনুল আস (রা)। তোমার নামের সাথে তাঁর নামের মিল আছে। তিনি ছিলেন মিসর, ফিলিস্তিন ও তিরাবিল্লিস বিজয়ী মহান সেনানায়ক।

: তার সাথে আমার তুলনা করো না, বন্ধু।

: তুলনা করছি না, ইতিহাস স্মরণ করছি মাত্র।

: আমি চাই জায়াদই হবে, আমাদের নেতা, তোমরা কি বলো?

আমরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই এক যোগে সবাই বলে ওঠে : হ্যাঁ। জায়াদই আমাদের নেতা। 

: ‘আর কথা নয়। এসো সবাই জায়াদের হাতে বায়াত গ্রহণ করি।’ আমর বলে।

আমরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই একসাথে হাত প্রসারিত করে। কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করে।

: আমরা জায়াদকে আমাদের ব্রিগেডের নেতা হিসেবে মেনে নিলাম। সে যত দিন আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর নির্দেশিত পথে আমাদের নির্দেশ দেবে আমরা তত দিন তার আনুগত্য করবো। ভুল করলে পরামর্শ দেবো। নিজেদের এবং স্বদেশের মুক্তির জন্য আমরা লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত লড়ে যাবো ইনশাআল্লাহ। 

: ‘আর কথা নয়, এবার কাজ শুরু করা যাক।’ ক্ষুদে বিজ্ঞানী খ্যাত আম্মান জায়েদি এবার মুখ খুলে।

: ‘হ্যাঁ আর দেরি নয়, আমাদের এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করা চলবে না।’ আমরও আম্মানের সাথে সুর মেলায়।

:‘এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আর কে কোথায় আটক আছে? কার অবস্থা কেমন, তা আগে দেখা দরকার। কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত আলো নেই। সবার আগে আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদে বিজ্ঞানী আম্মান জায়েদি আশা করি এর একটি সমাধান দিতে পারবে?’ 

জায়াদের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে মুখ খুলে আম্মান জায়েদি: ‘ব্রিগেড কমান্ডার আমরা এখনই কাজে লেগে গেলাম। আগে দেখে নেই, আমার টিমের কে কোথায় আছে? কিন্তু সেজন্যও আলো চাই। আচ্ছা আমার স্কুল ব্যাগটা কোথায় দেখি, এই তো পেয়ে গেছি।’

: ‘তা ব্যাগে কি লাইট আছে।’ আমর জানতে চায়। 

: ‘না, লাইট নেই। আমার পেন্সিল বক্সে কয়েক টুকরা রেডিয়ান আছে।’ আম্মান জাহেদি উত্তর দেয়। তারপর ব্যাগটি খুলে একটি কাপড়ের প্যাকেট থেকে কয়েক টুকরা রেডিয়ান বের করে। ক্রিস্টালের পেন্সিল বক্সের জিনিসগুলো ব্যাগের রাখে। তারপর রেডিয়ানগুলো পেন্সিল রাখলে চারদিকে হালকা আলো জ্বলে ওঠে।

হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল মুখ

: ‘আল হামদুলিল্লাহ।’ সবাই এক সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া আদায় করে। ওরা ভালো করে খেয়াল করে দেখে ওরা ১০ বন্ধু এখানে আটকা পড়েছে। ওরা আশপাশে তাকিয়ে দেখে। স্কুলটির বেশ কিছু অংশ এখনো অক্ষত আছে। তবে যেখানে ওরা আটকা পড়েছে আছে, সেই ভবনটির অধিকাংশই নিচের দিকে দেবে গেছে। বের হওয়ার মতো কোন পথ খোলা নেই।

: ‘ঐ যে দূরে একটু ফাঁক দেখা যাচ্ছে।’ হাম্মাদ চিৎকার করে ওঠে।

জায়াদ হাতের ইশারায় ওকে শান্ত থাকতে বলে। সে দেখতে পায় ঐ ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। সবাইকে যার যার জায়গায় চুপচাপ বসে থাকতে বলে, সে নিজে ঐ আলোর দিকে যায়। না ঐ ফাঁক দিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। উদ্ধারকারী দল কবে আসবে, বলা মুশকিল। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী চারদিক ঘিরে রেখেছে। ওরা আসবে বুলডোজার নিয়ে। ধ্বংসস্তূপের জঞ্জাল সরাতে। ভেতরে আটকা পড়া কোনো মানুষ বাঁচাতে নয়। ওরা এসেছে মানুষ মারতে বাঁচাতে নয়। বৈধ অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের ভূমি সম্পদ দখল করাই ওদের লক্ষ্য। ওরা জানে কাউকে বাঁচিয়ে রেখে তার সম্পদ ছিনতাই বা ডাকাতি করা যায় না। তাই হত্যা, মৃত্যু আর খুনেই ওদের উল্লাস। 

জায়াদ ওর ব্রিগেডের কাছে ফিরে আসে। ব্রিগেডের সবাই কম বেশি আহত। বাঁচতে হলে সবার আগে প্রয়োজন চিকিৎসা। খাদ্য ও পানি। তারপর এখান থেকে বের হতে হবে ইসরাইলি দখলদার সৈনিকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নয়তো ওদের হত্যা করে। কিন্তু সময় খুব কম। খাদ্য, পানীয় রসদও সামান্য। একমাত্র ভরসা আল্লাহর সাহায্য।


একমাত্র ভরসা আল্লাহর সাহায্য

জায়াদ সবাইকে আরো সামনে আসতে বলে। তারপর তার বক্তব্য শুরু করের : ‘বন্ধুরা। আমাদের এক মাত্র ভরসা আল্লাহর সাহায্য। তিনি ছাড়া আর কেউ এখান থেকে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। আমরা জানি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দা ও নবী হজরত ইউনুছ (আ)-কে তিমি মাছের উদর থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর ছায়াসঙ্গী প্রিয় সাহাবি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-কে সাথে নিয়ে মদিনা মোনাওয়ারায় হিজরতের সময় সাওর পর্বতের একটি গুহায় আত্মগোপন করেছিলেন। চারদিক থেকে শত্রুরা তাঁদের ঘিরে ফেলেছিল, এই গুহায় আত্মগোপনের সেই সংকটময় সময়েও নবী করিম (সা) ছিলেন আল্লাহর সাহায্যের ওপর পূর্ণ আস্থাশীল ও দুশ্চিন্তাহীন। আমরা তারই উম্মত। নবী করিম (সা)-এর জীবনের এ শিক্ষাই হোক আমাদের আজকের পাথেয়। আল্লাহর রাব্বুল আলামিন আমাদের প্রিয় নবী (সা)-এর মাধ্যমে আমাদের চলার পথের গাইডবুক পবিত্র কুরআন পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা)। 

এমন বিপদে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে সূরা ফাতিহা, দোয়া ইউনুছ, (লা ইলাহা ইল্লা আনতা, সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বালিমিন।’ অর্থ : ‘তুমি ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পূতপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত।’ সূরা আম্বিয়া : ৮৭) সূরা ইয়াসিনের প্রথম ৯ আয়াত, আয়াতুল কুরসি, দরূদ শরিফ ও তওবা ইসতেগফার পড়ে অনুতপ্ত মনে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। প্রার্থনা কবুল হলে আমাদের জন্য গাজী অথবা শাহাদাত যা কল্যাণকর রাব্বুল আলামিন তাই দান করবেন। এবার আমরা পরামর্শের মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো। কারণ পরামর্শভিত্তিক কাজেই আল্লাহ কল্যাণ দান করেন।’ বক্তব্য শেষ করে জায়াদ সবার কাছে পরামর্শ চায়।

: ‘আমার মনে হয় প্রথমেই আমরা সবাই তায়াম্মুম করে। প্রথমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবো। তারপর ব্রিগেড কমান্ডারের উল্লেখ করা দোয়াগুলো সিজদায় লুটিয়ে পড়ে আল্লাহর দরবারে তার সাহায্য প্রার্থনা করবো। তারপর কয়েকটি গ্রুপে ভাগে হয়ে এখান থেকে বের হওয়ার উপায় তালাশ করবো।’ আমর বললো।

: ‘এক দম ঠিক।’ আম্মার বললো।

: ‘আমার মনে হয় সবার আগে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। তারপর খাবার ও পানির অভাব পূরণে কী করা যায়, ঠিক করতে হবে। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’ হাম্মাদ বললো,

: ‘আর কারো কোন কথা আছে।’ জায়াদ জানতে চায়

: ‘না। এবার তোমার নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত জানাও।’ অন্যরা বললো

:‘ঠিক আছে। সবার পরামর্শ অনুসারে এবার আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।’ জায়াদ বললো।

: বলো।

: আমাদের সবার স্কুল ব্যাগেই ফাস্ট এইডের জন্য জীবাণুনাশক ও গজ ব্যান্ডেস ইত্যাদি থাকার কথা। কিন্তু সবার ব্যাগ হয় তো এমন দুর্ঘটনার পর হাতের কাছে নেই। তাই আমরা একে অন্যকে শেয়ার করবো। খাবার এবং পানিও তাই করবো। আমরা এক সাথে সব খাবার ও পানি শেষ করবো না। কারণ কত দিন এখানে আমাদের থাকতে হবে, কেউ জানি না। আমি আমাদের কাজের সুবিধার জন্য তিনটি গ্রুপে সবাইকে ভাগ করে দায়িত্ব দিতে চাই। প্রথম গ্রুপ হবে বিজ্ঞানী আম্মার জায়েদির নেতৃত্বে। তাদের দায়িত্ব দখলদার বাহিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষার করে তাদের চোখ ফাঁকি নয় তো ওদের খতম করে এখান থেকে বের হওয়ার বিজ্ঞানসম্মত উপায় বের করা। দ্বিতীয় গ্রুপে থাকবে হাম্মাদ এবং যারা বেশি আহত হয়েছে তারা। এদের দায়িত্ব আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে দোয়া করা। আমরের নেতৃত্বে থাকাবে দুজন। তাদের কাজ চারদিকে নজর রাখা এবং দখলদার বাহিনীর গতিবিধি আমাকে জানানো। তার আগে আসো, তায়াম্মুম করে সবাই দুই রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে সাহায্য প্রার্থনা করি। কারণ তার সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না।


আসছে দখলদার জায়নবাদী বুলডোজার

নামাজ ও মুনাজাত শেষে ওদের সবার মনে এক অনাবিল প্রশান্তির জোয়ার বইছে। ক্ষুধা ক্লান্তি আঘাতের যন্ত্রণা কোনোকিছুই ওরা অনুভব করছে না। ক্ষুদে বিজ্ঞানী ব্যস্ত স্কুল ভবনের পায়ু নিষ্কাশন পাইপের খুঁজে। যেখান থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে, দখলদারদের বুলডোজার উড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে। জায়াদকে তার প্ল্যান জানিয়েছে। সে ওকে পরামর্শ দিয়েছে, আত্মরক্ষা করে খুব সাবধানে কাজ করতে। বিপদে ধৈর্য হারাতে নেই। ধৈর্য হারালে পরাজয় নিশ্চিত। ধৈর্য়ের সাথে অগ্রসর হলে অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য আসবে। সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত ‘ইয়া আইয়ু হাল্লাযিনা আ-মানুছতা‘ঈনু বিসসাবরি ওয়াসসালা-তি; ইন্নাল্লা-হা মা‘আসসাবিরিন। হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’

আমর ধীর পায়ে জায়াদের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর বলে : ‘কিছু শুনতে পাচ্ছো?’

:‘হ্যাঁ। মনে হয় বুলডোজার নিয়ে ওরা ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে আসছে। আসতে দাও এ পর্যন্ত আসতে ওদের যথেষ্ট সময় লাগবে। বিজ্ঞানীকে ডাকো।’ জায়াদের আদেশে আমর বিজ্ঞানীকে ডাকে।

: ‘কমান্ডার বলো, কী করতে হবে?’ আম্মার জায়েদি বিনীতভাবে জায়াদের কাছে প্রশ্ন করে।

: ‘কিছু শুনতে পাচ্ছো?’

: হ্যাঁ পাচ্ছি। তবে এই মুহূর্তে গ্যাস নয়, অন্য কৌশলে ওদের কুপোকাত করতে হবে।

: কী সেই কৌশল বিজ্ঞানী বললো?

: ফাঁদ?

: মানে

: মানে খুব সহজ। এর মাধ্যমে আমরা এক ঢিলে দুই পাখি মারব।

: কীভাবে?

: পর্যবেক্ষণ টিমের সাহায্য প্রয়োজন।

: ঠিক আছে, আমর তো তোমার সামনেই আছে। প্রশ্ন করো?

: ওরা কোন দিক থেকে আসছে?

: ‘দক্ষিণ দিক।’ আমর উত্তর দেয়

: খুব ভালো। ঐ দিকেই আমরা ফাঁদ তৈরি করবো।

: ‘কীসের ফাঁদ?’ আমর প্রশ্ন করে

: ‘ওদের মরণ ফাঁদ?’ বিজ্ঞানী উত্তর দেয়

:‘বিষয়টি বুঝিয়ে বললো?’ জায়াদ ক্ষুদে বিজ্ঞানীকে বলে।

: ‘আমার সাথে আস।’ বলে ক্ষুদে বিজ্ঞানী আম্মার সামনে পা বাড়ায়। জায়াদ ও আমর তাকে অনুসরণ করে। আম্মার ওদের সাথে নিয়ে হাজির হয় ওদের বাংকারের পাশের আরেক ধ্বংসস্তূপে। ওরা বুঝতে পরে এটি ওদের স্কুলের ল্যাবরেটরি। সেখান আগে থেকেই বসা ছিলো আম্মারের টিমের সদস্য আসাদ ও ডেভিড। ডেভিড ফিলিস্তিনের নেটিভ ইহুদি। সে জায়নবাদী আগ্রাসনের বিরোধী। তার পরিবারের অন্যরা। তাই তো তার বাবা-মা তাকে হামাস পরিচালিত এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। কারণ এই স্কুলটি আল জাহারার সেরা স্কুল। কিন্তু বেতন-ভাতা খুব কম। এখানে ইসলাম ও আহলে কিতাবের ইতিহাসের সঠিক জ্ঞান শিখানো হয়। উদারপন্থী চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ ও স্বদেশ ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে গড়ে ওঠে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ প্রতিষ্ঠানের অনেক সাবেক খ্রিস্টান, ইহুদি ছাত্র আছেন যারা বিশ্বসেরা স্কলার। তারা দেশে বিদেশে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছেন। অনেকে হামাস ও মুসলমানদের সান্নিধ্যে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ ধ্বংসস্তূপে আটকরা পড়া ডেভিডকে নিয়ে তাই ওদের কোনো ভয় নেই। কারণে সেও আজ তাদের মতো জায়নবাদের আগ্রাসনের শিকার। ডেভিড স্বেচ্ছায় গাজী ব্রিগেডের সদস্য হয়েছে। জীবন-মৃত্যু এই সন্ধিক্ষণে তার চোখে মুখে জায়নবাদীদের প্রতি ঘৃণার আগুন জ্বলছ। 

জায়াদকে দেখে ডেভিড ওঠে দাঁড়িয়ে বলে : ‘কমান্ডার, আমরা খুঁজতে খুঁজতে এই কক্ষের সন্ধান পেয়েছি। আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা কবুল করেছেন।’

: ‘আম্মার এবার বলো। দক্ষিণ দিকের বুলডোজারগুলো তোমরা কীভাবে ফাঁদে ফেলবে?’

জায়াদের কথার উত্তরে আম্মার বলে: ‘ঐ যে দেখো। দক্ষিণ দিকে কয়েকটি ছোটো ছোটো ছিদ্র আছে। এই ল্যাবে আছে কেমিক্যাল আর গ্লুগান। ওরা যখন বুলডোজার নিয়ে অগ্রসর হবে। প্রথমে আমরা কিছু বললো না। বের হওয়ার মতো রাস্তা তৈরির পরই আমরা ওদের চোখ টার্গেট করো গ্লুগানে কেমিক্যাল মিশিয়ে আড়ালে থেকে ছুড়তে থাকবো। নিঃশব্দে ওরা ঢলে পড়বে। বুঝতেও পারে না। কোথা থেকে কী হচ্ছে। জিনের ভয়ে যেমন মানুষ পালায় আল্লাহর রহমতে ওরা ঠিক তেমনি করে পালাবে, ইনশাআল্লাহ। তখন ওদের চোখের সামনে দিয়ে আমরা নিরাপদে এখান থেকে বের হয়ে যাবো। পড়া-লেখার সাথে সাথে চলবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।’ 

অবশেষে মুক্তি আর বিজয়ের আনন্দ

জায়াদের নেতৃত্বে ওরা প্রস্তুত। জঞ্জাল সরাতে সরাতে গড় গড় শব্দে বুলডোজার আসছে। পুরো ব্রিগেডের হাতে কেমিক্যাল ভরা গ্লুগান। সবাই নিরাপদ দূরত্বে অ্যাম্বুশ করে আছে। কোন উত্তেজনা নেই। দৃঢ় চিত্ত। ঠাণ্ডা মস্তিষ্ক। বুলডোজারের সাথে বড়ো কোন বাহিনী নেই। কারণ দখলদাররা ধরেই নিয়েছে এখানে ওদের প্রতিরোধ করার মতো কেউ নেই। বিমান হামলা করে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর দখলদার যায়নবাদীদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। তাই বীর দর্পে এগিয়ে আসছে, কাপুরুষ দখলদাররা।

হঠাৎ বিমানের শব্দ। জায়াদ ভালো করে লক্ষ্য করে, হ্যাঁ বিমানেরই শব্দ। তার মানে কী?

সে হাতে ইশারায় ক্ষুদে বিজ্ঞানী আম্মারকে কাছে ডাকে। তার সাথে ইশারায় কথা বলে। ক্ষুদে বিজ্ঞানী তাকে জানায়। বিমান থেকে পেগাসাস প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওরা বুঝতে চাচ্ছে। ভবনের ভেতরে বিপজ্জনক কিছু আছে কি না। তাই সবাইকে কয়েক মিনিট নিঃশ্বাস বন্ধ করে গ্লুগানগুলো আড়াল করে রাখার নির্দেশ দিতে কমান্ডারকে পরামর্শ দেয়, বিজ্ঞানী। 

জায়াদ বিজ্ঞানীর পরামর্শ মতো সবার কাছে তার বার্তা পৌঁছে দেয়।

বিমান চলে গেছে। বুলডোজারগুলোও খুব কাছাকাছি এসে গেছে। ধপাস ধপাস শব্দ। ভবনের এক একটি ধ্বংস হওয়া দেওয়াল সরাচ্ছে।

ঐ তো বাইরের আলো এসে পড়ছে ওদের মুখে। বাংকাররূপী কক্ষটি আলোয় ভরে ওঠে। এক সাথে কেমিক্যাল ভর্তি ১০টি গ্লুগান সচল হয়ে ওঠে। নিঃশব্দে আগ্রাসী দখলদারদের চোখ ভেদ করতে থাকে। নিয়ন্ত্রণ হারানো বুলডোজার চাপায় পিষ্ট হতে থাকে চালক ও আগ্রাসী সৈন্যরা। অলৌলিক কোনো ঘটনা ঘটছে মনে করে দিশেহারা। পরাজয় মেনে নেওয়া ছাড়া ওদের উপায় নেই। ব্রিগেড গাজীর সদস্যরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করে না।

কারণ জায়নবাদীদের উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার আসার আগেই এ স্থান ত্যাগ করতে হবে। তাই আর এক মুহূর্ত নয়। জায়াদের নেতৃত্বে ব্রিগেড গাজী টিমের সদস্যরা বিজয়ের বেশে সামনে পা বাড়ায়। মুক্তি আর বিজয়ের আনন্দ ওদের চোখে মুখে। আরো বড়ো অভিযান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ওদের বুকে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ