ঘুড়ি

ঘুড়ি

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তমসুর হোসেন #

মাঝে মাঝে বিলুর যে কী হয় নিজেই বুঝতে পারে না। তার মাথায় তখন দিনরাত উমানি পোকা কামড়ায়। কোথাও স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না সে। হঠাৎ তার মাথায় খেয়াল হলো ঘুড়ি বানাবে। আর এই নিয়ে ওর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু বাঁশ পাবে কোথায়। কাঠাম বানাতে বাঁশের বাকারি লাগে। কেউ ঘর মেরামত করলে সেখানে বাঁশের বাকারি পাওয়া যায়। তার নিজের পাড়ায় না পেয়ে সে তা সংগ্রহ করতে সোনাইকাজি এলো। একটা বৃদ্ধ লোক গাছের ছায়ায় বসে আপনমনে কুলা বানাচ্ছিলো। বিলু পাশে বসে কাজ করা দেখে আর মনে মনে বাঁশ খোঁজে। ওকে দেখে লোকটা প্রশ্ন করে- ‘কোথায় বাড়ি?’ ‘কাজদা।’ সে তো ওদিকে মাঝে মাঝে কাজ করতে যায়। একে তো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। ভাবে লোকটা। ‘কার ছেলে? ‘আবুলের। কাজদায় তো বেশ ক’জন আবুল। কাঠুরিয়া আবুল, ঘাউয়া আবুল, আদমের ভাই আবুল আর বানভাসার বেটা আবুল। সে আবারও প্রশ্ন করে- ‘কোন আবুল?’ ‘আমার বাবা। কোন আবুল আবার!’ ‘আরে কার ছেলে?’ ‘বানভাসার ছেলে।’ ‘কার বাড়িতে এসেছো?’ ‘কারো বাড়িতে না। এমনি এসেছি।’ ‘এখানে কী করো?’ ‘কাজ করা দেখি। ভালোই তো কুলা বানাতে পারেন।’ ‘ভালো লেগেছে?’ ‘খুউব।’ ‘কিনবে নাকি?’ ‘টাকা নেই। পরে নিয়ে যাবো।’ লোকটার নাম ফজল। সে বিলুকে কুলা দিতে চায়। টাকা দিতে হবে না। পরে দিলেও চলবে। বিলু বলে : ‘ঘুড়ি বানাতে পারেন?’ ‘চেষ্টা করলে পারবো।’ ‘বানিয়ে দিন তো। ঘুড়ির খুব দরকার।’ ‘বাজারে পাওয়া যায়। কত রকমের ঘুড়ি আছে বাজারে।’ ‘আমি বাজার থেকে নেই না। নিজে বানাই।’ ‘বেশ কাজের ছেলে তো তুমি। নিজে বানাও গিয়ে। আমাকে বলছো কেন?’ ‘আমার বাঁশ নেই। একটু ফালি দেবেন?’ ‘লাগলে নিয়ে যাও।’ বাঁশ নিয়ে বিলু চলে যায় আপনের বাড়ি। ওকে নিয়ে বগলা পাড়তে মনুর জংগলে যায় সে। বগলার আটা না হলে ঘুড়ি বানাবে কী দিয়ে। স্কুল থেকে আসার সময় সে রঙিন কাগজ নিয়ে এসেছে। এখনো বগলার গোটা হলে ঘুড়ি তৈরি করতে পারে। মনুর জংগল হতে বগলা সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। তবে আপন পারে। অনেক উঁচু ডাল থেকে পাকা বগলা পেড়ে সে বিলুকে দেয়। বগলা পেয়ে দেরি করে না বিলু। মাঠের মাঝ দিয়ে বাড়ি চলে আসে। মায়ের কাছ থেকে কাঠারি নিয়ে ধার তুলে দক্ষ মজুরের মতো কাজে লেগে যায়। দুপুর গড়ালেও ক্ষুধার কথা মনে পড়ে না তার। অন্যদিন হলে ভাতের জন্য বাড়ি মাথায় তুলতো। আজ ওসবের বালাই নেই। বরং খাবার কথা বলতে গেলেই মায়ের সাথে মেজাজ দেখায়। ‘ভাত ঠান্ডা হচ্ছে, খাবিনে এখন?’ ‘তুমি খাও। আমি পরে খাবো।’ ‘সবার খাওয়া হয়ে গেলো। পরে কখনো খাবে? ‘অত তাড়া”োছ কেন? কাজ বাদ দিয়ে খাওয়া।’ বিলুর গোসল হয়নি। ওকে খাইয়ে মা দুপুরের নামাজ পড়বে। নামাজ পড়ে মা খানাপিনা করে। সে এতোটা মগ্ন হয়ে কাজ করছে যে ওঠার নাম নেই। মা নীরবে ওর ঘুড়ি বানানো দেখে। বাঁশের বাতা, কাগজ এবং বগলার গোটা নিয়ে বিলু যেভাবে ঘুড়ি বানাতে বসেছে তা দেখে মা হাসি আটকাতে পারে না। এ ঘুড়ি যে আকাশে উড়বে তা বহু ভাগ্যের কথা। যে এখনো নিজের খাতা সেলাই করতে পারে না সে বসেছে ঘুড়ি বানাতে। ওকে টেনে তুলে মা গায়ে পানি ঢেলে দেয়। তারপর মা ওকে নিজ হাতে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। নামাজ শেষে মার কুরআন পড়া অভ্যেস। এ সময়টা বিলু ঘুমায়। আজ সে ঘুমাবে না সেটা ওর ভাব দেখে বুঝতে পেরেছে মা । তবু শাসনের ধমকে বলে- ‘একটু ঘুমিয়ে নে। বিকেলে অঙ্ক সার আসবে।’ ‘ঘুমাবো মানে। ঘুড়ি কে বানাবে?’ ‘মন্টু আসুক। ও এখন বানাবে।’ ‘কাজ নেই মন্টুর। ভালো করে লুঙ্গি পরতে পারে না। সে এখন ঘুড়ি বানাবে।’ ভাব দেখলে মনে হয় বিলু বড় কাজের লোক হয়েছে। মন্টু ওর পনেরো বছরের বড় হবে। সে সংসারের সব কাজ করতে পারে। বিলুর বলে সে ঘুড়ি বানাতে পারবে না। সারাদিন খোটখাট করে দা দিয়ে হাত জখম করে কি না কে জানে। ‘যেভাবে কাটছো হাত জখম হবে। বললাম মন্টু আসুক।’ ‘অত মন্টু মন্টু করছো কেন।’ ‘কেন বলছি। সেবার মেলায় কার ঘুড়ি জিতেছে?’ ‘বলতে পারবো না।’ ‘সে জন্যই তো বলছি। ও এখোন সুন্দর করে বানিয়ে দেবে।’ ‘একটুও কাজ করতে পারছি না। ঘুড়ি খারাপ হলে দেখবে।’ সুন্দর করে বিলুকে ঘুড়ি বানিয়ে দেয় মন্টু। সুতা লাঠাই জুড়ে দিয়ে বিলুকে ঘুড়ি উড়ানোর কায়দা শেখায়। ঘুড়িটা বেশ ওড়ে। ভারসাম্য বজায় রেখে আকাশে উড়তে থাকে। বিলু ভালো করে ওড়াতে পারে না। কাজ ফেলে মন্টুর পক্ষে ওকে সঙ্গ দেয়া সম্ভব নয়। বাড়ির পশ্চিমে ঈদগাহ মাঠে ঘুড়ি নিয়ে একা একা ছোটাছুটি করে বিলু। মন্টু যেমন আস্তে সুতো ছেড়ে আকাশে ওড়ায় ঘুড়িকে, বিলু তেমন করলে পাক খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সে জন্য খোলা মাঠে ঘুড়ি নিয়ে ছুটে বেড়ায় বিলু। মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে একটা ছোট ছেলে প্রতিদিন ওর ঘুড়ি ওড়ানো দেখে। একদিন ছেলেটা ঘুড়ি নিয়ে জঙ্গলের ভেতর চলে যায়। ওর পেছনে ছুটে সে গাছের আড়ালে খড়ের বাড়ি দেখতে পায়। বাড়ির ভেতর একটা বুড়ো মস্ত বড় হুকোয় তামাক খাচ্ছে। বিলুকে দেখে সে বুড়োকে বলে- ‘দাদু, আমাদের মাঠে এ গুড্ডি ওড়ায়।’ বুড়োর চেহারা দেখে বিলুর মুখ চুপসে যায়। অমন বুড়ো কখনও দেখেনি সে। বড় বড় চোখ। মাথায় জটা। কয়লার মত দাঁত। বুড়ো ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাগলের মত ভঙ্গি করে বিলুকে বলে- ‘নামাজের মাঠে ঘুড়ি ওড়াও কেন। আর জায়গা নেই?’ ‘নেই।’ ‘কেন নদীর পাড় আছেনা?’ ‘ঘুড়ি যদি পানিতে পড়ে যায়। তখন কী করবো?’ ‘সাঁতার দেবে। সাঁতার কেটে ঘুড়ি তুলে আনবে।’ ‘আমি সাঁতার জানি না।’ বিলুর কথা শুনে দাঁত বের করে হাসে বুড়ো। কয়েকটা বড় বড় টান দেয়ার পর হুকো নামিয়ে রেখে বলে- ‘নামাজের মাঠে ঘুড়ি ওড়ালে কী হয় জানো?’ ‘জানি না।’ ‘তাকে কেউ বউ দেয় না। দিলেও বুড়ি বউ দেয়।’ ‘মা আমার জন্য ভালো বউ আনবে।’ ‘লোকে বউ দিলে তো।’ ‘আমি বুড়ি বউ বিয়ে করব না।’ বিলুর সাথে বুড়োটা সহজ করে কথা বললেও ঘুড়ি দেয়ার নাম নেই। ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। খুব খারাপ লাগছে ওর। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সেদিকে খেয়াল না করে বুড়ো তাকে আজেবাজে প্রশ্ন করছে। বিলু তাকে বলে- ‘যে ঘুড়ি নিয়েছে সে কোথায় গেল?’ ‘কার কথা বলছো?’ ‘সবুজ জামা পরা ছেলেটা আপনার কী হয়? এদিকে এলো ঘুড়ি নিয়ে।’ ‘ও মিলুর কথা বলছো? আছে। এখোনই আসবে। নানু বাড়িতে যাও না?’ ‘আম্মুর সাথে যাই। আম্মু এখন যাবে না।’ ‘তুমি আনোয়ারার ছেলে?’ ‘আম্মুকে চেনেন?’ ‘তোমার নানু আমার বন্ধু। একসাথে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি।’ ছেলেটা বুড়োর নাতি। তার কাছে ঘুড়ি নিয়ে বিলুকে দিয়ে হাত ধরে মাঠের দিকে চললো বুড়ো। বুড়ো বলে- ‘তোমাকে বাড়িতে রেখে আসি।’ ‘না না, একাই পারবো।’ ‘পিচ্চি ছেলে বলে কিরে! চারদিকে পেতের ভয়। একা যেতে পারবে।’ ‘ভূতকে ভয় পাই না।’ ‘আমি বাপু ওসব এড়িয়ে চলি। তোমার নানাসহ মাছ ধরতাম। ভূতেরা খেয়ে ফেলতো।’ ‘আপনি ভূত দেখেছেন?’ ‘অবশ্যই দেখেছি। কেমন সরু সরু পা। গায়ে পচা মাছের গন্ধ।’ বুড়োটা জঙ্গলের মাঝ দিয়ে রওনা দিলো। চারদিকে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। একটা লোক কুপি নিয়ে সামনে দাঁড়ালো। গায়ে ময়লা জামা। অগোছালো চুল। বিলুকে বলতে লাগলো- ‘খুব সুন্দরতো। মরিচ ডলে খেতে মজা হবে।’ লোকটার কথায় বুড়ো খুব রেগে গেলো। চোখ লাল করে বললো- ‘দেখছো থাপ্পড়। কার সাথে আবোলতাবোল কথা বলছো।’ ‘পেটে ভোক কামড়াচ্ছে। কিছু খেতে দাও। না দিলে ছাড়বো না।’ ‘সবাই আমাকে কী বলে ডাকে বলতো?’ ‘কী আর। সদ্দের বলে ডাকে।’ ‘পথ আগলে রাখছো কেন? এমন লাথি মারবো বাপের নাম ভুলবি।’ ‘সদ্দেরজি রাগছো কেন? ইয়ার্কি করলাম। ও যে নাতি তা কি বুঝিনি?’ বুড়োটা তাহলে ভুতের সর্দার। বিলু ভয়ে এতটুকু হয়ে গেলো। আজ বুঝি রক্ষা নেই। ওর অবস্থা টের পেয়ে কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগল বুড়ো । বিলু বললো- ‘আপনি কি ভুতের সর্দার?’ ‘কে বলেছে ?’ ‘পাগলটা যে বললো।’ ‘কথায় আছে না, পাগলে কি না বলে। আমি হলাম তোমার নানার বন্ধু রহমত খাঁ।’ বাড়ির পাশের জঙ্গলের কথা বিলুর জানাই ছিল না। এদিকে ওদিকে ঘুরে বুড়ো তাকে নিয়ে খালের ধারে এসে দাঁড়ালো। হেলেপড়া ঘরের সামনে বেঞ্চে ওকে বসিয়ে বুড়ো বললো- ‘নানু বাড়ি এসে খালি মুখে যাবে। ঝাল সন্দেশ খেয়ে যাও।’ ‘ঝাল সন্দেশ! জঙ্গলে পাবে ওসব?’ ‘দোকান থেকে কিনে খাওয়াব। ওরে গুগলু এতো সকালে বন্ধ করেছিস?’ বুড়োর গলা শুনে ঘর থেকে এক দাড়িওয়ালা বেরিয়ে এলো। কাঠ পুড়ে আগুন জ্বালানো। সেখানে প্লেট হাঁড়ি গামলা এলোমেলো করে রাখা। বুড়ো বললো- ‘এই অবস্থা! আজ দোকান খুলিসনি?’ ‘সব ভেঙেচোরে বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে।’ ‘বউকে মেরেছিস? তোকে নিয়ে পারা গেলো না।’ ‘ও শাকচুন্নি যে আমাকে সহ্য করতে পারে না।’ ‘শোন। কাঁচাআলু আর পচা পুঁটির লটপটি আছে?’ ‘না কর্তা। বাইন মাছে পাটশাকের পচানি আছে। দেবো একটু।’ ‘আরে না। আমার খাওয়ার কী আছে। নাতিটা এসেছে। গজার মাছের চোখ যদি খাওয়াতে পারতিস্। ভালো হতো।’ সন্ধ্যায় বিলুর ঘুমানোর অভ্যেস। ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। তা দেখে বুড়োটা বললো- ‘থাক থাক। নাতি ঘুমে টলছে। আর একদিন খাবো। আজ ওকে রেখে আসি।’ বিলুর তো ওসব খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে বুড়োটা যদি খায় খাক। বিলু বুড়োকে বলে- ‘এখন ঘুমাবো না। আপনি ইচ্ছে করলে খান। আমি বসে থাকি।’ ‘একটু পাটশাকের পচানি খাও সোনা।’ ‘আমি ওসব খেতে পারব না। নুডলস্ খেতেই বমি আসে। পচানি মারাচ্ছেন।’ ‘তাহলে চল বাড়িতে রেখে আসি। আজ মিটিং আছে। জলদি ফিরতে হবে।’ বুড়োর ঘাড়ে চড়ে বাড়িতে ফেরে বিলু। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সারারাত তাকে খুঁজেছে বাড়ির লোকেরা। অথচ সে শুয়ে ছিল গোয়ালঘরের গরু পাহারার মাচানের ওপর। গাঁয়ের কেউই রহমত খাঁ নামের সে বুড়োটাকে চেনে না। সে যে ভূতের সর্দারের সাথে ঘুরে বেরিয়েছে এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ