গুরুর উপদেশ

গুরুর উপদেশ

গল্প দেলোয়ার হোসেন মে ২০২৩

অনেক দিন আগে এক গ্রামে একটি ছেলে ছিল। তার নাম পবন। সে যেমন দেখতে সুন্দর তেমন তার সুন্দর ব্যবহার। গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসতো। 

পবন ছেলেটির মনে সুখ নেই। ঘরে সৎ মা। দিনরাত গজগজ করে আর যা-তা কথা বলে। অবস্থা এমন হয়ে উঠলো যে, পবন বুঝতে পারলো ভিন দেশে গিয়ে রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

যেমন ইচ্ছা তেমন কর্ম। পবন নিজের যা কিছু ছিল সব গুছিয়ে নিল। প্রাণ চায় না তবুও ঘর ছাড়তে হবে। কাউকে না জানিয়েই সে বেরিয়ে পড়তে চায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুরুমশায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে খুব শ্রদ্ধা করে পবন। তার পাঠশালায় সে লেখাপড়া শিখেছে। তখনও ভালো করে অন্ধকার কাটেনি। পবন পুঁটলি বগলে গুরুমশায়ের বাড়িতে হাজির হলো। অভিজ্ঞ গুরুমশায় প্রাক্তন ছাত্রের মুখ দেখেই সব বুঝতে পারলো। জিজ্ঞেস করলো, বাছা কী হয়েছে বলো।

তেমন কিছু নয় গুরুমশায়। তবে সংসার ছেড়ে আমি ভাগ্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো ঠিক করেছি। পবনের কথা মন দিয়ে শোনার পর গুরুমশায় তাকে বুঝিয়ে বললেন, অযথা রাগ করো না। বাপের বাড়িতেই থেকে যাও। বিদেশে পুরো পেট খাওয়ার চেয়ে নিজের ঘরে আধপেটা থাকা ভালো।

কিন্তু পবনের সংসারে থেকে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। গুরুমশায় আর পীড়াপীড়ি করলেন না। পাঁচটা পরামর্শ দেবো তোমায়, এগুলো মনে রাখলে বিপদ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। গুরুমশায়ের চরণ স্পর্শ করে পবন বললো, আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন। গুরুমশায় বললেন, প্রথম উপদেশ : যার কাছে কাজ করবে তিনি যা- আদেশ দেবেন তা নির্দ্বিধায় মেনে চলবে। দ্বিতীয় উপদেশ : কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না বা কাউকে কড়া কথা বলবে না। তৃতীয় উপদেশ : কখনো মিথ্যে কথা বলবে না। চতুর্থ : যারা তোমার থেকে উঁচু শ্রেণির লোক তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছু করবার চেষ্টা করবে না। আর শেষ উপদেশ- যেখানেই যাবে সেখানেই ধার্মিক এবং পণ্ডিত লোকদের সংস্পর্শে আসবে। পবন বললো, আপনার উপদেশ আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করবো।

কয়েক দিন ঘুরতে-ঘুরতে পবন এক শহরে গিয়ে হাজির হলো। তার অবস্থা এখন সঙ্গিন, সঙ্গে পয়সা যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন যে কোনো একটা কাজ জোগাড় করতে না পারলে তাকে অনাহারে থাকতে হবে।

হাঁটতে-হাঁটতে একটা গমের আড়তের সামনে এসে সে দাঁড়ালো। ব্যবসাদার এক ভদ্রলোককে পবন বললো, যে কোনো একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারেন হুজুর? কাজ আমার বিশেষ দরকার। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ পবনের দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুই বললো না। পবন বেশ চিন্তায় পড়ে গেল, ভাবলো ভাগ্যে আরো কষ্ট আছে আমার। শেষে ভদ্রলোক মুখ খুললেন, বললেন আমার কাছে কোনো কাজ নেই তবে, অন্য জায়গায় একটা ব্যবস্থা হতে পারে। গতকাল আমাদের রাজার প্রধান উজির তার চাকরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি একটি পছন্দসই লোক খুঁজছে। ভাবছি তোমাকে সেখানে মানাবে। একবার সেখানে গিয়ে দেখতে পারো। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে পবন তখনই প্রধান উজিরের বাড়ির দিকে ছুটলো। এসব ব্যাপারে দেরি করা ঠিক নয়। খবর পেয়ে অনেকেই হয়তো চাকরিটা বাগিয়ে নিতে চাইবে।

পবনের চমৎকার স্বাস্থ্য এবং সুন্দর ব্যবহার দেখে উজিরের পছন্দ হয়ে গেল। মস্ত এই লোকের খাস চাকরের পদটি পেয়ে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন পবন।

রাজা একদিন তার সৈন্য-সামন্ত, লোক-লস্কর নিয়ে রাজধানী থেকে বেরিয়ে পড়লেন। উজিরকেও সঙ্গে নিলেন।

রাজার দলবল মানেই বিশাল ব্যাপার। সৈন্য-সামন্ত, চাকরবাকর ছাড়াও গাইয়ে, বাজিয়ে, নর্তকী, হাতি ঘোড়া উট থেকে আরম্ভ করে গাধা ও ছাগল পর্যন্ত সঙ্গে চলেছে। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নানা জায়গা ঘুরে রাজার দলবল এবার অজানা এক অঞ্চলে ঢুকে পড়লো। এ এক অদ্ভুত জায়গা। চারদিকে শুধু বালু আর বালু। এই মরুভূমি ভেঙে যেতে- যেতে দিনের শেষে রাজার দল একটা ছোটো গ্রামে উপস্থিত হলো। গ্রামের মোড়ল ছুটে এসে রাজার সঙ্গে দেখা করলো। রাজাকে শ্রদ্ধা জানালো মোড়ল। সে বললো, সবাই আপনাকে সাহায্য করবে কিন্তু ...

কিন্তু শুনেই রাজা মুখ তুলে মোড়লের দিকে তাকালেন। দেখলেন বেচারার শুকনো মুখ। রাজা বললো, কোনো ভয় নেই, আপনার কোনো অসুবিধা থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। মোড়ল তখন কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললো, মহারাজ কত ভাগ্য করলে আপনার সেবার সুযোগ পাওয়া যায়। ঈশ্বরের দয়ায় খাবার দাবার আছে আমাদের ঘরে কিন্তু এক ফোঁটা জল নেই। অভাগা এই দেশে না আছে কোনো নদী না ঝরনা না কোনো কুয়া। জল ছাড়া চলবে কী করে।

জলই তো জীবন, জলের কথা শুনে সবার মুখ শুকিয়ে গেল। রাজা সঙ্গে সঙ্গে উজিরকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, যেখান থেকে হোক জলের ব্যবস্থা করো।

রাজা হুকুম দিয়েই খালাস। এই মরুভূমিতে কোথায় পাবে জল। জলের ব্যবস্থা না হলে উজিরের মুন্ডুই হয়তো কাটা যাবে। উজির মনে মনে অনেকক্ষণ ভাবলো এবং গ্রামের লোকদের খবর পাঠালো। সবার কাছে জানতে চাইলো জল কোথায় পাওয়া যেতে পারে।

কেউ কোনো সাহায্য করতে পারলো না। শুধু এই গ্রামের মাইলখানেক দূরে একটা বিরাট কুয়া আছে। কিন্তু কোনো কিন্তু নয়, জলের ব্যবস্থা করতেই হবে।

এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তখন বললো, মন্ত্রীমশায় কুয়ো আছে কিন্তু কোনো কাজে আসবে না। কয়েক বছর আগে একজন রাজা ঐ পাথর বাঁধানো কুয়া খুঁড়েছিলেন। এমন গভীর কুয়ো খুব কম দেখা যায়। ধাপে-ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে পাতাল পর্যন্ত। যত খুশি জল পাওয়া উচিত কিন্তু ঐ সিঁড়ি বেয়ে জল আনতে গিয়ে আজও কেউ ফিরে আসেনি। ওখানে হয়তো কোনো দৈত্যদানব আছে।

মন্ত্রীমশায় চিন্তায় পড়ে গেলেন। পবন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে মন্ত্রী বললেন, কথায় বলে কাউকে ভালোভাবে না বাজিয়ে বিশ্বাস করা উচিত নয়। রাজার জন্য তুমি জল নিয়ে এসো।

ভূত-প্রেত, দৈত্য দানবের কথা শুনলে কেউ সেদিকে যায় না। চাকরি রাখতে গিয়ে প্রাণ হারানোর কোনো মানেই হয় না। কিন্তু পবনের মনে পড়ে গেল গুরুমশায়ের কথা। যার কাছে কাজ করবে তার আদেশ মেনে চলবে।

পবন সঙ্গে-সঙ্গে মনিবকে জানিয়ে দিল, জল নিয়ে আসবার জন্য তৈরি সে। সাথে দুটো পিতলের ঘড়া নিলো পবন। নির্জন পথ ধরে চলছে পবন। সঙ্গে চলেছে সেই বৃদ্ধ যিনি পথ প্রদর্শকের কাজ করছেন। কিছুদূর যাওয়ার পর বৃদ্ধ দূর থেকেই কুয়াটাকে দেখিয়ে দিয়ে আর এগুলেন না। সে বললো, আমি বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, আপনি যান। পবনের খারাপ লাগলেও সে এগিয়ে চললো। বড়ো ঘড়া দুটো নিয়ে কুয়োর কাছে এগিয়ে গেল। এত বড়ো কুয়ো পবন আগে কখনও দেখেনি। কুয়োর সিঁড়িটাও দেখলো পবন।

কোথাও কোনো প্রাণীর লক্ষণ নেই। শ্বেত পাথরের বুকে খালি পা পড়লে যেমন শব্দ হয়, একটা ঘড়া হাত থেকে ফসকে পড়ে গিয়ে ঝন্ঝন আওয়াজ হলো।

একবার ইচ্ছে হলো সে ফিরে যায়। কিন্তু পবন পরাজয় মেনে নেবে না। নিচে নেমে ঘড়া দুটো ধুয়ে পবন এক পা উঠাবার পরই সে দেখলো বিরাট এক দৈত্য তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। দৈত্যটার এক হাতে বিরাট একখানা হাড় আর অন্য হাতে প্রদীপ। প্রদীপের আলোয় দৈত্যের ছায়া-কায়া মিলে এক ভয়াবহ দৃশ্য।

দৈত্য এবার মুখ খুললো, গলা তো নয় যেন মেঘের গর্জন। আমার সুন্দরী বউটাকে কেমন দেখলে বলো। পবন দেখলো দৈত্য একটা হাড় প্রদীপের সামনে তুলে ধরেছে। মাঝে-মাঝে হাড়টাকে আদর করছে।

এই দৈত্যের খুব সুন্দরী একটা বউ ছিল। দৈত্য তাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। হঠাৎ সে মারা যায়। কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধ দৈত্য বিশ্বাসই করতে চায় না যে তার বউ মারা গেছে। বউ এর দেহটা পচতে-পচতে এখন হাড়ের টুকরো ছাড়া আর কিছুই নেই। পবন ঘটনাটা জানতো না, কিন্তু গুরুর উপদেশ তার মনে পড়ে গেল। কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করো না। পবন দৈত্যকে বললো, সত্যিই দৈত্যরাজ এমন সুন্দরী বউ আপনি আর দ্বিতীয়টি পাবেন না।

দৈত্য বললো, তোমার চোখ দেখছি ভালো। আনন্দে উৎফুল্ল দৈত্য বলে উঠলো, তোমার অন্তর দেখার ক্ষমতা আছে। এর আগে আমি অনেক লোককে খুন করেছি। তারা বলে আমার হাতে এক টুকরো হাড়। ইয়ংম্যান তোমাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি তোমাকে সাহায্য করবো।

দৈত্য এবার জলভরা ঘড়া চোখের পলকে ওপরে তুলে দিল। পবন যাওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু দৈত্য ছাড়বে না, একটা উপহার তাকে নিতেই হবে। পবন কিছুই চাইছে না। দৈত্য তখন বললো, এখানকার রাজার ধনরত্ন কোথায় আছে তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। পবন বললো, রাজার ধনে তার কোনো লোভ নেই। তবে তুমি যদি সত্যিই সন্তুষ্ট হয়ে থাক তা’হলে এই কুয়ো ছেড়ে চলে যাও। সাধারণ লোকজন খুব জলের অভাবে আছে।

দৈত্য ভেবেছিল পবন হয়তো বিরাট কিছু চেয়ে বসবে, তাই সে অল্পতে খুশি হয়ে বললো, আমি এই কুয়া ছেড়ে এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। আমি তোমার কথায় খুশি হয়েছি।

জলের ঘড়া নিয়ে পবন আস্তে-আস্তে জলজ্যান্ত অবস্থায় ফিরে আসলো। তাই দেখে মন্ত্রী এবং রাজা খুব খুশি হলেন। কুয়োর ওখানে কী হয়েছিল তা সে বর্ণনা করলো। রাজাকে কুর্নিশ করে পবন বললো- মহারাজ, কুয়ো থেকে জল আনতে এখন আর কোনো বাধা থাকলো না। যে কেউ এখন জল আনতে পারবে।

পবনের ওপর রাজা, মন্ত্রী দু’জনেই খুব খুশি। রাজা মন্ত্রীকে বললেন, আমার খাস চাকরকে আপনি নিন আর আপনার চাকরকে আমাকে দিন।

এভাবে রাজকর্ম করার সুযোগ পেয়ে গেল পবন। ক্রমেই সে রাজার বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠলো। পবন সৎ এবং সে কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ফলে, তার পদোন্নতি হতে-হতে সে একদিন রাজার কোষাধ্যক্ষ হয়ে গেল। 

পবনের ভাগ্যে কী আছে তা কে জানে। কেননা রাজার ভাই ছিল হিংসুটে। সে চাইতো রাজার ভান্ডার থেকে টাকা পয়সা সরাতে। তারপর সুযোগ বুঝে রাজাকে শেষ করে নিজে রাজা হবে। এ ব্যাপারে পবনকে নিজের দিকে টানতে লাগলো রাজার ভাই। রাজার ভাই নিজের মতলব হাসিল করার জন্য নিজের মেয়েকে পবনের সাথে বিয়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলো।

এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে না। কিন্তু গুরুমশায়ের চার নং উপদেশটা পবনের মনে পড়ে গেল। যারা তোমার থেকে উঁচু শ্রেণির লোক তাদের সঙ্গে পাল্লা দেবার চেষ্টা করো না। পবন অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে এই রাজকীয় বিয়েতে অক্ষমতা প্রকাশ করলো।

ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপেই বাধা পড়ায় রাজার ভাই এক্কেবারে খাপ্পা হয়ে উঠলেন। সে মনে মনে ভাবলেন, পথের কাঁটা আগে সরাতে হবে। পবনের সর্বনাশ না করা পর্যন্ত তার মনে শান্তি নেই।

একদিন সুযোগ বুঝে সে রাজার সাথে দেখা করলো। মিথ্যা বললো, কোষাধ্যক্ষ রাজার সম্বন্ধে অসম্মানজনক কথা বলেছে, সে রাজপরিবারের মেয়েকে অসম্মান করেছে।

পবন কী কথা বলেছে, কীভাবে রাজাকে অপমান করেছে তা কেউ জানে না। রাজার ভাই নিজেও তা ব্যাখ্যা করলো না। সে যুগে রাজাদের আত্মসম্মান বোধ খুব টনটনে ছিল। কেউ রাজনিন্দা করেছে শুনলে তাদের মাথা ঠিক থাকতো না। রাজা বললো, যতক্ষণ না পবনের কাটা মুণ্ডু না দেখছে ততক্ষণ রাজপরিবারের কেউ জল স্পর্শ করবে না।

বেজায় খুশি হয়ে রাজার ভাই প্রস্থান করছিল। তখন রাজা ডেকে বললেন, আমি চাই না কেউ জানুক যে রাজার হুকুমেই কোষাধ্যক্ষের মুণ্ডুচ্ছেদ হয়েছে। ব্যাপারটা খুব গোপনে সারতে হবে। কথাটা ফাঁস হলে তোমার গুরুতর শাস্তি হবে।

রাজা এবার একজন সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, কয়েকজন সেনা নিয়ে তুমি বনের মধ্যে যে ছোটো দুর্গ তৈরি হচ্ছে ওখানে চলে যাও। যদি কেউ ওখানে গিয়ে দুর্গ তৈরির কাজ কত দূর হলো তা জানতে চায় তা’হলে তখনই তার মাথাটা কেটে ফেলবে। দেহটাকে বনের মধ্যে পুঁতে রেখে দেবে। আর মাথাটা নিয়ে রাজপ্রাসাদে চলে আসবে। হুকুমটা একটু অদ্ভুত লাগলো সেনাপতির কাছে। কিন্তু কিছুই করার উপায় নেই। সেনাপতি চলে গেল সেই বনে। 

সমস্ত রাত রাজা ঘুমতে পারলেন না। সকালে পবনকে ডেকে বললেন, বনের মধ্যে যে দুর্গটা তৈরি হচ্ছে সে কাজ কতদূর এগুলো একবার জেনে আসো। পবন ঘোড়া নিয়ে ছুটলো সেই বনে। যেতে-যেতে শহরের শেষ প্রান্তে এসে পবন শুনতে পেল মন্দিরের মধ্যে এক পণ্ডিত ধর্মের কথা বলছে। পবনের গুরুর কথা মনে পড়লো। আর সেই মন্দিরে গিয়ে লোকদের সাথে ধর্মের কথা শুনতে লাগলো। জ্ঞানের কথা শুনতে শুনতে পবন মোহিত হয়ে গেল। ক্রমেই বেলা বেড়ে চললো সে দিকে তার খেয়াল নেই।

এদিকে রাজার দুষ্টু ভাই বেশ অসুবিধায় পড়ে গিয়েছে। রাজ আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। কিন্তু খুব ক্ষুধা লাগছে সবার। ওদিকে রাজকন্যা কাঁদছে। পবনের মুণ্ডু না আসা পর্যন্ত কেউ জল স্পর্শ করতে পারছে না।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। রাজার ভাই ছটফট করছে আর খবরের আশায় বারবার জানালার দিকে ছুটে যাচ্ছে। শেষে ধৈর্য ধরতে না পেরে তাড়াতাড়ি সে ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘোড়ায় চড়ে ছুটলো সেই বনের দিকে। যে বনে পবনকে কতল করা হবে।

রাজার ভাই বনের মধ্যে গিয়ে দেখলেন, কয়েকটি লোক দুর্গ তৈরির কাজ করছে। কয়েকজন সৈন্য একমনে কাজ করা দেখছে। তা লক্ষ করে রাজার ভাই বললেন, তোমরা এখানে হাঁ করে কী দেখছো। তোমাদের যে কাজ করতে পাঠানো হয়েছে তার কত দেরি? 

এ কথা শুনেই সৈন্যরা সেনাপতির মুখের দিকে তাকালো। সেনাপতির ইঙ্গিত পেয়ে সৈন্যরা ছদ্মবেশি রাজার ভাইকে মুণ্ডুচ্ছেদ করলো। মুণ্ডুটা তারা একটা থালায় রেখে দিলো। রাজার ভাই যে প্রাণ হারালো তারা তা বুঝতে পারলো না। সেনাপতি এবার কাপড়ে জড়ানো মুণ্ডুটা নিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে ঘোড়া ছুটালো।

এদিকে রাজা সভা থেকে ফিরে পবনের মুণ্ডু আর তার ভাইকে না দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলেন। ভাবলেন, এবার আমাকেই খোঁজ-খবর করতে হবে। একলা ঘোড়া ছুটিয়ে রাজা বনের দিকে চললেন। পবন তখনও একমনে মন্দিরে বসে শাস্ত্রপাঠ শুনে যাচ্ছে।

হঠাৎ ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, স্বয়ং রাজামশাই ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে আসছেন। তখন মন্দির থেকে বেরিয়ে ছুটতে-ছুটতে সে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। রাজাও তখন ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়লেন।

রাজা পবনকে এখনও বহাল তরিয়ত দেখে খুব আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এমন সময়ে সেনাপতিও সেখানে হাজির হলেন। হাসি মুখে রাজার সামনে মুণ্ডুর মোড়কটি খুলে ধরলেন। রাজা চমকে উঠলেন, এ যে আমার ভাইয়ের মাথা। রাজা আর্তনাদ করে উঠলেন। আমার ভাই ওখানে কী করে গেল?

শোকার্ত রাজার মনে এখন নানা সন্দেহ উঁকি দিতে লাগলো। তিনি পবনের কাছে কিছুই চেপে রাখলেন না। পবনও এবার কাঁদতে-কাঁদতে রাজার ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের কথা প্রভুর কাছে নিবেদন করলো। যা এতদিন গোপন ছিল তা সমস্ত ফাঁস হয়ে গেল।

রাজা এবার দুঃখ প্রকাশ করলেন, তারপর পবনকে রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতে অনুরোধ করলেন। রাজার অনুরোধ কি আর ফেলতে পারে পবন?


* প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্যিক দেলোয়ার হোসেন ছিলেন ‘কিশোরকণ্ঠের’ একজন নিয়মিত লেখক। এই পত্রিকার হিতাকাক্সক্ষীও ছিলেন। কষ্ট করে আসতেন ‘কিশোরকণ্ঠের’ প্রতিটি অনুষ্ঠানে। আমরা তাঁর হৃদয়ের প্রশস্ততার কাছে ঋণী।

ইন্তিকালের আগে তিনি অনেক গল্প লিখে রেখে গেছেন। এই গল্পটি মিসেস দেলোয়ার কর্তৃক প্রাপ্ত। তাঁর প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমরা এই অসামান্য কথাশিল্পীর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। 

- সম্পাদক

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ