চাঁদের হাসিতে কান্না ঝরে

চাঁদের হাসিতে কান্না ঝরে

গল্প আগস্ট ২০১২

শরীফ আবদুল গোফরান ..
আকাশে মেঘ জমেছে। দক্ষিণ দিকের বড় খালে অনেক পানি। ঢেউয়ে ঢেউয়ে এসে জমা হয় অনেক কচুরিপানা। খালের পাড়ে বড় বড় গাছগুলো নুইয়ে পড়েছে। এসব গাছে এলোমেলোভাবে পেঁছিয়ে থাকে শূন্য লতা। তাছাড়া অনেক পরগাছাও জন্মে এসব গাছে। অনেক পাখপাখালি ভিড় জমায়। উড়ে আসে বকের সারি। বাসা বাঁধে। সকাল হলে পাখির কিচিরমিচির শব্দে পুরো এলাকা ভরে যায়। বড় হিজল গাছটার তলায় প্রতিদিন বসে বিশ্রাম নেয় আব্দুস সালাম। মাঝে মধ্যে তার বন্ধু কালামও হিজল তলায় বসে সালামের সাথে গল্প জমায়।
আব্দুস সালাম সহজ সরল। দুই বছর হলো বাবাকে হারিয়েছে। সংসারে মা ছাড়া আর কেউ  নেই। গ্রামের জুনিয়র স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। এখন আর স্কুলে যায় না। বাবা নেই বলে সংসারের সব কিছু এখন তাকেই করতে হয়। গরুর জন্য ঘাস কাটা, মাঠের কাজ, এমনকি সংসারের ছোটখাটো সব কাজই তাকে করতে হয়।
সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যায় আব্দুস সালাম। দিনের আলো নিভার সাথে সাথে পিঠটাকে মেলে দেয় বিছানায়। ঘুমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুমে যে আসে না। সে কল্পনায় চলে যায় অনেক দূর। এর মধ্যে কেটে যায় অনেক সময়। হয়ে যায় গভীর রাত। কানে ভেসে আসে ভাওয়াইয়া গানের সুর। গভীর রাতে মাঝিরা নাও ভাসায় কক্সগঞ্জ খালে। এই খালের শীর্ণ পানির স্রোত সাপের মত এঁকে বেঁকে গিয়ে মিশেছে ডাকাতিয়ায়। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, তার ফাঁকে চাঁদ আর তারাদের লুকোচুরি খেলা। হঠাৎ উড়ে আসা দমকা বাতাস ঘরের চালে যেন বাজনা বাজিয়ে দেয়। খালের টলটলে পানিতে নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দের সাথে পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া গানের সুরে একাকার হয়ে যায়। উদাস করে সালামের মন।
বর্ষা এলে সালামের কষ্ট হয়। মাঠ ঘাট ভরে যায় পানিতে। বিলে শুধু পানি আর পানি। শুধু ভাসতে থাকে কচুরিপানা। গরু-ছাগল নিয়ে পড়তে হয় কষ্টে। এ সময় ওদের জন্য খাবার সংগ্রহ করা খুব কঠিন। রোজ রোজ কচুরিপানা কেটে আনতে হয় আব্দুস সালামকে। বর্ষায় খড় আর কচুরিপানা খাইয়ে গরু-ছাগল বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
ঘুম থেকে উঠেই আব্দুস সালাম কোষা নিয়ে চলে যায় কক্সগঞ্জের খালে। কোষা ভর্তি কচুরিপানা নিয়ে বাড়ি ফেরে। গোসল করে। তারপর পেট ভরে শুঁটকির ভর্তা আর মরিচ পোড়া দিয়ে পান্তা খায়। কোষায় লগি মারতেই নজর পড়লো খালের পাড়ে নুয়ে যাওয়া পেয়ারা গাছটার দিকে। পাতার ফাঁকে ঝুলছে ডাসা ডাসা পেয়ারা। আব্দুস সালাম আস্তে করে কোষাটা কিনারে ভিড়িয়ে পেয়ারা গাছটির ডালে উঠে বসে। গাছে উঠতে ওর খুব ভাল লাগে। এভাবে গাছে উঠে কতবার যে হাত-পা ভেঙেছে! এই তো গেলো বৈশাখে সাকিবদের কয়া আমগাছে উঠে কি যে দুর্ঘটনা ঘটালো। একটা চিকন ডালের ওপর ভর দিতেই মড়াৎ করে ডালটা ভেঙে গেলো। অমনি নিচে পড়ে সালামের বাঁ হাতের হাড়টাই ভেঙে যায়। তবুও যেন তার আক্কেল হয় না। দু’মাস পর্যন্ত ব্যথায় ভুগেছে। খালের পশ্চিম পাশে খোনার বাড়ি। সকাল হলে অনেক হাঁস এসে সাঁতার কাটে এখানে। একটা পেয়ারা ছিঁড়ে চিবুতে চিবুতে গাছে হেলান দিয়ে আব্দুস সালাম তাকিয়ে আছে পানির দিকে। কয়েকটি হাঁস ডুব দিয়ে পানির নিচ থেকে মাছ ধরে আনছে। খালে কচুরিপানা সরানো খালি জায়গাটায় রোজ রোজ একদল পাতিহাঁস এভাবে সাঁতার কাটে। ডুব দিয়ে মাছ ধরে।
খালের পাড়ে ঝোপ-জঙ্গলে মাছরাঙা, কুঁচবক, শালিক, দোয়েল তাদেরও কম আড্ডা নয়। খালের পাড়ে মাছরাঙা চুপটি মেরে বসে থাকে। কুঁচবকগুলো একপায়ে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকে মাছের অপেক্ষায়। ছোট ছোট টুনি পাখিগুলো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে।
পুব পাড়ে দাঁড়কাকগুলো দলবেঁধে কা কা করছে। দাঁড়কাকদের কা কা শব্দে কান ঝালাপালা। কে যেন বাঁশ কাটছে। বাঁশ কাটার শব্দেই কাকগুলো চেঁচামেচি করছে।
আব্দুস সালাম এগিয়ে যায় বাঁশবনের দিকে। লতা পেঁচিয়ে জঙ্গল করে রেখেছে পুরো বাঁশবনটাই। হাত দিয়ে জঙ্গল সরিয়ে বাগানের ভেতের প্রবেশ করে আব্দুস সালাম।
জঙ্গলের ভেতর থেকে ফুড়ুত করে একটা দোয়েল উড়ে যায়। আব্দুস সালাম দেখে বাঁশ কাটছে খোনার বাড়ির কালাম। ওর বাবা আম্বর আলী কুলো, ঝুড়ি বানায়। এসব বাজারে বিক্রি করেই ওদের সংসার চলে। আব্দুস সালামকে দেখে একগাল হেসে ওঠে কালাম, আব্দুস সালাম যে, বন্ধু কহন আইলি।
: অনেকক্ষণ অইছে। বইয়া আছিলাম ঐ গাছডার ওপরে। কালাম আইজকা পাখিডা আর দেহি নাইরে, কতক্ষণ ধইরা বইয়া রইলাম।
: চলতো দেইখা আহি, অহন আছেনি।
এই খালে আসে এক জোড়া পানকৌড়ি। ওরা রোজ রোজ পানকৌড়ির দিকে নজর রাখতো। হিজলগাছের ডালে কাঠ-কুটো দিয়ে বাসা বানিয়েছে পানকৌড়িরা। ডিমও পেড়েছে। মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে পানির নিচ থেকে মাছ ধরে ঠোঁটে চেপে পানির উপরে ভেসে ওঠে। সালাম আর কালাম রোজ রোজ গাছের ফাঁক দিয়ে মজা করে এসব দেখে।
কালাম বাসায় সবুজ বর্ণের ডিমগুলো ধরতে যায়, সালাম বাধা দেয়। মা বলেছেন, পাখির বাসায় ডিম ধরতে নেই। পাখির ডিমে হাত দিলে বাচ্চা হয় না। ডিম পচে যায়। তাই সে বাধা দিয়ে বলে, ধরিস না, ধরলে বাচ্চা অইবো না।
: আরে অইবো, অইবো! ওসব বাজে কথা, কতো ধরলাম।
: মায়ে কইছে, পাখির ডিম ধরলে পচে যায়।
: তোমার মা-তো কতো আজগুবি কথা কইতে পারে। হ্যাঁরে সালাম, তোর সুবেদার কাকা কবে আইবোরে?
: ঈদের ৩-৪ দিন আগে আইবো।
: তুই কেমনে বুঝলি?
: ক্যান, ওর হ্যাবলা পোলাডারে দেখছি লাফাই লাফাই কইতাছে, বাবা আইবো, বাবা আইবো।
: এবার অত খুশি ক্যানরে? নতুন কোন খবর আইছে নাহি?
: হ! নতুন খবরইতো। সামনে ঈদ না। নতুন জামা কাপড় আনবো। এ জন্যইতো এত খুশি।
আমিও ছোড বেলায় এমন কইরা লাফাইতাম। বাবা হাটত্তুন নতুন জামা কাপড় আনলে আর ঈদের অপেক্ষা  করতাম না। রাতেই গায়ে দিয়া হুইয়া পরতাম।
: তোর জন্য আনবো না?
: আমাগো ভাগ্যে কি অতসব আছে? বাবা মারা যাওনের পর আমরাতো কাকার করুণায় বাঁইচ্ছা আছি।
: আচ্ছা ক তো, তোর কাকা এবার ঈদে বাড়ি আইতে বন্দুক আনবো?
: জানি না।
বন্দুকের কথা মনে হতেই সালামের মুখে কালো মেঘের ছায়া নেমে আসে। বড় করুণ দেখায় ওর মুখটা সালামের কাকা বাড়ি আইলে তো জঙ্গলে হগল পাখি গুলানরে পাগল বানাই ছাড়বো। তিনি তো কোনো পাখিকে রক্ষা করে না। সামনেই যা পান সবই মারে। গত ঈদে বাড়ি এসে বলাখাল থেকে চল্লিশটা বালিহাঁস মেরে এনেছিল। গাঁয়ের অনেক ছেলেই কাকার সাথে যায়। সালাম কখনো যায়নি। ওর খুব কষ্ট হয়। রক্ত দেখলে রাতে ওর ঘুম হয় না। কারণ জঙ্গলের পাখিগুলোকে সে ভালোবাসে।
কচুরিপানার ঝাঁকের ভেতর থেকে দীঘল কালো একটি বালিহাঁসকে গলা উঁচিয়ে ভাসতে দেখে সালাম। এক সময় পানকৌড়িটা উড়ে গিয়ে পানির ওপর নুয়ে থাকা গাছের ডালে বসে। তারপর ডানা মেলে রোদ পোয়ায়। পাখিটাকে রোজ সালাম রোদ পোয়াতে দেখে। সে আনন্দ পায়। কিন্তু তাদেরকে কোনো প্রকার বিরক্ত করে না। হঠাৎ আকাশটা কালো হয়ে যায়। গোমড়ামুখো আকাশটা নুয়ে পড়ে মাথার ওপর। রোদ নেই, কেমন যেন ছায়া ছায়া পরিবেশ। এদিকে গুমট গরমও। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসে নড়ে উঠলো খালের পানি। নড়ে উঠলো সালামের কোষাও। সালাম কালাম দু’জনে উঠলো কোষায়। লগি মারছে বাড়ির দিকে। বৃষ্টির পানিতে ভরে যায় খাল-বিল।
রমজান মাস প্রায় শেষ। আর মাত্র ৩-৪ রোজা সামনে। শহর থেকে ঈদের ছুটিতে অনেকেই গাঁয়ে আসতে শুরু করেছে। দুপুুর নাগাদ কাকার নাওটাও ঘাটে এসে ভিড়লো। কাকা বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে একটা ব্যাগ হাতে নাও থেকে নামলেন। বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন কাকা। বাড়ির সবাই খুশি।
পরদিন বিকেলবেলা কাকা খালের পাড়ে ঘুরছেন। পাড়ার ছেলেমেয়েরা খালের পাড়ে জটলা পাকিয়েছে চাঁদ দেখার জন্য। আজ চাঁদ উঠলে কাল ঈদ। সবার মনে আনন্দ। হঠাৎ তার চোখে পড়ে পানকৌড়িটা।
পাখিটা একটি গাছের ডালে পাখনা মেলে বসে আছে। কাকা তার ছেলেকে বন্দুক নিয়ে আসতে বললেন। বন্দুকটা হাতে নিয়েই কাকা গুলি ছুড়লেন পানকৌড়িটাকে লক্ষ্য করে। বন্দুকের শব্দে সমস্ত বাঁশবন কেঁপে উঠলো। খালের পাড় ঘেঁষে হুমড়ি খেয়ে পড়লো পানকৌড়িটা। ওর কালো পালক জড়ানো শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লাল তাজা রক্ত। ছটফট করছে। কিন্তু তার শরীরে আর পালানোর শক্তি নেই। সালাম গুলির শব্দ পেয়ে ছুটে আসে হিজল তলায়। কাকা আঙুল উঁচিয়ে বলেন, দেখনি প্রথম বারেই একটা পানকৌড়ি।
সালাম কোনো কথা বলতে পারছে না। ওর বুকে অনেক কষ্ট। দু’গাল বেয়ে টপটপ ঝরছে চোখের পানি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রক্তেভেজা পানকৌড়িটার দিকে। গলার খানিকটা ছোপ ছোপ রক্তে লাল হয়ে গেছে। কচুরিপানার ঝাঁকের ভেতর থেকে দীঘল কোলো গলা উঁচিয়ে অন্য পানকৌড়িটাও দেখছে তার সঙ্গী পরাজিত পানকৌড়ির রক্ত।
ঈদের বাঁকা চাঁদটি লজ্জায় অল্পক্ষণের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারাদের রঙও মলিন। মেঘের ফাঁক গলে গলে চোখে পড়ে রক্তিম আভা যেন পানকৌড়ির রক্তের ছিটা পড়েছে আকাশে। বিপদ সাইরেন বেজে উঠেছে বাতাসের গায়ে। খালে ভেসে বেড়ানো কোষা নাও এর মুখ ঘুরে গেল আস্তে আস্তে। ভরা বর্ষায় খালের পানিগুলো উপছে পড়ছে। জীবন্ত পানকৌড়িটা সইলা পানিতে ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে হারানদিয়া ঘাটের দিকে। অজানার উদ্দেশে। নতুন ঠিকানায়।


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ